মাওলানা ইরফান জিয়া
আয়া সোফিয়া নিয়ে কথা শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো। তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে অবস্থিত এই স্থাপত্যটিকে নতুন করে মসজিদ ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ঘোষণার পর থেকেই এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে তুমুল আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়েছে। মুসলমানগণ মসজিদ চালুর ঘোষণায় খুশি হবেন এটাই স্বাভাবিক। আবার এন্টি মুসলিম সম্প্রদায় এঘটনায় অখুশি হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
কিন্তু একটা বিষয়ের যৌক্তিক সমাধান কখনই এমন সাম্প্রদায়িক বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব নয়। এজন্য আমাদের দ্বারস্ত হতে হবে ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজের; যেগুলোতে আয়া সোফিয়ার আদ্যপান্ত সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিবরণ রয়েছে। পাশাপাশি যারা এ বিষয়ে আপত্তি তুলছেন তাদের আপত্তির জায়গাগুলো নিয়েও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ হওয়া দরকার।
ফিরে দেখা ইতিহাস
বাইজেন্টাইন সম্রাট সম্রাট জাস্টিনিয়ান প্রথম এর রাজত্বকালে ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে আয়া সোফিয়া নির্মাণ করা হয়। ৫৩৭ থেকে ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অর্থোডক্স গির্জা হিসেবে আয়া সোফিয়া ব্যবহৃত হয়। চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ক্যাথলিক খ্রিষ্টানেরা অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বর্তমান ইস্তাম্বুল আক্রমণ করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং আয়া সোফিয়াকে অর্থোডক্স গির্জা থেকে ক্যাথলিক গির্জায় রূপান্তরিত করে। যার দরুন আয়া সোফিয়া ১২০৪ থেকে ১২৬১ সাল পর্যন্ত ক্যাথলিক গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
সুলতান মুহাম্মদ ফাতেহ
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বর্তমান ইস্তাম্বুল দখলের জন্য অনেক জাতিই চেষ্টা করেছে। নানা জাতির নানা সম্রাট ২৯ বার সহস্রাধিক বছরের পুরনো এই রাজধানী দখলের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সফল হননি। ১৪৫৩ সালের ২৯ মে। তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে প্রবেশ করলেন। সুলতান প্রথমত চেয়েছিলেন যুদ্ধ ছাড়াই চুক্তির মাধ্যমে এটি অর্জন করতে। এলক্ষ্যে তিনি যুদ্ধের পূর্বে কয়েকবার দূত পাঠিয়ে বাইজেন্টাইন সম্রাট একাদশ কনস্ট্যান্টাইন ড্রাগাসেসকে চুক্তি সম্পাদনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি।
যাই হোক। শহর বিজয়ের পর সুলতান আয়া সোফিয়ার দিকে মনোযোগী হন। বিজিত শহরের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী সুলতান চাইলেই আয়া সোফিয়াকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ গণ্য করে যা ইচ্চা তাই করতে পারতেন। কিন্তু সুলতান সেটিকে গির্জার দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে ব্যক্তিগত অর্থে ক্রয় করে মসজিদের নামে ওয়াকফ করে দেন।
তুরস্ক ও কামাল পাশার ধর্মনিরেপেক্ষতা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুরস্কে উসমানীয় খেলাফতের অবসান হয়। কামাল পাশা তুরস্ককে আধুনিক বানানোর জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করে। এ নীতির আলোকে সে দেশের মানুষের উপর অনাকাঙ্ক্ষিত সব বিষয় চাপিয়ে দিতে থাকে। আরবী বর্ণমালা দূরীকরণ, পর্দা নিষিদ্ধকরণ সহ দেশের সকল স্তর থেকে সে ইসলামকে সরিয়ে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। এরই অংশ হিসেবে সে আয়া সোফিয়াতেও নামায নিষিদ্ধ করে সেখান মসজিদের চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু গণমানুষের অব্যাহত চাপে ১৯২৩ থেকে ১৯৩৪ পর্যন্ত আয়া সোফিয়া মসজিদ হিসেবেই ব্যবহৃত হতে থাকে। অবশেষে ১৯৩৪ সালে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে মুস্তফা কামাল আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ১৯৩৫ সালে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়।
তুরস্কে ইসলাম ও এরদোয়ান
মৌলিকভাবে তুর্কি জাতি কখনই সেকুলার ছিলোনা। তাদের উপর জোর করে সেকুলারিজম চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো। এর প্রমাণ বর্তমান তুরস্ক। ২০০২ থেকে ২০১৮ টানা পাঁচবারের নির্বাচনে সেখানে ইসলামপছন্দ সরকার জয়লাভ করেছে।
আয়া সোফিয়ার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। প্রায় ছয় দশক ধরে আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করার জন্য আন্দোলন হয়ে আসছিল। গত ১০ ই জুলাই ২০২০ শুক্রবার তুরস্কের আদালত আয়া সোফিয়ার ব্যাপারে ১৯৩৪ সালে করা মুস্তফা কামালের মন্ত্রীপরিষদের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা দেয়। এরপরই প্রেসিডেন্ট রজব তায়্যেব এরদোয়ান সেটিকে মসজিদ হিসেবে ব্যবহারের এক নির্দেশনায় স্বাক্ষর করেন।
দেশের আপামর জনসাধারণ এমনকি বিরোধী দলও এরদোয়ানের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্ত যুক্তরাষ্ট্র, গ্রিস, সাইপ্রাস, ইউনেনেস্কা সহ কয়েক ডজন দেশ ও সম্প্রদায় প্রতিক্রিয়া ও নিন্দা জানিয়েছে। নিন্দাজ্ঞাপনের তালিকায় মুক্তচিন্তার কিছু মুসলমানও আছেন।
কেন এই আপত্তি
আয়া সোফিয়াকে সুলতান মুহাম্মদ গির্জার দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন। এটাই প্রমাণসমৃদ্ধ কথা। ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তিপত্রটি আজ অবধি আঙ্কারার ‘তার্কিশ ডকুমেন্ট অ্যান্ড আর্গুমেন্ট ডিপার্টমেন্ট’-এ বিদ্যমান। কেনার পর সুলতান মুহাম্মদ সেটিকে মসজিদের নামে ওয়াকফ করে দেন।
মুসলিম শরীয়া আইন অনুযায়ী কোন স্থানকে বৈধভাবে মসজিদ হিসেবে ঘোষণা দেয়ার পর পৃথিবী ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত সেখানে অন্য কোন কিছুই করা যায় না। সুতরাং আয়া সোফিয়ার আইনত মালিক সুলতান মুহাম্মদ কর্তৃক ঘোষিত মসজিদকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করাটাই ছিলো মূলত বেআইনি কাজ। ৮৬ বছর ধরে চলে আসা একটা বেআইনী কাজকে অবৈধ ঘোষণা করাটা কিছু মানুষের কাছে কেন আপত্তিকর মনে হলো, তা সাধারণ বিচার-বুদ্ধিতে বোধগম্য নয়।
আয়া সোফিয়া ক্রয় নিয়ে সন্দেহ
আয়া সোফিয়া খৃস্টানদের কাছ থেকে ক্রয় করা হয়েছিলো, নাকি দখল করা হয়েছিলো তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। তৎকালীন বিশ্বের সমরনীতি অনুযায়ী আয়া সোফিয়াকে মুসলমানরা দখল করে নিলেও সেটা দোষের কিছু ছিলো না। কিন্তু আমরা আগেও বলে এসেছি যে, সুলতান মুহাম্মদ কর্তৃক আয়া সোফিয়া ক্রয়ের দলিল আজো বিদ্যমান।
তাছাড়া সুলতান মুহাম্মদ সে সময়ে খৃস্টানদের সাথে যে ব্যবহার করেছেন তাতেও প্রমাণ হয়, আয়া সোফিয়াকে দখল করার কোনো প্রয়োজন তার ছিলো না। তিনি অর্থোডক্স প্যাট্রিয়ার্খকে মন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ছিলেন। গির্জায় সমবেত হয়ে খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে নিয়মিত প্রার্থনা করার অনুমতি দিয়ে ছিলেন। ধর্মযাজকদের ওপর হতে কর মওকুফ করেছিলেন। তুর্কীদের সহায়তায় অনেক গির্জা পুনর্নিমাণও করা হয়।
অথচ আমরা যদি তৎকালীন অমুসলিম সম্প্রদায়ের নীতির দিকে লক্ষ করি তাহলে এর সম্পূর্ণ বিপরীত দেখব। কনস্টান্টিনোপল পতনের ৪০ বছরের মাথায় গ্রানাডায় মুসলমানদের পতন হয়। ইতোপূর্বে স্পেনের অনেক অংশই মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিলো। সর্বশেষ শহর হিসেবে গ্রানাডারও পতন হয়। রাজা ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলার সাথে মুসলমানদের ৪৭ দফার চুক্তি হয়েছিলো। যেখানে বলা হয়েছিলো, মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা বহাল রাখা হবে। শুধু তাই নয়, তাদের পারিবারিক আইন চর্চার জন্য কাজি নিয়োগ দেয়া হবে, মাদ্রাসাও চালানো যাবে। কিন্তু শেষে গ্রানাডার পরিণাম কী হয়েছিলো তা সবারই জানা।
গ্রানাডার গ্রান্ড মসজিদ তো বটেই, ছোটখাট মসজিদও গির্জায় রূপান্তরিত হয়। মুসলমানদেরকে জোর করে খৃস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়। সৃষ্টি হয় ইনকুজিশনের মর্মান্তিক ইতিহাস!
অথচ ইস্তাম্বুলকে যুদ্ধের মাধ্যমে জয় করেও মুসলমানরা নিজেদের ইতিহাসে এধরনের কোন কালিমা লেপনের সুযোগ দেননি। বরং বিজয়ী জাতি হিসেবে পরাজিত জাতিকে এমন সব সুবিধা দিয়েছে যার ছিটেফোটাও চুক্তির মাধ্যমে গ্রানাডার অধিকার পাওয়া রাজা ফার্ডিন্যান্ড দেখাতে পারেনি।
অনেকে আবার গির্জা ক্রয়ের বিষয়টি মেনে নিয়ে আরেক ধাপ এগিয়ে এসে আপত্তি তোলেন। তারা বলেন, সুলতান মুহাম্মদ যদিও এটি ক্রয় করে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, কিন্তু ঐতিহাসিক এ স্থাপনাটি ক্রয় করে হলেও তার ঐতিহ্য বিনষ্ট করা উচিৎ হয়নি।
আবার অনেকে বলেন, সুলতান মুহাম্মদ জোরপূর্বক এটি খৃস্টানদের কাছ থেকে ক্রয় করেছিলেন। এমন কথা যারা বলেন তারা আসলে গির্জার বিষয়ে খৃস্টানদের ধারণা এবং এর পরিচালনা নীতি সম্পর্কে কোনো খবরই রাখেন না।
খৃস্টানদের জন্য গির্জা বিক্রি করা অনেক আগে থেকেই খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। মুসলমানরা যেমন চিন্তা করে, তাদের মসজিদ প্রজন্মের পর প্রজন্ম শেষ অবধি থাকবে, খ্রিস্টানদের মধ্যে তেমন চিন্তাধারা কাজ করে না। তাই গির্জগুলোতে যখন প্রার্থনাকারী আসা বন্ধ হয়ে যায় কিংবা ডোনেশন সংগ্রহ করতে না পারে, তখন গির্জার কমিটি তা বিক্রি করে দেয়। যদি গুগলে Churches for Sale লিখে সার্চ দেয়া হয়, তবে হাজার হাজার গির্জা বিক্রির খবর পাওয়া যাবে। এর বিপরীতে mosque for sale লিখে সার্চ দিলে একটিও পাওয়া যাবে না, ইনশাআল্লাহ।
দেখুন, বিশ্বের খৃস্টান সম্প্রদায় একবারের জন্য এ কথা বলার সাহস করছে না যে, আয়া সোফিয়াকে গির্জায় পরিণত করা হোক। তারা জানে যে বিক্রিত গির্জা ফেরত পাওয়ার দাবি ধোপে টিকবে না। যাদুঘর বানানোর দাবির পেছনে তাদের উদ্দেশ্য হলো, আয়া সোফিয়াকে বিক্রি করে তারা নিজেরা তো এর ধর্মীয় ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হয়েছেই, এখন যেনো এর বৈধ মালিক মুসলমানরাও এটাকে ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করতে না পারে।
সুশীল সমাজের কথা
কিছু সুশীল মানুষ আবার আয়া সোফিয়াকে তুলনা করছেন বাবরী মসজিদের সাথে। তারা বলছেন, কোনো মসজিদকে জোর করে মন্দির বানানো যেমন আমরা সমর্থন করিনা, ঠিক তেমনি কোনো গির্জাকে মসজিদ বানোনোর বিষয়টিও আমরা সমর্থন করতে পারিনা।
বিরাট ইনসাফের কথা! কোথায় বাবরি মসজিদ আর কোথায় আয়া সোফিয়া। কোনো ধরনের ঐতিহাসিক প্রমাণ ছাড়া শুধু মিথের উপর ভিত্তি করে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ দখল করেছিলো উগ্র হিন্দুরা। একে কেন্দ্র করে দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলমানকে তারা হত্যা করেছে। বাবরি মসজিদের সাথে কিনে নেয়া গির্জা আয়া সোফিয়ার মিল তারা কোথায় খুঁজে পান জানি না।
পাঁচশতাধিক বছর পূর্বে গির্জাকে মসজিদ বানানো নিয়ে আপনাদের আপত্তি। তাহলে মাত্র ৮০ বছর পূর্বে যে মুস্তফা কামাল মসজিকে জাদুঘর বানালো, সেটা নিয়ে আপনাদের কোনো আপত্তি নেই কেনো? আপনাদের ইনসাফটা কি তাহলে একপেশে হয়ে গেলো না?
ইউনেস্কোর উদ্বেগ ও খোড়া যুক্তি
১৯৮৫ সালে আয়া সোফিয়া জাতিসংঘের ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। গত ১০ জুলাই এটিকে মসজিদ ঘোষণা দেয়ার পর ইউনেস্কোর মহাপরিচালক অদ্রে আজুলে বলেছেন, ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত স্থাপনার কোনো ধরনের সংস্কার যাতে এর বৈশ্বিক মূল্যবোধকে নষ্ট না করে তা মানার বাধ্যবাধকতা রাষ্ট্রের রয়েছে৷ এই বিষয়ে প্যারিসে তুরস্কের রাষ্ট্রদূতের কাছেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি৷ আয়া সোফিয়াকে ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে সম্পর্কের অনন্য উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাদুঘর হিসেবে স্থাপনাটি তার এই ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে এবং মতবিনিময়ের প্রতীক হিসেবে টিকে রয়েছে৷ নতুন ঘোষণায় যার বরখেলাপ ঘটেছে।’ আয়া সোফিয়ার ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্টেটাস পুনর্বিবেচনা করা হবে বলেও ইউনেস্কো জানিয়েছে।
একটি স্থাপনার ধর্মীয় পরিচয় কী, তা বিবেচনা করে সেটাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় রাখা বা রাখার বিষয়টি কতটুকু যুক্তিযুক্ত। এরচেয়ে বড় কথা হলো , ইতোপূর্বে ইউনেস্কো যেসব বিষয়কে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছে সেগুলোতেও তো অনেক ধর্মীয় বিষয় রয়েছে। গির্জা, মন্দির, খৃস্টানদের সমাধি এমনকি মসজিদও আছে। কই সেগুলোর ধর্মীয় পরিচয় তো বিশ্ব ঐতিহ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পথে কোনো বাধা সৃষ্টি করলো না! আসলে ইউনেস্কোর আগের কর্মকাণ্ড যাই হোক আন্তর্জাতিক খৃস্টান সম্পদ্রায়ের চাপে এখন সে আর কোনো নীতিমালার ধার ধারছে না।
মসজিদগুলোও জবাব চায়
তুরস্কে ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক আয়া সোফিয়ার মসজিদে প্রত্যাবর্তন নিয়ে সমালোচনায় সবচেয়ে বেশী সোচ্চার খৃস্টান সম্প্রদায়। তাদের কথা হলো, যেহেতু এটা এক সময় খৃস্টানদের গির্জা ছিলো; সুতরাং এটার সাথে তাদের ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে।
একটা স্থাপনা কোনো এক সময় গির্জা থাকলেই যদি এত বড় বড় কথা বলা যায়, তাহলে আমাদেরও কিছু বলার আছে। তুরস্কের পার্শ্ববর্তী খৃস্টান দেশ গ্রীস। যেই দেশটি আয়া সোফিয়ার ব্যাপারে অনেক সোচ্চার। সেখানে প্রায় ১০ হাজারের উপরে উসমানী আমলের ঐতিহাসিক ইসলামী স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে। উসমানী আমলে নির্মিত সেসব মসজিদ এবং ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর বর্তমান অবস্থার কোনো খবর কি আপনাদের আছে? কিছু মসজিদকে নবায়নের নামে গির্জায় পরিণত করা হয়েছে। অন্যান্য মসজিদ পরিণত করা হয়েছে নাইট ক্লাব, থিয়েটার, এবং প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদনককেন্দ্রে।
১৪৬৮ সনে গ্রীসের থেসেলোনোকিতে ‘হামজা বে’ মসজিদটি শুধু নামাজের জন্য ব্যবহৃত হত। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের কয়েক বছর পর মসজিদের মিনার ধ্বংস করে দেওয়া হয়। মিনারার উপরে কারুকাজ এবং মূল্যবান পদার্থগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। ভেতরে কাঠের মিম্বার ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ১৯২৭ সনে গ্রীসের ন্যাশনাল ব্যাংকের মালিকানায় আসার পর মসজিদটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। সেখানে বানানো হয় দোকান ও সিনেমা। ১৯৮০ পর্যন্ত মসজিদটি ব্যবহার হয় প্রাপ্ত বয়স্কদের মুভি দেখানোর কাজে।
