(আয়াত ১-৯)
মুফতী ইবরাহীম হাসান দা.বা.
আয়াতসমূহ ও তরজমা
الم. اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ. نَزَّلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ وَأَنْزَلَ التَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ … … رَبَّنَا إِنَّكَ جَامِعُ النَّاسِ لِيَوْمٍ لَا رَيْبَ فِيهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُخْلِفُ الْمِيعَادَ.
অর্থ : আলিফ লাম মীম। আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সবকিছুর ধারক। তিনি আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন সত্যতার সাথে; যা সত্যায়ন করে পূর্ববর্তী কিতাবসমুহের। নাযিল করেছেন তাওরাত ও ইঞ্জীল, এ কিতাবের পূর্বে, মানুষের হিদায়াতের জন্য এবং অবতীর্ণ করেছেন মীমাংসা। নিঃসন্দেহে যারা আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করে, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন আযাব। আর আল্লাহ হচ্ছেন পরাক্রমশীল, প্রতিশোধ গ্রহণকারী। আল্লাহর নিকট আসমান ও যমীনের কোন বিষয়ই গোপন নেই। তিনিই সেই আল্লাহ, যিনি তোমাদের আকৃতি গঠন করেন মায়ের গর্ভে, যেমন তিনি চেয়েছেন। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। তিনি প্রবল পরাক্রমশীল, প্রজ্ঞাময়। তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো রূপক। সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে, তারা অনুসরণ করে ফিতনা বিস্তার এবং অপব্যাখ্যার উদ্দেশে তন্মধ্যেকার রূপকগুলোর। আর সেগুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর, তারা বলেন, আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি। এ সবই আমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। আর বোধশক্তি সম্পন্নেরা ছাড়া অপর কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। হে আমাদের পালনকর্তা! সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্যলংঘনে প্রবৃত্ত করো না এবং তোমার নিকট থেকে আমাদিগকে অনুগ্রহ দান করো। তুমিই সব কিছুর দাতা। হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি মানুষকে একদিন অবশ্যই একত্রিত করবে; এতে কোনই সন্দেহ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর ওয়াদার অন্যথা করেন না। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১-৯)।
শিরকমুক্ত একত্ববাদ
শুরুতেই আল্লাহ তাঁর একত্ববাদ এবং তিনি শিরকমুক্ত একথার ঘোষণা করেছেন। তিনি অংশিদারমুক্ত হওয়ার যুক্তি-প্রমাণ পেশ করে তার একত্ববাদকে প্রমাণ করেছেন। আল্লাহর একত্ববাদকে যে ব্যক্তি দুনিয়াতে স্বীকারোক্তি দিবে সে ব্যক্তি নাজাত পাবে। আর যে ব্যক্তি সবকিছুকে মেনে নিবে কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদকে বিশ্বাস করবে না সে কখনো মুক্তি পাবে না। মৃত্যুর পর তার জন্য যে শাস্তি নির্ধারণ হবে সেটা কখনো শেষ হবে না। এজন্য কুরআনে পাকের মৌলিক তিনটি বিষয়ের প্রথম নম্বর হলো তাওহীদ, দ্বিতীয় নাম্বার হলো রিসালাত, তৃতীয় নাম্বার হলো আখেরাত। সূরা আলে ইমরানের দ্বিতীয় আয়াত থেকেই একত্ববাদের আলোচনা আরম্ভ হয়েছে। তিনি একত্ববাদের দাবী করে বলেছেন- الله لا إله إلا هو। অর্থ : আল্লাহ তো ঐ সত্তা যিনি ছাড়া কোন মা’বূদ নেই। ইবাদত বা উপাসনা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই প্রাপ্য। যদি কোন বান্দা আল্লাহর সাথে গাইরুল্লাহরও উপাসনা করে তাহলে সে আল্লাহ তা‘আলার সাথে শরীক করার কারণে চির জাহান্নামী হয়ে যাবে। আমরা অনেকে ইবাদত কাকে বলে সেটা না বুঝার কারণে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করে থাকি। অথচ আমরা নাম দিয়েছি মুমিন-মুসলমান। আবার উপাসনা আল্লাহ ছাড়া গাইরুল্লাহরও করে থাকি। এ জন্য ইবাদতের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। ইবাদত কাকে বলে এটাও জানতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা যতগুলো কাজ করার নির্দেশ দান করেছেন সেগুলোর সবই ইবাদত এবং যতগুলো করতে নিষেধ করেছেন সেগুলো থেকে বিরত থাকার নামও ইবাদত। যখন ঐ নিষিদ্ধ কাজগুলো করার সুযোগ আসবে তখন সেগুলো না করে বিরত থাকলে ইবাদত হয়ে যাবে। আল্লাহ যে কাজ করার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন, যে কাজের প্রশংসা করেছেন সেই কাজগুলোও ইবাদত। ইবাদতের সংজ্ঞা হলো : العبادة اسم جامع لكل ما يحبه الله ويرضى به। যেসব কাজ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পছন্দ করেন বা যেগুলোর ব্যাপারে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন তা-ই ইবাদত। আল্লাহ তা‘আলা দু‘আ করার জন্য আল্লাহকেই বাছাই করতে বলেছেন। আল্লাহ বলেন, وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ অর্থ : যখন বান্দা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে আমি কোথায়? তখনই বলে দিবে আমি নিকটেই। যখন আমার নিকট দু‘আ করে তখন আমি তার দু‘আ কবুল করে নিই। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন- ادعوني استجب لكم অর্থ : আমার নিকট দু‘আ করো আমি তোমাদের দু‘আকে কবুল করে নিব। হাদীসে এসেছে, اذا سالتم فاسالوا الله অর্থ : যখন তোমরা চাইবে তখন একমাত্র আল্লাহর নিকট চাইবে। এই দু‘আ ইবাদত। অনেক মানুষ আল্লাহর কাছে চেয়ে যখন না পায় তখন মাজারে গিয়ে মাজার ওয়ালার কাছে চাইতে থাকে। বাবা বলে ডাকতে থাকে, আমার অমুক প্রয়োজন পুরা করে দিন, আমার সন্তান হয় না; সন্তান দিন, মামলায় জড়িয়ে গিয়েছি; আমার পক্ষে রায় দিয়ে দিন ইত্যাদি ইত্যাদি। যা আল্লাহর কাছে চাইতে হয় তা মাজারওয়ালার কাছে চাইতে থাকে। ভ্রান্ত আকিদার মাজারওয়ালাকে মনে করে তিনি আমার সব অবস্থা জানেন। তিনি সব প্রয়োজন পূরণ করতে পারেন। এই যে সে মাজারওয়ালার নিকট দু‘আ করল ও তার কাছে চাইল এটা সে শিরক করল। কিন্তু সে মুসলমান। নামায পড়তে পড়তে কপালে দাগ পড়ে গেছে। মসজিদে এসে দু রাকাআত নামায পড়ে দু‘আ করে না পেয়ে মাজারে চলে গেছে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে যে আমল করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে যে আমল শিক্ষা দিয়েছেন তা হলো, আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকে আমাদের সব জিনিস চাইতে হবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে চাওয়া যাবে না। মান্নত করা এবং মান্নত পুরা করা ইবাদত। এখন যদি কোন বান্দা মাজারের নামে মান্নত করে যে, আমার ছেলে সুস্থ হলে মাজারে শিরনি দিব, খাসি দিব তাহলে এটা শিরক হবে। মাজারওয়ালাকে সন্তুষ্ট করার জন্য মান্নত করা শিরক। তার হয়ত এটাই বিশ্বাস যে মাজারওয়ালার দৃষ্টি আমার উপর পড়লে আমার মান্নতের বিষয় পূরণ হবে। মূলত এই মান্নত সে গায়রুল্লাহর জন্য করল। গায়রুল্লাহর নামে হওয়ার কারণে সে মুশরিক হয়ে গেল। আমরা এ রকম অজানা অবস্থায় অনেক শিরকের মধ্যে লিপ্ত থাকি। কেউ কেউ পীরের সামনে গিয়ে সিজদায় পড়ে যায়। বলে যে, পীরকে সম্মান করার জন্য আমি সিজদা করলাম। মাথা কপাল এমনকি নিজের বডি কোন গাইরুল্লাহর সামনে নত করা শরীয়তে জায়েয নেই। সম্মানের জন্য সামন্য নত করাও ইবাদত। আমরা রুকু করি। রুকুতে আমরা কপাল মাটিতে ঠেকাই না। এই রুকুটা নামাযের একটি আমল। এটা ইবাদত। সিজদাও একটা ইবাদত। এখন যদি কেউ পীরের সামনে হাত কাচুমাচু করে হাত জড়ো করে মাথা নিচু করে, তাহলে সে পীরকে সিজদা করল। পীরের ইবাদত করল। পীরের পুঁজা করল। সে মুশরিক হয়ে গেল। এ দিকে সে বলছে আল্লাহ এক কিন্তু কাজ-কর্মে শিরক করছে। এজন্য আল্লাহ একত্ববাদকে কুরআনে স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। বলেছেন, الله لا إله إلا هو অর্থ : আল্লাহ ঐ সত্তা যিনি ছাড়া কোন মা’বূদ নেই। তিনি ছাড়া কারো ইবাদত করা যাবে না।
আল্লাহ কেন মা’বূদ?
আল্লাহ একা কেন মা’বূদ? তার দলীল হিসেবে আল্লাহ তাঁর চারটি বিশেষ গুণকে বর্ণনা করেছেন। এই চারটি গুণ যে সত্তার মধ্যে পাওয়া যাবে তিনি একমাত্র মা’বূদ হতে পারবেন। আর আমরা যদি সকলে লক্ষ্য করি তাহলে বুঝতে পারব, এই চারটি গুণ আল্লাহ ছাড়া কারো মাঝে নেই। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা মা’বূদ। চারটি গুণ হলো-
