আহলে হাদীস কি ও কেন?

মুফতী হাফিজুর রহমান

উৎপত্তি ও ইতিহাস :
আহলে হাদীস পরিভাষাটি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. এর হাত ধরেই উৎপত্তি লাভ করে। এর পূর্বে হুবহু এ শব্দটির ব্যবহার তেমন পাওয়া যায় না। অবশ্য আহলে হাদীস শব্দের সমর্থক শব্দের ব্যবহার এর পূর্বে সাহাবা তাবিয়ীদের যুগেও লক্ষ্য করা যায়। নবম শতাব্দিতে খলীফা মামুনুর রশীদের খিলাফত যুগে যখন কুরআন আল্লাহর সৃষ্টি কি সৃষ্টি নয়- এ দ্বন্দ্ব
মাথা চাড়া দিয়ে উঠে তখন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এবং তার হাদীস বিশেষজ্ঞ শিষ্যগণ এক্ষেত্রে নীরবতার পথ অবলম্বন করেন। তখন থেকেই আহলুল হাদীস শব্দটি
ব্যাপকভাবে আলোচনায় উঠে আসে। ফলে শব্দটি একটি পারিভাষিক রূপ পরিগ্রহ করে।-  a briet history of islam by karen arms armstrong, phoenix, london, আলকামিল ফিত তারীখ ৩/১৭৯।
অন্য একটি সূত্র মতে ইসলাম আগমনের তৃতীয়তম শতাব্দির দিকে সমসাময়িক আইন শাস্ত্রের আলেমদের হাদীসের উপর অধিক জোর দেয়ার মাধ্যমে এ পরিভাষার সূচনা হয়। oxford islamic studies

আহলে হাদীসের সমর্থক শব্দ : আসহাবুল হাদীস, সাহিবুল হাদীস, আসহাবুল আসার, সাহিবুল আসার, আহলুস সুন্নাহ, মুহাদ্দিস।

আহলে হাদীস শব্দের আভিধানিক অর্থ :
আহলে হাদীস শব্দটি একটি ফারসী ব্যাকরণিক যুক্ত শব্দ। তবে সংযুক্ত শব্দ দুটি ভিন্নভাবে মূলত আরবী ভাষার শব্দ। যৌগিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে ফারসী ব্যকরণ নীতি ব্যবহৃত হয়েছে। মূল আরবী শব্দ হলো, আহলুল হাদীস। আহলুন শব্দের অর্থ ধারক, অনুসারী, উপযুক্ত, বিশিষ্টতর, অধিকতর নিজস্ব বা একান্ত, ঘনিষ্ঠতর। আরবীতে বলা হয় আহলুর রজুলি। অর্থ
ব্যক্তির বেশি ঘনিষ্ঠতর। সুতরাং আহলুল হাদীস যুক্ত শব্দটির আভিধানিক অর্থ দাড়ায়, এমন ব্যক্তি যে হাদীসের সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ, হাদীসের অনুসারী, হাদীসের ধারক। যেমন হাদীসে এসেছে أوترو يا اهل القرآن । অর্থ হে কুরআনের ধারকগণ তোমরা বিতর নামাজ আদায় করো।
সুনানে তিরমিযী, হাদীস ৬৭৫। অতএব আভিধানিক অর্থে যে ব্যক্তি যে কোনো উপায়ে যে কোনো পদ্ধতিতে হাদীসের সাথে সম্পৃক্ত হবে তাকেই আহলে হাদীস উপাধিতে ভূষিত করা যাবে। অন্যদিকে পবিত্র করআনের অনেক জায়গায় কুরআনকে হাদীস বলে অভিহিত করা হয়েছে। সুতরাং আভিধানিক অর্থে কুরআনের সাথে যারা বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত হয় তাদেরকেও আহলে হাদীস বলা যেতে পারে।

আহলে হাদীস শব্দের পারিভাষিক অর্থ :
আহলে হাদীস শব্দের দুটি পরিভাষা রয়েছে। একটি হলো শাস্ত্রীয় পরিভাষা। দ্বিতীয়টি হলো পরিবর্ধিত আধুনিক পরিভাষা।

আহলে হাদীস শব্দের শাস্ত্রীয় পরিভাষা :
১। শাস্ত্রীয় পরিভাষা সম্বন্ধে আবু মুহাম্মদ ইবনে কুতাইবা রাহ. বলেন, সাহিবে হাদীসগণ সত্যকে যথাস্থান থেকে অন্বেষণ করেন এবং মূল জায়গা থেকে একে অনুসন্ধান করে আনেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ ও আসারকে জলে স্থলে, পূর্ব পশ্চিমে অন্বেষণ করার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করেন। তারা একটি হাদীস বা একটি
