মুফতী হাফিজুর রহমান
বায়েজীদ বোস্তামীর মাজার ও তাঁর অলৌকিক ক্ষমতাবলে জিন-পরীকে কচ্ছপে রূপান্তরিত হওয়ার চটকদার কাহিনির সত্যতা ইতিহাস সমর্থিত নয়। ‘এ মাজারটি সম্পর্কে একটি নিরপেক্ষ প্রতিবেদন পেশ করেছেন জনাব আবদুল মান্নান তালিব তার রচিত “বাংলাদেশে ইসলাম” নামক একটি গ্রন্থে। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে ইসলামিক ফউন্ডেশন বাংলাদেশ। সেই গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘প্রাচীন সুফী দরবেশদের মধ্য হতে খ্রিস্টীয় নবম শতকে পারস্যের বায়েজীদ বোস্তামীর (মৃত্যু ২৬১হি.) চট্টগ্রাম অঞ্চলে আগমনের কথা শোনা যায়। চট্টগ্রাম শহরের পাঁচ মাইল উত্তরে নাসিরাবাদ গ্রামের পর্বত চূড়ায় তার স্মারক সমাধিও দেখা যায়। জনশ্রুতি আছে যে তৎকালে এ অঞ্চল গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। জঙ্গলে হিংস্র জানোয়ার ও জিনদের বসবাস ছিল। হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) এ অঞ্চলে আগমন করে ইসলাম প্রচার করেন। ফলে এখানে জনবসতি গড়ে উঠে। অবশ্য জনশ্রুতির সত্যতা প্রমাণ করার মত কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। তবে একথা সবাই স্বীকার করেন যে, বায়েজীদ বোস্তামী (রহ.) এখানে ইন্তেকাল করেননি। পারস্যেও বোস্তাম নগরে ২৬১ হিজরীতে তাঁর ইন্তেকাল হয় এবং তথায় তাঁর সমাধি বিদ্যমান। বাংলাদেশে ইসলাম পৃঃ ১১১
এই প্রতিবেদন থেকে প্রতিভাত হল বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) এর মাজার নামে যে মাজার রয়েছে তা কবরশূন্য একটি কল্পিত মাজার।’ পয়গামে সুন্নত ১৪২৭-২৮ হি. পৃষ্ঠা ২১৫
পয়গামে সুন্নতে বাংলাদেশে ইসলাম গ্রন্থের উদ্ধৃতিতে বায়েজীদ বোস্তামীর বাংলাদেশে আগমন সম্বন্ধে যে জনশ্রুত তথ্যটি তুলে ধরা হয়েছে তা নিছকই জনশ্রুত এবং উদ্ভট কল্পকথা। ইতিহাসের সাথে এর সামান্যতম সংশ্লিষ্টতা নেই। খিজির আ. (শুদ্ধ হলো খাজির) এর মাজার, খিজির আ. এর খলীফার মাজার, কালু-গাজীর মাজার নামে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে বহু কাল্পনিক মাজার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বায়েজীদ বোস্তামীর মাজার ও এধরনের একটি কল্পিত মাজার। এর সাথে বাস্তবতার কোনো যোগসূত্র নেই। -খাইরুদ্দীন যিরিকলী, আলআ’লাম ৩/২৩৫, ইমাম যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১৩/৮৯
তাছাড়া বায়েজীদ বোস্তামী রাহ. যে বোস্তাম শহরে মৃত্যু বরণ করেছেন তা ঐতিহাসিক সত্য। এতে ন্যূনতম সন্দেহ করার অবকাশ নেই।
• যাকারিয়া বিন মুহাম্মদ কাযভীনী রাহ. বলেন, আবুল ফাতহ মুহাম্মদ বিন ফযল ইসফারায়িনী রাহ. দীর্ঘ একটা সময় বাগদাদে কাটিয়েছেন। যখন তিনি খুরাসানে ফিরে যাওয়ার মনস্থ করলেন। তখন তার শিষ্যরা তার বিদায়ের ব্যাপারে অনুযোগ করল। তখন তিনি বললেন, সম্ভবত আল্লাহ তা‘আলা চাচ্ছেন, আমার সমাধি একজন সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তির পাশে হবে। যখন তিনি বিস্তাম নগরীতে পৌঁছালেন তখন তার ইন্তেকাল হয়। এবং আবু ইয়াযীদ বিস্তামী রাহ. এর সমাধির পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। বিস্তামের সূফীবাদের পুরোধা ঈসা বিন ঈসা রাহ. বলেন, আমি স্বপ্নে আবু ইয়াযীদ কে দেখি, সে বলছে, আমাদের কাছে একজন মেহমান এসেছে। তাকে তোমরা সম্মান করো। সে সময় আবুল ফাতহ পৌঁছে গিয়েছিল। এবং মৃত্যু বরণ করে। আমি নিজের জন্য আবু ইয়াযীদ এর সমাধির পাশে একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে রেখেছিলাম। কিন্তু এক্ষেত্রে শায়খ আবুল ফাতহকে প্রাধান্য দেই। এবং তাকে আবু ইয়াযীদ এর পাশে সমাহিত করি।-যাকারিয়া বিন মুহাম্মদ কাযভীনী, আসারুল বিলাদ ওয়া আখবারুল ইবাদ ১/২০
• ইমাম যাহাবী রাহ. বলেন আবু ইয়াযীদ বিস্তাম নগরীতে ২৬১ হিজরীতে মৃত্যু বরণ করেন।-সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১৩/৮৯
• খাইরুদ্দীন যিরিকলী রাহ. বলেন, আবু ইয়াযীদ তাইফুর বিন ঈসা বিস্তামী ইরাক এবং খুরাসানের মধ্যবর্তী জনপদ বিস্তামের অধিবাসী ছিলেন। এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।-খাইরুদ্দীন যিরিকলী, আলআ’লাম ৩/২৩৫
উল্লেখ্য, বায়েযীদ বোস্তামীর মূল নাম হলো, আবু ইয়াযীদ তাইফুর বিন ঈসা আলবিস্তামী। কিন্তু লোক মুখে বায়েজীদ বোস্তামী হিসেবে প্রশিদ্ধ হয়ে গেছে। বোস্তামী মূলত বিস্তামী অথবা বাস্তামী হবে। বোস্তাম নামে পৃথিবীতে কোনো জনপদের নাম নেই। জনপদটি হলো বিস্তাম অথবা বাস্তাম। তবে অধিকাংশের মতে বিস্তামীই শুদ্ধ। বোস্তামী শব্দটি কায়েদায়ে বোগদাদীর মত ভুল পরিচিতি লাভ করে। অথচ শব্দটি হলো বাগদাদ। সুতরাং উপরোক্ত তথ্যবিবরণীতে প্রমাণিত হলো, চট্টগ্রামে বায়েজীদ বোস্তামী মাজার নামে যে মাজারটি রয়েছে তা একটি মিথ্যা এবং কাল্পনিক মাজার। এ মাজার যিয়ারতকে বৈধতা দেয়ার কোনোই সুযোগ নেই।