১. الحي অর্থ চিরঞ্জীব চিরস্থায়ী। যার হায়াত কখনো ছিলো না এমনটা হয়নি। সর্বদা আছেন এবং থাকবেন। এমন কোন সময় আসবে না যখন তার হায়াতটা থাকবে না। আর আল্লাহ ব্যতীত সমস্ত মাখলুক এমন যা এক সময় ছিলো না। কিন্তু আল্লাহর সত্তা ছিলো। এমন একটা সময় ছিলো যখন জিবরাঈল, মিকাঈল, মালাকুল মাউত, ইসরাফীল, মালেক, রিযওয়ান, জান্নাত, জাহান্নাম এমনকি আরশ বহনকারী ফেরেশতা কেউ ছিলো না। এমন একটা সময় ছিলো যখন আল্লাহ ছাড়া কিছুই ছিলো না। আবার এমন একটা সময় আসবে যখন আল্লাহ ছাড়া কিছুই থাকবে না। আল্লাহ চিরস্থায়ী- চিরঞ্জীব। আল্লাহ ব্যতীত আর কোন মাখলুক চিরঞ্জীব নয়।
২. القيوم আল্লাহই একমাত্র সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। কোন মাখলুক এমন নেই যে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। একজন মানুষের একটি কারখানা যদি বড় হয়ে যায় তাহলে একা সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। একেক সেকশনের জন্য একেকজন সুপারভাইজার বানিয়ে দেয়। একেক ডিপার্টমেন্টের একেকজনকে হেড বানিয়ে দেয়। আর তারাও একেবারে ছোট থেকে বড় সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ একা করতে পারে না। আল্লাহ এমন এক সত্তা যিনি অণু পরমাণু থেকে নিয়ে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করেন। ক্ষুদ্র একটা প্রাণী যাকে দেখান জন্য আমাদেরকে অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়; আল্লাহ তারও নিয়ন্ত্রণ করছেন। আর আসমান বিশাল এক মাখলুক। এরও নিয়ন্ত্রক আল্লাহ। মানুষ নিজেকেই নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে আল্লাহ। এ জন্যই তো মানুষ সব সময় সুস্থ থাকতে চায়, বেঁচে থাকতে চায়, কিন্তু হঠাৎ সে মৃত্যুবরণ করে। কারণ তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। তার নিয়ন্ত্রণ করছে আল্লাহ। তিনি যখন ইচ্ছা নিয়ে গেছেন। যখন ইচ্ছা তাকে অসুস্থ করে দিয়েছেন। যখন ইচ্ছা তাকে সুস্থ করে দিয়েছেন। যখন ইচ্ছা তখন তাকে বৃদ্ধ বানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলার নিয়ন্ত্রণেই সবকিছু হয়। এই হলো দ্বিতীয় গুণ। আর এই দুটোকে বলা হয় আল্লাহ তা‘আলার اسم أعظم। কুরআন শরীফের তিনটি আয়াতে ইসমে আযম রয়েছে। ১. আয়াতুল কুরসীর প্রথম অংশ الله لا اله الاهو الحي القيوم ২. সূরা আলে ইমরানের আয়াত الله لا اله الاهو الحي القيوم ৩. সূরা তোয়া-হা’র আয়াত وعنت الوجوه للحي القيوم গুলোর মধ্যে ইসমে আযম আছে। আল্লাহর এই اسم أعظم যে মানুষটি অর্জন করতে পেরেছে সে সফতলতা অর্জন করতে পেরেছে।
হযরত মূসা আ. নিজের সকল উম¥তকে নিয়ে ফিরাউন বাহিনী থেকে পলায়নের জন্য রওয়ানা হয়েছেন। সামনে লোহিত সাগর। নীল দরিয়া নয়। এটা ভুল। বরং লোহিত সাগর। যেটা পার হওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ হযরত মূসা আ. কে বললেন আপনার লাঠি দ্বারা পানিতে আঘাত করুন। বর্ণিত আছে, মূসা আ. ইসমে আযম বলে আঘাত করেছেন। সাথে সাথে মূসা আ.-এর বারটির গোত্রের জন্য বারটি রাস্তা তৈরি হয়ে গেছে। হযরত সুলাইমান আ. বিলকিসের সিংহাসন আনাবেন। বললেন, বিলকিস রওয়ানা দিয়েছে। সে আমার কাছে আসার আগে কে তার সিংহাসন নিয়ে আসতে পারবে? সুলাইমান আ.-এর দরবারে এক বড় শক্তিশালী জিন ছিলো। যাকে আমরা দেও বলি। সে বলেছে, আমি তার সিংহাসন আপনার আজকের এই মজলিস শেষ হওয়ার আগে আগে এনে দিব। মজলিস সকালে বসে বিকেলের মধ্যে শেষ হয়ে যেত। হযরত তাকে অনুমতি দিলেন না। পাশেই আরেকজন মানব ছিলো। তিনি জিন নন। তার কাছে কিতাবের ইলম ছিলো। অর্থাৎ اسم أعظم এর ইলম ছিলো। সেই আলেম ব্যক্তি বলে উঠল, أَنَا آتِيكَ بِهِ قَبْلَ أَنْ يَرْتَدَّ إِلَيْكَ طَرْفُكَ অর্থ : আপনার চোখের পলক পড়ার পূর্বেই আমি সিংহাসন নিয়ে আসব। মানুষের পলক পড়ে কতক্ষণ পরপর? অনিচ্ছা সত্ত্বেও বারবার পড়তে থাকে। সুলাইমান আ. দেখলেন, পলক পড়ার আগেই সিংহাসন হাজির। যেন كُنْ فَيَكُونُ এর মত হাজির। সুলাইমান আ. আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন, هَذَا مِنْ فَضْلِ رَبِّي অর্থ : এটা আমার প্রতিপালকের করুণায় হয়েছে। যে যামানায় বড় কোন ক্রেন ছিলো না, কোন যান্ত্রিক বাহন ছিলো না। সেই যমানায় বিলকিসের বিশাল সিংহাসন যা একটা ঘরের চেয়ে বড় সেটাকে উঠিয়ে নিয়ে চলে এসেছে। কে আনলো? ঐ ব্যক্তি যার কাছে اسم أعظم এর ইলম ছিলো। এই ইসমে আযমের অধিকারী কে? একমাত্র আল্লাহ। তো আমরা ভাবতে পারি আমাদেরটা কেন হয় না? আমরা বারবার জপতে থাকি الْحَيُّ الْقَيُّومُ । তাহলে কাজ হয় না কেন? একটা পাওয়ারফুল গুলি যেটা কমপক্ষে ১০০০ মিটার যাবে। মানে ১ কি.