মুফতি হাফিজুর রহমান
সুস্বাগতম চট্টগ্রাম!
আমরা ফেনী লেমুয়া ছাগল নাইয়া পেরিয়ে চট্টগ্রামের সীমানায় ঢুকে পড়েছি। চট্টগ্রাম এ মাটি মানুষের প্রাণ। সাগরের দেশ পাহাড়ের দেশ এ চট্টগ্রাম। অপরূপ প্রকৃতির আল্পনায় আঁকা আমাদের চট্টগ্রাম। নীল সবুজের বিপুল আয়োজন এর প্রতিটি অঙ্গে। উচ্চারণ হলেই গাটা ঝরঝরে হয়ে উঠে বিপুল সম্ভাবনায়। হৃদয়টা ফুরফুরে হয়ে উঠে বিষম আবেগে।
খ্রীষ্ট বর্ষের নবম শতকে আরাকানের রাজা চট্টগ্রাম এলাকাটি নিজের হাতে নিয়ে নেয়। এতে অনেক রক্তপাত হয়। অনেক প্রাণের সমাধি হয়। রাজা যুদ্ধজয় শেষে পাহাড়ের চূড়ায় একটি লিখনি ঝুলিয়ে দেয়। ওতে লেখা ছিল Tista- ta-gung। অর্থ যুদ্ধ করা অনুচিত। ওখান থেকেই চট্টগ্রাম নামের ধারা শুরু হয়।
গাড়ির চাকা ঘুরছে। সাথে যেন গাড়িও ঘুরছে। আমরাও ঘুরছি লাটিমের মতন। চোখের তারায় ভেসে উঠছে মিরসরাইয়ের সারি সারি পাহাড়। আমোদে ভ্রমণ যেন শুরু হল। দূর থেকে চোখে পড়ে পাহাড় চূড়ার সেনা ছাউনি। ছাউনিগুলোকে ছোট ছোট টঙ্গের মত মনে হচ্ছে।
বেলা ১১.৪৯ মিনিট। তবু পাহাড় চূড়ায় কুয়াশার ছায়া। যেন দূর আকাশে মেঘ জমেছে। দুধরাঙ্গা পাহাড়ি পথগুলোকে মনে হচ্ছে প্রলম্বিত সাপ কিলবিল করে উপরে উঠে যাচ্ছে। ‘ঘাগড়া সেনা নিবাস’ লেখাটা কোন এক ফাঁক ফোকরে চোখের পলকে আটকে যায়। এখানে এক দুজন ডোরা কাটা মানুষ ছাড়া আর তেমন কিছু দেখতে পাই নি।
দিগন্তজোড়া ফসলী খেতে দেখছি কিষাণের মুখে সবুজের হাসি। গামছা মাথার কিষাণের সাথে অবলা নারীরাও কাস্তে হাতে মাথ ঝুঁকে আছে। এরা কেন থালা বাটি গোছাবে? রান্না ঘরের কোনায় বসে মাটির চুলোয় আগুন ফুঁকবে। পুরুষের মত এদেরও চোখ কান নাক হাত পা আছে। ওরা যেখানে যাবে আমরাও যাবো। ওরা যা পরবে আমরা তাই পরব। সবখানে ওদের পাশে থাকব। ওদের মত চলব। হ্যা তাই যেন হয়। একচুলও যেন এদিক ওদিক না হয়। ওরা দু মনে ধানের আঁটি মাথায় তুলে নেয়। তুমিও নাও। ওরা লুঙ্গি পরে। তুমিও পর। ওরা উদাম গায়ে হেঁটে বেড়ায়। তুমিও তাই কর। ওরা চুল ছেটে ছোট করে। তুমিও কর। ওরা প্যান্ট পরে। তুমিও পর। ওরা দাঁড়িয়ে ইয়ে করে। তুমিও করো। ওরা বাচ্চা দেয় না। তুমি দিয়ো না। এসবে আগে একাকার হয়ে নাও। পরে কাস্তে হাতে ওদের পাশে দাঁড়াও। কলম হাতে ওদের পাশে বসো। সমান যখন হবেই তো সবটাতেই হও। এ ক্ষেত্রে সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্ভাচেভ এর একটি অভিব্যক্তি তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। তিনি বলেন, ‘… কিন্তু আমরা আমাদের কঠিন বাস্তবতা বিধৌত দুঃসাহসিক ইতিহাসের অতীত বছরগুলোতে নারীদের সেসব অধিকার ও প্রয়োজনের প্রতি মনোযোগ আরোপ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি যা মা ও গৃহিণী হিসেবে, তেমনিভাবে সন্তানদের আচার আচরণ ও শিষ্টাচার সভ্যতা শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে নারীদের