সৈয়দ কামারুজ্জামান নাজির
পৃথিবীর আকাশে তখন অন্ধকারের কালো মেঘ। হেদায়তের প্রদীপ নিষ্প্রভ। চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে অজ্ঞতা। জুলুম আর শোষণে অশান্ত হয়ে ওঠছে পুরো পৃথিবী। ন্যায়, নীতি ও নিষ্ঠতা হয়ে আছে মাটিচাপা। কোথাও শান্তির পরিবেশ নেই। এমন প্রতিকূল পরিবেশে মক্কার বুকে আবির্ভূত হলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মহান আল্লাহর বার্তা ও শান্তির পয়গাম নিয়ে। হেদায়তের প্রদীপ জ্বালিয়ে হাজির হলেন মক্কার দুয়ারে দুয়ারে। সাফা পাহাড়ে সমবেত করলেন আপন গোত্রকে। তাওহিদের পথে আহ্বান করবেন সবাইকে। ধারণা ছিল সবাই তাঁর ডাকে সাড়া দিবে। অন্ধকার জগৎ ছেড়ে আলোর পথে আসবে। যেহেতু তারা সেই ছোট্টবেলা থেকে সত্যবাদী তথা আল-আমিন হিসেবে তাঁকে বিশ্বাস করে। কিন্তু না! আজ তারা বিশ্বাস করেনি তাঁকে। গ্রহণ করেনি তাঁর দাওয়াতী পয়গামকে। উল্টো ঠাট্টাবিদ্রƒপ করতে লাগলো। আবু লাহাব অভিশপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠলো, মুহাম্মাদ! ধিক তোমাকে! এজন্যই কী আমাদেরকে সমবেত করেছো। ব্যথিত হৃদয় নিয়ে সাফা থেকে ফিরলেন উম্মাহর দরদী নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তবুও নিরাশ নন তিনি। না, তিনি নিরাশ হতে পারেন না। নিরাশার জন্য তিনি প্রেরিত হননি। তিনি উম্মাহর আশার আলো। মুক্তির অগ্রদূত। তাই বিরামহীনভাবে চালিয়ে গেলেন দাওয়াতি কাজ। মক্কায় হচ্ছে না; গেলেন তায়েফবাসীর কাছে। কিন্তু! হায় তায়েফ! কী ঔদ্ধত্য তাদের প্রিয় নবীর ওপর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহ্বান করলেন মুক্তি ও শান্তির পথে। তারা মুখ ফেরালো উল্টো দিকে। তাও শেষ নয়! সমাজের মূর্খ ও অপদার্থগুলোকে লেলিয়ে দিলো তাঁর পিছনে। মূর্খরা তাঁকে পাথর ছুড়ে ছুড়ে রক্তাক্ত করে ফেললো। আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলো তাঁর পবিত্র দেহখানি। এতো কিছুর পরও তিনি তাদের প্রতি কিন্তু সামান্যও রাগান্বিত হননি। কোন কটু কথাও বলেননি। আর ধ্বংস কামনা তো বহুত দূর কী বাত! অথচ আসমান থেকে তায়েফকে সমূলে ধ্বংস করে দেওয়ার সুযোগ ছিলো তাঁর। কিন্তু না! বরঞ্চ তাদের দরদে তিনি চরম ব্যথিত। তাদের কল্যাণ কামনায় ব্যাকুল তাঁর হৃদয়। আহ! কী চমৎকার ব্যাকুলতা! কী পরম উদারতা তাঁর! সত্যিই তিনি রাহমাতুল্লিল আলামিন!
