মুফতী ইবরাহীম হাসান দা.বা.
মহান রাব্বুল আলামীন এই পৃথিবীকে তৈরি করেছেন খুবই ক্ষণস্থায়ী আবাসস্থল হিসেবে। ক্ষণস্থায়ী এই আবাসস্থলে অবস্থানের জন্যে সৃষ্টি করেছেন মানুষ, নানা প্রকার প্রাণী, উদ্ভিদ, বৃক্ষরাজি ও বস্তুসামগ্রী। এই সকল কিছুর মধ্যে আবার মানুষকে দান করেছেন শ্রেষ্ঠত্ব। মানুষ হলো রাব্বুল আলামীনের নিকট আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টিজগতের সেরা।
মানুষের জন্য আল্লাহ তা‘আলা এই পৃথিবীর অগণন নিয়ামত সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি এসকল নিয়ামতের প্রতি মানুষের রয়েছে স্বভাবজাত ভালোবাসা। পার্থিব জগতের নিয়ামতের প্রতি মানুষের মনে এই ভালোবাসাও আল্লাহ তা‘আলাই তৈরি করে দিয়েছেন। কুরআনে কারীমে সূরা আলে ইমরানের চৌদ্দ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاللَّهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الْمَآبِ
এই আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা দৃষ্টান্ত হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নিয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে এখান থেকে পার্থিব জগতের অন্যান্য নিয়ামতের প্রতি মানুষের স্বভাবজাত ভালোবাসার বিষয়টিও ফুটে ওঠে।
তবে পার্থিব জগত সম্পর্কে ভিন্ন রকম বর্ণনাও আছে। সুনানে তিরমিযীর একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
عن سهل بن سعد، قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: لو كانت الدنيا تعدل عند الله جناح بعوضة ما سقى كافرا منها شربة ماء
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যদি এ পৃথিবীর মূল্য আল্লাহর কাছে একটি মাছির ডানার সমপরিমাণও হতো, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা সেখান থেকে একজন কাফেরকে এক চুমুক পানিও পান করাতেন না।
রাসূলুল্লাহর একথা থেকে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এই পুরো পৃথিবীই যেখানে আল্লাহর কাছে মাছির পাখার চেয়েও মূল্যহীন সেখানে এর নিয়ামত সমূহের প্রতি মানুষের মনে কেনো এই ভালোবাসা তৈরি করে দেয়া হলো? পার্থিব জগতের মূল্যহীন বিষয়াবলীকে কেনো মানুষের সামনে লোভনীয় করে তোলা হলো? কুরআন-হাদীসের বক্তব্য ও উলামায়ে কেরামের মতামত থেকে এর তিনটি উদ্দেশ্য বের হয়ে আসে।
এক. আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে দিয়ে অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও এই পৃথিবীকে সাজিয়ে তুলতে চেয়েছেন। পৃথিবীকে সাজিয়ে তুলতে হলে বৃক্ষরোপণ, ফল-ফসল উৎপাদন, গৃহ বিনির্মাণ ইত্যাদির প্রয়োজন রয়েছে। সেজন্যেই তিনি এখানকার বস্তুসামগ্রীর প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তুলেছেন। যেনো মানুষ আগ্রহী হয়ে এসবের প্রতি মনোযোগী হয়। মানুষের মনে এসবের প্রতি স্বভাবজাত আগ্রহ না থাকলে তারা এসব সৃজনশীল কাজ করতো না। ফলে তখন আর ফুল-ফল, বৃক্ষরাজী এবং বিভিন্ন প্রকার স্থাপত্যশৈলিতে এই পৃথিবী সুশোভিত হয়ে উঠতো না।
