মুহাম্মাদ ইরফান জিয়া
মঙ্গলবারে মা’হাদের একটা বৈঠক চলছে। মুদীর সাহেবের ফোনটা বেজে উঠেলো। ও প্রান্তের কথা না শোনা গেলেও মুদীর সাহেবের চেহারায় খুশির আভা সুস্পষ্ট। তাঁর কিছু প্রতিউত্তর শুনে মনে হলো ও প্রান্তের মানুষটি আগামীকাল মা’হাদে আসছেন। জামি‘আতুল উলুমিল ইসলামিয়া থেকে হযরতপুর মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া-এ যাওয়ার পথে এখানে তাশরীফ আনবেন।
মুদীর সাহেবের ফোনালাপ শুনতে শুনতে আমার কেন যেন মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ সাহেবের কথা মনে পড়লো। জামি’আতুল উলুম আর মারকাযের নাম শুনেই কি না জানিনা- মনে হলো, শরীফ মুহাম্মাদ সাহেবের সাথেই মুদীর সাহেবের কথা হচ্ছে আর তাঁরই আগমন ঘটছে মা’হাদে। আমার ধারণা মিলে গেলো। ফোনালাপ শেষ হওয়ার পর জানা গেলো- মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ সাহেবের কাছে মা’হাদে আগমনের আবদার জানিয়ে রাখা হয়েছিলো। সে আবেদন তিনি কবুল করেছেন। আগামীকাল বিকেল তিনটায় আসবেন। থাকবেন আসর পর্যন্ত।
মাহাদ প্রাঙ্গনে
বুধবার। ঊনত্রিশ শাওয়াল চৌদ্দশ চল্লিশ হিজরী। জুলাই দু’হাজার উনিশ-এর তিন তারিখ। জোহরের নামায পড়ে জামি‘আতুল উলুমে চলে গেলেন মাওলানা মাহমূদুল হাসান সাহেব ও মাওলানা সাঈদুর রহমান সাহেব। সবাই অধীর অপেক্ষায় বসে আছে। দোতলার জানালা থেকে বারবার তাকাচ্ছিলাম। মোটরসাইকেলের শব্দে সচকিত হলাম। মুদীর সাহেব ও অন্যান্য আসাতিযায়ে কেরাম এগিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন।
শরীফ মুহাম্মদ সাহেবের হাতে সময় খুব বেশি নেই। ওযু সেরে তিনি দোতলার মেহমানখানায় বসলেন। আসাতিযায়ে কিরামের সাথে আলোচনার পাশাপাশি হালকা চা-নাস্তা পেশ করা হলো। দেখলাম, এক ফাঁকে তিনি নিজের নোটবুকে কী যেন টুকে রাখলেন। নিচতলায় ছাত্ররা তাঁর কাছ থেকে কিছু শোনার জন্যে বসে আছে। কয়েক মুঠো নাস্তার পর দেরি না করে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে ।
আলোচনায় সজীব মজলিস
মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ সাহেবের আলোচনাপূর্ব ভূমিকায় মুদীর সাহেব মা’হাদের সাথে তাঁর বিশেষ মহব্বত এবং হৃদ্যতার কথা তুলে ধরলেন। এ সম্পর্ক ও অধিকারের বলেই মা’হাদ মাঝেমধ্যে তাঁকে এখানে এসে কিছু বলার আবদার করে থাকে। মা’হাদে তাঁর দ্বিতীয়বার আগমনের জন্যে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে মুদীর সাহেব তাঁকে মা’হাদের তলাবাদের উদ্দেশে পাঠদানসূচক কিছু আলোচনা পেশ করতে অনুরোধ করলেন।
মা’হাদের সকল আসাতিযা ও পরিচালনা পরিষদের শোকগুযারী করে মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ সাহেব তাঁর আলোচনা শুরু করেন। মা’হাদের ছাত্ররা বর্তমান সময়ের শীর্ষস্থানীয়, নেক, যোগ্য ও নেককারদের আস্থাভাজন আলেমদের সান্নিধ্য পাচ্ছে বলে তাদেরকেও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর আহ্বান করেন।
কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়া আদায়ের বিষয়টিকে সুস্পষ্ট করতে গিয়ে তিনি বলেন, “নেক কাজের সবটুকু মানুষের সাধ্যের মধ্যে নেই। সেজন্যে নেক কাজের তাওফীক আল্লাহর কাছ থেকে চাওয়াও অনেক বড় বিষয়। মানুষ তার কাজের ব্যাপারে অবশ্যই দায়বদ্ধ। তবে এ কথাও বাস্তব যে সে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওফীক প্রাপ্ত না হলে সে ভালো কাজ করতে সক্ষম হবে না। সুতরাং কখনো নেক কাজের তাওফীক পেলে সেটাকে নিজের কৃতিত্ব মনে না করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে।
