বিতর্ক সংলাপ : কাদিয়ানী এজেন্ডায় ঈসা আ. এর মৃত্যুবরণ

মুফতী হাফিজুর রহমান


১ম : ঈসা আ.মৃত্যু বরণ করের নি; আকাশে উত্তোলিত হয়েছেন।

২য় : ঈসা আ.মৃত্যুবরণ করেছেন; আকাশে উত্তোলিত হন নি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলছেন,

”আমিতাদের বলি নি তুমি যা আমাকে আদেশ করেছ তাছাড়া অন্য কিছু, যথা – ‘তোমরাআল্লাহ্‌রউপাসনা করো যিনি আমার প্রভু ও তোমাদের প্রভু’, আর আমিতাদেরসাক্ষী ছিলাম যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম, কিন্তু যখন তুমিআমার মৃত্যুঘটালে তখন তুমিই ছিলে তাদের উপরে প্রহরী। আর তুমিই হচ্ছোসব-কিছুরইসাক্ষী। সূরা মায়েদা১১৭ 

১ম: আয়াতাংশের অর্থ হলো, …..কিন্তু যখন তুমি আমাকে তুলে নিলে বালোকান্তরিত করলে তখন তুমিই ছিলে তাদের কার্যকলাপের তত্ত্বাবধায়ক। সূরা মায়েদা ১১৭

২য় :

পবিত্র কোরআনের এ  আয়াতেتَوَفَّيْتَنِي শব্দটি আছে। এর অর্থ মৃত্যু ঘটানো। জানাযার নামাযের দোয়ার মধ্যে এই শব্দটি আছে।

তাছাড়া, বিভিন্ন অনুবাদক এসব অর্থ লিখেছেন যেমন-

লোকান্তর : এক মুজিবলোকান্তরে লক্ষ

মুজিব ঘরে ঘরে এখানে লোকান্তার অর্থ কি?

উঠিয়ে নেয়া: তোরেআল্লাহ উঠিয়ে নিয়ে যায় না কেন? এখানে উঠিয়ে নেয়া অর্থ কি?

নিয়ে নেয়া:  আল্লাহ আমার দাদাকে নিয়ে গেছেন, এর অর্থ কি? এসবের অর্থ কি মৃত্যু নয়? 

১ম :

ঈসা আ. এর স্বাভাবিক মৃত্যু হলে আবার পৃথিবীতে আসতেন না। অথচ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, তিনি আবার পৃথিবীতে আগমন করবেন।

২য় :

“বরং তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন আল্লাহ তা’আলা নিজের কাছে।”  এখানে নিজের কাছে বলতে কি বোঝায়?আল্লাহ তো সর্বত্র বিরাজিত। আবারআল্লাহর আরশ তো সপ্ত আসমানের উপরে।  কখনো কখনো তিনি নিচের আসমানে নেমে আসেন বলে হাদীসে আছে। তবে২য় বা ৪র্থ আসমানে নয়।

দ্বিতীয়তঃ পবিত্রকুরআনের কোথাও  হযরত ঈসা আ. এর 2য় আগমনের কথা আছে কি?

হাদীস বাদে কোরআন কি একটি পূর্নাঙ্গ কিতাব?  কোরআন কি পূর্ণাঙ্গ কিতাব, নাকি হাদীস ছাড়া কোরআন পূর্ণাঙ্গতা পায় না। কোন টা ঠিক। কোরআন একটিপূর্নাঙ্গ কিতাব সেই কথা আল্লাহ্ পাক কোরআনে অনেক জায়গায় উল্লেখ করেছেন।যেমন সূরা নামল ২৭ আয়াত ৭৫ এ বলেছেন
وَمَا مِنْ غَائِبَةٍ فِي السَّمَاء وَالْأَرْضِ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ
অর্থ, আকাশে ও পৃথিবীতে এমন কোন গোপন ভেদ নেই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে না আছে।

১ম :

হাদীস হলো পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা। প্রতিটি মুমিনের জন্য এ হাদীস অনুসরণ করা আবশ্যক। সে হাদীসে এসেছে, ঈসা আ. পুনরায় পৃথিবীতে আগমন করবেন।

২য় :