দুই. আল্লাহ তা‘আলা সব ধরনের স্থায়ী নিয়ামত তৈরি করেছেন জান্নাতে। তবে সেসব নিয়ামতের আংশিক নমুনা পৃথিবীতেও তৈরি করেছেন এবং সেগুলোর প্রতি মানুষের ভালোবাসা তৈরি করেছেন। উদ্দেশ্য, দুনিয়ার এসব নিয়ামত দেখে যেনো মানুষ আখেরাতের নিয়ামত সম্পর্কে খুব সামান্য হলেও ধারণা লাভ করতে পারে এবং আখেরাতের নিয়ামতলাভে আগ্রহী হয়।
উদাহরণস্বরূপ, দুনিয়াতে একটি উল্লেখযোগ্য নিয়ামত হলো গাছ। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য গাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। কুরআনে কারীমেও আল্লাহ তা‘আলা আখেরাতের নিয়ামত হিসেবে উল্লেখ করেছেন বৃক্ষরাজির কথা। পৃথিবীর গাছ দেখে ও এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করার পর মানুষ যখন আখেরাতের গাছের কথা শুনবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা আখেরাতের গাছের প্রতিও আগ্রহী হবে এবং সেটাকে অর্জন করতে প্রয়াসী হবে।
গাছের পাশাপাশি আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতের নিয়ামত হিসেবে বর্ণনা করেছেন সুশোভিত উদ্যানের কথা, ঝর্ণা-নহরের কথা। ডাগর চোখের হুরের কথা। পৃথিবীতে যদি মানুষ এসকল জিনিস প্রত্যক্ষ না করতো অথবা প্রত্যক্ষ করলেও এসবের প্রতি মহব্বত না থাকতো, তাহলে আখেরাতে একই ধরনের নিয়ামতের কথা শুনে তার মনে কোনো ভাবান্তর হতো না এবং এগুলোর প্রতি আগ্রহও বোধ হতো না। অথচ আখেরাতের নিয়ামতের প্রতি আগ্রহ বোধ হওয়া এবং সেজন্যে পৃথিবীতে সৎকর্ম করা মানুষের জন্য জরুরী। আল্লাহ তা‘আলা বান্দার এ প্রয়োজনকে পূর্ণ করার জন্যেই পার্থিব জগতের নিয়ামতের প্রতি কিছুটা ভালোবাসা তৈরি করে দিয়েছেন।
তিন. পার্থিব জগতের নিয়ামতের প্রতি আমাদের মনে মহব্বত তৈরির বড় একটা উদ্দেশ্য হলো এর মাধ্যমে আমাদের পরীক্ষা নেয়া। আল্লাহ তা‘আলা দেখতে চান যে, আমরা দুনিয়াবী নিয়ামত পেয়ে এর মধ্যেই আকণ্ঠ ডুবে যাই, নাকি এসব নিয়ামতরাজী ভোগ করার মাঝেও আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ রাখি। এই পরীক্ষাটা নেয়ার জন্যেই আল্লাহ তা‘আলা আমাদের কাছে দুনিয়ার ভোগসামগ্রীকে লোভনীয় করে তুলেছেন।
মহব্বতের সীমা
উপর্যুক্ত তিনটি উদ্দেশ্য থেকে বোঝা গেলো, মৌলিকভাবে এই পৃথিবী এবং এর সকল ভোগসামগ্রী আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণ মূল্যহীন। শুধু কয়েকটি বিশেষ উদ্দেশ্যে এর নিয়ামতসমূহকে আমাদের কাছে লোভনীয় করে তোলা হয়েছে। যদি আমরা প্রথম উদ্দেশ্যটির দিকে তাকাই, তাহলে দেখবোÑ যেহেতু পৃথিবীকে সাজিয়ে তোলার জন্যেই আমাদের মনে এই মহব্বত তৈরি করা হয়েছে, আর পৃথিবীটা হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী, সুতরাং এই মহব্বতটাও হতে হবে ক্ষণস্থায়ী। এমন যেনো না হয়, এই ক্ষণস্থায়ী মহব্বতের কারণে আমরা চিরস্থায়ী আখেরাতের নিয়ামত থেকেই বঞ্চিত হয়ে গেলাম।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সবসময় সাহাবায়ে কেরামকে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যখনই দুনিয়াবী কোনো আলোচনা সামনে এসেছে, তখনই এর বিপরীতে আখেরাতের নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। হযরত ফাতিমা রাযি. একবার নবীজীর কাছে এসেছিলেন ঘরের কাজের জন্যে একজন খাদেম চাইতে। নবীজী আলী রাযি. -এর ঘরে গিয়ে তাঁকে বললেন,