করণীয় ছিল। এ সুফল থেকে সমাজ চরমভাবে বঞ্চিত হয়েছে। নারীরা যেহেতু বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আত্মনিয়োগ করছে, ভবন নির্মাণের তদারকি করছে, বিভিন্ন উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে, উপন্তু অন্যান্য শ্রমনির্ভর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে তাই তারা এতটুকু সময়ও বের করতে পারছে না, যার দ্বারা পারিবারিক দৈনন্দিন কাজ সামলাবে। সন্তান পালন ও পারিবারিক উন্নত পরিবেশ সৃষ্টিতে অবদান রাখবে। এখন আমাদের নিকট এ তত্ত্ব বড় পরিষ্কারভাবে উন্মোচিত হয়েছে যে, আমাদের বহু সমস্যা রয়েছে যা শিশু ও তরুণদের জীবনপদ্ধতি কেন্দ্রিক, নীতি নৈতিকতা, সভ্যতা সংস্কৃতি ও উৎপাদন সংক্রান্ত। এগুলো একারণেই দেখা দিয়েছে যে, আমাদের মাঝে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়েছে। পারিবারিক কর্মব্যস্ততা পালনে সবাই দায় দায়িত্বহীন ও উদাসীন হয়ে গেছে। আমরা নারীদের প্রত্যেক বিষয়ে পুরুষের সমকক্ষ দাঁড় করানোর যে রাজনৈতিক যথার্থ ও নিষ্ঠাপূর্ণ চেষ্টা করেছি এটা সে চেষ্টার বিপরীত ফলাফল। এ জন্য এখন আমরা সমাজ পুনর্গঠনে এ ত্রুটি সামলানোর চেষ্টা শুরু করে দিয়েছি। আর এ কারণেই মিডিয়া, জনসংগঠন, বিভিন্ন কর্মস্থল এমনকি নিজ নিজ বাড়িতে এমন জোরালো আলোচনা পর্যালোচনা চালানো হচ্ছে যে, নারীদের নিরেট নারীত্বের মিশনের প্রতি কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায় এবং তার জন্য আমাদের কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ।’ (Persstroica, p.117)
আমরা মিঠা নালা মিরসরাই ময়ানি সাহের খালি বারিয়া চালা চন্দ্রনাথ মন্দির এর বুক চিড়ে সীতাকুণ্ডের সীমানায় ঢুকে পড়েছি। এখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এলোমেলো কিছু পাহাড়। কিছু দূর গিয়ে একটি সাইনবোর্ড দেখে চমকে উঠি। আরে ঢাকার ভুটানিক্যাল গার্ডেন সীতাকুণ্ডে এল কি করে। হুবহু একি শব্দ। একি বর্ণ। একি নামের দুটি গার্ডেন হতে পারে?….। পরে তলিয়ে দেখি আসলে ব্যাপারটিতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ Botanical কোন নাম নয় যে অন্যদের জন্য তা নিষিদ্ধ কিংবা তাস্কর্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এর অর্থ হল উদ্ভিৎ সম্বন্ধীয়। সুতরাং বাংলাদেশের সব উদ্ভিদ বাগানকেই বুটানিকাল গার্ডেন বলা যেতে পারে। এতে দোষের কিছু নেই। কপাল কুঁচকাবারও কিছু নেই।
খানিক পরে চোখের তারায় ভেসে উঠে অদ্ভুত একটি শব্দ। অদ্ভুত একটি নাম। পাহাড় চূড়ায় বালু সিমেন্টের ছোট্ট একটা ঘর। বহু রকমের রং চড়ানো তাতে। আশে পাশে লাঠি সোটার মাথায় লাল কাপড় উড়ছে। মাজারের গায়ে বড় অক্ষরে লেখা ‘ডাইল চাইলের মাজার’। ডাইল চাইল বেচারারাও নিরাপদ নয় এসব জটপাঁকানো চুলো মানুষগুলো থেকে। শুনেছিলাম কোনো এক পথের ধারে জনৈক ভদ্র লোক তার প্রাকৃতিক কাজটি সম্পন্ন করেছিল। প্রকট দুর্গন্ধে মানুষের পথ চলতে কষ্ট হচ্ছিল। এ দেখে জনৈক চাল সওদাগর হলুদ রঙ্গের ভেজা পদার্থ স্তুপের উপর দু মুঠো চাল ফেলে জিনিসটাকে ঢেকে দেয়। এতে দুর্গন্ধের বেশ উপশম হয়। পরে আরেক পথিক সওদা হাতে ফেরার পথে ওর উপর কিছু ডাল ছিটিয়ে দেয়। ভেবেছে হয়তো এতে পূন্যের কিছু আছে। এভাবে এখানে একটি মাজার গজিয়ে উঠে। স্বার্থবাজ কিছু অমানুষের আয়ের পথ খোলে। নাম হয় ডাইল চাইলের মাজার। গল্পে শোনা এটাই কি সে মাজার কি না যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। নতুবা গড়ে উঠা এ মাজারের নাম করণের সাথে হুবহু এ জাতীয় কোনো ইতিহাস জড়িয়ে আছে। তবে এ মাজার ভেঙ্গে পাহাড় খুড়ে এক টুকরো হাড়ও খুঁজে পাওয়া যাবে না এব্যাপারে মোটামোটি নিশ্চিত। আর পাওয়া গেলেও সেটা কোনো ভাল মানুষের হাড় হবে না। কোনো কুকুর বিড়াল কিংবা জটধারী কোন গাঁজাখোরের অপবিত্র হাড় হবে বলেই প্রবল ধারণা।
মাজার পুঁজোয় আজ চট্টগ্রামের আলো বাতাস দুষিত হয়ে পড়েছে। চাটগায়ের ঘরের কোনায় কোনায় মাজার গড়ে উঠেছে। এ মাজার সংস্কৃতি কি শেষ হবে না কোন দিন? পাহাড়ের চিপেয় চাপায় দু একটি বাতি ঘর, দু চারটে আলোর মিনার দাঁড়িয়ে আছে। গাঢ় আঁধারেও আলো হারিয়ে যায়। যেন রাতের আঁধারে দূর আকাশে নিভু নিভু তারা। এখন অমাবস্যার গহীন রাত্রি। হু হু করে বেড়ে চলছে মিথ্যার আঁধার। রুখে দেবার মত কেউ নেই।….
আমরা বাতাসের মত হু হু গতিতে এগুচ্ছি। সামনে ভাটিয়াড়ি। বেশ সুন্দর সাজানো গুছানো পরিপাটি এলাকা। বাংলাদেশের একমাত্র মিলটারি একাডেমি বি এম এ এখানেই অবস্থিত। দুধারে উঁচু উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর ঝর সুরে ঝর্ণা বয়। ডান দিকের জানালার ফাঁক গলিয়ে চোখ মেলে দেখতে পাচ্ছি সাগর পাড়ের বড় বড় জাহাজ। এ যেন জাহাজ নয়; প্রকাণ্ড শুভ্র প্রাসাদ। পাহাড়ের ফাঁক ফোকর দিয়ে ভেসে উঠছে সাগর তীরের বিশাল প্রকাণ্ড জাহাজগুলো। আমরা মাথা উঁচু করে দেখে নিই।
ভাটিয়ারি থেকে হাত বাড়ালেই ফয়জ লেক। অপরূপ সবুজের বিপুল আয়োজন আঁকা বাঁকা হৃদের দুকূল জুড়ে। ডিঙ্গিতে চড়ে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় দিগন্তজোড়া সবুজের গভীরে।
তখন ইংরেজদের শাসন কাল। চট্টগ্রাম শহর ঘেষা পাহাড়তলীতে গড়ে উঠেছে রেলওয়ে কারখানা। প্রয়োজন হয় পানি সরবরাহের। এর তদারকি করছেন Foy নামের একজন ইংরেজ প্রকৌশলী। আপন মেধা দিয়ে তিনি কয়েকটি পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে বাধ নির্মাণ করে তৈরি করেন অনুপম এ হৃদটি। দীর্ঘ এলাকা জুড়ে বয়ে যাওয়া এ লেকের নৈসর্গিক সৌন্দর্য অপরূপ ও মোহনীয়। সময়ের বাঁকে বাঁকে Foy.s lake শব্দটি ফয়েজ লেক নামে পরিচিত হয়ে উঠে। এ ফয়েজ লেকের সাথেই চট্টগ্রামের ব্যস্ত নগরি সাগর পাড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মহাকালের সাক্ষি হয়ে। আমরা বাণিজ্যিক এ শহরটাকে হাতের ডানে রেখে ভাটিয়ারি হয়ে হাটহাজারির দিকে এগিয়ে যাই। এ পথেই পাড়ি জমাবো সুদূর রাঙ্গামাটি।
সূর্যটা সোজা মাথার উপরে জ্বল জ্বল করছে। ঢলে যেতে সময় নেই। উঁচু নিচু সবুজের বুক চিড়ে হু হু শব্দ করে আমরা এগিয়ে চলছি। আশে পাশে দু’ চোখ মেলে দেখছি অচেনা নতুন প্রকৃতি। ঝির ঝিরে বাতাসে সবুজ পাতার মর্মর ধ্বনির তালে আমরা ছুটছি। হাটহাজারি সীমানায় ঢুকে এগার মাইলে এসে একটা ফাষ্টফুডের সামনে মামা গাড়ি থামালেন।
জালাল শাহ মসজিদে অবতরণ
১১ মাইল। শুনতে কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত লাগছে। এটা এলাকার নাম হলো কেমন করে! মাথায় জিজ্ঞাসা গিজ গিজ করছে। সময় নেই তলিয়ে দেখার। নতুবা ঘেটে খুড়ে রহস্যটা তুলে আনা যেত। যে মানুষটার মুখ থেকে এ নামের পথ চলা সূচিত হয়; সেও হয়তো ভাবতে পারে নি, কালে কালে এটা একটা শত উচ্চারিত নামে পরিণত হবে। সবুজ এ বাংলায় হাস্যকর লজ্জাকর অদ্ভুত নামের শেষ নেই। দু’ কদম বাড়ালে রাস্তা ঘেষা একটি মসজিদ। ঘন্টার কাটা একের কোঠায়। নামাজটা আগে ভাগেই পড়ে নিতে হবে। আমাদের সাদা ছোট্ট মিছিলটা মসজিদের দিকে এগিয়ে যায়। মসজিদের নামটাও কপাল কুঁচকাবার মত। হযরত জালাল শাহ মসজিদ। আমরা জানি হযরত শাহ জালাল। এখানে নামটা উল্টে গিয়ে জালাল শাহ হয়ে গেল। হতে পারে এ নামে কোন মনীষী ছিলেন। তার নামে এ মসজিদ হয়েছে। না জেনে বিরূপ কিছু বলতে পারছি না। তবে চট্টগ্রামটা খাজা-পুঁজোরীদের অভয়ারণ্য। তাই না জেনে ভাল কিছু বলতেও কষ্ট হয়।
মসজিদটা বেশ ছিমছাম পরিপাটি। সামনে খোলা চত্তর। দক্ষিণ দিকটায় পুরনো দেয়ালে ঘেরা একটা মাঝারি গোরস্তান নিঝুম ঘুমিয়ে আছে। ভিতরে দুচারটে কাঠাল বৃক্ষ। গা জুড়ে ছোট্ট কাঠালের ছড়া বেরিয়েছে। দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। সমাধিটার দেয়াল ঘেষে সারি সারি নারিকেল গাছ । ঝিরঝিরে বাতাসে চেরা চেরা পাতাগুলো ঝরঝর শব্দ তুলে গান করছে। গাছের ডগায় থরে থরে সাজানো কচি কচি ডাবগুলো ঝুলছে। খেতে যেমন দেখতে তার চে বেশি সুন্দর লাগছে। উত্তর দিকে ইয়া বড় একটা মিনার। মাথায় দুটো হর্ণ দু দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে।
প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়ে গেলাম। কি উৎকট গন্ধ রে বাবা! নাক ছিড়ে যেতে চায়। চোখ মুখ ঘুচিয়ে নাক মুখ চেপে ধরে কোন মতে কাজ সমাধা করি। ওযুখানার দিকে বয়ে যাওয়া পথটার ধারে একজন মানুষ গোসল করছে। মুয়াজ্জিন কিংবা ইমাম হবে হয়তো। এক ধরণের এতগুলো সাদা মানুষ দেখে জিজ্ঞেস করলেন কোথা থেকে এসেছি কোথায় যাবো ইত্যাদি। চেষ্টা করেছে শুদ্ধ করে বলতে। কিন্তু আঞ্চলিকতা এড়াতে পারে নি। শব্দগুলোর সাথে আউলা ঝাউলা আঞ্চলিকতা লেগেই ছিল। সব খুলে বললাম।
এক দুজন করে ওযুটা সেরে নিলাম। তখন দুপুর একটা। সবাই একাকি দুরাকাত করে পড়ে নিলাম। খোদার নেয়ামত কতটা সময়োপযোগী এবং কতটা কল্যাণকর তা এ সফরে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধ হচ্ছে। দূর সফরে দেহ মন হেলে পড়েছে। এখন যে কোন কাজেই চাই একটুখানি প্রশান্তি, একটুখানি শিথিলতা। ইসলাম প্রয়োজনীয় এ প্রশান্তিটুকু দিতেও ভুল করে নি। এক দুজন করে নামাজ শেষে চত্তরে নারিকেলের ছায়ায় এসে দাঁড়ালাম। ফুরফুরে বাতাসের গায়ে শরীরটাকে এলিয়ে দিলাম। নিজেকে মেলে ধরলাম দখিনা হাওয়ায়। কাঠাল গাছের দিকটায় একটা জটলা লেগে গেল। কাঠাল গাছ ফুড়ে গজিয়ে উঠা শিশু কাঠালগুলো দেখছে সবাই অধির আগ্রহে। আর মাঝে বিশারতুল্লাহ দাঁড়িয়ে ফল বিশেষজ্ঞের মত কি যেন বুঝাচ্ছে আর নখ উঁচিয়ে দেখাচ্ছে। গাড়ি রেখে মামা এলেন একটু বিলম্ব করে। এদিকে আমাদের নামায শেষ। মামা শুনে জুনায়েদ বোগদাদী সেজে গেলেন। জামাত না করে একা একা পড়া হল! কেমন কথা!! সাদা মুখটাকে কালো করে মামা নামাজে দাঁড়ালেন। আমরা তেমন গা করলাম না। হঠাৎ পাল্টে যাওয়া এসব মানুষকে বুঝাতে খুব ঘাম ঝরাতে হয়। আমরা দু পা হেঁটে গিয়ে গাড়িতে চড়ে বসি। সামনে হাটহাজারি মাদরাসা। কেউ দেখেছে। কেউ দেখে নি। না দেখাদের মাঝে আমি অন্যতম। হাটহাজারি দেখার স্বপ্ন আমার অনেক দিনের। সে দুরন্ত কৈশোরে বুনেছিলাম একটুখানি স্বপ্নবীজ। বীজ ফুটে কিশলয় হয়েছে। সময়ের সজীবতায় লকলকিয়ে বেড়ে উঠেছে। ডাল পালা ছড়িয়ে পাতায় পাতায় ছেয়ে গেছে। আজো মুকুল ছাড়ে নি। পাপড়ি মেলে ফুল ফোটে নি।
ক্ষুধা নিবারণ
এখন টনটনে দুপুর। দু মুঠো খেয়ে নিতে হবে। পরে আর সময় হবে না। এক আধটু ক্ষুধা লাগতে শুরু করেছে। এর মধ্যে হাটহাজারী পড়ুয়া এক ছাত্রের সাথে দেখা। ছেলেটা আতাউল্লাহর চেন জানা। ওকে গাড়িতে তুলে নেয়া হল। মাদরাসা কত দূর? কোন হোটেলটা ভাল হবে? ছেলেটা সব খুলে বলল। খানিক পর একটা হোটেলের মুখে এসে দাঁড়ালাম। নাম মুসলিম হোটেল। হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্রদের কাছে হোটেলটা বেশ পরিচিত। এক নামে সবাই চেনে। খাবারের মান তুলনামূলক ভাল। এখান থেকে দু পা আগালেই মাদরাসা। ছাত্রদের আনা গোনা দেখেই বুঝা যাচ্ছে মাদরাসা জাতীয় কিছু একটা আছে আশে পাশে কোথও। আমরা নেমে তরতর করে হোটেলটাতে ঢুকে পড়ি। মামাকে বলে দেয়া হল গাড়িটি মাদরাসায় রেখে আসুন। আমরা হাত ধুয়ে ছোট ছোট অংশে ভাগ হয়ে চেয়ার পেতে বসে গেলাম। অপেক্ষা- এটা যে কোন হোটেলের জন্য বেধে দেয়া নিয়ম বলা যায়। তাই জিনিসটাকে এড়ানো গেল না। খানিক পর সবার পাতে বড় বড় রুই মাছের ফালি তুলে দেয়া হল। ঝোলের সাথে যেন লাল হলুদের গুড়ো রং মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। লালে টুক টুক করছে। খেলাম। ভিন দেশী রান্না। একটু কেমন কেমন লাগল। ছোট্ট একটি থালায় করে বড় বড় কাঁচা সবুজের কখান মরিচও দেয়া হল। চোখে পড়ার মত প্রকাণ্ড দীর্ঘ মরিচ।
(চলমান, ইনশাআল্লাহ)