সুন্নাহকে অন্বেষণ করার ক্ষেত্রে মূল বর্ণনাকারী থেকে সরাসরি গ্রহণ করা অবধি পদব্রজে ভ্রমণ করতে থাকেন। এরপর হাদীসগুলোর উপর অবিরাম পর্যালোচনা ও গবেষণা-বিশ্লেষণ করতে থাকেন। এরপর হাদীসের শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা, কার্যকারিতা ও বিলুপ্ত হওয়া না হওয়ার ব্যাপারগুলো চূড়ান্তভাবে নির্ণয় করেন। ফকীহদের মধ্য হতে যারা নিজস্ব অভিব্যক্তি বা অভিমতের মাধ্যমে হাদীসের বিপরীত মত পোষণ করেছেন তাদেরকে চিহ্নিত করে এ ব্যাপারে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। এতে করে অস্পষ্ট থাকার পর প্রকৃত সত্যটি পরিস্ফুটিত হয়েছে, বিলুপ্ত হওয়ার পর সমুন্নত হয়েছে, বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর সমন্বিত হয়েছে। ফলে যে ব্যক্তি সুন্নাহ বিরোধী ছিল সে সুন্নাহর অনুসারী হয়ে গেছে, যে এ ব্যাপারে অসচেতন ছিল সে সচেতন হয়েছে এবং অমুক তমুকের উক্তির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত দেয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণীর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। তাবীলু মুখতালিফিল হাদীস ১/৬৯
২। খতীব বাগদাদী রাহ.  বলেন, আল্লাহ তাআলা আহলে হাদীসদেরকে শরীয়তের মূল ভিত্তি বানিয়েছেন। তাদের মাধ্যমে সর্বধরনের কদাকর বিদাতকে নির্মূল করেছেন। তারা সৃষ্টিজীবের মাঝে আল্লাহ তাআলার বিশ্বস্তজন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং উম্মাহর মধ্যকার সেতুবন্ধ। উম্মাহকে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে চেষ্টা সাধনাকারী, তাদের আলো
সমুজ্জ্বল, তাদের মাহাত্ম চলমান, তাদের নির্দেশনাবলি আলোকোজ্জ্বল, তাদের মাযহাব-পথ সুস্পষ্ট, তাদের প্রমাণাদি শক্তিশালী। আসহাবে হাদীস ব্যতীত প্রত্যেক শ্রেণীর লোকেরা নিজেদের প্রবৃত্তি-চাহিদার পক্ষাবলম্বন করে থাকে এবং নিজেদের মতামতকেই সুন্দর মনে করে থাকে। কারণ আসহাবে হাদীসের পাথেয় হলো আলকুরআন। সুন্নাহ হলে তাদের প্রমাণপুঞ্জি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন তাদের দলনেতা। তার সাথেই তারা সম্পৃক্ত হন। প্রবৃত্তিক চাহিদার বাহনে তারা সমাসীন হন না। নিজেদের মত-অভিমতের ব্যাপারে তারা ভ্রক্ষেপ করেন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তারা যা কিছু বর্ণনা করেন তাই তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয়। তারাই ন্যায় পরায়ন। তারাই বিশ্বাসযোগ্য এবং নিরাপদ। তারাই দীনের রক্ষক এবং প্রহরী। তারাই ইলমের বাহক এবং
সংরক্ষক। কোনো হাদীসের ব্যাপারে মতভিন্নতা হলে তারাই হবেন আশ্রয়স্থল। তারা যে সিদ্ধান্ত দিবেন তাই গ্রহীত এবং শ্রুত হবে। তাদের প্রত্যেক আলেম ফকীহ, সচেতন, মহান ইমাম, খোদাভীরু, বিশেষ শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী, নির্ভরযোগ্য কুরআন বিশেষজ্ঞ, সুন্দর আলোচক। তারাই সংখ্যাগুরু। তাদের পথই সঠিক পথ। -শরাফু আসহাবিল হাদীস লিল খতীব আলবাগদাদী ১/৮
