মুফতী হাফিজুর রহমান
দাজ্জাল শব্দের ব্যবচ্ছেদ
‘দাজ্জাল’ শব্দটি আরবী দাজল [دجل] ধাতুমূল থেকে নির্গত। এর অর্থ প্রতারণা করা, মিথ্যা বলা। সুতরাং দাজ্জাল শব্দের অর্থ প্রতারক, মিথ্যুক, ভণ্ড। দাজ্জালকে মাসীহে দাজ্জালও বলা হয়। ‘মাসীহ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ এমন জিনিস যা মর্দন করা হয়েছে। যেহেতু দাজ্জালের চক্ষু মর্দিত বা বিকৃত হবে তাই তাকে মাসীহে দাজ্জাল বলে অভিহিত করা হয়। আর ঈসা আ. রুগ্ন ব্যক্তিকে হাত দ্বারা মর্দন করে দিলে সে সুস্থ হয়ে যেত। তাই তাঁকে ঈসা মাসীহ আ. বলা হয়। এ বিষয়ে আরো উক্তি রয়েছে। তবে শব্দটির উচ্চারণ বিষয়ে ভিন্ন কিছু অভিমতও পাওয়া যায়। কেউ বলেন, মিসসীহে দাজ্জাল, কেউ বলেন মিসসীখে দাজ্জাল, আবার কেউ কেউ বলেন, মাসীখে দাজ্জাল। তবে এ অভিমতগুলো তেমন সবল নয়। (আলমুফহিম লিমা আশকালা মিন তালখীসি কিতাবি মুসলিম ৩/১৫)।
দাজ্জাল আগমনের পূর্বাবস্থা
আসমা বিনতে ইয়াযিদ আনসারিয়া রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর ঘরে অবস্থান করছিলাম। তখন তিনি দাজ্জাল বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, দাজ্জালের আবির্ভাবের পূর্বে তিনটি বৎসর এমন হবে যে, প্রথম বৎসর আকাশ তার এক তৃতীয়াংশ বৃষ্টি বন্ধ করে দিবে। ভূমি তার এক তৃতীয়াংশ ফসল উৎপাদন বন্ধ করে দিবে। দ্বিতীয় বৎসর আকাশ তার দুই তৃতীয়াংশ বৃষ্টি বন্ধ করে দিবে। ভূমি তার দুই তৃতীয়াংশ ফসল উৎপাদন বন্ধ করে দিবে। তৃতীয় বৎসর আকাশ তার পরিপূর্ণ বৃষ্টি বন্ধ করে দিবে। পাশাপাশি ভূমিও তার ফসল উৎপাদন পরিপূর্ণরূপে বন্ধ করে দিবে। ফলে সুস্থ ও অসুস্থ সকল গরু ছাগল ও প্রাণীর প্রাণহানি ঘটবে। (মুসনাদে আহমদ; হাদীস ২৭৫৬৮)
দাজ্জালের গঠন আকৃতি
এক চোখা দাজ্জাল
হযরত আনাস ইবনে মালেক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পৃথিবীতে এমন কোনো নবী প্রেরিত হননি যিনি স্বীয় উম্মতকে একচোখা মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বিষয়ে সতর্ক করে যাননি। মনে রেখো, সে হবে একচক্ষুহীন। পক্ষান্তরে তোমাদের প্রতিপালক একচক্ষুবিশিষ্ট নন। দাজ্জালের দু’চোখের মাঝে কাফের (كافر) লিখিত থাকবে। (সহীহ বুখারী; হাদীস ৬৫৯৮)
ভয়ঙ্কর চোখা দাজ্জাল
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দাজ্জালের ডান চোখ কানা হবে। তার দৃষ্টিহীন চক্ষুটি স্ফীত আঙ্গুর ফলের মত দৃশ্যমান হবে। (সহীহ বুখারী; হাদীস ৬৫৯০)
এলোকেশী দাজ্জাল
হযরত হুযাইফা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দাজ্জালের বাম চক্ষু কানা হবে। সে এলোকেশী হবে। তার সাথে কৃত্রিম জান্নাত-জাহান্নাম থাকবে। তার জাহান্নাম হবে জান্নাত আর জান্নাত হবে জাহান্নাম। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ৭৫৫১)
দাজ্জালের দু’টি চক্ষুই ত্রুটিযুক্ত হবে
দাজ্জালের কোন চক্ষুটি ত্রুটিযুক্ত হবে তা নিয়ে হাদীসের মূলপাঠে দুই ধরনের উদ্ধৃতিই রয়েছে। কোনো হাদীসে দাজ্জালের ডান চক্ষু কানা বলা হয়েছে। কোনো হাদীসে আবার বাম চক্ষুকে কানা বলা হয়েছে। বাহ্যত দুই ধরনের বর্ণনার মাঝে সংঘর্ষ লক্ষ্যগোচর হয়। এ সংঘর্ষ নিরসনে শাইখ মুফতী রফী উসমানী দা.বা. তার আলামাতে কিয়ামত আওর নুযূলে মাসীহ গ্রন্থে বলেন, মোটকথা দাজ্জালের দু’টি চক্ষুই ত্রুটিযুক্ত হবে। বাম চোখটি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে কোটরগত থাকবে। আর ডান চোখটি আঙ্গুর ফলের মত বাইরে বের হয়ে থাকবে। (পৃষ্ঠা ১৪৬)
বস্তুত দাজ্জালের চক্ষু বিষয়ক বর্ণনাগুলোর সামগ্রিক বিচারে প্রতীয়মান হয়, দাজ্জালের এক চোখ সম্পূর্ণ অকেজো ও কোটরগত হবে। আর অপর চক্ষুটি স্ফীত বীজের মত দৃশ্যমান হবে। তার দু’চোখের মধ্যখানে কাফের লেখা থাকবে। শিক্ষিত অশিক্ষিত সকল বিশ্বাসী মানুষ তা পাঠ করতে সক্ষম হবে। মূল বিষয়টি আল্লাহই ভালো জানেন।
দাজ্জালের সাথে ফেরেশতার সঙ্গদান এবং ভয়ঙ্কর ফেতনার ঘনঘটা
হযরত সাফীনা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দাজ্জালের সাথে দু’জন ফেরেশতা থাকবে, যারা দু’জন নবীর আকৃতিতে তার সাথে সদা বিদ্যমান থাকবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি ইচ্ছা করলে সেই দু’জন নবীর নাম ও তাঁদের পিতার নামও বলতে পারবো। তাদের একজন তার ডান দিকে থাকবে আর অপরজন বাম দিকে থাকবে। এটা হবে পরীক্ষাস্বরূপ। দাজ্জাল তাদের উদ্দেশ্যে বলবে, আমি কি তোমাদের প্রভু নই? আমি কি মানুষকে জীবিত করতে পারি না? আমি কি মৃত্যু দান করতে পারি না? তখন একজন ফেরেশতা বলবে, তুই মিথ্যা বলছিস। ফেরেশতার এ কথা অপর ফেরেশতা ব্যতিরেকে আর কেউ শুনতে পাবে না। তখন অপর ফেরেশতা তার জবাবে বলবে, তুমি সত্য বলছ। দ্বিতীয় ফেরেশতার কথাটি সকলেই শুনতে পাবে। ফলে মানুষ মনে করবে, দ্বিতীয় ফেরেশতা দাজ্জালকে সত্যবাদী বলছে। এটিও পরীক্ষাস্বরূপ হবে। (মুসনাদে আহমদ; হাদীস ২১৯৭৯, মাজমাউয যাওয়ায়িদ; হাদীস ১২৫১৭)
দাজ্জালের চক্ষু হবে সবুজ কাঁচের মত
হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দাজ্জালের চোখটি (সবুজ) কাঁচের ন্যায় সবুজ দেখাবে। (সহীহ ইবনে হিব্বান; হাদীস ৬৭৯৫)
দাজ্জালের আগুন পানির বিভ্রান্তি
১. হযরত হুযাইফা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আবির্ভাব কালে দাজ্জালের সাথে আগুন ও পানি থাকবে। মানুষ যেটাকে আগুন মনে করবে মূলত সেটা হবে শীতল পানি। আর যেটাকে শীতল পানি মনে করবে প্রকৃতপক্ষে সেটা হবে ঝলসানো আগুন। যদি তোমাদের কেউ দাজ্জালের সাক্ষাৎ লাভ করে তাহলে সে যেন অগ্নিতে প্রবেশ করে। কারণ সেটা তো সুমিষ্ট উৎকৃষ্ট পানি। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ৭৫৫৫, সহীহ বুখারী; হাদীস ৭১৩০)
২. হযরত হুযাইফা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দাজ্জাল যখন আবির্ভূত হবে তখন তার সাথে স্রোতস্বিনী ও অগ্নিকূণ্ড থাকবে। যে ব্যক্তি তার স্রোতস্বিনীতে প্রবেশ করবে তার পাপের বোঝা বৃদ্ধি পাবে এবং তার পুণ্য হ্রাস পাবে। আর যে ব্যক্তি তার অগ্নিকূণ্ডে প্রবেশ করবে তার পুণ্য বৃদ্ধি পাবে এবং তার পাপ হ্রাস পাবে। (মুসতাদরাকে হাকেম; হাদীস ৮৩৩২)
ইহুদীরাই হবে দাজ্জালের সহচর
হযরত আনাস ইবনে মালেক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইস্পাহানের সত্তর হাজার ইহুদী দাজ্জালকে অনুসরণ করবে। তাদের দেহে বিশেষ ধরনের দীর্ঘ চাদর থাকবে। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ৭৫৭৯)
দাজ্জালের ভয়ে সাহাবায়ে কেরামের কান্না এবং দাজ্জালের বিরুদ্ধে নবীজীর জিহাদেরপ্রতিশ্রুতি
হযরত আয়িশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার গৃহে প্রবেশ করলেন। তখন আমি ক্রন্দন করছিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করলে আমি বললাম, আল্লাহর রাসূল! দাজ্জালের কথা স্মরণ হয়েছে। (তাই তার ভয়ে কাঁদছি। ) তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে যদি আমার জীবদ্দশায় আত্মপ্রকাশ করে তাহলে আমিই তোমাদের পক্ষ থেকে তাকে প্রতিহত করবো। আর যদি সে আমার মৃত্যুর পর আত্মপ্রকাশ করে তবুও তোমাদের শঙ্কিত হবার কারণ নেই। কারণ দাজ্জালের মিথ্যুক প্রমাণিত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে একচোখা হবে। পক্ষান্তরে তোমাদের প্রতিপালক এক চক্ষুবিশিষ্ট নন। (মুসনাদে আহমদ; হাদীস ২৪৫১১)
দাজ্জালের আবির্ভাবস্থল
হযরত আয়িশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, দাজ্জাল ইস্পাহানের ইয়াহুদিয়া অঞ্চল থেকে আত্মপ্রকাশ করবে। (মুসনাদে আহমদ; হাদীস ২৪৫১১)
বুখ্তনসর যখন বাইতুল মাকদিসে আগ্রাসন চালিয়েছিল তখন ইহুদীদের একটি বড় অংশ জেরুজালেম ছেড়ে ইস্পাহানের এ ইয়াহুদিয়া অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিলো। ফলে ওই এলাকার নাম হয়ে যায় ইয়াহুদিয়া। ইহুদী সম্প্রদায়ের মধ্যে ইস্পাহানী ইয়াহুদীদের বিশেষ এক মর্যাদা রয়েছে। (ফাতহুল বারী ৩০/৪৫)
দাজ্জালের সহচরদের মুখাকৃতি
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দাজ্জাল ভূপৃষ্ঠের পূর্বদিকস্থ খোরাসান অঞ্চল থেকে আত্মপ্রকাশ করবে। তার সাথে প্রচুর পরিমাণ অনুসারী থাকবে। তন্মধ্য হতে একদল অনুসারীর চেহারা স্ফীত চ্যাপ্টা ঢালের মত দেখাবে। (সুনানে তিরমিযী; হাদীস ২২৩৭, সুনানে ইবনে মাজাহ; হাদীস ৪০৭২)
কৌতুহলবশতও দাজ্জালের সাক্ষাত নিষিদ্ধ
হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি দাজ্জালের আত্মপ্রকাশের সংবাদ শুনবে সে যেন দাজ্জাল থেকে দূরে সরে যায়। আল্লাহর শপথ! নিজেকে মুমিন ধারণাকারী জনৈক ব্যক্তি (চ্যালেঞ্জ করার জন্য) দাজ্জালের কাছে আসবে। অতঃপর সে দাজ্জালের সৃষ্ট সংশয়পূর্ণ অলৌকিক বিষয়াদি দেখে নিজেই তার অনুসারী হয়ে যাবে। (সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ৪৩২১)
দাজ্জালের সাথে জনৈক সাহাবীর লাইভ সংলাপ
হযরত ফাতেমা বিনতে কায়েস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক আহ্বানকারীকে ঘোষণা করতে শুনলাম, নামাযের সময় হয়ে গেছে। ফলে আমি মসজিদে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে জামাআতে নামায আদায় করলাম। আমি পুরুষদের পেছনে নারীদের একটি কাতারের মাঝে ছিলাম। নামায শেষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে মিম্বারে আরোহণ করলেন। এরপর বললেন, তোমরা প্রত্যেকেই যার যার অবস্থানেই বসে থাকো। এরপর বললেন, তোমরা কি জানো আমি তোমাদেরকে কি কারণে বসতে বলেছি? সাহাবায়ে কেরাম রাযি. বললেন, এ ব্যাপারে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদেরকে উৎসাহ বা ভয় দেখানোর জন্য বসতে বলিনি। বরং এ (কথা শোনানোর) জন্য বসতে বলেছি যে, তামিম দারী একজন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ছিলো। সে আমার কাছে এসে ইসলামের উপর বাইয়াত গ্রহণ করেছে। সে আমার কাছে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছে, যা তোমাদের কাছে বর্ণিত দাজ্জালের ঘটনার সাথে সম্পূর্ণ মিলে যায়। সে বলেছে, বনু লাখম এবং বনু জুযাম গোত্রদ্বয়ের কিছু লোককে সাথে নিয়ে আমি একদা সমুদ্রভ্রমণে বের হই। একসময় ঝড়ের কবলে পড়ে দিকভ্রান্ত হয়ে গেলে এক মাস পর্যন্ত সমুদ্রের ঢেউ আমাদের নিয়ে খেলা করতে থাকে। পরিশেষে ঢেউ পশ্চিম দিকের একটি দ্বীপে আমাদেরকে নিয়ে পৌঁছায়। অতঃপর আমরা ছোট ছোট নৌকায় চড়ে দ্বীপের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে সেখানে একধরনের বিশেষ প্রাণীর সন্ধান পাই। প্রাণীটি স্থূল ও ঘনচুলবিশিষ্ট ছিলো। দেহের চুল অধিক হওয়ায় তার অগ্র-পশ্চাত নির্ণয় করা যাচ্ছিল না। আমরা প্রাণীটিকে দেখে বললাম, তোর ধ্বংস হোক! তুই কে? প্রাণীটি বললো, আমি হলাম জাস্সাসাহ (শাব্দিক অর্থ গোয়েন্দা বা গোপনে সংবাদ সংগ্রহকারী)। আমরা বললাম, সেটা আবার কি? সে বললো, তোমরা (প্রথমে) গির্জার ভিতরে থাকা ওই লোকটার নিকটে যাও। কারণ সে তোমাদের সংবাদের ব্যাপারে গভীর প্রতীক্ষায় আছে। যখন সে আমাদের সাথে কথা বলছিল তখন আমরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম, না জানি এটা শয়তান কিনা!! ফলে দ্রুত প্রাণীটির কাছ থেকে সরে পড়ি এবং গির্জার ভিতরে প্রবেশ করি। গির্জার ভিতরে আমরা দীর্ঘকায় এক মহামানবকে শিকলে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পেলাম। এমন ভয়ঙ্কর মানুষ আমরা ইতিপূর্বে প্রত্যক্ষ করিনি। তার দুই হাত কাঁধ পর্যন্ত এবং দুই পা গোছা পর্যন্ত শক্ত শিকলে বাঁধা। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ধ্বংস হোক তোর! কে তুই? সে বললো, তোমরা তো আমাকে পেয়েই গেছো এবং আমার অবস্থা ও অবস্থানও দেখে ফেলেছো। সুতরাং তোমরা বলো, তোমরা কারা? উত্তরে আমরা বললাম, আমরা আরবী সম্প্রদায়। অতঃপর সে তাদের পুরো ঘটনার ফিরিস্তি তার সামনে তুলে ধরলো। শিকলে বাঁধা লোকটা জিজ্ঞেস করলো, বাইসান (Baysan) এর খেজুর বৃক্ষগুলোতে কি এখনো ফল আসে? আমরা বললাম, হ্যাঁ, আসে। সে বললো, অচিরেই এমন একটি সময় আসবে যখন ওই বৃক্ষগুলোতে কোনো ফল আসবে না। অতঃপর জিজ্ঞেস করলো, বুহাইরা তাবারিয়াতে (টাইবেরিয়া লেক) এখনো পানির মজুদ আছে? আমরা বললাম, হ্যাঁ আছে। সেখানে প্রচুর পরিমাণ পানি রয়েছে। সে বললো, অচিরেই