দেখুন, শুকরিয়ার দু’টি দিক আছে। প্রথম দিকটি হলো, মুখে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। আরেকটি দিক হলো, নিজের কাজে সেটিকে ফুটিয়ে তোলা। কেউ একজন তার বাবাকে মুখে মুখে খুব ভালোবাসার দাবি করে। কিন্তু বাবা কোন আদেশ করলে বা তার কোন দরকার এলে পালিয়ে বেড়ায়। তাহলে কিন্তু তার কথা সম্পূর্ণ অর্থহীন বলে গণ্য হবে। আর যদি সে বাবার যেকোন প্রয়োজনে লাফিয়ে অগ্রসর হয়, বুঝতে হবে- এর কথা কাজে মিল আছে।
আমরা যারা এ প্রতিষ্ঠানে আছি, তারা যদি সত্যিকারার্থে এর আসাতিযায়ে কিরামের শুকরিয়া আদায় করতে চাই এবং শুকরিয়ার অনুভূতি হৃদয়ে লালন করতে চাই, তাহলে আমাদেরও কথা-কাজে মিল থাকতে হবে। শুধু বাহ্যিক কানুন মেনে চললেই হবে না। বরং এসব কানুনের বাইরে উস্তাদদের দিলের ভেতরের যেসব ইচ্ছা ও মানশা লুকায়িত থাকে সেটাকেও বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করতে হবে।
বিশ্বাস করুন, জীবনের আটচল্লিশটি বসন্ত পেরিয়ে আজ আমার একথাই মনে হচ্ছে- হায়! ছাত্রত্বের সময়টা যদি আরো সুন্দর করে কাটাতে পারতাম। উস্তাদগণ আমার কাছ থেকে কানুনের বাইরেও কিছু জিনিস চেয়েছিলেন। আমি কানুন তো ভঙ্গ করিনি কিন্তু তাঁদের মনের চাওয়াটাকে হয়তো পাশ কাটিয়ে গেছি। আফসোস হয়, যদি উস্তাদদের মনের পাতায় লিখিত সে আইনটাও মেনে চলতাম তাহলে আজ জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো! আজ আমার জীবন থেকে মূল্যবান সেসব রত্ন হারিয়ে গেছে।
যেকোনো প্রতিষ্ঠানেই শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যে আইন করা হয়। এ রীতিটা শুধু আমাদের অঙ্গনে নয়। ক্যাডেট স্কুলে আছে। কলেজে আছে। ঢাকা ভার্সিটিতে আছে। পুলিশ-আর্মিসহ সব জায়গায় আছে। প্রতিষ্ঠানে থাকতে হলে এসব নিয়ম মেনে চলতে হয়। এ কথা বলা যায় না, শরীয়ত তো এবিষয়টা আমার ওপর বাধ্য করেনি তাহলে প্রতিষ্ঠান কেন করবে? আমরা যদি নিজেদের জীবন গড়তে চাই তাহলে আত্মসমর্পণের সাথে থাকতে হবে। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাবার জন্যে সুযোগ খোঁজা যাবে না। এসব নিয়ম ও কঠোরতাকে তারবিয়তের অর্থে গ্রহণ করতে হবে। একটু শাস্তি মনে হলে হোক। এর মধ্যেই স্বাদ ও আনন্দ খুঁজে নিতে হবে।
আপনারা যদি ছাত্রত্ব থেকে পরিপূর্ণ ইস্তিফাদা চান, তাহলে এ বিষয়টার প্রতি লক্ষ রাখুন। লিখিত আইন মানুন। অলিখিত আইনও মানুন। মৌখিক আইন মেনে দেখুন। মনের ভেতরের সুপ্ত মানশাও মেনে চলার চেষ্টা করুন। আপনাদের জন্যে আজ আমি নিজের জীবন থেকে অভিজ্ঞতার এই বার্তাটা রেখে যাচ্ছি। পরবর্তীতে আফসোস করতে না চাইলে এখন থেকেই আমলের চেষ্টা করুন।
আপনাদের মধ্যে এখন তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। এখন অনেক কিছু করতে মনে চাইবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, চাইলেও কিন্তু আপনি দুনিয়ার সব সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না। সব ধরনের জ্ঞান অর্জন করে ফেলতে পারবেন না। সুতরাং এখনই সবকিছুতে ঝাঁপিয়ে না পড়ে আগে একাডেমিক পড়াশোনা আর সুহবতের মাধ্যমে একটা রুচি গড়ে তুলুন। একটা বাছাই প্রবণতা আপনার মধ্যে আসুক। এটাই আপনাকে বলে দেবে কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক। কোথায় যাবেন আর কোথায় যাবেন না। কী শোনবেন, কী শোনবেন না।