৩। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন, মুক্তিপ্রাপ্ত দল হওয়ার সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত হল ঐসব আহলুল হাদীস ওয়াস সুন্নাহ ব্যক্তিবর্গ যারা
১। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্য কাউকে অনুসৃত ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করে না। এবং গোড়ামি, স্বদলপ্রীতি কিংবা প্রান্তিকতায় লিপ্ত হয় না।
২। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী এবং সামগ্রিক অবস্থা সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি অবগত।
৩। হাদীসের শুদ্ধতা ও দুর্বলতা নির্ণয়ে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন। এবং মানুষের ইমাম।
৪। হাদীসের ক্ষেত্রে ফকীহ তথা গভীর ব্যুৎপত্তি এবং পাণ্ডিত্বের অধিকারী এবং হাদীসের অর্থ ও তাৎপর্য সম্বন্ধে সবিশেষ অবগত।
৫। সত্যায়ন, কার্যকর করণ এবং ভালবাসার দিক থেকে হাদীসের অনুসারী।
৬। যারা হাদীসকে ভালবাসে তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখে এবং যারা হাদীসের সাথে বৈরিভাব পোষণ করে তাদের সাথে বৈরিতার সম্পর্ক রাখে।
৭। কুরআন সুন্নাহর আলোকে নিবন্ধ রচনা করে। যেসব নিবন্ধ সুন্নাহর আলোকে প্রমাণিত নয় সেগুলোকে দীনের মূলনীতি এবং সারবস্তু হিসেবে গ্রহণ করে না। বরং যেগুলো কুরআন সুন্নাহর আলোকে প্রমাণিত একমাত্র সেগুলোকেই তারা মূলনীতি হিসেবে বিশ্বাস করে এবং
তার উপর আস্থা পোষণ করে। মাজমূউল ফাতাওয়া লিইবনে তাইমিয়া ৩/৩৪৭
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. আরো বলেন, নিঃসন্দেহে আহলে হাদীস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার শিষ্যবৃন্দ যথা খুলাফায়ে রাশিদীন এবং অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম এর ইলম সম্বন্ধে উম্মাহর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবগত এবং ঘনিষ্ঠ। -মাজমূউল
ফাতাওয়া লিইবনে তাইমিয়া ১/৩০৮
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. অন্যত্র বলেন, আমরা আহলে হাদীস বলে শুধু হাদীস শ্রবণকারী, লিপিবদ্ধকারী কিংবা বর্ণনাকারীদেরকেই উদ্দেশ্য নেই না; বরং আহলে হাদীস বলে আমরা ঐ সমস্ত ব্যক্তিবর্গকেও উদ্দেশ্য নিয়ে থাকি যারা হাদীস মুখস্থ করে, তার দৃশ্যমান ও নিগূঢ় অর্থ সম্বন্ধে অবগতি লাভ করে এবং তা গভীরভাবে উপলব্ধি করে এবং অনুসরণ করে। -মাজমূউল
ফাতাওয়া ৪/৯৪
তিনি আরো বলেন, আহলুল হাদীস ওয়াস সুন্নাহ সাহাবায়ে কেরামের কর্মপন্থা সম্বন্ধে সবিশেষ অবগত। প্রতি যুগের প্রতিটি জনপদে তারাই কুরআন সুন্নাহর ইলমের ধারক-বাহক। পূর্ববর্তী এবং পরবর্তীদের মধ্য হতে তারাই সৃষ্টি জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ। শারহু আকীদাতিল আসফাহানিয়্যাহ ১/১৬৫