মি. যাবে। সামনে কোন মাখলুক পড়লে তা ভেদ করে চলে যাবে। কিন্তু এ পাওয়ার আসার জন্য কি করতে হবে। রাইফেলের ভিতর ঢুকিয়ে তারপর মারতে হবে। এটা যদি হাতে মারা হয় তাহলে মানুষ তো দূরের কথা বিড়ালও আঘাত পাবে না। বরং তার ভালো লাগবে যে, কে যেন আমার শরীরটা ম্যাসেজ করে দিল। অথচ পাওয়ার হওয়ার জন্য যেটা দরকার সেটা হয়নি। আমাদের মুখ থেকে শব্দ বের হয়। কিন্তু এটার পাওয়ারের জন্য যে শক্তি দরকার সে শক্তি অর্জন হয়নি। এক মুরীদ পীর সাহেবকে বলছে, আমাকে ইসমে আযম শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন, তুমি ইসমে আযম শিখতে পারবে না। তো সে বললো, আপনি শিখিয়ে দিন। আমি শিখতে পারব। বারবার পিড়াপিড়ির কারণে তিনি অন্যান্য মুরীদদের বললেন, একে হাত-পা বেঁধে এই কুঁপে ফেলে দাও। মুরীদরা পীরের আদেশ অনুযায়ী তার হাত-পা বেঁধে কুঁপে ফেলে দিলো। সে কতক্ষণ চিৎকার চেচামেচি করে থেমে গেলো। হাত-পা বাঁধা। সাতারও কাটতে পারে না। কিছুক্ষণ পর সে দেখছে আমি তো এখন ডুবে যাব। মারা যাব। বাঁচার কোন উপায় নেই। সমস্ত গাইরুল্লাহ থেকে নিরাশ হয়ে সে চিৎকার দিয়ে উঠে বললো, আল্লাহ। অর্থাৎ হে আল্লাহ! এখন রক্ষাকারী একমাত্র তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। তখন পীর সাহেব তাড়াতাড়ি তাকে উঠিয়ে এনে বললো, ইসমে আযম তো সেটাই যেটা তুমি বললে। কিন্তু তুমি ওই সময় যে বিশ্বাস নিয়ে বলেছ সে বিশ্বাস নিয়ে বলতে হবে। আর যদি ওই বিশ্বাস নিয়ে না বলো; তবে কাজ হবে না।
৩. আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللَّهَ لَا يَخْفَى عَلَيْهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ অর্থ : আসমান যমীনে এমন কোন বস্তু নেই যা আল্লাহর নিকট গোপনীয়, অস্পষ্ট। অর্থাৎ আসমান যমীনে যেখানে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর নখদর্পণে আছে। সব কিছুকে আল্লাহ দেখছেন। সব কিছুর প্রয়োজন আল্লাহ জানেন। সবকিছুর প্রয়োজন আল্লাহ পূর্ণ করছেন। এবং সব কিছু সম্পর্কে আল্লাহ অবগত আছেন। সর্বপরি জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ। আমাদের ইলম কতদূর? আমদের পিঠে কী আছে আরেক জন না বলে দিলে আমাদের খবর হয় না। নিজের পিঠে ময়লা পড়েছে নিজের খবর নেই; অপরজনেরটা জানা তো দূরের কথা। আল্লাহর সব কিছুর ইলম আছে। তিনি এ জন্যই মা’বূদ যে তিনি সবকিছুর জ্ঞান রাখেন। আল্লাহ ব্যতীত মানুষ আজ গাছের পূজা করে, মাটির পূজা করে, কবরের পূজা করে, সূর্যের পূজা করে, নক্ষত্রসহ যত কিছুর পূজা করে। এর কোনটাই সর্বব্যাপী জ্ঞানের অধিকারী নয়। এতএব তারা মা’বূদ হওয়ার যোগ্য নয়।
৪. هُوَ الَّذِي يُصَوِّرُكُمْ فِي الْأَرْحَامِ كَيْفَ يَشَاءُ অর্থ : তিনি পবিত্র ঐ সত্তা যিনি মাতৃগর্ভে যেভাবে চান তোমাদের গঠনাকৃতি দান করেন। চতুর্থ গুণ হলো কুদরত। আল্লাহ এত বড় কুদরতের অধিকারী এত বড় ক্ষমতাবান। আল্লাহ বলছেন তোমাদের সকলের আকৃতি আল্লাহ গঠন করেছেন। তিনি কোথায় সৃষ্টি করেছেন সেটাও চিন্তা করুন। কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তিন অন্ধকারের ভিতর। মানুষ যদি কোন দামী জিনিষ বানায় তাহলে কারখানায় পাওয়ারফুল বাতি থাকে। আলোর মধ্যে তৈরি করা হয়। যে কারখানায় উড়োজাহাজের পার্টস তৈরি হয় সে কারখানা কি অন্ধকার! হাজার পাওয়ারের লাইট হয়ত সেখানে জ্বলছে। দিনের মত আলোর মধ্যে সেটা তৈরি করা হচ্ছে। আর আল্লাহ মানুষকে নিখুঁতভাবে তৈরি করেছেন। ভ্রুতে কতগুলো চুল দিয়েছেন। মাথায় চুল, জায়গায় জায়গায় পশম। যেখানে যেভাবে দরকার সেভাবে তৈরি করেছেন। এবং সেখানে রঙ প্রয়োগ করছেন। কে সাদা হবে, কে কালো হবে, কে লাল হবে, কে শ্যামলা হবে সব বর্ণ আল্লাহ সেখানে দিয়েছেন। আল্লাহ এমন কারিগর যে তিনি পৃথিবীর সকল মানুষের আকৃতি ভিন্ন ভিন্ন করে সৃষ্টি করেছেন। এমন দুজন মানুষ বের করা যাবে না যাদের ১০০% গঠন এক রকম। দুই যমজও পরিপূর্ণ মিলে না। কিছু চুল পরিমাণ বেশ কম হলেও হয়। কে করলেন এটা? কত বড় ক্ষমতার অধিকারী! এজন্যই তিনি বলেছেন, তিনিই পবিত্র ঐ সত্তা যিনি মাতৃগর্ভে তোমাদের আকৃতি দান করেছেন। তিন অন্ধকারে সে তৈরি হয়েছে। তিন অন্ধকারের মধ্যে তিনি যেমন ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি দান করছেন। এ রকম না যে একই মায়ের গর্ভের হলে একই রকমের হতে হবে। না একজন এক রকম আরেকজন আরেক রকম। লোকেরা বলে এতো বাবার মত হয়েছে। এতো মায়ের মত দেখতে। এতো চাচার মত হয়েছে। আল্লাহ এরকম আকৃতি দিতে থাকেন। এটার নাম কুদরত-ক্ষমতা। এটা একটা ক্ষমতার দৃষ্টান্ত। এর চেয়েও বড় ক্ষমতার দৃষ্টান্ত হলো, আল্লাহ বলছেন, তিনি আসমানকে শূন্যের উপর স্থির করে রেখেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, خَلَقَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا অর্থ : আল্লাহ আসমানকে খুটিহীন স্থির করে রেখেছেন। এই চার গুণে গুণানিত্ব হওয়ার কারণেই তিনি ছাড়া আর কোন মা’বূদ হবে না। আর কারো মধ্যে এই চার গুণ পাওয়া যাবে না। সুতরাং আর কেউ মা’বূদও হতে পারবে না।
তিনি মহা পরাক্রমশালী কুদরতওয়ালা। আমার আপনার মধ্যে শক্তি একটু বেশি হলেই হাঁটতে চলতে দু-চারজনকে লাথি মারি, ধাক্কা মেরে মেরে ফেলে দিই। শক্তি বেশি কি করবে? আল্লাহ হিকমতওয়ালা হওয়ার কারণে আমরা কোটি কোটি অপরাধ করা সত্ত্বেও আমাদেরকে ধরেন না। শ্রমিকরা উল্টা পাল্টা করলেই কারখানার মালিকরা কলার ধরে বলে, বেটা বের হও এখান থেকে। চাকরিচ্যুত করে তখনই। আল্লাহর কত নাফরমানি করছি। আযান হচ্ছে, মসজিদে আসছি না। রমযান মাস চলছে, দিব্যি আরামে খাচ্ছি। হজ্জ ফরয হয়ে গেছে, হজ্জ করি না। যাকাত ফরয হয়, যাকাত দিই না। মিথ্যা কথা বলি। খিয়ানত করি। অনেক লোক আল্লাহর একত্ববাদকেই স্বীকার করে না। খালেক বলেও স্বীকার করে না। কিন্তু আল্লাহ তাকেও খাওয়ান। তিন বেলা খাবার, ঘর-বাড়ী, স্ত্রী-পুত্রসহ তার জন্য আরাম আয়েশের যাবতীয় সামানা দিয়ে রাখছেন। আমি আপনি হলে পারতাম না। ঢিল দিয়ে রেখেছেন। আমার এই বান্দা খাচ্ছে খাক; খেয়ে খেয়ে আমার এদিকে আসে কিনা; আমি দেখি। সর্বশেষ যখন না আসে তো আল্লাহর আযাব শুরু হয়ে গেলে আর শেষ নেই। নিস্তার পাবে না। তো এটার নাম عَزِيزٌ حَكِيمٌ। আল্লাহর একত্ববাদের এই চারটি গুণই হলো দলীল। কেউ যদি মা’বূদ হওয়ার দাবী করতে চায়, তাহলে তাকে বলতে হবে, আমি চিরস্থায়ী চিরঞ্জীব। বলতে হবে আমি সর্ব নিয়ন্ত্রণকারী। বলতে হবে আমি মহা কুদরতওয়ালা, শক্তিশালী। আল্লাহ ছাড়া কেউ এ দাবী করতে পারবে না। এ কারণে তিনিই মা’বূদ। আল্লাহ আমাদেরকে তার ইবাদত করার তাওফীক দান করুন। অন্য কারো ইবাদত না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে খ্রিস্টানদের কিছু পণ্ডিত আসলো। এসে ধর্মীয় আলোচনা শুরু করে দিয়েছে। আলোচনা করতে করতে তারা তাদের ত্রিত্ববাদকে তুলে ধরছে। আল্লাহ, মারয়াম ও ঈসা আ. (নাউযুবিল্লাহ) এ তিন মিলে আল্লাহ। আল্লাহ বলেন তারা কাফের হয়ে গেছে। যারা বলে আল্লাহ তিনের এক। ঈসা আ. সম্পর্কে তারা বলতে লাগলো, ইনি তো আল্লাহর পুত্র (নাউযুবিল্লাহ)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তাদের সামনে এই চারটি দলীলকেই পেশ করলেন। বললেন, ঈসা আ. কে যদি আল্লাহর পুত্র বলো তবে তিনি কি الْحَيُّ الْقَيُّومُ? তারা স্বীকার করল, না। তিনি الْحَيُّ الْقَيُّومُ হলে এখনো জীবিত থাকত। তোমরাই বলো তিনি শূলিবিদ্ধ হয়ে গেছে। তিনি জীবিত নেই। তাহলে তিনি الْحَيُّ কিভাবে হলেন। الْقَيُّومُ মানে হলো যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি জীবিতই না। কি নিয়ন্ত্রণ করবেন? আল্লাহ প্রজ্ঞাময় মহাজ্ঞানী। একথাগুলো যখন তিনি প্রমাণ হিসেবে পেশ করলেন তখন সকলে মেনে নিল আল্লাহ হতে হলে চার গুণবিশিষ্ট হতে হবে। ঈসা আ.-এর মধ্যে এই চার গুণ তো নেই। তারাও মেনে নিল। কিন্তু এখন তারা বলতে লাগলো, আল্লাহ তো কুরআনেই বলেছেন روح الله। আর এর অর্থ (শাব্দিক অর্থে) আল্লাহর আত্মা। অতএব আল্লাহর পুত্র না হলে আল্লাহর আত্মা কিভাবে হয়? এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহ সূরা আলে ইমরানের ৭নং আয়াত নাযিল করেন।
মহান আল্লাহর কালামে পাকের মাঝে কিছু কিছু বাক্য কিছু কিছু শব্দ কিছু কিছু আয়াত এমন আছে যার আভিধানিক অর্থ আমাদের বুঝে আসে কিন্তু এর রূপরেখা কি এর বাস্তব অবস্থা কি তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। আর এটাও আল্লাহ বলছেন-যারা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায় মানুষের মাঝে, সঠিকতা অর্জন করতে চায় না, সঠিক বিষয় অন্বেষণ করতে চায় না তারাই ঐ আয়াতগুলোর দিকে যায়, যার অর্থ ব্যাখ্যা একমাত্র আল্লাহই জানেন। আর যারা বিভ্রান্ত করে না, সঠিকটি অর্জন করতে চায় তারা আল্লাহর ঐ সমস্ত আয়াতের দিকে ধাবিত হয় যার অর্থ ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট। এ আয়াতটি তিনি তাদের ঐ কথার প্রেক্ষিতে নাযিল করেন যে আয়াতের মধ্যে আল্লাহ ইরশাদ ফরমান, هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ অর্থ : তিনি আল্লাহ যিনি হে মুহাম্মাদ! আপনার প্রতি এই কিতাব নাযিল করেছেন। مُحْكَمَاتٌ বলা হয় ঐ সব আয়াতকে যার অর্থ ও ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট। যে কোন ব্যক্তি আরবী ভাষা সম্পর্কে যদি পারদর্শিতা অর্জন করে সে এই আয়াতের অর্থ বুঝতে পারবে। আল্লাহ বলেন সেই আয়াতগুলোই হলো ইসলামী শিক্ষার মূল। আর কিছু আয়াত রয়েছে অস্পষ্ট। কোনটার অর্থই বুঝা যায় না। কোনটার অর্থ বুঝা যায় কিন্তু আমাদের এর রূপরেখা জানা নেই। যেমন الم। এর অর্থ জানা নেই। কিন্তু روح الله -এর শাব্দিক অর্থ বলতে পারব। আল্লাহ বলেন, আল্লাহ ছয় দিনের মধ্যে আসমান-যমীন ও আরশ-কুরসীকে সৃষ্টি করে আরশে সমাসীন হয়েছেন। কিন্তু আল্লাহ কীভাবে উপবিষ্ট হলেন? তার রূপরেখা কি? তার আকার কি? আকৃতি কি? তার ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। এবং এ নিয়ে পর্যালোচনা করার অধিকারও আমাদের নেই। কেন নেই এর উত্তরে আল্লাহ নিজেই বলেন, لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ অর্থ : আল্লাহ কোন মাখলুক সদৃশ নন। তাহলে কিভাবে তার আকৃতি বয়ান করবেন। কোন মাখলুক সদৃশ তিনি নন। ইমাম মালেক রহ.-এর দরবারে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী এক ব্যক্তি এসে বললো, আল্লাহ কুরআনে استوى على العرش বলেছেন এর অর্থ কি? ইমাম মালেক রহ. এ প্রশ্ন শুনে এত আশ্চার্যান্বিত হলেন যে, তিনি ঘর্মাক্ত হয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ মাথা নত করে থাকার পর মাথা উঠিয়ে বললেন استوى على العرش শব্দের অর্থ জানা আছে। কিন্তু এর রূপরেখা আমাদের জানা নেই। এ নিয়ে প্রশ্ন করা বিদআত। এ নিয়ে তর্কবিতর্ক করা হারাম। এর উপর ঈমান আনা ওয়াজিব। এ কথা বলে তিনি বলেছেন, এ লোকটাকে আমার দরবার থেকে বের করে দাও। একে এই প্রশ্ন করার সুযোগ কে দিল? অনুরূপ روح الله، تبارك اسم ربك، ويبقى وجه ربك-ও মুতাশাবিহাতের অন্তর্ভুক্ত। এখন যদি বসে আল্লাহর একটা চেহারার রূপ কল্পনা করেন জায়েয হবে না। وجه শব্দ আল্লাহর জন্য ব্যবহার হয়েছে। বাংলায় যার অর্থ চেহারা। তবে কি রূপরেখা তা আমাদের জানা নেই। আল্লাহ সে কথাই বলছেন। অনেক মানুষ আছে ভালো জিনিষকেও বসে বসে পেঁচায়। সোজা একটা কথাকে না এভাবে না ওভাবে জিলাপির মতো পেঁচাতে থাকে। এত পেঁচানোর কি আছে। মানে এদের অন্তরে বক্রতা আছে। তারা ঐ সমস্ত সুস্পষ্টগুলো ছেড়ে দিয়ে অস্পষ্টগুলোর পিছনে দৌড়ায়। নামায রোযা নেই। কোন রকম অল্প কাপড় লাগিয়ে রেখেছে। কোন রকম মূল জায়গাটা ঢেকে রেখেছে। বড় বড় শিকল দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে রেখেছে। যদি বলেন, কিরে ভাই! আপনার এ অবস্থা কেন? বলে আমারাই তো আসল কালাম পড়েছি। মোল্লা মৌলবীরা তো ঐ আসল কালাম পড়েনি। জিজ্ঞাসা করা হলো, নামায পড় না? বলে নামায কী পড়ব? আল্লাহ তো আমার ভিতরে চলে এসেছে (নাউযুবিল্লাহ)। তারা বলে, পুরা কুরআনের সার হলো সূরা ফাতিহা; সূরা ফাতিহার সার হলো بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ। আর এর সার হলো ب। এই দেখেন ب (নিচের ঠোঁট আর নিম দাড়ি)। এই তো পুরা কুরআন আমার মধ্যে। আল্লাহ আমার মধ্যে ঢুকে আছে। আর আমি নামাজ পড়ব কি করতে? এখন তার সাথে কিছু মুরীদ যোগদান করে। এগুলোও তার সাথে হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ বাবা করে। এই শুরু হয়ে গেল ভণ্ডামী। মানুষের মাঝে বলে বেড়ায় সারা দুনিয়ায় ইবলিস সিজদা করেছে। আমরা কোথায় সিজদা করব? পৃথিবী নাপাক হয়ে রয়েছে। তাকে বলা হবে তুমি পৃথিবী মাড়াও কেন? তুমি পৃথিবীর নিচে চলে যাও। এগুলো হলো مُتَشَابِهَاتٌ, যেগুলোর ব্যাখ্যা একমাত্র আল্লাহ জানেন। আর তারা এর পিছনে দৌড়ায় মানুষের মাঝে ফেতনা ছড়ানোর জন্য। এবং তার ভ্রান্ত ব্যাখ্যা তালাশ করার জন্য। অথচ আল্লাহ বলেছেন, এর ব্যাখ্যা একমাত্র আল্লাহ জানেন এবং যারা ইলমে পারদর্শী। ইলমে পারদর্শী বলে কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহকে বুঝানো হয়েছে। যারা ইসলামকে কুরআন থেকে, সুন্নাত থেকে এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে হাসিল করে। শুধু কিতাব থেকে নয়। কুরআন কিছুক্ষণ চর্চা করলাম। বাংলা বাজার থেকে একটা বাংলা বুখারী শরীফ বগল দাবা করে নিয়ে আসলাম। একা একা বসে বুখারী শরীফ চর্চা করছি আর দীন শিখছি। এতে দীন শেখা হবে না। দীনকে জানার জন্য দুই জিনিষ জরুরী। ১. কিতাবুল্লাহ ২. রিজালুল্লাহ। আল্লাহর মহাগ্রন্থকে ব্যাখ্যাদানকারী সাহাবায়ে কেরামের জামাআত জরুরী। নতুবা আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কেন প্রেরণ করলেন? কেন তাঁর সঙ্গে সোয়া লক্ষ সাহাবায়ে কোরামের জামাআতকে দিলেন? কেন তাঁদের সঙ্গে তাবিয়ীনদের জামাআতকে দিলেন। কেন তাঁদের সঙ্গে তাবে তাবেয়ীনদের জামাআতকে দিলেন? কেন প্রত্যেক যুগে উলামায়ে কেরামকে দিলেন? আমার পক্ষে আপনার পক্ষে একা একা দীন অর্জন করা সম্ভব না। উস্তাদ ছাড়া বুখারী শরীফ পড়ে। নিজে আরবী পড়তে জানে না, অনুবাদক লিখে দিয়েছে ব্যাস ওটাই পড়ে; এর বেশি পারে না। বলে যে, আমি দীন শিখছি। উলামায়ে কেরাম এগুলো কিছুই জানেনা। যারা বুখারী শরীফকে সরাসরি পড়তে পারে এবং সরাসরি অর্থ বোঝে তারা দীন জানতে পারেননি। আবার সে সমস্ত বিভ্রান্তিকর পুস্তক মসজিদের মধ্যে রেখে প্রচার করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি আমার উম্মতের ব্যাপারে তিন জিনিষের আশঙ্কা বোধ করি।
১. ধন সম্পদের আধিক্য, যে কারণে পরস্পর হিংসা হবে। মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি হবে।
২. প্রত্যেক ব্যক্তি কুরআন খুলে বসে। মনে করে, আমিও কুরআন পাকের একজন বড় চর্চাকারী এবং কুরআন পাকের পারদর্শী। অথচ সে শুধুমাত্র অনুবাদ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারে না। অনুবাদ ছাড়া তার আর কোন জ্ঞান নেই। সে বলে যে, আমিও কুরআনে পারদর্শী। নবী বলেন যে, আমি তাদের ব্যাপারে আশঙ্কা বোধ করি।
৩. ঐ ব্যক্তি যে ইলম অর্জন করার পর ইল্মকে বরবাদ করে দিবে। ইলম চর্চা করার পর ইলমকে বরবাদ করে দিবে। এই তিন প্রকার উম্মতের ব্যাপারে আমি আশংকা বোধ করি।
এজন্য মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, যারা ইলমে পারদর্শী তারা বলেন যে, আমরা আল্লাহ তা‘আলার এই বাণীগুলোর প্রতি ঈমান রাখি যে সবগুলি আমাদের রবের পক্ষ থেকে এসেছে। যদিও এর অর্থ, মর্ম আমরা বুঝি না। জানি না। আল্লাহ বলেন, জ্ঞানী ব্যক্তিরাই উপদেশ গ্রহণ করে থাকে। অর্থাৎ জ্ঞানী ব্যক্তিরা লাফালাফি করে না। যাদের জ্ঞান আছে তারা লাফালাফি করে না। তারা খুব গাম্ভীর্য নিয়ে থাকে। যাদের অল্প বিদ্যা তারাই দৌড়ায়, লাফালাফি করে। আয়াতের مُتَشَابِهَاتٌ নিয়ে খুব দৌড়ায়। যারা ইলমে পারদর্শী; যারা জ্ঞানী, তারা নসীহত অর্জন করে যে, হ্যাঁ এটাও আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেছেন। আমাদের এগুলোর প্রতি ঈমান রাখতে হবে। ব্যাস এটুকুই শেষ যে, আল্লাহ নাযিল করেছেন। এ কথার প্রতি ঈমান রাখতে হবে। মর্ম-ব্যাখ্যা আল্লাহ তা‘আলার উপর ছেড়ে দিতে হবে। তো আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে জানালেন যে, আল্লাহ তা‘আলা যাকে হিদায়াত দিতে চান সেই ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা مُحْكَمَاتٌ তথা ঐ সমস্ত আয়াত যেগুলোর অর্থ ব্যাখ্যা জানা আছে সেগুলো তাদেরকে শিখার এবং অনুসরণ করার তৌফিক দান করেন। এ জন্য পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দু‘আ শিখেয়েছেন। আমরা যেন ঐ সমস্ত লোকদের মত না হই যারা অস্পষ্ট আয়াত নিয়ে দৌড়ায়, সেগুলোর পিছনে পড়ে থাকে এবং সেগুলোর মর্ম-ব্যাখ্যা নিয়ে দৌড়ায়। যারা এগুলো নিয়ে দৌড়াবে তাদের অন্তরের মধ্যে বক্রতা আছে। তাই আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ চাইতে হবে যা পরবর্তী আয়াতে বিবৃত হয়েছে رَبَّنَا لا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا অর্থ : আমাদেরকে হেদায়েত দেয়ার পর আমাদের অন্তরগুলোকে আপনি বক্র করে দিয়েন না। হিদায়াত দিয়েছেন; হিদায়াতের উপর অটল রাখুন। وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً এবং আপনার পক্ষ থেকে খাস রহমত আমাদের প্রতি বর্ষণ করুন। إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ নিশ্চয় আপনি মহান দাতা। অনেক বড় দাতা। যে ব্যক্তি এ আয়াত নিয়মিতভাবে নামযের পরে মোনাজাতে পড়বে এবং দু‘আ করবে আল্লাহ তা‘আলা ঐ ব্যক্তিকে মৃত্যু পর্যন্ত হেদায়াতের উপর রাখবেন ইনশা আল্লাহ। এবং তার মৃত্যু ঈমানের উপর হবে ইনশাআল্লাহ। উলামায়ে কেরাম বলেছেন একথা। এজন্য প্রত্যেক মুসলমানের মুখস্থ হওয়া উচিত।
মানুষের অন্তর আল্লাহর দু-আঙ্গুলের মধ্যখানে। হাদীসে এসেছে, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ঘুরিয়ে দেন। এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘনঘন এ দু‘আ করতেন يا مقلب القلوب ثبت قلبي على دينك অর্থ : হে অন্তর পরিবর্তনকারী আল্লাহ! আপনি আমাদের দিলকে দিনের উপর অটল রাখুন। দীনের উপর দৃঢ় রাখুন। হযরত উম্মে সালামা রাযি. একবার জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এই দু‘আ কেন পড়েন আপনি? আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে হিদায়েত দিয়েছেন; আবার কি আমরা হিদায়েত ছেড়ে দিব? তিনি বললেন, বল কি তুমি? আল্লাহ তা‘আলার দুই আঙ্গুলের মধ্যখানে অন্তর। তিনি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ঘুরিয়ে দিতে পারেন। আমরা এই যুগে দেখি বড় দাড়ি মাশাআল্লাহ। আলখেল্লা লাগানো। পাগড়ি পরিহিত। আবার সব ছেড়ে দিয়ে ইহুদি-খ্রিস্টানদের চাইতে অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এমন হয় কিনা বলেন, হিদায়াত ছেড়ে দিয়েছে এজন্য আল্লাহ তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। এই জন্য দু‘আ করতে থাকতে হবে। পরবর্তী আয়াতে আরেকটি দু‘আ আছে। এটার সাথে সেটার সম্পর্ক হলো যখন আমরা আল্লাহর কাছে হিদায়াতের দু‘আ করছি তখন কেউ মনে করতে পারে, ও! তুমি দুনিয়ার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আল্লাহর কাছে বক্রতামুক্ত জীবন চাইছো; আসলে না। আমরা দুনিয়ার জন্য নয়; আখেরাতের জন্য চাইছি। সেটা পরের আয়াতে আসছে। رَبَّنَا إِنَّكَ جَامِعُ النَّاسِ لِيَوْمٍ لَا رَيْبَ فِيهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُخْلِفُ الْمِيعَادَ। আমরা আল্লাহর কাছে যে হিদায়াত চাইছি বক্রতামুক্ত অন্তর চাইছি সেটা এজন্য না যে, দুনিয়াতে আমরা সুখে থাকব। বরং এ জন্য চাইছি যে, আমরা আখেরাতে বিশ্বাসী। কেননা আপনি সমস্ত মানুষকে একদিন একত্রিত করবেন। যেই দিনটার ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ নেই। رَبَّنَا إِنَّكَ جَامِعُ النَّاسِ লোকেদেরকে একত্রিত করবেন এমন একদিন যে দিনের ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ নেই। কেউ যদি সন্দেহ করে যে কিয়ামত কখন আসবে? সে মরে দেখুক। কিয়ামত যে সংঘটিত হবে এতে আমরা কেন বিশ্বাসী? যেহেতু আল্লাহ ওয়াদা করেছেন إِنَّ السَّاعَةَ لَآتِيَةٌ لَا رَيْبَ فِيهَا কুরআনের দু-তিন জায়গায় একথা এসেছে। নিশ্চয় কিয়ামত আসবেই আসবে। এতে কোন সন্দেহ নেই। এ জন্য আমরা বিশ্বাসী। আর আল্লাহ তা‘আলা ওয়াদা করেছেন এ ব্যাপারে আল্লাহ ওয়াদা ভঙ্গ করবেন না। দু’টোকে মিলিয়ে বলতে হবে; আগেরটার সাথে এটি মিলিয়ে নিলে ভালো رَبَّنَا إِنَّكَ جَامِعُ النَّاسِ لِيَوْمٍ لَا رَيْبَ فِيهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُخْلِفُ الْمِيعَادَ। আমরা অনেকে জানি- এটা আযানের দু‘আর মধ্যে আছে। ওখানে إِنَّكَ لَا تُخْلِفُ الْمِيعَادَ আছে। আর এখানেلا يُخْلِفُ আছে। এই দু’টি আয়াতকে আমরা দু‘আ বানিয়ে যখনই হাত তুলি তখন رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ যেমন পড়ব তেমনি رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ আমরা অবশ্যয়ই পড়ব। তাহলে অবশ্যয়ই ইনশা আল্লাহ মৃত্যু পর্যন্ত হিদায়াতের উপর থাকা যাবে। এবং মৃত্যু ঈমানের উপর হবে। আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের কামনা বাসনা অর্জন করার তৌফিক দান করুন। আমীন।