লোননিনা প্রদেশের নাদরা অঞ্চলের ফায়েক পাশা মসজিদও গীর্জায় পরিণত করা হয়েছিল। ১৯৭০ সনে মসজিদটিকে বানানো হয়েছিল বিনোদনকেন্দ্রে। বর্তমানে মসজিদটি পরিত্যাক্ত অবস্থায় আছে। একইভাবে গ্রীসের রাজধানী এথেন্সসহ সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ আরও শহরগুলোতেও মসজিদগুলো এরকমই পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
রোমান আগুরায় অবস্থিত ফাতেহ মসজিদটি সম্পর্কে জানা যায় এটি উসমানি সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ এর আমলে নির্মিত হয়েছে। ২০১০ সাল নাগাদ মসজিদটি ব্যবহৃত হয়েছে স্টোররুম হিসাবে। ২০১৭ সালে এটি মেরামত ও সংস্কার কাজ শেষ হওয়ার পর থেকে প্রদর্শনী হল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
স্পেন ও গ্রানাডার মসজিদগুলোর অবস্থা তো আগেই বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক খৃস্টানসম্প্রদায়ের প্রতি আমাদের আহ্বান, পূর্বে গির্জা থাকার যুক্তিতে আয়া সোফিয়া নিয়ে বড় বড় কথা বলার আগে এই মসজিদগুলোর ব্যাপারে উত্তর দিন। এগুলোর মধ্যে অনেক মসজিদই তো এমন ছিলো, যেখানে আগে অন্য স্থাপনাই ছিলো না। মুসলমানগণ ভূমি ক্রয় করে সেখানে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। সেসব মসজিদের এই পরিণতি কারা করেছে?
হাজার হাজার মসজিদকে গির্জা ও নাট্যশালায় পরিণত করার পর আপনাদের মুখে এধরনের আবদার ভালো শোনায় না।
তুরস্কের উদারনীতি ও পরিশিষ্ট
আয়া সোফিয়া মসজিদে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে তুরস্ক। সাথে সাথে তুরস্ক এও জানিয়েছে যে, আয়া সোফিয়ার ব্যবহার পরিবর্তন হলেও স্থাপনার বৈশিষ্ট্য সুরক্ষিত থাকবে। জনসাধারণ এবং সকল দর্শনার্থী-পর্যটকের জন্য এটি উন্মুক্ত থাকবে।
টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে এরদোয়ান জানান, ২৪ জুলাই থেকে সেখানে নামাজ আদায় করা যাবে৷ তবে সবার প্রার্থনার উপযোগী করে তুলতে ছয় মাস সময় লাগবে৷ তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইবরাহীম কালিন বলেন, ‘আয়া সোফিয়া নামাজের জন্য উন্মুক্ত হওয়ায় এটি তার পরিচয় থেকে বঞ্চিত হবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘তুরস্ক এখনো খৃস্টানদের ভাবমূর্তি সংরক্ষণ করবে। ঠিক যেমন আমাদের পূর্বপুরুষরা সকল খৃস্টানের মূল্যবোধ সংরক্ষণ করেছেন।’
একদিকে ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত আয়া সোফিয়ার বৈধ মালিকানা। অন্যদিকে প্রতিপক্ষের আপত্তির মুখে তুরস্কের সীমাহীন বিনয় ও উদারতার । এরপরও যদি কেউ আয়া সোফিয়ার বিষয়ে তুরস্কের পদক্ষেপকে ভুল বলতে চান, তাহলে তিনি জেগে থেকে ঘুমাচ্ছেন। তাকে ঘুম থেকে জাগানোর সাধ্য কারোরই নেই।
তথ্যসূত্র:
- উইকিপিডিয়া, বাংলা।
- ডয়েচে ভেলে, বাংলা।
- যুগান্তর, ১১ জুলাই ২০২০।
- প্রথম আলো, ১২ জুলাই ২০২০।
- কালের কণ্ঠ, ১৪ জুলাই ২০২০।
- ইসলাম টাইমস২৪.কম, ১৮ জুলাই ২০২০।
- ফাতেহ ২৪. কম, ১১ জুলাই ২০২০।
মাশা’আল্লাহ
amin, ya rabbal alamin!