রাসুলের জীবনের বাঁকে বাঁকে আছে উম্মাহর জন্য পরম শিক্ষা
মক্কার জুলুম নির্যাতনে অতিষ্ঠ প্রায়। কাফেরদের নিপীড়নে তটস্থ সাহাবাগণ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বড়োই চিন্তিত জাতিকে নিয়ে। প্রত্যাদেশ এলো এবার মদিনায় হিজরতের। মদিনায় হিজরতের দ্বারা শুরু হলো ইসলামের আরেক ইতিহাস। সূচিত হলো রাসুলের বৈচিত্র্যময় জীবনের কীর্তিমান এক অধ্যায়।
মক্কার জীবন ছিলো দাওয়াত ও তাবলিগ কেন্দ্রিক। তাইতো শত জুলুম অবিচারের পরও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের প্রতি দয়া ও উদারতা দেখিয়েছেন। কিন্তু মাদানী জীবন ছিলো কিছুটা ভিন্ন। সেখানের সাথে যুক্ত হয়েছে স্বাধীন একটি ইসলামী রাষ্ট্র। পৃথিবীর ইতিহাসে যা ছিল এক অনন্য রাষ্ট্রব্যবস্থা। সে রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিখুঁত পরিচালনায় মদিনা হয়ে ওঠে শান্তি ও নিরাপত্তার কেন্দ্রবিন্দু। মানুষের যাপিত জীবন আনন্দময় হয়। প্রত্যেকইে যার যার অধিকার পায়। বিচারকার্য সবই চলে সুষ্ঠুভাবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদালতে কারো প্রতি অন্যায় অবিচার করা হয়নি। সবার ওপর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। অপরাধীকে অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে হয়। হোক সে নেতৃস্থানীয় বা সম্ভ্রান্ত কেউ। কারো সুপারিশ চলে না। যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ কুরাইশদের একটি ঘটনায় বুঝে আসে।
মাখযুমী গোত্রের এক মহিলা চুরি করে ধরা পড়লো। রাসূলের আদালতে এখন তার বিচারকার্য। ইসলামিক আইনে চুরির বিধান হাত কাটা স্বীকৃত। কুরাইশরা পড়লো এবার মহাবিপদে। এটা তাদের মান-সম্মানের প্রশ্ন। এদিক-ওদিক ছুটাছুটি শুরু হলো। অবশেষে হিব্বুর রাসূল উসামাকে সুপারিশ করার জন্য পাঠাতে সক্ষম হলো তারা। উসামা তাদের কথায় সরলমনে সুপারিশ করে বসলেন। হে রাসুল! মাখযুমি মহিলার বিচার একটু…! উসামার আবদার শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেলো। ধমকি দিয়ে বললেন, উসামা! তুমি কী আল্লাহ প্রদত্ত আইনে সুপারিশ করছো? শুনে রাখো, মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতিমাও যদি চুরি করে তারও হাত কাটা হবে। উসামা অনুতপ্ত ও শঙ্কিত। সাথে সাথে রাসূলের কাছে ক্ষমা চাইলেন। তিনি তাকে ক্ষমা করে দিলেন।
পাঠক! এই ঘটনার মূল শিক্ষা এটাই, আল্লাহর বিধানে কোন পরিবর্তন নেই। তাঁর বিধান সর্বদা সবার জন্য প্রযোজ্য। বংশ ও গোত্র ভেদে কোন তারতম্য নেই। ধনী-গরিব, দুর্বল ও সবলে নেই কোন বৈষম্য। কিন্তু বর্তমান শাসকদের কাছে তা অকল্পনীয়। একদিকে তো তারা আল্লাহর বিধান ও রাসূলের আদর্শকে সেকেলে ভাবে, অপরদিকে তাদের তথাকথিত শাসনে ন্যায়-নীতি ও নিষ্ঠতা নেই।
অপর আরেক ঘটনায় স্পষ্ট ফুটে ওঠে মুহাম্মাদে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুপম চরিত্র। তিনি বিশ্বনবী ও বিশ্বনেতা। বদর যুদ্ধের দিন সাহাবায়ে কেরামকে সারিবদ্ধ করে জিহাদের জন্য প্রস্তুত করছেন। সেখানে সাওয়াদ ইবনে গাযিয়্যাহ নামক এক সাহাবী সেই সারি থেকে কিছুটা সামনে অগ্রসরমান ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাতে থাকা তীর দ্বারা সাওয়াদের পেটে আলতো একটা আঘাত করে বললেন, হে সাওয়াদ! সোজা হও। এতে সেই সাহাবী বলে ওঠেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমাকে আঘাত করেছেন; অথচ আল্লাহ আপনাকে ন্যায়নীতি ও ইনসাফের সাথে প্রেরণ করেছেন। আমি প্রতিশোধ চাই! রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে সাথে পেট মোবারক খুলে দিয়ে বললেন, তোমার প্রতিশোধ নাও। উপস্থিত সাহাবাগণ নির্বাক। বিস্ময়াভিভূত হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছেন। রাগে-ক্রোধে ফেটে যেন চৌচির। কিন্তু, সেই সাহাবীর উদ্দেশ্য ছিলো ভিন্ন। হৃদয়ে ছিলো পবিত্র এক স্বপ্ন ও তামান্না। আজ তা বাস্তবায়নের মোক্ষম সুযোগ। অতএব, সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না।
ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছেন রাসুলের দিকে। প্রতিশোধ নিবেন। কাছে গিয়ে উপস্থিত সবাইকে চমকিয়ে দিলেন তিনি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জড়িয়ে পবিত্র পেটে চুম্বন করতে লাগলেন। কোন প্রতিশোধও নিলেন না। কীভাবেই বা নিবেন! তিনি যে, উম্মাহর দরদি নবী ও বিশ্বনেতা।
কিন্তু আফসোস! আজকের পৃথিবী ও তার শাসকদের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ক্ষমতা যার শাসন তার। ক্ষমতার বলয়ে আইনের চাকা ঘুরে। টাকা ও শক্তির জোরে বিশ্ব চলে। নিজ দল ও বলয়ের স্বার্থেই হয় সবকিছু। কার্যত গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা থাকলেও বাস্তবে তার দেখা মিলে না। কিন্তু প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শাসন ক্ষমতা ছিলো অনন্য ও অতুলনীয়। তার মধ্যে আছে উম্মাহর মুক্তি ও শান্তি। অমুসলিমরাও তা স্বীকার করতে বাধ্য। যদিও আমলে নেয় না তারা।
শ্রী জওহরলাল নেহেরু বলেন, হযরত মুহাম্মদের প্রচারিত ধর্ম, এর সততা, সরলতা, ন্যায়নিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সমতা ও ন্যায়নীতি পার্শ্ববর্তী রাজ্যের লোকদের অনুপ্রাণিত করে। কারণ এ সমস্ত রাজ্যের জনসাধারণ দীর্ঘদিন যাবত একদিকে শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক নিপীড়িত, শোষিত ও নির্যাতিত হচ্ছিল; অপরদিকে ধর্মীয় ব্যাপারে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হচ্ছিল পোপদের হাতে। তাদের কাছে এ ইসলাম ও মুহাম্মদের নীতি নতুন ব্যবস্থা মুক্তির দিশারী। -চেপে রাখা ইতিহাস; পৃষ্ঠা ১৯।
স্যার উইলিয়ম মূর বলেন, সম্রাট হিরাক্লিয়াসের অধীন সিরিয়াবাসী খ্রিস্টানগণ যেভাবে বাস করেছিলেন আরব মুসলমানদের অধীনে তাঁর অপেক্ষা অধিক পরিমাণ রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা ভোগ করেছিলেন। -প্রাগুক্ত; পৃষ্ঠা ১৮।
বস্তুত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাচার ও রাষ্ট্রনীতি অনিন্দ্য সুন্দর ও চমৎকার। এ থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া দরকার। জীবনের প্রতিটি পদে তাঁর আদর্শকে গ্রহণ করা উচিত। যেহেতু উম্মাহর মুক্তি ও শান্তি তাঁর অনুসরণে ও অনুকরণে। পশ্চিমা ও ফিরিঙ্গিদের মতাদর্শে নয়। তিনি আমাদের উসওয়াহ বা আইডল। এটা আমাদের বুঝতে হবে। দৃঢ় বিশ্বাসও থাকতে হবে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারী হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমিন।
তথ্যসূত্র: সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, সীরাতে ইবনে হিশাম, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইফতা (১ম বর্ষ) মা’হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়া, ঢাকা।