৪। ইবনে হাজর আসকালানী রাহ. বলেন, একটি দল সদা সর্বদা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। আর তারা হলো ফুকাহাউ আসহাবিল হাদীস। অর্থাৎ আহলে হাদীস ফকীহগণ সদা সর্বদা সাহায্যপ্রাপ্ত দল হিসেবে পরিগণিত হবে। ফাতহুল বারী ১/১৪০
৫। আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. সাহায্যপ্রাপ্ত দল সম্বন্ধে বলেন, যদি তারা আসহাবুল হাদীস না হন তবে আমি জানি না তারা কারা? মুজামু লিসানিল মুহাদ্দিসীন ৩/১২৯
২। আধুনিক আহলে হাদীস পরিভাষা :
যে ব্যক্তি ফিকহের গভীরতায় না গিয়ে হাদীসের দৃশ্যমান অর্থ গ্রহণ করে নিছক হাদীসকে অনুসরণ করে তাকেও আধুনিক পরিভাষায় আহলে হাদীস বলা হয়। ইবনে তাইমিয়া রাহ. আহলে হাদীস পরিভাষায় ব্যাপকতা আনতে গিয়ে বলেন, শুরু তিন যুগের সালাফ তাথা
পূর্বসূরিগণ এবং তৎপরবর্তীদের যারা অনুসরণ করে তারাও হল আহলে হাদীস। -মাজমূউল ফাতাওয়া ৬/৩৫৫

আধুনিক আহলে হাদীস পরিভাষার শ্রেণী ভাগ :
যারা আহলে হাদীসের পারিভাষিক অর্থকে বিস্তৃত অর্থে গ্রহণ করেন তাদের মাঝে দুটি শ্রেণী লক্ষ করা যায়। এক। ভারত উপমহাদেশীয় আহলে হাদীস। দুই। আরব্য আহলে হাদীস।
উপমহাদেশীয় আহলে হাদীসের বৈশিষ্টগত পরিচিতি :
১। সাধারণত উপমহাদেশীয় আহলে হাদীসগণ তাকলীদ তথা নির্দিষ্ট কোনো সালাফ ইমামের ব্যাখ্যা গ্রহণ করাকে শিরক বলে অভিহিত করেন।
২। সালাফের মধ্যকার মতবিরোধপূর্ণ ধর্মীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ের বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হন।
৩। তারা কখনো নিজেদেরকে সালাফী বলে পরিচয় দিলেও অনেক ক্ষেত্রে তারা অনুসৃত আসলাফ ইমামদের ব্যাপারে শ্রদ্ধাবোধ দেখান না।
৪। তারা এক কুরআন এবং এক হাদীস বলে শ্লোগান দিলেও তাদের মাঝে প্রচুর পরিমাণ মত-পথ বা মতভিন্নতা লক্ষ করা যায়। এমন কি তাদের এক শ্রেণী কর্তৃক অন্য শ্রেণীকে কাফের বলার তথ্যও লক্ষ্যগোচর হয়।
৫। তারা নিজেদের মতাদর্শকে অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়ার মানষিকতা পোষণ করেন । পরমত সহিষ্ণুতাবোধ তারা লালন করতে চান না।
৬। তারা নিজেদেরকেই একমাত্র হাদীসের অনুসারী বলে দাবি করেন। অন্যদেরকে হাদীস বিরোধী বলে অভিহিত করেন।
৭। তারা হাদীস অনুসরণকে কেন্দ্র করে স্বতন্ত্র পরিচিতি লাভের জন্য আহলে হাদীসের মত অতি সম্মানিত একটি উপাধিব্যাঞ্জক শব্দকে সাম্প্রদায়িক এবং দলীয় রূপে চিত্রায়িত করে থাকেন।

আরব্য আহলে হাদীসের বৈশিষ্টগত পরিচিতি :
১। তারা আহলে হাদীস শব্দটিকে কেবল বৈশিষ্টগত দিক থেকে ব্যবহার করেন। স্বতন্ত্র পরিচিতি লাভের জন্য ব্যবহার করেন না।
২। তারা ঢালাওভাবে তাকলীদকে বাকা চোখে দেখেন না। বরং তারা সাধারণ মানুষের জন্য নির্দিষ্ট কোনো আলেম বা ইমামের তাকলীদকে আবশ্যক মনে করেন।
৩। মতবিরোধপূর্ণ ধর্মীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে তারা উদার দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন।
৪। তারা আইম্মায়ে সালাফের ব্যাপারে আদৌ বিরূপ মন্তব্য করেন না কিংবা অশ্রদ্ধা দেখান না।
৫। তারা আহলে হাদীস শব্দের বিস্তৃত অর্থ গ্রহণ করলেও নিজেদেরকেই একমাত্র আহলে হাদীস মনে করেন না। বরং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর সকল সদস্যকেই আহলে হাদীস মনে করেন।
৬। তারা নিজেদের মতাদর্শকে অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়ার মানষিকতা লালন করেন না।
৭। তাদের অধিকাংশ আলেম কোনো না কোনো মাযহাবের অনুসরণ করে থাকেন।
৮। তাদের কেউ কেউ নিজেদেরকে সরাসররি কোনো মাযহাবের সাথে সম্পৃক্ত না করলেও ফিকহ, ফতওয়া, মাযহাব এবং মাযহাবের অনুসারীদের ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন। তারা সাধারণ মানুষকে আলেমদের অনুসরণ এবং তাদের সাথে যুক্ত থাকার জন্য
উৎসাহিত করে থাকেন।
৯। আরবের মূল ধারার আলেমগণ মুজতাহিদ ইমাম ও তাদের সংকলিত ফিকহী মাযহাবসমূহের ব্যাপারে পরিপূর্ণ শ্রদ্ধাশীল। তারা কখনোই মাযহাব অনুসারীদের ব্যাপারে অশালীন মন্তব্য করেন না। যারা এ ধরনের অনাকাক্সক্ষীত কাজে ব্যতিব্যাস্ত তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন দেশ থেকে সেখানে গিয়ে স্থানান্তরিত হয়েছেন।
১০। শাইখ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব ইবনে সুলাইমান নাজদী রাহ., শায়খ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম আলে শায়খ রা., শায়খ আব্দুর রহমান সা’দী রাহ., শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ., শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেহ আলউসাইমীন রাহ., শায়খ সালেহ ইবনে
ফাওযান, শায়খ আবু বকর জাবের আল জাযায়েরী রা., শায়খ আতিয়্যা সালেম, শায়খ শানকীতি রাহ. প্রমুখ আরব বিশ্বের খ্যাতনামা শায়খদের প্রায় সকলেই নির্দিষ্ট কোনো ইমামকে অনুসরণ করে থাকেন। তাদের সকলেই মতবিরোধপূর্ণ মাসআলা মাসায়েলের ব্যাপারে উদার দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন।

উপমহাদেশীয় আহলে হাদীস এবং তাদের যুগ-সীমানা :
প্রকৃত অর্থে আহলে হাদীস হলো, হাদীস শাস্ত্রের সুগভীর পাণ্ডিত্ব অর্জনকারী উলামায়ে মুহাদ্দিসীন। হাদীস, ফিকহ, তাফসীরসহ দীনে ইসলামের বিভিন্ন শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলোতে প্রচুর পরিমাণ আহলুল হাদীস শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। তাদের রিফারেন্সে প্রচুর পরিমাণ
হাদীস বিষয়ক আলোচনা সেখানে স্থান পেয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় আহলে হাদীস শব্দটি মূলত বর্তমান কালের ডক্টর  শব্দটির মতই একটি শাস্ত্রীয় উপাধিব্যঞ্জক পরিভাষা। মূলত এ অর্থেই আহলে হাদীস পরিভাষাটি ব্যবহৃত হত। পরবর্তীতে কেউ কেউ এ পরিভাষাটিতে
আরো ব্যাপকতা এনেছেন। যদি আহলে হাদীসের এ বর্ধিত ও বিস্তৃত অর্থ গ্রহণ করা হয় তবে ইমাম আবু হানীফ, ইমাম শাফিয়ী, ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. এর ব্যাখ্যা অনুসারে যারা হাদীস অনুসরণ করে থাকে তারাও আহলে হাদীস শ্রেণীভুক্ত হবে।
কারণ ইমাম চতুষ্টয়ের প্রত্যেকেই হাদীসের শাস্ত্রের একেকজন উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। ড.
আব্দুল্লাহ ফকীহ বলেন, তেমনিভাবে অনেকে আহলে হাদীস নাম ব্যবহার করেন। এ আহলে হাদীস অর্থ হলো, বর্ণনা এবং বোধগত দিক থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহকে ধারণকারী এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাহ্যিক এবং লুকায়িত পথনির্দেশনাকে অনুসরণ কারী। সুতরাং এ অর্থে আহলে সুন্নাতের প্রতিটি সদস্যই আহলে হাদীস। বস্তুত মূল পারিভাষিক অর্থ বিবেচনায় সাধারণ হাদীস অনুসারীদেরকে আহলে হাদীস বলা যায় না। এবং বলাটা সমীচীনও নয়। কারণ
মুহাদ্দিসীনে কেরাম পরিভাষাটিকে এতটা ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করেন নি। কুরআন হাদীস সম্বন্ধে সামান্য জানা শোনা ব্যক্তিও এ সত্য ও বাস্তবতাকে স্বীকার করতে বাধ্য। তাছাড়া আহলে হাদীসদের অনুসরণ করলেও আহলে হাদীস নাম ধারণ করা যায় না। কারণ বিশেষ
উপাধী ধারী কোনো ব্যক্তির অনুসরণ করে কেউ সে উপাধি ধারণ করতে পারে না। সাহাবীদের অনসরণ করলেই সাহাবী উপাধী ধারণ করা যায় না। উপাধী ধারণ করা আর অনুসরণ করা এক জিনিস নয়। একথা ইতিহাস স্বীকৃত, অতীতে পৃথিবীর অনেক জায়গায় আহলে হাদীসদের মাযহাব চালু ছিল। সেখানকার অধিবাসীরা আহলে হাদীসদেরকে অনুসরণ করতেন। তাই বলে তারা নিজেদের ক্ষেত্রে আহলে হাদীস নাম ধারণ বা ব্যবহার করতেন এমন কোনো ঐতিহাসিক তথ্য খুজে পাওয়া যায় না। হাদীস অনুসরণ করে আহলে
হাদীস নাম ধারণ করা এবং সেটাকে দলীয় ও সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়ার প্রবণতা কেবল এ ভারত উপমহাদেশেই লক্ষ করা যায়। শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. এর
বক্তব্যেও এ কথাটির প্রমাণ পাওয়া যায়। আর একথা ইতিহাস স্বীকৃত বৃটিশ ভারতের পূর্ব যুগে পৃথিবীর কোথাও নিছক হাদীস অনুসরণ করেই আহলে হাদীস উপাধি বা নাম ধারণ করা কিংবা এ নামে দলীয় রূপ দেয়ার তথ্য পাওয়া যায় না। -মাজমূউ ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িলি ইবনে উসাইমিন ৯/৩৯৩, ফাতওয়াশ শাবাকাতিল ইসলামিয়া ৯/২২৫৯, মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনে বায ৮/৩৬১, আদদুররুরস সানিয়্যাহ, ১/২৭৭, মুকাদ্দামাতুল ইজায ফি বা’দী মাখতাফা ফীহিল আলবানী ওয়াবনু উসাইমীন, ওয়াবনু বায ১/৬, লিকাআতুল বাবিল মাফতুহ ১৯/৩২, ১২/১০০, মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনে বায ৪/১৬৬, ইয়ানাতুল মুসতাফীদ শারহু কিতাবিত তাওহীদ ১/১২, আইসারুত তাফাসীর ৭৭৭, মাউকিফুল উম্মাহ মিন ইখতিলাফিল আইম্মাহ ১৪, ফাতাওয়া আরকানিল ইসলাম ৩৯৭, মাজাল্লাতুল মাজমাইল ফিকহি ৫৯, ২১৯, মাসিক আলকাউসার জানুয়ারী ’১৬, ২১

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *