মুফতী হাফিজুর রহমান
সূচনা কথা
কালচার ও রিলিজন। এ দুইয়ের পারস্পরিক সম্পৃক্তি আছে কি নেই, বিভিন্ন বলয়ে এ নিয়ে নানা কথার উদ্গীরণ হয়। সংস্কৃতিকাতুরে কিছু মানুষ সংস্কৃতিকে স্বতন্ত্র একটি ধর্মের রূপ দিতে চান, ‘দীনে ইলাহী’র মত যেখানে সকল ধর্ম-পেশার মানুষ একাকার হয়ে যাবে। সংস্কৃতিপন্থীদের প্রতিপাদ্য দাবি হলো, সংস্কৃতিকে প্রচলিত ধর্মের মত করে শ্রেণীবদ্ধ করে ফেলা যাবে না। একে সর্বজনীনতার রূপ দিয়ে পালন করতে হবে।
এ দেশীয় কথিত সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পহেলা বৈশাখ এক আলোচিত নাম। বলা চলে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রধানতম আসনটিই অলঙ্কৃত করে আছে এ পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখের মত এ সাংস্কৃতিক যজ্ঞের সাথে ধর্মীয় সম্পৃক্তি আছে কি নেই? এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে একটু গভীরে যেতে চেষ্টা করবো।
বৈশাখ নামের ব্যবচ্ছেদ
বৈশাখ এখন একটি নাম। এ নামে আপাতত আমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়। নাম সে তো নামই। পরিচয়ের মাধ্যম। কোনো কিছুর পরিচয় তুলে ধরতে নামের জুড়ি নেই। নামকরণে অবশ্য আবেগ, অনুভূতি, বিশ্বাস ইত্যাকার নানা বিষয়-আশয়ের বিরাট দখল থাকে। কখনো আবার অপরিকল্পিতভাবেই কোনো নামের সৃষ্টি হয়। সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের বিশেষ ধর্মীয় শব্দ যোগে আমাদের দেশে জায়গা-অঞ্চলগত নামের অভাব নেই। কারণ ইতিহাস বলে, এ অঞ্চল একসময় সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের অভয়ারণ্য ছিল। এ দেশের সিংহভাগ মুসলিমের বংশলতিকা ধরে এগোতে থাকলে একসময় সনাতনী কিংবা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নাম চলে আসবে। এ কারণে ভারতে ‘ঘর ওয়াপসি’ নামে একটি গ্রুপ দাঁড়িয়ে গিয়েছে। তারা বলে, মুসলিম! তুমি তো আমাদের। তুমি আপন ঘরে চলে এসো। মুসলিমদেরকে আপন (?) ঘরে ফিরিয়ে নিতে বেশ কসরত করে যাচ্ছে তারা। মুসলিমরা আঁধার থেকে আলোর পথে এসেছে। আবার আঁধারে ফিরে যাবে? মুসলিমরা এতোটা বোকা হয়তো এখনো হয়নি। আমরা অবশ্য তাদের সাথে সহমত পোষণ করে আরেকটি ঘর ওয়াপসি গ্রুপ দাঁড় করাতে পারি। সেখানে আমরা খুব সহজেই বলতে পারি, এ পৃথিবীর সকল মানুষ আদমের সন্তান। আদম আলাইহিস সালামই হলেন আমাদের আসল ঠিকানা, আসল ঘর। চলো আমরা সে ঘরেই ফিরে যাই!
বৈশাখ খণ্ডিত কিছু সময়ের একটি নামমাত্র। বৈশাখ নামের যে সময়গুলো চলে যায় তা আর ফিরে আসে না। শুধু নামটি পরবর্তীতে আসা কিছু খণ্ডিত সময়ের সাথে যুক্ত হয়। বৈশাখ নামকরণে সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের ঘরোয়া বিশ্বাসের ছাপ পড়েছে নিবিড়ভাবে। কারণ বৈশাখ মানে বিশাখা সম্বন্ধীয়। বিশাখার আভিধানিক অর্থ কা- বা শাখাহীন বৃক্ষ। হিন্দু দেবতা ব্রহ্মার পুত্র দক্ষ। এ দক্ষের কন্যা হলো বিশাখা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এ বিশাখা দেবীর নাম থেকেই বৈশাখ নামের সৃষ্টি। অন্য একটি সূত্র মতে বিশাখা বুদ্ধের বিশিষ্ট এক নারী শিষ্যের নাম। হতে পারে এ নাম হতে বৈশাখ নামের সৃষ্টি। এখন ‘এসো হে বৈশাখ’ বলে শুধু নতুন একটি মাসকে আহ্বান করা হচ্ছে, নাকি বিশাখা দেবী বা দেবী বিষয়ক কোনো কিছুকে আহ্বান করা হচ্ছে সেটা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। এসো হে বৈশাখ… কবিতার রচয়িতা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ব্রহ্ম ধর্মালম্বী ছিলেন। তিনি তার বিশ্বাস নিয়ে কবিতা লিখেছেন এবং বৈশাখকে ডেকেছেন। কিন্তু একজন অমুসলিম কবির ধর্মীয় বোধ-বিশ্বাস থেকে উৎসারিত কবিতা তো আমরা মুসলিমরা পাঠ করতে পারি না!
মঙ্গলশোভাযাত্রা আসলে কী?
মঙ্গলশোভাযাত্রা এখন পহেলা বৈশাখের প্রধানতম অনুষঙ্গ। একসময় পহেলা বৈশাখে এর সংযুক্তি দৃশ্যমান ছিলো না। তখন ব্যবসাকেন্দ্রিক পহেলা বৈশাখের একটা রূপ দেখা যেত। নগরকেন্দ্রিক এর স্বতন্ত্র কোনো বহিঃপ্রকাশ ছিলো না। কিন্তু এখন আমরা পহেলা বৈশাখ কেন্দ্রিক মঙ্গলশোভাযাত্রা নামে বড় ধরনের একটা আপত্তিকর আয়োজন প্রত্যক্ষ করি। এ সংযুক্তি কেন? কোথা থেকে এলো?
এক. মঙ্গল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে- (ক) কল্যাণ, (খ) সপ্তাহের চতুর্থ দিবসের নাম, (গ) সৌরজগতের একটি গ্রহের নাম। সাধারণত মঙ্গলের এ তিনটি অর্থই ব্যবহৃত হয়। তবে মঙ্গল শব্দটির শক্তিশালী একটি ধর্মীয় দিকও রয়েছে। সনাতনী ধর্মাচারে মঙ্গল শব্দের বহু কীর্তি বিদ্যমান। এবার দেখা যাক, হিন্দু ধর্মাচারে মঙ্গল শব্দের ধর্মীয় রূপ কী?
১। মূর্তিপূজক সম্প্রদায়ের নিকট মঙ্গল নামে একজন দেবতা রয়েছে। মঙ্গল হলো, যৌনতা, যুদ্ধ এবং শক্তির দেবতা।
২। হিন্দু ধর্মের মধ্যযুগীয় আখ্যানকবিতাকে মঙ্গলকাব্য নামে অভিহিত করা হয়। যে কাব্যে দেবতাদের আরাধনা হয়, মাহাত্ম্য ও গুণকীর্তন হয়, যে কাব্য শ্রবণে মঙ্গল হয় এবং যে কাব্য গৃহে রক্ষিত হলে মঙ্গল সাধিত হয় তাকেই মঙ্গলকাব্য নামে অভিহিত করা হয়। মঙ্গলকাব্য আবার তিন শাখায় বিভক্ত। মনসামঙ্গল, চণ্ডিমঙ্গল ও অন্যদামঙ্গল।
৩। পূজার সময় যে পাত্র ব্যবহার করা হয় তাকে বলা হয় মঙ্গলঘট।
৪। বিশেষ পূজার জন্য যে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয় তাকে বলা হয় মঙ্গলপ্রদীপ।
৫। পূজার সময় মঙ্গলপ্রদীপ ঘুরিয়ে যে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটানো হয় তাকে বলা হয় মঙ্গল আরতি।
৬। হিন্দু ধর্মাচারে বিশেষ একটি পূজা রয়েছে যার নাম মঙ্গলপূজা।
৭। হিন্দু ধর্মে বিবাহের প্রথম আচারের নাম হলো মঙ্গলাচরণ।
৮। হিন্দু ধর্মে বিবাহকালে সূর্যোদয়ের পূর্বে বর-কনেকে চিড়ে ও দধি আহার করানো হয়, যাকে দধিমঙ্গল নামে অভিহিত করা হয়।
৯। হিন্দু ধর্ম মতে বিপদ হতে রক্ষাকামনায় প্রিয়জনের মণিবন্ধে যে সূতা বেঁধে দেয়া হয় তাকে বলা হয় মঙ্গলসূত্র বা রাখি।
১০। সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী উৎসব উপলক্ষে যে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয় তাকে বলা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।
দুই. শোভা অর্থ সৌন্দর্য, কান্তি, বাহার, সৌন্দর্যের বা উজ্জ্বলতার বিকাশ।
তিন. যাত্রা অর্থ গমন, প্রস্থান, নির্গমন, অতিবাহন, যাপন, নির্বাহ, দেবতার উৎসবাদি। শোভাযাত্রা মানে বহুলোকের একত্রে সমারোহের সহিত গমন।
যাত্রা শব্দটির আভিধানিক অর্থের মাঝেই হিন্দুধর্মীয় ভাবার্থ বিদ্যমান। উইকিপিডিয়া যাত্রা শব্দটির ধর্মীয় রূপটিকে আরো পরিষ্কার করে দিয়েছে। উইকিপিডিয়া বলছে, যাত্রা শব্দের ইংরেজি রূপ হলো Yatra। সংস্কৃতি ভাষায় বলা হয় यात्रा। বাংলায় আমরা লিখি যাত্রা। যাত্রার সংজ্ঞায় উইকিপিডিয়া বলছে, Yātrā (Sanskrit: यात्रा, ‘journey’, ‘procession’, in Hinduism and other Indian religions, generally means pilgrimage to holy places such as confluences of sacred rivers, places associated with Hindu epics such as the Mahabharata and Ramayana, and other sacred pilgrimage sites. (https://en.wikipedia.org/wiki/Yatra)
অর্থাৎ যাত্রা শব্দটি ব্যবহৃত হয় সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় কোনো কাজে গমনার্থে। সুতরাং মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়, মঙ্গলশোভাযাত্রা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি বিশেষ ধর্মীয় অনুষঙ্গ। মিডিয়ায় সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের মঙ্গলশোভাযাত্রার বহু চিত্র প্রত্যক্ষ করা যায়। তাতে সম্মুখ ভাগের ব্যানারে লেখা থাকে, ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী উৎসব উপলক্ষে মঙ্গলশোভাযাত্রা’। সচেতন বোদ্ধাদের বোধ হয় অতিরিক্ত আর প্রমাণের প্রয়োজন হবে না। (https://www.facebook.com/noyonchatterjee5/ posts/352298235171846)। এসব সূত্র সামনে রেখে কি বলা সম্ভব মঙ্গলশোভাযাত্রা একটি অসাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠান?
মঙ্গলশোভাযাত্রায় বাঘ-পেঁচার মূর্তি
অনেকে বলেন, মঙ্গলশোভাযাত্রায় ব্যবহৃত নির্দিষ্ট পশু-পাখির প্রতীকগুলো এ দেশের ন্যাশনালিটি ধারণ করে। আসলে কি তাই? ঢাবির চারুকলা অনুষদের ডিন ড. নিসার হোসেন দৈনিক সমকালে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ১৯৮৯ সালের প্রথম শোভাযাত্রার ঘোড়া ও বিশাল বাঘের মুখ এবারের শোভাযাত্রায় থাকছে। থাকছে সমৃদ্ধির প্রতীক হাতি। (http://bit.ly/ 2nMISkj) ডিন মহোদয় বলছেন, হাতি হচ্ছে সমৃদ্ধির প্রতীক। আর আমরা বলছি, না, এটা আবহমান গ্রাম বাংলার প্রতীক। কারটা সত্য? ভারতীয় (http://bit.ly/2nsiHvU) এ লিংকটিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, হিন্দু ধর্ম মতে গনেশ তথা হাতি হচ্ছে সমৃদ্ধির প্রতীক। (https://www.facebook.com/noyonchatterjee5/photos/a.296717957396541.1073741828.249163178818686/353737258361277/?type=3&theater)
১৪.৪.’১৪ ইং তারিখে ‘লক্ষ্মীপেঁচায় সমৃদ্ধি, গাজী ও বাঘ দুঃসময়ের কাণ্ডারী’ শিরোনামে bdnews24.com এর অনলাইন পোর্টালে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, লোকজ ঐতিহ্যের নানা প্রতীক নিয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রত্যাশায় করা এই শোভাযাত্রায় স্থান পেয়েছে- মা ও শিশু, হাঁস ও মাছের ঝাঁক, বিড়ালের মুখে চিংড়ি, শখের হাঁড়ি। মঙ্গলযাত্রায় ছিল হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের দুঃসময়ের কাণ্ডারীর প্রতীক হিসেবে ‘গাজী ও বাঘ’, সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে লক্ষ্মীপেঁচার পাশাপাশি শিশু হরিণ, মা ও শিশু, হাঁস ও মাছের ঝাঁক।
প্রতিবেদনটিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, সমৃদ্ধির প্রতীক হলো লক্ষ্মীপেঁচা। এর উপস্থাপনভঙ্গিতে প্রতীয়মান হয়, মঙ্গলশোভাযাত্রা একটি প্রার্থনামূলক ইবাদত। যাতে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ কামনা করা হয়।
একদিকে বলা হচ্ছে, এগুলো গ্রাম বাংলার লোকজ সংস্কৃতির ধারক। অন্যদিকে বলা হচ্ছে সমৃদ্ধির প্রতীক। যদি ধরে নেই, এগুলো গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির ধারক তাহলে কথা হলো, আমাদের গ্রাম-বাংলায় একটা কুসংস্কার চালু আছে, ‘পেঁচা কুলক্ষণ বহন করে।’ এতে দেখা যাচ্ছে, পেঁচা এটা গ্রাম বাংলার কুসংস্কৃতির ধারক। কুসংস্কৃতি কি কোনো প্রচারের বিষয় হলো? আর যদি বলি, পেঁচা সুলক্ষণ ও সমৃদ্ধির প্রতীক তাহলে বলবো, এটা হিন্দু বিশ্বাস। মুসলিম বিশ্বাসে এসবের কোনো স্থান নেই। কারণ হিন্দু বিশ্বাস মতে লক্ষ্মী দেবীর বাহন হলো পেঁচা। সে পেঁচা নাকি মঙ্গল ও সমৃদ্ধি বহন করে। সুতরাং এতে প্রতীয়মান হচ্ছে, মঙ্গলোশোভাযাত্রা ও তাতে ধারণকৃত মূর্তি মুখোশ সবই ভিনদেশীয় ও ভিনধর্মীয় সংস্কৃতি। এগুলোর সাথে বাংলাদেশ ও মুসলিমদের কোনো সম্পর্ক নেই।
(https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article772232.bdnews)
মঙ্গলশোভাযাত্রায় ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মূর্তি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। অথচ ক্ষ্যাপা ষাঁড় শিবের বাহনগত প্রতিকৃতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মঙ্গলশোভাযাত্রায় বাঘের মূর্তি-মুখোশ অতিমাত্রায় ব্যবহৃত হয়, যা দূর্গার বাহনগত প্রতিকৃতির নির্দেশ করে। একই সাথে হাতিও অতিমাত্রায় ব্যবহৃত হয় যা গণেশ দেবতা নির্দেশ করে। গণেশকে মঙ্গলমূর্তি হিসেবে বিশ্বাস করে হিন্দুরা। সে হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রায় গনেশের প্রতিকৃতি থাকা অত্যাবশ্যক পর্যায়ের।
এছাড়া মঙ্গলশোভাযাত্রায় সূর্যের প্রতিকৃতি (মানুষের মাথার মত) অনেক বেশি দেখা যায়। এটা হচ্ছে হিন্দুদের সূর্য দেবতার প্রতিকৃতি। উইকিপিডিয়া বলছে- সূর্য হিন্দুধর্মের প্রধান সৌর দেবতা। হিন্দু ধর্মীয় সাহিত্যে সূর্যকে যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করা হয়ে থাকে। কারণ সেই একমাত্র দেবতা যাকে মানুষ প্রত্যহ প্রত্যক্ষ করতে পারে।
(https://bn.wikipedia.org/wiki/সূর্য দেবতা)
মঙ্গলশোভাযাত্রায় ব্যবহৃত এসকল প্রতিকৃতি হিন্দুধর্মীয় সংস্কৃতি থেকে এসেছে। এ সম্পর্কে নিউইয়র্ক ইউনিভির্সিটি থেকে প্রকাশিত সালেক খান রচিত Title Performing the (imagi) nation: A Bangladesh Mise-en-scene নামক বইয়ের ২১৬ পৃষ্ঠায় মঙ্গলশোভাযাত্রা সম্পর্কে বলা আছে- People Marching in the parade also carry paiper mache portrits Depicting mythical figures and animals. These caracters Are taken from Hindu puja and rituals.
অর্থাৎ মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত নানা প্রকারের মূর্তিগুলো হিন্দুদের পূজা অনুষ্ঠান থেকে ব্যবহার করা হয়েছে।
মঙ্গলশোভাযাত্রার ইতিকথা
মঙ্গলশোভাযাত্রার সূচনা হয় ১৯৮৯ সালে। নামকরণ হয় ১৯৯৬ সালে। প্রশ্ন হলো, চারুকলা কেন এ আয়োজনের সূচনা করলো? এবং সেটা বছরের সূচনা দিনে করতে হবে এ তত্ত্ব চারুকলা কোথায় পেল? গ্রামবাংলায় কি পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এ ধরনের শোভাযাত্রার আয়োজন হতো? ইতিহাস তো এ প্রশ্নের ইতিবাচক কোনো উত্তর দেয় না। তবে চারুকলা এ ব্যাপারটিতে কেন এতো প্রাগ্রসর হলো? অতীতে গ্রামবাংলার কোথাও যদি এ ধরনের আয়োজন না হয়ে থাকে তাহলে সেটা তো বাংলার সংস্কৃতি হতে পারে না। চারুকলার নিজস্ব সংস্কৃতি হতে পারে। যদি প্রমাণিত হয় গ্রামবাংলায় এ ধরনের শোভাযাত্রার আয়োজন হয়েছে তবে প্রশ্ন হবে সেটা কোন সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি হিসেবে পালিত হয়েছে? অনলাইন তথ্য বলছে, বছরের প্রথম দিন এভাবে শোভাযাত্রার আয়োজন করার কালচার ভারতের মারাঠী হিন্দুদের মাঝে চালু আছে। তাদের অনুষ্ঠানটির নাম Gudi Padwa (https://en.wikipedia.org/ wiki/Gudi_Padwa) এছাড়া ভারতীয় অন্যান্য জাতিসত্তার মাঝেও বছরের প্রথম দিন শোভাযাত্রা বের করার নিয়ম চালু আছে। তবে সেগুলো কোন না কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক।
সংস্কৃতি কাকে বলে?
একটা জাতির দীর্ঘদিনের জীবনাচরণের ভেতর দিয়ে যে মানবিক মূল্যবোধ সুন্দর ও কল্যাণের পথে এগিয়ে চলে তাই সংস্কৃতি। বিভিন্ন আচার-প্রথা, নিয়ম কানুন, বিশ্বাস সবই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং কোনো বিষয় কোনো সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি হয়ে উঠতে হলে তার অস্তিত্ব ওই সম্প্রদায়ের মাঝে বিদ্যমান থাকতে হবে। অতএব মঙ্গলশোভাযাত্রার নামে বর্তমানে যা কিছুর আয়োজন হচ্ছে তার কোন সূত্রই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বাঙ্গালী বা মুসলিম জাতিসত্তার মাঝে। তাহলে এটাকে কি করে গ্রহণীয় সংস্কৃতি হিসেবে অভিহিত করা যায়?
ভুল পথে মঙ্গলশোভাযাত্রার ইউনেস্কো যাত্রা!
ইউনেস্কোতে জায়গা করে নিতে সত্য মিথ্যা ও নীতিনৈতিকতার কোনো বালাই নেই। যে কোনো উপায়ে চমকে দেয়া কিছু পারফরমেন্স প্রেজেন্টেশন করতে পারলেই হলো। বেচারা মঙ্গলশোভাযাত্রা ইউনেস্কোতে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। কিন্তু ইউনেস্কো মহোদয় তার জন্ম তারিখে গলদ করে ফেলেছেন। ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে কথিত মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘের ইউনেস্কো। ইউনেস্কো কেন মঙ্গল শোভাযাত্রাকে Intangible Cultural Heritage হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য বয়ান করতে গিয়ে বলেছে, `the tradition of Mangal Shobhajatra began in 1989 when students, frustrated with having to live under military rule, wanted to bring people in the community hope for a better future.` (http://bit.ly/2oBrEnF) অর্থাৎ এরশাদের মিলিটারি রুলের কারণে ছাত্ররা হতাশাগ্রস্ত ছিলো। ফলে ভবিষ্যত মঙ্গল কামনায় তারা এই মঙ্গলশোভাযাত্রার সূচনা করে।
কিন্তু ইউনেস্কো পরিবেশিত এ তথ্য সম্পূর্ণ ভুল। ইতিহাস বলছে, ১৯৮৯ সালে চারুকলার উদ্যোগে কথিত এই শোভাযাত্রা যখন শুরু হয়, তখন তার নাম মঙ্গলশোভাযাত্রা ছিলো না, ছিলো বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। মঙ্গলশোভাযাত্রা নামকরণ করা হয় ১৯৯৬ সালে। তখন মোটেও মিলিটারি শাসন ছিলো না, ছিলো গণতান্ত্রিক সরকার। (http://bit.ly/2nCQDJG,)
হালখাতা পূজা একটি হিন্দুধর্মীয় অনুষ্ঠান
আমাদের দেশের কর্ণধারগণ বলেন, নববর্ষ উদযাপন বিষয়টি মূলত ব্যবসা-বাণিজ্যে আমাদের অতীতের পণ্য বিনিময় ব্যবস্থা থেকে এসেছে। এর সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্কটা সংস্কৃতির। তারা একথা বলে মূলত বর্ষবরণ থেকে সব ধরণের ধর্মীয় সম্পৃক্তিকেই নাকচ করতে চাচ্ছেন।
এবার লক্ষ্য করুন বর্ষবরণের সাথে হিন্দুধর্মের সম্পৃক্তি
হালখাতা অনুষ্ঠানের নামে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজা অনুষ্ঠান। যাকে হালখাতা পূজা বা নতুন খাতা পূজা নামে অভিহিত করা হয়। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে পূজার লিস্টে হালখাতা পূজাও বিদ্যমান রয়েছে। হিন্দুদের নিকট হালখাতা পূজা অনুষ্ঠানে বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর পূজা করা অবশ্য কর্তব্য। এমনকি এ পূজার সময় কী মন্ত্র পাঠ করতে হয় তাও সুনির্দিষ্ট। রবীন্দ্রনাথের জীবনীগ্রন্থেও হালখাতা পূজার বিবরণ পাওয়া যায়।
উইকিপিডিয়া বলছে, বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে ‘পহেলা বৈশাখ’ দিনটি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় উৎসবের মধ্য দিয়ে পালিত হয়। কলকাতার কালীঘাট মন্দির ও দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে এই দিন প্রচুর পূণ্যার্থী পূজা দেন এবং ব্যবসায়ীরা লক্ষ্মী-গণেশ ও হালখাতা পূজা করেন। (https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AC%E0%A7%88%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%96)
এবার লক্ষ্য করা যাক বর্ষবরণের সাথে ইসলামের সম্পৃক্তি
বর্ষবরণের নামে কথিত এসব আনুষ্ঠানিকতার সাথে ইসলামের ইতিবাচক কোনো সম্পৃক্তি নেই। তবে নেতিবাচক সম্পৃক্তি আছে। ইসলাম এমন একটি সর্বজনীন ও সর্বব্যাপী আদর্শ যা সর্ববিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদানের একচেটিয়া অধিকার রাখে। বর্ষবরণের গতি-পথ, নৈতিকতা-অনৈতিকতা এবং বৈধতা-অবৈধতা নিয়ে কথা বলতে ইসলাম বাধ্য। সুতরাং ইসলাম পহেলা বৈশাখের নামে প্রচলিত বর্ষবরণের এটুজেড বিশ্লেষণ করে নীতিনির্ধারণীমূলক কথা বলবে এবং বলতেই হবে। এটা ইসলাম ও ইসলামের ধারক-বাহকদের নৈতিক দায়বদ্ধতা। পহেলা বৈশাখে নারী পুরুষের অবাধ চলাচল হয়। এ বিষয়ে কি ইসলামের বিধিনিষেধ নেই? পহেলা বৈশাখে পর্দাবিধান চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়। এ ব্যাপারটিতে কি ইসলামে কোনো কথা বলা নেই? পহেলা বৈশাখে চরম আপত্তিকর পোশাকের প্রদর্শনী হয়। এ ব্যাপারে কি ইসলাম কথা বলে না? পহেলা বৈশাখে জীবচিত্র ধারণ করা হয়। এ ব্যাপারে কি ইসলাম নীরবতা পালন করে? পহেলা বৈশাখে ভিন্ন ধর্মের সাথে সাদৃশ্য অসংখ্য ধর্মীয় সংস্কৃতি লালন করা হয়। এ ব্যাপারে কি ইসলাম কিছুই বলে না? তবে এর সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই- এ কথার কি ব্যাখ্যা? সুতরাং পহেলা বৈশাখের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই- কথাটা সর্বৈব অপাংক্তেয় ও ভঙ্গুর।
মহাভারতে মঙ্গলযাত্রা
মহাভারত হিন্দুদের প্রধানতম ধর্মগ্রন্থ। তাতে তাদের ধর্মাচারের অনেক কিছুই বিবৃত হয়েছে। রাষ্ট্রের উঁচু স্তর থেকে অবিরাম প্রচারণা চলে, মঙ্গলশোভাযাত্রা হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ নয়। এটি একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসব। অথচ মঙ্গলযাত্রার কথা হিন্দু ধর্মগ্রন্থ মহাভারতে রয়েছে। মহাভারতের দ্বিতীয় খণ্ডের ১০১ পৃষ্ঠায় মঙ্গলযাত্রা করার নির্দেশ দেয়া আছে। (http://bit.ly/2pauCn8) উপরন্তু ১৩-১৫ই এপ্রিল অনেক দেশেই বর্ষবরণ পালিত হয়। তবে সবগুলোই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। কোথাও বৌদ্ধ ধর্মীয়, কোথাও হিন্দু ধর্মীয় আবার কোথাও শিখ ধর্মীয়। ইসলামের সাথে এর বিন্দুমাত্র সংযুক্তি নেই। তা সত্ত্বেও আমরা বলতে থাকি যে, পহেলা বৈশাখ অসাম্প্রদায়িক উৎসব! বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব!! (https://en.wikipedia.org/wiki/Vaisakhi)
রবী ঠাকুরের জীবনে পহেলা বৈশাখ পূজা
‘এসো হে বৈশাখ! এসো এসো’ কবিতাটি একশ্রেণীর মানুষের পূজনীয় কোরাসে পরিণত হয়েছে। কতটা মমতা দিয়ে তারা কবিতাটি আবৃত্তি করে! কিন্তু তারা আদৌ চিন্তা করে না, এ কবিতাটি কে রচনা করেছে? কি বিশ্বাসে রচনা করেছে? কবিতাটির রচয়িতা রবী ঠাকুর বেশ মমতা ভরে বৈশাখী পূজা পালন করতেন। ‘রবী জীবনী’র সপ্তম খণ্ডে রবীন্দ্র জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল লিখেছেন, ‘ওই বৎসর নববর্ষের দিনটি রবীন্দ্রনাথ শান্তি নিকেতনে ছিলেন, তাই প্রথানুযায়ী ছাত্র ও শিক্ষকদের নিয়ে মন্দিরে উপাসনা করে বর্ষবরণ করেন।’ এরপর উক্ত গ্রন্থের ২৫৮ পৃষ্ঠায় বর্ষশেষের উপাসনার কথা আছে। প্রশান্ত কুমার পাল লিখেছেন, ‘৩১ চৈত্র (শুক্র, ১৩ এপ্রিল) সন্ধ্যায় কলকাতার বহু অতিথি এবং ছাত্র ও শিক্ষকদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বর্ষশেষের উপাসনা করেন।’ এতে দেখা যাচ্ছে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পহেলা বৈশাখকে পূজা হিসেবে পালন করতেন। সেখানে আজকে রবীন্দ্রভক্তরা কোন যুক্তিতে এই দিবস পালনকে সেক্যুলার হিসেবে দাবি করে বুঝে আসে না। তিনি তার কবিতায় কোন বিশ্বাসে বৈশাখকে আহ্বান করেছেন তা কি আর বলে বুঝানোর প্রয়োজন আছে?