খেদমতের সোনালি উসুল
আপনারা যারা ইফতা পড়ছেন তাদের জন্যে খেদমতের বিশাল এক জগত অপেক্ষা করছে। সামাজিক জীবনের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত এ ময়দানের কর্মক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত। জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান জানতে মুচি, রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সচিব, মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি -সবাই আপনার কাছে ফোন করবে। একজন মুফতী শুধু মুফতীই নন। তিনি একজন মনোবিজ্ঞানীও বটে। হাজারো মানুষের ভেতরের গল্প জানেন। সমাধানের পাশাপাশি তিনি সান্ত্বনাও দেন। মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ একাজ দীনের সরাসরি একটি খেদমত। সুতরাং নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করুন।
ইফতা’র বিস্তৃত অধ্যয়নের পর উস্তাদদের নির্দেশনায় একেকজন একেক বিষয় নিয়ে পারদর্শিতা অর্জন করুন। ফারেগ হওয়ার পরও এ মেহনত করতে পারেন। কারো মধ্যে হয়তো সংবিধান নিয়ে উৎসাহ আছে। আপনি উপযুক্ত একটা সময় ব্যয় করে সংবিধানের তুলনামূলক পড়াশোনা করুন। কেউ নারী বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারেন। নারীদের হিজাব, তালাক, মীরাস, বাইরে কাজ করা ইত্যাদি বিষয়ে যতো রকম আপত্তি উত্থাপন করা হয়, সেগুলোর একটা তালিকা করে অধ্যয়ন শুরু করতে পারেন।
এভাবে একটা সময়ে গিয়ে আপনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞে পরিণত হবেন। আপনার উস্তাদও সে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হলে লোকজনকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। চাইলে আপনি সীরাত বিষয়েও অধ্যয়ন করতে পারেন। একটা সময়ে আপনি সীরাত বিষয়ে সংশয়বাদীদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন এবং এ বিষয়ে উলামায়ে কেরামের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন। কাজ করতে চাইলে ব্যাংক-বীমা, লেনদেন, ইসলামী লেবাস, ইস্তেশরাকসহ আরো অসংখ্য ক্ষেত্র আপনার সামনে খোলা রয়েছে।”
আলোচনার এখানে এসে মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ সাহেব আবারো সবাইকে শুকরিয়া জানালেন । মাওলানা মাহমূদুল আমীন, মাওলানা হাফীজুর রহমান, মাওলানা মাসঊদুর রহমান, মাওলানা মাহমূদুল হাসান, মাওলানা সাঈদুর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট আরো অনেকের প্রতিই ভরপুর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন।
মান্যতার কিছু কথা
কৃতজ্ঞতার দ্বিতীয় পর্ব শেষে মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ সাহেব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার অবতারণা করলেন। বিষয়টা আজকাল নতুন কিছু তর্কের জন্ম দিয়েছে। তর্কগুলো বড়দের বিষয়ে। তাঁদের কি ভুল হতে পারে না? তাদের ভুল ধরার অধিকার কি আমাদের নেই?’ এমন নানা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে কিছু মানুষের মনে।
এ প্রসঙ্গে মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ সাহেব মা’হাদের তরুণ আলেমদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘এখনই এসব তর্ক শুরু করে দেবেন না। আগে শিখুন, পড়ুন। লম্বা একটা সময় গবেষণার মধ্যে ব্যয় করুন। দু-চার দশ বছর দেখুন। তারপর যদি আপনার তাহকীকে মনে হয়, -বড়দের এ বিষয়টা এমন না হয়ে এমন হবে। ধীরে ধীরে, আদবের সাথে উপস্থাপন করুন। তা না করে এখনি যদি আপনি পরিপক্কতা আর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছাড়া কথা বলা শুরু করেন, একটা সময়ে গিয়ে আপনি নিজেই লজ্জিত হবেন। আমি আমার বয়স থেকেই বলছি। আমার জীবনে বিশ বছরের টগবগে তরুণকে যে মেজাযে দেখেছি, তিরিশ বছর বয়সে যখন তার দু’ হাতে ভর করে দু’ ছেলে দাঁড়িয়ে আছে তখন তাকে একেবারে বিপরীত চিন্তা লালন করতে দেখেছি। যেই ছেলে তরুণ অবস্থায় কোনো কিছুকেই কিছু মনে করেনি, কর্মজীবনের বারো বছর পার হওয়ার পর তাকে অন্যদের থেকেও নত হয়ে চলতে দেখেছি।
এখন আপনার বেড়ে ওঠার বয়স। এখন মুরব্বীরা যেভাবে সিঞ্চন করতে চাচ্ছেন করতে দিন। যে সার প্রয়োগ করতে চাচ্ছেন করার সুযোগ দিন। এখন এ কথা বলবেন না যে, আমার গোড়ায় আমি নাপাক সার প্রয়োগ করতে দেব না। আপনাদের সিঞ্চিত পানি গ্রহণ করার কোনো দরকার আমার নেই। আমি নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখন যদি এ কথা বলেন তাহলে অঙ্কুরেই শেষ হয়ে যাবেন। চারাগাছ হয়ে বেড়ে ওঠা আপনাকে মুরব্বীরা গবাদি পশু ও কীট-পতঙ্গ থেকে রক্ষা করতে পারবেন না।
সুতরাং এ সময়টায় অন্তত মুরব্বীদের কথার বাইরে না গিয়ে তাদের দেখানো পথে চলুন। তারা যখন কোনো কিছু করতে বলেন, খুব সাহসের সাথে করুন, সময় লাগান। তাদের নাহজ ও ফিকরের বাইরে এমন কিছুতে নিজের জীবনের বাজি লাগিয়ে দেবেন না, যার জন্যে কিছুদিন পর আপনাকেই আফসোস করতে হয় অথবা ঠিক বিপরীত প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে যেতে হয়।”
তলাবাদের উদ্দেশে শেষ কথা
আমরা মজলিসের আলোচনার শেষ দিকে চলে এসেছি। মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ সাহেব সেদিনের মজলিসে তলাবাদের উদ্দেশে আরো বিশেষ কয়েকটি নসীহত করে তাঁর আলোচনা শেষ করেন।
- নিজেদের মর্যাদার অনুভূতি থাকতে হবে। নিজেদের অবস্থান চিনতে হবে। সমাজের মানুষ না বুঝুক। তারা তো কতো কিছুই বোঝে না। কারো নিজের জমিতে স্বর্ণের খনি থাকলেও সে জমি সামান্য বেশি দাম পেলেই বেচে দেয় শুধুই না জানার কারণে। তাই সমাজের মানুষের বোঝা না বোঝার দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। আমাদের নিজেদের মাকাম নিজেদেরকেই বুঝতে হবে। এ মর্যাদার অনুভূতি অন্তরে লালন করতে হবে।
- সময়কে কাজে লাগাতে হবে। অনেকে সময় ব্যয় হয়ে যাওয়াকে মনে করে সময়কে কাজে লাগানো। অথচ বিষয়টা এমন নয়। সময়কে নষ্ট না করে ইবাদত অথবা আহরণে সময়কে ব্যায় করতে হবে। তাহলেই সময় কাজে লাগবে। মাঝে মাঝে নিজেই নিজেরর হিসাব নিয়ে দেখতে হবে সময়গুলো কাজে লাগছে কি না।
- প্রচুর মেহনত করতে হবে। মেহনত না করলে মানুষ গড়ে ওঠে না। আমরা যখন ছোটবেলায় হাফেজ্জী হুজুর, মুহাদ্দিস সাহেব হুজুর, শাইখুল হাদীস সাহেব হুজুর, খতীব উবাইদুল হক সাহেবদের মতো বড়দের দেখেছি তখন নিজেদের জ্ঞানস্বল্পতার কারণে মনে করেছি, যোগ্য হতে হলে অনেক বয়স লাগে। অনেক বয়স হলে, অনেক আমল জমা হলে তারপর মানুষ বড় ও যোগ্য হতে পারে। আশি বছরের আগে যে কেউ বড় হতে পারে শৈশবে সেটা আমাদের কল্পনাতেও ছিলো না। তখন তো বুঝিনি কিন্তু এখন দেখছি, যারা বড় হওয়ার ছিলেন তারা ত্রিশ বছরের আগেই বড় হয়ে গেছেন। আগের জমানাতেও হয়েছে, এ জমানাতেও তার দৃষ্টান্ত রয়েছে।
- আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই দীনী আত্মমর্যাদাবোধ থাকতে হবে। ইলমে দীনের ধারক বাহক হিসেবে কিছুতেই দুনিয়াদারদের থেকে নিজেকে ছোট মনে করা যাবে না। এটা অহংকার নয়। আত্মমর্যাদবোধের সাথে অহংকারের সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। আত্মমর্যাদাবোধের দাবি হলো, তালিবে ইলমী শানের খেলাফ সকল কাজ পরিহার করা। সময়কে কাজে লাগানোর যে মূলনীতি আমি বলেছি আত্মমর্যাদাবোধ থেকেই সেটার তাগিদ অনুভূত হয়ে থাকে।
আমাদের আকাবির ও আসলাফ অনেক মেহনত ও বিনিদ্র রাত্রি যাপন করে দীন ও শরীয়তকে এত সুন্দরভাবে বিন্যস্ত করে গেছেন। লক্ষ লক্ষ কিতাব লিখে গেছেন। আমরাও যদি মেহনত করি, পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে কিছু রেখে যেতে পারব। এমন যেন না হয় আমরা পৃথিবীর খেলাঘরে এলাম আর কিছুদিন রঙ তামাশা দেখে চলে গেলাম। আল্লাহ পাক তাওফীক দান করুন। আমীন।
শেষ হয়েও হলো না শেষ
আলোচনা শেষ হয়ে গেলো। মা’হাদের উস্তাদ-ছাত্র সকলের মধ্যে অন্যরকম এক সজীবতা বিরাজ করছে। শরীফ মুহাম্মদ সাহেবের দরাজ কণ্ঠের বক্তব্য সবার মাঝে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে। মুগ্ধতা বিরাজ করছে সবার মাঝে। খুব চমৎকার একটা সময় কাটছিলো। মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ সাহেবের ভাষায় বললে সময়টা কাজে লাগছিলো। এত দ্রুত কেটে গেলো বলে আফসোস হচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, প্রিয় এ মানুষটাকে আমরা মা’হাদ থেকে এক বিকেলেই হারিয়ে ফেলছি না। তিনি কথা দিয়েছেন, মাঝেমধ্যে হলেও এসে তাঁর প্রতি প্রচণ্ড অনুরক্ত এসব মানুষের পিপাসা নিবারণ করে যাবেন।
আসরের সময় ঘনিয়ে এসেছে। মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ সাহেব মা’হাদের অফিস কক্ষে বসে আছেন। আনন্দ বিনিময় করছেন সবার সাথে। বলছেন, আমাকে অসংখ্য মানুষ ভালোবাসেন। আমি নিজেও জানিনা এর কারণ কী? মাওলানা আবু তোরাব মাসুম আর মাওলানা ইসমাঈল হাসান জামি’আতুল উলুমিদ দীনিয়ায় খেদমত করছে। মা’হাদে শরীফ মুহাম্মদ সাহেব এসেছেন শুনে তারা ছুটে এসেছে। তাদেরকে পেয়ে তিনি আনন্দিত।
আসরের পর। মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ সাহেব একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে লাগলেন। মা’হাদে এসে যাদের সাথে দেখা হয়েছিলো কাউকেই বাদ দিলেন না। নিজেই খোঁজ করে সবার সাথে বিদায়ী মুসাফাহা করতে লাগলেন। বিষয়টা অভাবনীয় হলেও অভূতপূর্ব নয়। বয়স বা যোগ্যতায় যে যেমনই হোক না কেন, সবার সাথে আন্তরিকতা প্রদর্শন মুসলিম হিসেবে আমাদের কর্তব্য। আমাদের আকাবির ও আসলাফের চর্চিত ইসলামের চিরায়ত রূপও এটাই। আজ বিকেলের মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ সাহেবের মাঝে সে চিরায়ত রূপটাই জীবন্ত হয়ে উঠলো।