ঠিক। নবীজী সা. কুরআনের ব্যাখ্যা। হাদীস নয়।

হাদীসে আছে ঈসা (আঃ) আবার পৃথিবীতে আসবেন, ঠিক আছে। তবে তিনি যে বনিইসরাইলের ঐ ঈসা নবীই এখানে এটা কিন্তু বলেননি।

সূরা সফের ৬ নং  وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُمَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّـهِ إِلَيْكُم مُّصَدِّقًالِّمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِنبَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ ۖঅর্থ:আরস্মরণ করো! মরিময়পুত্র ঈসাবলেছিলেন — ”হে ইসরাইলের বংশধরগণ! আমিনিশ্চয়ই তোমাদের নিকট আল্লাহ্‌ররসূল, আমার সমক্ষে তওরাতে যা রয়েছে আমিতার সমর্থনকারী, আর সুসংবাদদাতাএমন এক রসূল সন্বন্ধেযিনি আমার পরে আসবেন,তাঁর নাম ‘আহ্‌মদ’।’’

এখানে ঈসা আ. বলেছেন, আমার পরে আসবেন তার নাম আহমদ অর্থাৎ মুহাম্মদ সা.

পরেবলতে বেচে থাকতে বোঝা যায় কি? তাছাড়া নিম্নের আয়াতে বোঝা যায় সকল নবী গতহয়ে গেছেন অর্থাৎ মারা গেছেন। নবীজী সা. ইন্তেকালের পরে আবু বকর সিদ্দিকএই আয়াতটি পাঠ করে সকলকে সান্তনা দিয়েছিলেন।

সূরা আল এমরানের144 নং আয়াতوَمَامُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِهِ الرُّسُلُ ۚ أَفَإِنمَّاتَ أَوْ قُتِلَ انقَلَبْتُمْ عَلَىٰ أَعْقَابِكُمْ ۚ وَمَن يَنقَلِبْعَلَىٰ عَقِبَيْهِ فَلَن يَضُرَّ اللَّـهَ شَيْئًا ۗ وَسَيَجْزِي اللَّـهُالشَّاكِرِينَ.আরমুহাম্মদ একজনরসূল বৈ তো নন। নিঃসন্দেহ তাঁর পূর্বে রসূলগণ গত হয়েগেছেন। অতএব তিনি যদি মারাযান অথবা তাঁকে কাতল করা হয় তাহলে কি তোমরাতোমাদের গোড়ালির উপরে মোড়ফেরাবে/পিছপা হবে? আর যে কেউ তার গোড়ালিরউপরে মোড় ফেরে সে কিন্তু, আর আল্লাহ্ অচিরেইপুরস্কার দেবেন কৃতজ্ঞদের।

৩য় :

ভাই ! আপনাকে বিনীতভাবে কয়েকটি প্রশ্ন করবো। আশা করি উত্তর দিয়ে বাধিত করবেন।

১। আপনি কি হাদীসকে ইসলামী শরীয়াতের দ্বিতীয় প্রমাণসূত্র হিসেবে স্বীকার করেন ?

২। মাইন্ড না করলে আরেকটা বিষয় জানতে চাই। আপনার ধর্মমতটা আমাদেরকে অনুগ্রহ করে একটু জানাবেন। এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পেলে আপনার সাথে সংলাপকরাআমাদের জন্য সহজ হবে। ধন্যবাদ ভাই। অনেক অনেক ভাল থাকুন।

২য় :

ধন্যবাদ, আপনার প্রশ্নের উত্তরগুলি :

১। একজন মুসলিম হিসেবে অবশ্যই আমি হাদীসকে 2য় প্রমাণ সূত্রে হিসাবে স্বীকার করি। তবে, ১ম নয়।

২। ধর্মমত বলতে কি বলছেন,  বুঝতে পারি নি। তবে আমি জন্ম সূত্রে একজন হানাফী মুসলিম। 

আমার এক বড় ভাই (এলাকার) আছে। তিনি আমাকে ঈসা আ. সম্পর্কে এরকম কোরআনেরআয়াতগুলি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। নতুবা আমার বিশ্বাসও আগে আপনারমতই ছিল। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আমার-আপনার সকলের সঠিক জ্ঞান লাভ করারতৌফিক দান করুন। 

৩য় :

ভাই ! ঈসা আ. আকাশে উত্তোলিত হয়েছেন না স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন এ বিতর্কটা খুব বেশি পুরনো নয়। নতুন নুবওয়াত দাবির সাথে এ বিতর্কটা ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। নতুন নবুওয়াত দাবির মূল ফাউন্ডেশন বলা চলে এ বিতর্কটাকে। এ বিতর্কটাকে একটু দাঁড় করানো গেলে নবুওয়াত বা নবী দাবির বিষয়টিকে আম জনতার মাঝে ক্ষুদ্রাকারে হলেও প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। গোলাম আহমদ কাদিয়ানী সাহেব তার নবীত্বকে প্রমাণ করার জন্য এ বিতর্কটাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি কুরআন হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা করে বলতে চেয়েছেন, বস্তুত ঈসা আ. স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁকে ঊর্ধ্বাকাশে তুলে নেয়া হয় নি। প্রতিশ্রুত যে মাসীহ এর আগমনের কথা  হাদীসে বলা হয়েছে সে বস্তুত মারইয়াম আ. তনয় ঈসা আ. নন; অন্য কেউ। সুতরাং এ দাবির আলোকে নিজেকে প্রতিশ্রুত মাসীহ বলে দাবি করতে তাকে তেমন বেগ পেতে হবে না। যদি প্রমাণ করা যায়, ঈসা আ. স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন; আকাশে উত্তোলিত হয় নি তাহলে খুব সহজেই ঈসা আ. এর পুনরাগমন এবং তাঁর আকাশ হতে অবতরণকে অস্বীকার করা যাবে। যে ব্যক্তি ভুল ব্যাখ্যা ও বিতর্কের ডামাডোলে উপরোক্ত বিষয়টিকে মেনে নিবে তার জন্য গোলাম সাহেবকে নবী হিসেবে মেনে নিতে কষ্ট হবে না। এ বিতর্ক নিয়ে এ যাবত অনেক আলোচনা হয়েছে। মুসলিম গবেষকগণ এ বিষয় নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। এ জায়গাটিতে এসে খ্রীষ্টান এবং কাদিয়ানী সম্প্রদায় অনেকটা একাকার হয়ে যান। বিশিষ্ট মুসলিম স্কলার আহমদ দিদাদ রহ. খ্রিষ্টানদের সাথে এ বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক করেছেন। তার সে ভিডিও ইউটিউবে সহজলভ্য।

ভাই ! আপনাকে যে ব্যক্তিটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে ঈসা আ. এর স্বাভাবিক মৃত্যুর বিষয়টি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন আপনি কৌশলে তার ধর্মমত সম্বন্ধে একটু ধারণা লাভ করুন। হয় তিনি খ্রিষ্টান, নয় কাদিয়ানী। অন্যথায় তিনি এ দু গ্রুপের কোনো একটির পাতা ফাঁদে পা দিয়েছেন। এবং আপনাকেও সে ফাঁদে ফেলতে পেরেছেন বলে আমার প্রবল ধারণা হয়। একজন সচেতন ও বিজ্ঞ মুসলিম হিসেবে আপনার জন্য করণীয় ছিল তার বুঝগুলোকে গ্রহণ করার পূর্বে বিপরীত মতটি সম্বন্ধেও সাম্যক ধারণা লাভ করা। নেট সার্চ করলেই এ সম্বন্ধে প্রচুর নিবন্ধ ও আলোচনার সমাহার লাভ করতে পারতেন। অবশ্য এ কাজটি এখনো করার অবকাশ রয়েছে।

এবার আপনারমন্তব্যগুলো নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।

১। পবিত্র কুরআনের تَوَفَّيْتَنِي শব্দটি দ্বারা আপনি প্রমাণ করতে চাচ্ছেন, ঈসা আ. স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন; উত্তোলিত হননি। কুরআনের উপরোক্ত ক্রিয়া পদটির ধাতুগত অর্থ সম্বন্ধে আলোচনার পূর্বে একটি বিষয় আমাদের সকলেরই জেনে রাখা প্রয়োজন, মৃত্যু মানে জীবনের পরিসমাপ্তি নয়; বরং মৃত্যু মানে জীবনের আবর্তন। জাগতিক এ জীবনকে ইহজীবন বলাহয়। মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে বারযাখী জীবন বা পরজীবন বলা হয়। মৃত্যুর একটি আরবীসমর্থক শব্দ হলো ইন্তেকাল। এর অর্থ স্থানান্তরিত হওয়া বা কালান্তরিত হওয়া। সুতরাং মৃত্যু মানে জীবনান্তরিত হওয়া, এক জীবন থেকে অন্যজীবনে প্রত্যাবর্তন করা। জীবনান্তরের ব্যাপারটি পৃথিবীর সকল মানুষের জীবনে ঘটেছে বা ঘটবে।

তবে সকলের জীবনান্তরের ধরণ এবং জীবনান্তরোত্তর অবস্থার ধরণ এক নয়। রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনান্তরিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর জীবনান্তরোত্তর অবস্থা আর অন্যদের জীবনান্তরোত্তর অবস্থা এক নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরজীবন বা কবর জীবনের সাথে ইহজীবনের বেশ সাযুজ্য বিদ্যমান। যেটা অন্যদের ক্ষেত্রে নেই। তদ্রূপ ঈসা আ. জীবনান্তরিত হয়েছেন। কিন্তু তার জীবনান্তরিত হওয়ার ধরণ আর অন্যদের জীবনান্তরিত হওয়ার ধরণ এক নয়। তিনি বিশেষ ব্যবস্থাপনায় আকাশে উত্তোলিত হওয়ার মাধ্যমে ইহজীবন পরিবর্তন করেছেন। সুতরাং কুরআনের উপরোক্ত ক্রিয়াপদের প্রচলিত অর্থ মৃত্যুবরণও যদি করা হয় তাহলেও ঈসা আ. এর আকাশে উত্তোলিত হওয়ার ব্যাপারটিকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

تَوَفَّيْتَنِي ক্রিয়া পদটির ধাতুগত বিশ্লেষণ :

পবিত্র কুরানের দুটি জায়গায় মাসীহ ঈসা (আ.) সম্পর্কে تَوَفَّي-‘তাওয়াফফা‘ ক্রিয়াপদটি ব্যবহৃত হয়েছে। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত নং ৫৫ আর সূরা আল-মায়েদা : আয়াত নং ১১৭ দ্রষ্টব্য)।

আরবী শব্দপ্রকরণ শাস্ত্র মতে তাওয়াফফা ক্রিয়াপদটির ধাতুমূল হলো ওয়াও, ফা, ইয়া। এ ধাতুমূল থেকেই তাওয়াফফা শব্দটি গঠিত হয়েছে। এ ধাতুমূলের ক্রিয়ামূল হলো আলওয়াফউ- الوفي। এ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো, পূরণ করা, পূর্ণ করা, সম্পন্ন করা। সুতরাং الوفيক্রিয়ামূলের বর্ধিত রূপ تَوَفَّي এর মূলানুগ, আভিধানিক ও প্রকৃত অর্থ হলো, পাওয়া, লাভ করা, পূর্ণ করা, পুরোপুরি নিয়ে নেয়া। আর তাওয়াফফা ক্রিয়ামূলের রূপক অর্থ হলো মৃত্যু দান করা, মৃত্যু ঘটানো। বিখ্যাত আরবী অভিধান গ্রন্থগুলোতে আছে,توفاه استكمله । অর্থাৎ তাওয়াফফা অর্থ পরিপূর্ণ করা, পরিপূর্ণ নিয়ে নেয়া। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন, আরবি অভিধানে “তাওয়াফফা” শব্দটির অর্থ ‘আল-ইসতীফা’ (পরিপূর্ণ করা, সমাপন করা) এবং ‘কবজ’ (গ্রহণ করা)। এটা তিন ধরনের হয়ে থাকে। (এক) নিদ্রা যাওয়া অর্থে তাওয়াফফা। (দুই) মৃত্যুবরণ অর্থে তাওয়াফফা এবং (তিন) রূহ আর শরীর দুটোর সমষ্টিগত স্থানান্তর অর্থে তাওয়াফফা। ঈসা (আ.) তৃতীয় প্রকারের তাওয়াফফা’র মাধ্যমে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। (সূত্র : ইবনে তাইমিয়্যাহ রচিত ‘আল-জাওয়াবুস সহীহ : ২/২৮০)।

উল্লেখ্য, ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. কাদিয়ানীদের তালিকাভুক্ত মুজাদ্দিদদের একজন।

সুতরাং প্রতীয়মান হলো যে, শব্দটির হাকীকী বা প্রকৃত অর্থ ‘মৃত্যু দেয়া নয়, বরং এর প্রকৃত অর্থ হলো,أخذ الشيئ وافيا -(কোনো জিনিস পুরোপুরি নিয়ে নেয়া)

হাসান বসরী রহ. বলেন,

 الوفاة-(ওফাত) শব্দটি  পবিত্রকুরানে৩টিঅর্থেব্যবহৃতহয়েছে। (১)  ‘মৃত্যু’। যেমন আল্লাহতালা ইরশাদ করেন,{ الله يتوفى الأنفس حين موتها} তথা আল্লাহ মানুষের প্রাণ হরণ করেন তার মৃত্যুর সময় -(সূরা যুমার : ৪২)। (২) ‘নিদ্রা’। যেমন আল্লাহতালা ইরশাদ করেছেন,  { وهو الذي يتوفاكم بالليل} তথা তিনি সেই সত্তা যিনি রাত্রিবেলায় তোমাদের নিদ্রা দেন।’ (সূরা আন’আম : ৬০)। (৩) ‘পুরোপুরি উঠিয়ে নেয়া। যেমন – আল্লাহতালা’র ইরশাদ : {فلما توفيتني{إذقال الله يا عيسى إني متوفيك}}

তথা যখন আপনিআমাকে পুরোপুরি নিয়ে নিলেন -(সূরা মায়েদা : ১১৭); যখন আল্লাহ বললেন,হে ঈসা! নিশ্চয়আমি তোমাকে পুরোপুরি নিয়ে নেব -(সূরা আলে ইমরান : ৫৫)। ফাতহুল ক কাদীর ২/৯৫; ইমাম মুহাম্মদইবনে আলী আশ-শাওক্বানী রহঃ।

হাসান বসরী রহ. আরো বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জনৈক ইহুদীকে বলেন :  নিশ্চয়ঈসামাসীহমৃত্যুবরণকরেননি। তিনি নিশ্চয় কেয়ামতের পূর্বে তোমাদের নিকট ফিরে আসবেন। তাফসীরে ইবনে আবি হাতেম, হাদীস ৬২৬৬

উল্লেখ্য, ইমাম হাসান বসরী রহ. কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের তালিকাভুক্ত মুজাদ্দিদদের অন্যতম ব্যক্তিত্ব।

সারকথা, আল্লাহতালা’র ইরশাদ (কেয়ামতের দিবসে ঈসা ইবনে মরিয়াম প্রভুর উদ্দেশ্যে বলবেন) : { فلما توفيتني} এর অর্থ হবে, “আর যখন আপনি আমাকে পুরোপুরি নিয়ে নিলেন” -(সূরা মায়েদা : ১১৭)। এরপর  { إذ قال الله يا عيسى إني متوفيك} -এর অর্থ হবে  “যখন আল্লাহ বললেন, হে ঈসা! নিশ্চয় আমি তোমাকে পুরোপুরি নিয়ে নেব।” (সূরা আলে ইমরান : ৫৫)। 

২।আপনি বলেছেন,

‘বরং তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন আল্লাহ তা’আলা নিজের কাছে।”  এখানে নিজের কাছে বলতে কি বোঝায়? আল্লাহ তো সর্বত্র বিরাজিত। আবারআল্লাহর আরশ তো সপ্ত আসমানের উপরে।  কখনো কখনো তিনি নিচের আসমানে নেমে আসেন বলে হাদীসে আছে। তবে২য় বা ৪র্থ আসমানে নয়।

২য়তঃ পবিত্র কুরআনের কোথাও  হযরত ঈসা আ. এর 2য় আগমনের কথা আছে কি?