ألا أعلمكما خيرا مما سألتماني، إذا أخذتما مضاجعكما تكبرا أربعا وثلاثين، وتسبحا ثلاثا وثلاثين، وتحمدا ثلاثا وثلاثين فهو خير لكما من خادم
অর্থ : তোমরা যা কামনা করেছ, তারচে’ উত্তম বিষয় আমি কি তোমাদের শিখিয়ে দিব না? যখন তোমরা ঘুমাতে যাবে তখন চৌত্রিশবার আল্লাহু আকবার, তেত্রিশবার সুবহানাল্লাহ, তেত্রিশবার আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করলে তোমার জন্যে সেটা খাদেম থেকেও উত্তম হবে। (সহীহ বুখারী; হাদীস ৩৭০৫)
হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. একবার একটি গাছ লাগাচ্ছিলেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান দিয়ে অতিক্রম করার সময় বললেন, কী লাগাচ্ছ আবূ হুরাইরা? তিনি বললেন, আমার জন্য একটি গাছ লাগাচ্ছি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
ألا أدلك على غراس خير لك من هذا؟ قال: بلى يا رسول الله، قال: قل: سبحان الله، والحمد لله، ولا إله إلا الله، والله أكبر، يغرس لك بكل واحدة شجرة في الجنة
অর্থ : আমি কি তোমাকে এরচে’ উত্তম গাছের সংবাদ দিব? আবূ হুরাইরা বললেন, নিশ্চয়ই ইয়া রাসূলাল্লাহ! নবীজী বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং আল্লাহু আকবার (পাঠ করলে) প্রত্যেকটি তোমার জন্য জান্নাতে একটি করে বৃক্ষ রোপণ করবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ; হাদীস ৩৮০৭)
দুনিয়ার মহব্বতের সীমা-পরিসীমার ব্যাপারে একটি দৃষ্টান্ত পেশ করছি। আমরা জানি, নৌকা চলাচলের জন্য পানি অত্যাবশ্যকীয় একটি বিষয়। কিন্তু এর জন্য শর্ত হলো, পানি নৌকার বাইরে থাকতে হবে। ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না। দুনিয়ার মহব্বতটাও এমনি। পৃথিবীতে চলতে গেলে এর মহব্বত লাগবে। কিন্তু সেটা আমাদের দিলে প্রবেশ করতে পারবে না। প্রবেশ করলে সেটা হবে নদীর পানি নৌকার ভেতরে চলে আসার মতো। যার অনিবার্য পরিণাম হচ্ছে ধ্বংস।
শেষকথা
সংক্ষিপ্ত এ আলোচনা থেকে বোঝা গেলো- পার্থিব জগতের নিয়ামত ও বস্তুসামগ্রীর প্রতি আমাদের মহব্বত আল্লাহপ্রদত্ত স্বভাবজাত একটি বিষয়। এই মহব্বত আমাদের মধ্যে থাকতেই পারে। এগুলোকে প্রয়োজন মাফিক ব্যবহারও করতে হতে পারে। তবে শর্ত হলো, এই মহব্বত এবং ব্যবহার হতে হবে নির্দিষ্ট একটি সীমার ভেতরে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু শর্তের সাথে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শর্ত হচ্ছেÑ এই মহব্বতকে অন্তরের গভীরে প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না। আখেরাতের মহব্বতের উপর এটাকে কিছুতেই প্রাধান্য দেয়া যাবে না। এসব নিয়ামত ভোগ করতে হবে শুধুই প্রয়োজন পূরণের মাধ্যম হিসেবে। এসব শর্ত মানতে পারলেই দুনিয়া ও আখেরাত উভয় দিকের মহব্বতের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান সম্ভব।
অনুলিখন : মাওলানা ইরফান জিয়া