নববর্ষ পালনে দুঃখ-কষ্ট মুছে যাবে?
অগ্নি উপাসক, হিন্দু, বৌদ্ধ ও উপজাতিদের বিশ্বাস হলো, এভাবে বছরের প্রথম দিনটি পালন করা হলে সারা বছরের জরা-দুঃখ-কষ্ট সব মুছে যাবে। বৌদ্ধরা বিশ্বাস করে পানি দিয়ে বৈসাবী খেললে জরা-দুঃখ দূরীভূত হয়ে তারা শুদ্ধ হয়ে যাবে। অগ্নি উপাসকদের বিশ্বাস হলো, আগুন তাদের জরা-দুঃখ মুছে শুদ্ধ করে দেবে। এই বিশ্বাস হিন্দুদের মাঝেও সংক্রামিত। তাই দেখা যায়, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে যে গানটা গাওয়া হয় তাতে একটা পঙ্ক্তি আছে- ‘মুছে যাক গ্লানি ঘুঁচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’। পঙ্ক্তিটিতে স্পষ্টই বলা হচ্ছে, আগুন দিয়ে শুদ্ধ হওয়া যাবে। বস্তুত নববর্ষ অগ্নি-উপাসকসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান হওয়ার কারণেই প্রকৃত ইসলামীবেত্তারা কখনই এ অনুষ্ঠান পালনে অনুমতি বা স্বীকৃতি দেননি।
মঙ্গলশোভাযাত্রা কি আসলে ঐতিহ্যের পর্যায়ে পড়ে?
২৭ বছর আগে, ১৯৮৯ সাল থেকে মঙ্গলশোভাযাত্রার সূচনা হয়। এত অল্প সময়ে কি কোনো কিছু ঐতিহ্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে? ঐতিহ্যের মাঝে কি সময়ের ব্যবধান এতোটাই সংকীর্ণ। একটা প্রজন্ম পার না হতেই তা ঐতিহ্যের রূপ নিলো! তবে এটা হিন্দুয়ানী ঐতিহ্যের পর্যায়ভুক্ত হতে পারে। কারণ তারা এটাকে সম্ভবত বহুকাল ধরেই পালন করে আসছে। সুতরাং মঙ্গলশোভাযাত্রা হিন্দুধর্মীয় ঐতিহ্য হতে পারে। কিন্তু বাঙ্গালী বা বাংলাদেশী ঐতিহ্য হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
নববর্ষে আরো যেসব পূজা উৎসব পালিত হয়
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে পহেলা বৈশাখে অনেক পূজা পার্বণই পালন করা হয় হিন্দু বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে। যথা :
১. হিন্দুদের ঘটপূজা, গণেশ পূজা, সিদ্ধেশ্বরী পূজা, ঘোড়ামেলা, চৈত্রসংক্রান্তি পূজা-অর্চনা, চড়ক বা নীল পূজা বা শিবের উপাসনা ও সংশ্লিষ্ট মেলা, গম্ভীরা পূজা, কুমীর পূজা, অগ্নিনৃত্য, বউমেলা, মঙ্গলযাত্রা এবং সূর্যপূজা।
২. ত্রিপুরাদের বৈশুখ মারমাদের সাংগ্রাই ও পানি উৎসব।
৩. চাকমাদের বিজু উৎসব (ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমাদের পূজা উৎসবগুলোর সম্মিলিত নাম বৈসাবি)।
৪. হিন্দু ও বৌদ্ধদের উল্কিপূজা।
৫. অগ্নি পূজকদের নওরোজ।
সুতরাং পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে যত আয়োজন সবই ভিন্ন ধর্মালম্বীদের। মুসলমানদের এখানে কিছুই নেই। অতএব মুসলমানরা পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে কোনো পূজা করতে পারে না। নাম তার যাই হোক।
পহেলা বৈশাখ তো মুসলমানরাই চালু করেছে!
অনেকে বলেন, পহেলা বৈশাখ অনুষ্ঠান মোঘল আমল থেকে চালু হয়েছে। বাদশাহ আকবার এটা চালু করেছে। সে মুসলিম ছিল। হিন্দুরা তো এটা চালু করেনি। সুতরাং মুসলমানদের চালু করা বিষয় অনুসরণ করতে মুসলমানদের সমস্যা কোথায়? বাহ্যত বেশ যৌক্তিক প্রশ্ন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাদশা আকবর মুসলিম ছিলেন কিনা? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা নিম্নে তার কিছু কার্যক্রম ও ধারণা-বিশ্বাসের ফিরিস্তি তুলে ধরছি।
১. সম্রাট আকবর ইসলাম ধর্মের পরিবর্তে ‘দীনে ইলাহী’ নামে নতুন এক ধর্মের প্রবর্তন করেন। এই নতুন ধর্মের প্রধান উপাদান ছিল সূর্যের উপাসনা। বাদশাহ প্রভাতে, দ্বিপ্রহরে, সন্ধ্যায় ও অর্ধরাত্রে বাধ্যতামূলকভাবে সূর্য পূজা করতেন। তিনি তিলক লাগাতেন ও পৈতা পরতেন। সূর্যোদয়ের সময় ও মধ্যরাত্রিতে নহবত ও নাকাড়া বাজান হতো। এই নতুন ধর্মে সূর্যের নাম উচ্চারণকালে ‘জাল্লাত কুদরাতুহু’ বলা হতো। বাদশাহ বিশ্বাস করতেন, সূর্য রাজা-বাদশাহদের অভিভাবক ও হিতাকাক্সক্ষী। তিনি তাই হিন্দুদের কাছ থেকে সূর্যকে বশীভূত করার মন্ত্র শিখেছিলেন। মাঝরাত্রে ও ভোরে তিনি এই মন্ত্র পাঠ করতেন। শিবরাতে তিনি যোগীদের আসরে সমস্ত রাত্রি বসে থাকতেন এবং বিশ্বাস করতেন, এতে আয়ু বৃদ্ধি পায়।
২. গৌতম নামের জনৈক ব্রাহ্মণের কাছ থেকে বাদশাহ মূর্তি, সূর্য, আগুন, ব্রহ্মা, মহামায়া, বিষ্ণু, কৃষ্ণ ও মহাদেব পূজার কায়দা কানুন শুনে বড়ই উৎফুল্ল হতেন এবং এসব গ্রহণও করতেন। উপরন্তু এই ধর্মে আগুন, পানি, গাছ, গাভীরও পূজা করা হত। নক্ষত্র পূজার ব্যাপারেও বাদশাহ অত্যধিক আগ্রহ প্রকাশ করতেন।
৩. হিন্দুদের পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করাও ছিল এই ধর্মের কর্তব্য। সম্রাট আকবর হিন্দুদের পূনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করতেন। মৃত্যুর পর তিনি পুনরায় অন্য কোন সিংহাসনে আরোহন করবেন বলে বিশ্বাস করতেন। ব্রাহ্মণগণ তাকে বুঝিয়েছিল, শক্তিশালী বাদশাহর শরীরে আত্মার জন্ম হয় এবং মহা মনীষীগণের আত্মা মৃত্যুর সময় মস্তকের তালু দিয়ে বের হয়ে যায়। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি মাথার তালু টাক করে ফেলতেন এবং মস্তকের চারদিকে চুল রেখে দিতেন। বাদশাহ জৈন সাধুদের দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন। সাধু সঙ্গ লাভের পর হতে তার নিকট সব সময় এমনকি ভ্রমণের সময়েও একজন জৈন সাধু থাকত। জৈন ধর্ম অনুযায়ী বাদশাহ নিজেও গোশত ভক্ষণ ত্যাগ করেছিলেন।
৪. অগ্নিপূজকদের দ্বারাও বাদশাহ যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন। তার আদেশে দরবারের সম্মুখে সর্বক্ষণ অগ্নি প্রজ্জ্বলনের ব্যাবস্থা করা হয়। ঘণ্টাধ্বনি প্রভৃতি গ্রহণ করা হয় খ্রিস্টানদের নিকট থেকে। মোটকথা ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্মই বাদশাহর চোখে সুন্দর মনে হত। তার চোখে সবচেয়ে বেশি সুন্দর মনে হতো হিন্দুধর্ম। তাই তার নতুন ধর্ম ‘দীন-ই-ইলাহীর’ বেশির ভাগ উপাদানই গৃহীত হয়েছিল হিন্দুধর্ম হতে। তাই সঙ্গত কারণেই হিন্দু এবং রাজপুতদের নিকটই এই অদ্ভুত ধর্ম সমাদর লাভ করেছিল সবচাইতে বেশি। সম্ভবত বাদশাহ আকবেরর কাম্যও ছিল তাই।
৫. দীন-ই-ইলাহীর মূলমন্ত্র ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাহ, আকবারু খলিফাতুল্লাহ’। যারা নুতন এ ধর্মে দীক্ষিত হত তাদেরকে এরূপ শপথ বাক্য উচ্চারণ করতে হতো- ‘আমি অমুকের পুত্র অমুক এতদিন বাপ-দাদাদের অনুকরণে ইসলাম ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠত ছিলাম। এখন স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে পূর্বধর্ম পরিত্যাগ করে ‘দীন-ই-ইলাহী’ গ্রহণ করছি এবং এই ধর্মের জন্য জীবন, সম্পদ ও সম্মান বিসর্জন দিতে প্রস্তুত আছি।’
এছাড়া আরো অসংখ্য ইসলামবিরোধী কুফরী বিধান প্রচলিত ছিল বাদশাহ আকবরের দীনে ইলাহীতে। সুতরাং সম্রাট আকবরকে মুসলিম বলার কোনো সুযোগ নেই। উপরন্তু কোনো মুসলিম কোনো কিছুর প্রচলন করলেই তা পালনীয় হয়ে যায় না। বরং সেটাকে ইসলামের কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখতে হয় তা কতটুকু গ্রহণীয় আর কতটুকু বর্জনীয়। (https://www.facebook.com/ noyonchatterjee5/photos/a.296717957396541.1073741828.249163178818686/361898294211840/?type=3&theater)
তাছাড়া সম্রাট আকবর বাংলা সন চালু করেছিলেন বটে কিন্তু তিনি নববর্ষও উদযাপন করতেন এবং মঙ্গল-শোভাযাত্রাও করতেন তার প্রমাণ কী?
ঢাবির চারুকলা অনুষদে গোমাংস নিষিদ্ধ
আচ্ছা ধরে নিলাম, চারুকলা নিরেট বাঙ্গালিয়ানা সংস্কৃতি লালনের উদ্দেশ্যে মঙ্গলশোভাযাত্রার আয়োজন করে থাকে। এর সাথে হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে চারুকলা অনুষদ ক্যান্টিনে গরুর মাংস নিষিদ্ধ কেন? চারুকলার সকল শিক্ষার্থীই কি হিন্দু? সংবাদের ভাষ্য মতে ১৪২৪ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ শুক্রবার সাড়ে ৯টার দিকে মঙ্গলশোভাযাত্রা শেষে চারুকলা অনুষদের ক্যান্টিন থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে তেহারী পরিবেশন করা হয়। তেহারীতে গরুর মাংস ছিল জানতে পেরে শিক্ষার্থীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ক্যান্টিনে ভাংচুর করে। বৈশাখ উদযাপনে শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ক সাগর হোসেন সোহাগ বলেন, ‘চারুকলা অনুষদে গরুর মাংস রান্না সম্পূর্ণরূপে নিষেধ। কিন্তু ক্যান্টিন ম্যানেজার নাকি বিষয়টি জানেনই না। এটা কেমন কথা। না জেনে তিনি ক্যান্টিন পরিচালনা করছেন? তিনি পরিকল্পিতভাবেই এ কাজ করেছেন। আমাদের দাবি, তাকে ক্যান্টিন থেকে বিতাড়িত করতে হবে এবং তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।’ চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. নিসার হোসেন বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। চারুকলার ক্যান্টিনে কখনো গরুর মাংস পরিবেশন করা হয় না। কিন্তু তারা এটি কেন করলো, সেটি তদন্ত করে দেখতে হবে। এর মধ্যে মনে হচ্ছে একটা দুরভিসন্ধি আছে। সে কোনোদিন তেহারি করে না। আজ কেন করলো সেটিও খতিয়ে দেখার বিষয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা অনেক আগেই শুনেছি যে, পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ভণ্ডুল করার একটা ষড়যন্ত্র চলছে। মনে হচ্ছে এ ঘটনাটি তারই একটি অংশ। বাংলা নববর্ষ- ১৪২৪ উদযাপন কমিটির সমন্বয়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এটাতে একটি দুষ্টচক্রের ষড়যন্ত্র আছে। এটি খতিয়ে দেখা উচিত। এটাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। খুব কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে ডিনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তদন্তসাপেক্ষে দায়ীদের আইনের আওতায় আনা হবে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন কাজ করার সাহস না পায়।’ (http://m.risingbd.com/cat/news/221992/url)
যারা এতদিন পহেলা বৈশাখী পূজাকে ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব বলতো, মঙ্গলপূজাকে বাঙালীত্বের উৎসব বলতো তারাই আজকে গরুর মাংসের বিরোধিতা করছে। কেন? এরা পেঁচার মধ্যে মঙ্গল খুঁজে পায়, এরা সূর্যদেবের মূর্তির মধ্যে মঙ্গল দর্শন করে, কিন্তু গরুর মাংসের মধ্যেই তাদের অ্যালার্জি! কেন? গরুর মাংস কি বাঙালী সংস্কৃতি না? এতে কি প্রতীয়মান হয় না চারুকলা আয়োজিত পুরো অনুষ্ঠানটিই হিন্দুধর্মীয় সংস্কৃতি লালন করে? যে চারুকলা লক্ষ্মীপেঁচার মধ্যে এতদিন মঙ্গল খুঁজেছে, সে আজ গরুর মাংসে ষড়যন্ত্র খুঁজে পেয়েছে। (https://www.facebook.com/noyonchatterjee5/photos/a.296717957396541.1073741828.249163178818686/360831014318568/?type=3&theater)
স্কুল মাদরাসায় মঙ্গলশোভাযাত্রা পালন বাধ্যতামূলক?
গত বছর দেশের প্রতিটি স্কুল ও সরকার পরিচালিত মাদরাসাগুলোতে নোটিশ পাঠিয়েছে প্রশাসন। বলেছে, বাধ্যতামূলকভাবে মঙ্গলশোভাযাত্রা করতে হবে। এ দেশের সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, কাউকে অন্য ধর্ম পালনে বাধ্য করা যাবে না। বিশেষত সংবিধানের মৌলিক অধিকার- ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ অংশের ৪১ এর ২ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, ‘কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোন ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হইলে তাঁহাকে কোন ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করিতে হইবে না’। সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে সরকার এখন মুসলিম শিশু-কিশোরদেরকে একটি বিশেষ ধর্মের ধর্মাচার পালনে বাধ্য করছে। শাসকই যদি সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখায় তবে জনসাধারণ কি করবে?
মঙ্গলশোভাযাত্রায় চারুকলার বাণিজ্যিক রূপ
মঙ্গলশোভাযাত্রার নামে তাদের ব্যবসায়িক আয়টাও কম নয়। একটা মুখোশ নিয়ে শোভাযাত্রায় হাঁটতে হলে খরচ করতে হয় ১৫শ’ থেকে ২০ হাজার টাকা। তাছাড়া ছোট আকারের মুখোশ রয়েছে যেগুলোর দাম ৬শ’ থেকে ৮ হাজার টাকার মধ্যে। এছাড়া পাখির দাম ৮০০ টাকা, সরার দাম ৬০০ টাকা, ছবির দাম ২০০০ টাকা থেকে ১০০০০ টাকা। আর বড় আইটেমগুলোর মোটা দাম তো রয়েছেই। https://www. facebook.com/noyonchatterjee5/posts/525005274567807
শেষকথা
বর্ষবরণের ধারণা ইসলামী শরীয়তে নেই। বর্ষকে বরণ করার মত কোনো কিছুই মুসলমানের সংস্কৃতিতে নেই। এটা হলো, ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি। এর সাথে যদি অবিধানিক অন্য কোনো অনুষঙ্গ যুক্ত হয় তাহলে সে ব্যাপারে ইসলাম কতোটা কঠোর হবে তা বলাই বাহুল্য। আর যদি সে অনুষঙ্গগুলো কুফর-শিরক আশ্রিত হয় তাহলে তো সমাধান খুবই সহজ। যারা বলেন, প্রচলিত বৈশাখী উৎসব নিছক দেশীয় কালচার, এর সাথে ইসলামকে টেনে আনার দরকার নেই তাদের ঈমানগত অবস্থান নির্ণয় করা খুবই জটিল। আল্লাহ আমাদেরকে সর্বপ্রকার অনাচার থেকে মুক্ত থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।