হাদীস বাদে কোরআন কি একটি পূর্নাঙ্গ কিতাব?  কোরআন কি পূর্ণাঙ্গ কিতাব, নাকি হাদীস ছাড়া কোরআন পূর্ণাঙ্গতা পায় না। কোন টা ঠিক। কোরআন একটি পূর্নাঙ্গ কিতাব সেই কথা আল্লাহ্ পাক কোরআনে অনেক জায়গায় উল্লেখ করেছেন। যেমন সূরা নামল ২৭ আয়াত ৭৫ এ বলেছেন
وَمَا مِنْ غَائِبَةٍ فِي السَّمَاء وَالْأَرْضِ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ
অর্থঃ আকাশে ও পৃথিবীতে এমন কোন গোপন ভেদ নেই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে না আছে।’

উত্তর : ১। ভাই ! আল্লাহ তাআলা সর্বত্র বিরাজমান কি বিরাজমান নন এবং বিরাজমান হলে তার রূপরেখা কি ? এটি একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। সে আলোচনায় আপাতত যাচ্ছি না। আপনার কথা মত সর্বত্র বিরাজমান হলে ভূমণ্ডল নভোমণ্ডলের যেখানেই ঈসা আ. কে নেয়া হবে সেখানেই তিনিআল্লাহর নিজের কাছে বলে গণ্য হবে। আশা করি বিষয়টি উপলব্ধি করতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয়। উপরন্তু সহীহ হাদীসে আছে, ঈসা আ. দ্বিতীয় আসমানে অবস্থান করছেন। সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৯ (ইসরা অধ্যায়)। সুতরাং পবিত্র কুরআনের ‘নিজের কাছে” এর ব্যাখ্যা হাদীসের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হলো।

২। পবিত্র কুরআনের কোথাও ঈসা আ. এর দ্বিতীয় আগমনের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। হাদীসে আছে, ঈসা আ. দ্বিতীয়বার পৃথিবীতে আগমন করবেন। কোনো বিষয় যদি কুরআনে না থাকে কিন্তু হাদীসে থাকে তাহলে সেটা মানতে হবে। কারণ হাদীস ইসলামী শরীয়াতের দ্বিতীয় প্রমাণসূত্র।

হাদীস বাদে কুরআন অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। তবে সেটা মৌলিকভাবে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হলো হাদীস সমগ্র। পবিত্র কুরআন হলো শেকড় আর হাদীস হলো তার কাণ্ড ও শাখা প্রশাখা। অন্য দিকে পবিত্র কুরআনে একাধিকবার হাদীসের বাণী মেনে চলার ব্যাপারটি বেশ গুরুত্বসহকারে উল্লেখিত হয়েছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে হাদীস বাদে শুধু কুরআনকে মেনে চলার কোনো সুযোগ নেই। শুধু কুরআনকে সার্বিক বিবেচনায় পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান করা হলে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের কথা পবিত্র কুরআনের কোথাও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয় নি। যে কারণে আহলে কুরআন তথা মুনকিরীনে হাদীস বা হাদীস অস্বীকারকারী সম্প্রদায় (প্রাচ্যবাদে দীক্ষিত সম্প্রদায়) পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে না। তারা কুরআনকেই ইসলামের একমাত্র মান্য গ্রন্থ মনে করে; অন্য কিছুকে নয়।

আর আপনার উল্লেখিত আয়াতটির অর্থ হলো আকাশ পৃথিবীর সবকিছুই পবিত্র কুরআনে মৌলিকভাবে উল্লেখিত হয়েছে। এর অর্থ এই নয়, আপনার ঘরের দরজা জানালা, হান্ডি পাতিল সবকিছুই পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে।

৩। আপনি বলেছেন,

‘ঠিক। নবীজী সা. কুরআনের ব্যাখ্যা। হাদীস নয়।

হাদীসে আছে ঈসা (আঃ) আবার পৃথিবীতে আসবেন, ঠিক আছে। তবে তিনি যে বনিইসরাইলের ঐ ঈসা নবীই এখানে এটা কিন্তু বলেননি।

উত্তর : আপনার এ কথার ক্ষেত্রে ‘ডাল মেঁ কুস কালা মালুম হোতা হ্যঁয়’ প্রবাদটি প্রযোজ্য। আপনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর বাণী তথা হাদীসের মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করতে চাইছেন। এটাই আহলে কুরআন এবং মুনকিরীনে হাদীসের মূল ফাউন্ডেশন। আপনার বিশ্বাস যদি এমনটিই হয় তাহলে আপনার সাথে বিতর্কের দীর্ঘমেয়াদী আরেকটি পর্ব দাঁড় করাতে হবে। কিন্তু আপনি দ্বিতীয় লাইনে গিয়ে বলছেন, হাদীসে আছে ঈসা (আঃ) আবার পৃথিবীতে আসবেন, ঠিক আছে। এখানে তো প্রচণ্ড রকমের একটি সংঘর্ষ লেগে গেল। খুব বেশি স্ববিরোধী হয়ে গেল। উপরন্তু আপনি আমাকে বেশ স্পষ্ট করেই বলেছেন, একজন মুসলিম হিসেবে অবশ্যই আমি হাদীসকে 2য় প্রমাণ সূত্র হিসাবে স্বীকার করি। তাহলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের ব্যাখ্য; হাদীস নয়।– আপনার এ কথার অর্থ কি ? বুঝিয়ে বলবেন কি ?

‘তবে তিনি যে বনিইসরাইলের ঐ ঈসা নবীই এখানে এটা কিন্তু বলেননি।’

ভাই ! আপনি এ কি কথা বললেন ? খুব বেশি ছেলে মানুষী ব্যাপার হয়ে গেল না ? ইসলাম বিষয়ে সামান্য জানা শোনা থাকলেও এমন অগভীর কথা বলার কথা নয়। হাদীসে ঈসা ইবনে মারইয়াম শব্দটিই এসেছে। তাহলে কি আপনার বিশ্বাসের জন্য বনী ইসরাইল শব্দটি যুক্ত করা প্রয়োজন ছিল ? এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না। বস্তুত সব প্রশ্নের উত্তর দেয়াও এক ধরণের বোকামো বলে মনে হয়।

৪। আপনি বলেছেন,

‘আমার পরে মানে কি আমি বেচে থাকতে । মুসা. আ.এর কবরও তো পাওযা যায না। আর যেখানে পবিত্র কুরআনে রয়েছে– নিঃসন্দেহ তাঁর (মুহাম্মদ স.) পূর্বে রসূলগণ গত হয়ে গেছেন। সূরা আল এমরানের 144’

উত্তর : আমার পরে মানে তো সবধরনের চলে যাওয়ার পরে বুঝায়। শুধু স্বাভাবিক মৃত্যুর মাধ্যমেই চলে যাওয়ার পরে বুঝায় না। তদ্রূপ গত হয়ে যাওয়া তো একটি ব্যাপকভিত্তিক শব্দ। এখানে সবধরণের গত হওয়াই চলে আসে। ভাই এ বিষটি খুবই অগভীর বলে মনে হলো। এ মনে হওয়ার ক্ষেত্রে আমার সীমাবদ্ধতাও দায়ী হতে পারে।

ভাই ! আপনি যদি কাদিয়ানী ধর্মমত গ্রহণ করে থাকেন তাহলে আপনার সাথে বিতর্কের ধরন পাল্টে যাবে। আশা করি উত্তর দিবেন। ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।

সর্বশেষে আপনার প্রার্থনা বাক্য দিয়েই পর্যালোচনার ইতি টানছি-আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আমাকে-আপনাকে সকলকে সঠিক জ্ঞান লাভ করার তাওফিক দান করুন। 

২য় :

প্রিয় ভাই, আপনার লেখাগুলো পড়লাম।  ভাল  লাগল। আপনার  অবগতির জন্যজানিয়ে রাখছি যে, আমার একবন্ধু  প্রায়ই আমার কাছে আসতো এবং কোরআন হাদীসচর্চার নামে আমার সাথে  এসব  বিষয়ে আলাপ করত।পরে জানলাম সে কাদিয়ানী  মতগ্রহণ করেছে।

১ম.

ভাই ! এক সাগর মুগ্ধতা শুধু আপনারই জন্য। খুব বেশি প্রীতহলাম। আমার সংশয়ের সবটুকু শঙ্কা কেটে গেল। অনেক অনেক ভাল থাকুন।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *