মুফতী হাফিজুর রহমান
যাইদ বিন খালিদ জুহানী রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদা প্রতিজ্ঞা করলাম, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রাতের নামায আদায় করা দেখবো। তো দেখলাম, তিনি সংক্ষিপ্ত দু রাক‘আত নামায আদায় করলেন। এরপর বেশ দীর্ঘ দু রাক‘আত নামায আদায় করলেন। এরপর আবার দু রাক‘আত নামায আদায় করলেন। এ দু রাক‘আত পূর্বের দু রাক‘আত থেকে কম দীর্ঘ ছিল। এরপর আবার দু রাক‘আত নামায আদায় করলেন। এ দু রাক‘আত পূর্বের দু রাক‘আত থেকে কম দীর্ঘ ছিল। এরপর আবার দু রাক‘আত নামায আদায় করলেন। এ দু রাক‘আত পূর্বের দু রাক‘আত থেকে কম দীর্ঘ ছিল। এরপর আবার দু রাক‘আত নামায আদায় করলেন। এ দু রাক‘আত পূর্বের দু রাক‘আত থেকে কম দীর্ঘ ছিল। এরপর (এক রাক‘আত) বিতর পড়লেন। এ ছিল মোট ১৩ রাক‘আত। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৮৪০
আবূ মালিক কামাল ইবনে সাইয়িদ সালিম বলেন, হাদীসে বর্ণিত রাকাআত সংখ্যার চেয়ে বেশি পড়া জায়েয কি না ? এটা এমন একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যাকে কেন্দ্র করে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থী এবং সুন্নাহর ব্যাপারে আগ্রহী ভাইদের মাঝে বিবাদ বিসংবাদ ফুসে উঠছে। তারা সমসাময়িক এক বিজ্ঞ ইমামের তাকলীদ করে বলেন, এগার রাক‘আতের বেশি পড়া জায়েয নেই!! সম্ভবত সে এ ক্ষেত্রে একটি পুণ্যের অধিকারী হবে। পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী বিপুল সংখ্যক উলামায়ে কেরামের অভিমত হলো, নির্দিষ্ট সংখ্যক রাক‘আতের অতিরিক্ত আদায় করা জায়েয আছে। একারণেই কাযী ইয়াজ রহ. বলেন, রাতের নামাযের ব্যাপারে এমন কোনো রাক‘আত সংখ্যা নির্ধারিত নেই যে এর কম বেশ করা যাবে না। এব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। রাতের নামায একটি ইবাদত। এর পরিমাণ যত বৃদ্ধি পাবে পুণ্যও ততো বৃদ্ধি পাবে। ইবনে আব্দুল র্বার রহ. আততামহীদ গ্রন্থে বলেন, এ ব্যাপারে মুসলিমদের মাঝে কোনো মতভিন্নতা নেই যে, রাতের নামাযে কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। এটা নফল নামায, ভাল কাজ এবং পুণ্যের কাজ। যে ইচ্ছে কম পড়বে যে ইচ্ছে বেশি পড়বে।
আমি বলি, এ অভিমতের শুদ্ধতার ব্যাপারে নিম্নের বর্ণনাগুলো প্রকৃষ্ট প্রমাণ বহন করে।
১. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রাতের নামায দু রাক‘আত দু রাক‘আত করে। যখন সুবহে সাদিক উদিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করবে তখন এক রাক‘আত সংযোজন করার মাধ্যমে বিতর পড়ে নিবে। সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৭৩
২. রবীআহ ইবনে কা’ব আসলামী রা. একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, আপনার সাথে জান্নাতে থাকতে চাই। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, অধিক সেজদার মাধ্যমে তোমার নিজের জন্য আমাকে সহায়তা করো। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১২২
৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তুমি যখন আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশে সিজদা করবে আল্লাহ তা‘আলা এর মাধ্যমে অবশ্যই তোমার একটি পদমর্যাদা সমুন্নত করবেন এবং তোমার একটি পাপ মার্জনা করে দিবেন।
৪. উপরোক্ত প্রমাণাদির আলোকে প্রমাণিত হয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জন্য যে সংখ্যা চয়ন করেছেন তা সীমাবদ্ধ এবং সংকীর্ণ নয়। কারণ,
(ক) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কর্মপন্থা তাঁর উক্তিকে সীমাবদ্ধ করে দেয় না।
(খ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগার রাক‘আতের বেশি পড়তে নিষেধ করেননি। বরং তিনি আমাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট অধিকতর প্রিয় নামাযকে নির্ধারিত করেছেন। আর তা হলো রাতের তৃতীয়াংশে দাউদ আলাইহিস সালাম এর নামায। এজন্যই শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, (২২/২৭২-২৭৩) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমাযানের রাতের নামাযের ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো রাক‘আত সংখ্যা উল্লেখ করে যাননি। …আর যে ব্যক্তি ধারণা করে, রমাযানে রাতের নামাযে নির্দিষ্ট সংখ্যা আছে এর কম বেশ করা যাবে না সে ভুল করেছে।
(গ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের নামাযের এ নির্দিষ্ট সংখ্যার ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করেননি। যদি মেনে নেয়া হয়, তিনি এ ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করেছেন (এমন কথা কেউ বলেন নি।) তাহলেও এ ব্যাপারটি পূর্বোক্ত ব্যাপকভিত্তিক প্রমাণাদিকে সংকীর্ণ করার উপযোগী নয়। স্বতঃসিদ্ধ মূলনীতি হলো ব্যাপক ভিত্তিক কোনো বিষয়কে তার কোনো একটি শাখাগত বিষয়ের কারণে সংকীর্ণ করা যায় না। তবে বিরোধপূর্ণ হলে ভিন্ন কথা।
লেখক আরো বলেন, আমরা পিছনে আলোচনা করে এসেছি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমাযান এবং রমাযানের বাহিরে নিজ ঘরে রাতের নামায এগারো অথবা তের রাক‘আতের বেশি পড়তেন না। তবে যে রাতগুলোতে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে তারাবীহ নামায পড়েছেন সে রাতের নামাযের রাক‘আত সংখ্যা উল্লেখ নেই। এবং এ রাতগুলোর রাক‘আত সংখ্যা নির্ধারণের ব্যাপারে কোনো সহীহ হাদীস নেই। এ কারণেই এ রাতের নামাযের রাক‘আত সংখ্যা নিয়ে মতভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে।
এরপর লেখক মহোদয় তারাবীহ এর রাক‘আত সংখ্যার ব্যাপারে চারটি মত (আট, বিশ, ছত্রিশ, চল্লিশ) উল্লেখ করে বলেন, আমি বলি, এ ব্যাপারে ইবনে তাইমিয়া রহ. (২২/২৭২-২৭৩) যে অভিমত পেশ করেছেন তাই শিরোধার্য যে, …তারাবীহ এর রাক‘আত সংখ্যার ব্যাপারে সবগুলো মতই যথাযথ। রমাযান মাসে উল্লেখিত পদ্ধতির যে কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে সেটাই উত্তম হবে। মুসল্লীদের অবস্থা ভেদে শ্রেষ্ঠত্ব বিবেচিত হবে। যদি মুসল্লীরা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম হয় তাহলে তিন রাক‘আত বিতরসহ তের রাক‘আত পড়া উত্তম হবে। যেমনটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে রমাযান এবং রমাযানের বাইরে পড়তেন। আর যদি তারা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম না হয় তাহলে বিশ রাক‘আত তারাবীহ পড়াই উত্তম। অধিকাংশ মুসলিমরা এর উপরই আমল করছে। কারণ এটা দশ এবং চল্লিশের মধ্যবর্তী পদ্ধতি। আর যদি কেউ চল্লিশ রাক‘আত বা কম বেশি পড়ে তাও জায়েজ আছে। এগুলোর কোনোটিই অপছন্দনীয় হবে না। একাধিক ইমাম এ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে অভিমত পেশ করেছেন। যেমন ইমাম আহমদ রহ. প্রমুখ। আর যে ব্যক্তি ধারণা করে, রমাযানে রাতের নামাযে নির্দিষ্ট সংখ্যা আছে এর কম বেশ করা যাবে না সে ভুল করেছে। আমি বলি, ফিকহী অনুধাবন এমন হওয়াই যুক্তযুক্ত। যৌক্তিক এ ফিকহী বোধ থেকে আমাদের কতক ভাইয়েরা কতটা যোজন দূরে চলে গেছে যারা হারাম শরীফের তারাবীহ এর জামাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং দশ রাক‘আত পড়েই উঠে চলে যায় !! আল্লাহ আমাদের এবং তাদের মার্জনা করুন। সহীহু ফিকহিস সুন্নাহ ১/৪১৮-৪১৯