এর পানি শুকিয়ে যাবে। অতঃপর সে জিজ্ঞেস করলো, যুগার এর ঝর্ণাধারার কি অবস্থা? ঝর্ণা থেকে কি পানি প্রবাহিত হয়? স্থানীয় লোকজন কি সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে চাষাবাদ করে? আমরা বললাম, হ্যাঁ। অতঃপর সে বললো, উম্মী (অক্ষরজ্ঞানহীন) সম্প্রদায়ের নবীর ব্যাপারে আমাকে বলো। সে কি কি করছে? আমরা বললাম, তিনি মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় চলে গেছেন। সে জিজ্ঞেস করলো, আরব সম্প্রদায় কি তার সাথে যুদ্ধ করেনি? আমরা বললাম, হ্যাঁ, যুদ্ধ করেছে। এরপর জিজ্ঞেস করলো, সে আরবদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছে? আমরা তাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম যে, আরবের সকল মানুষের উপর তিনি বিজয়ী হয়েছেন। অধিকাংশ আরব তাকে মেনে নিয়েছে। সে বললো, আরবদের জন্য তাকে অনুসরণ করাই শ্রেয় হবে। এখন আমি তোমাদের কাছে আমার স্বীয় পরিচয় তুলে ধরছি, শোনো! আমি হলাম মাসীহে দাজ্জাল। অচিরেই আমাকে ভূপৃষ্ঠে আত্মপ্রকাশ করার অনুমতি প্রদান করা হবে। আমি আত্মপ্রকাশ করবো। বিশ্বজুড়ে বিচরণ করবো। পৃথিবীর এমন কোনো শহর নগর থাকবে না যেখানে আমি প্রবেশ করবো না। চল্লিশ রজনি আমি এভাবে বিশ্বব্যাপী ঘুরে বেড়াবো। তবে আরবের মক্কা ও তাইবা (মদীনা) শহরে আমি প্রবেশ করতে পারবো না। যখনই শহরদ্বয়ের কোনো একটি দিয়ে প্রবেশ করতে ইচ্ছা করবো তখন উন্মুক্ত তরবারী হাতে একজন ফেরেশতা আমার গতিরোধ করবে। কারণ শহরদ্বয়ের প্রতিটি সড়ক পথ তখন ফেরেশতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
ঘটনাটি শোনার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় লাঠি দ্বারা মিম্বরে আঘাত করে বললেন, এটিই হচ্ছে তাইবা শহর! এটিই হচ্ছে তাইবা শহর! আমি কি তোমাদের কাছে পরিপূর্ণরূপে ঘটনা বর্ণনা করতে পেরেছি? সবাই বললো, হ্যাঁ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সাবধানে থেকো! দাজ্জাল বর্তমানে সিরিয়ার সমুদ্রে অথবা ইয়েমেনের সমুদ্রে অবস্থান করছে! না!! বরং পূর্বদিকে অবস্থান করছে! পূর্বদিকে অবস্থান করছে! পূর্বদিকে অবস্থান করছে! (সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৯৪২)
উল্লেখ্য, টাইবেরিয়া লেক ও বাইসান এলাকা বর্তমানে ইসরাইলের দখলাধীন রয়েছে।
দাজ্জালের নিষিদ্ধ নগরী
হযরত আবূ বাকরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মদীনা নগরীতে কখনো দাজ্জালের আশঙ্কা প্রবেশ করবে না। কারণ সেদিন মদীনার সাতটি গেট থাকবে। প্রতিটি গেটে দু’জন করে ফেরেশতা নিযুক্ত থাকবে। (সহীহ বুখারী; হাদীস ৭১২৬)
দাজ্জালের ভয়ে মানুষ পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিবে
হযরত উম্মে শুরাইক রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি, দাজ্জালের ভয়ে পলায়ন করে মানুষ পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিবে। উম্মে শুরাইক রাযি. জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর রাসূল! আরব সম্প্রদায় তখন কোথায় থাকবে? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আরব সম্প্রদায় তখন সংখ্যায় অল্প থাকবে। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৯৪৫)
দাজ্জাল প্রতিরোধে নববী নির্দেশনা ও দাজ্জালী ফেতনার রূপরেখা
হযরত নাওয়াস বিন সাম‘আন রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাজ্জাল বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। কখনো রাসূল সাল্লøাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বরধ্বনি উঁচু হচ্ছিল কখনো আবার নিচু হচ্ছিল। আলোচনার এক পর্যায়ে ভয়ে আমাদের মনে হচ্ছিল, দাজ্জাল পাশের খেজুর বাগানে এসে উপস্থিত হয়েছে। আমরা যখন আলোচনা শুনে সন্ধ্যার দিকে আবার রাসূল সাল্লøাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ফিরে এলাম তখন তিনি আমাদের চেহারায় উদ্বিগ্নতার ছাপ চিহ্ন দেখে বললেন, কি হয়েছে তোমাদের? আমরা বললাম, আল্লাহর রাসূল! সকালে আপনি দাজ্জাল বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনার সময় কখনো আপনার স্বরধ্বনি উঁচু হচ্ছিল কখনো আবার নিচু হচ্ছিল। আলোচনান্তে আমাদের মনে হচ্ছিল, দাজ্জাল পাশের খেজুর বাগানে লুকিয়ে রয়েছে। একথা শুনে রাসূল সাল্লøাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে যদি আমার জীবদ্দশায় আত্মপ্রকাশ করে তবে আমিই তোমাদের পক্ষ থেকে তাকে প্রতিরোধ করবো। আর যদি আমার মৃত্যুর পর আত্মপ্রকাশ করে তাহলে প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব হবে নিজের পক্ষ থেকে দাজ্জালকে প্রতিরোধ করা। আর আল্লাহ তা‘আলাই সকল মুসলিমকে তত্ত্বাবধান করবেন। সে বলিষ্ঠ যুবক রূপে আত্মপ্রকাশ করবে। তার চক্ষু স্ফীত আঙ্গুর ফলের ন্যায় বহিরাংশে দৃশ্যমান থাকবে। তাকে আব্দুল উয্যা বিন কতন -এর মত দেখাবে। তোমাদের মধ্য হতে কেউ যদি তাকে পেয়ে যায় তাহলে সে যেন সূরায়ে কাহ্ফের প্রথম দশটি আয়াত পাঠ করে নেয়। সে ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী একটি সড়ক পথ থেকে আত্মপ্রকাশ করবে। ডানে বামে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও বিপর্যয়-গোলযোগ ছড়িয়ে পড়বে। হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা অটল অবিচল থেকো। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর রাসূল! সে এ পৃথিবীতে কত দিন অবস্থান করবে? উত্তরে রাসূল সাল্লøাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, চল্লিশ দিন। প্রথম দিন হবে এক বৎসরের সমান। দ্বিতীয় দিন এক মাসের সমান। তৃতীয় দিন হবে এক সপ্তাহের সমান। আর বাকি দিনগুলো সাধারণ দিনের মতই হবে। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর রাসূল! ভ্রমণকালে তার চলার গতি কেমন হবে? উত্তরে রাসূল সাল্লøাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঝঞ্ঝাবায়ু তাড়িত বাদলের ন্যায় গতিময় হবে তার পথচলা। এভাবে সে এক সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে নিজেকে প্রভু হিসেবে স্বীকার করে নেয়ার দাবি জানাবে। তারা দাজ্জালকে প্রভু হিসেবে স্বীকার করে নিবে এবং দাজ্জালের কথাকে তারা বিশ্বাস করবে। ফলে দাজ্জাল তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে আকাশকে তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করতে নির্দেশ দিবে। ফলে আকাশ বৃষ্টি বর্ষণ করবে। ভূমিকে নির্দেশ দিবে ফসল উৎপন্ন করতে। ভূমি ফসল উৎপন্ন করবে। সন্ধ্যাবেলা যখন তাদের গরু ছাগলগুলো মাঠ থেকে ফিরে আসবে তখন স্তনগুলো দুধে পরিপূর্ণ থাকবে। উদর স্ফীত থাকবে। অতঃপর দাজ্জাল অন্য এক সম্প্রদায়ের নিকট যাবে এবং নিজেকে প্রভু বলে স্বীকার করে নিতে তাদের নিকট দাবি জানাবে। তারা তাকে প্রভু হিসেবে স্বীকার করবে না। দাজ্জাল তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে চলে যাবে। ফলে তারা দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে যাবে। তাদের কোনো ধন-সম্পদই অবশিষ্ট থাকবে না। সবকিছুই নিঃশেষ হয়ে যাবে। দাজ্জাল এক অনুর্বর ভূমির পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে। এ সময় ভূমিকে আদেশ করবে, তুমি তোমর গর্ভস্থ রত্নভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দাও। ফলে ওই ভূমির সকল রতœভা-ার বেরিয়ে এসে দাজ্জালের পিছনে পিছনে এমনভাবে চলতে থাকবে যেরূপ মৌমাছিরা তাদের রাণী মাছির পেছনে পেছনে দল বেঁধে চলতে থাকে। সে একজন বলিষ্ঠ যুবককে কাছে ডেকে তরবারীর আঘাতে দুই টুকরো করে দিবে। লাশের দু’টি টুকরো এতটা দূরত্বে ছিটকে পড়বে যতোটা দূরত্বে লক্ষ্যবস্তুর দিকে নিক্ষেপিত তীর গিয়ে পড়ে। অতঃপর দাজ্জাল দ্বিখণ্ডিত সে যুবককে আহবান করলে যুবকটি সংযুক্ত হয়ে উঠে চলে আসবে। এভাবে তার ভয়াবহ ফিতনা বিশ্ব জুড়ে চলতে থাকবে। সর্বশেষে ঈসা ইবনে মারইয়ামকে আল্লাহ তা‘আলা আকাশ থেকে প্রেরণ করবেন। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৯৩৭)
সহীহ মুসলিমের অপর বর্ণনায় এসেছে, দাজ্জাল প্রথমে ওই যুবকটির উপর কঠোরতা আরোপ করবে। তার কটি-পৃষ্ঠে প্রচুর প্রহারকরা হবে। বলবে, এখন কি আমার উপর ঈমান এনেছিস? যুবকটি উত্তরে বলবে, তুই হচ্ছিস দাজ্জাল! অতঃপর দাজ্জাল যুবকটিকে দুই পা ফেড়ে দেহের মাঝ বরাবর চিড়েফেলার নির্দেশ দিলে তাকে চিড়ে ফেলা হবে। এরপর দাজ্জাল যুবকটির দ্বিখ-িত দেহকে সংযুক্তকরে জীবিত করে বলবে, এখন কি বিশ্বাস হচ্ছে যে, আমিই হচ্ছি প্রভু? উত্তরে যুবকটি বলবে, এখন তো পরিপূর্ণ বিশ্বাস হয়েছে, তুই-ই হচ্ছিস দাজ্জাল। যুবকটি বলবে, হে লোকসকল! আমার পরে সে আর কোনো ব্যক্তির সাথে এমন আচরণ করতেপারবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এরপর দাজ্জাল যুবকটিকে জবাই করে হত্যা করতে চাইলে আল্লাহ তা‘আলা যুবকটির গলদেশকে তা¤্রধাতু বানিয়ে দিবেন। ফলে দাজ্জাল তাকে আর জবাই করতে পারবে না।এরপর দাজ্জাল যুবকটির এক হাত ও এক পা ধরে দূরে নিক্ষেপ করবে। লোকেরা মনে করবে, দাজ্জাল তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করেছে। অথচ সে জান্নাতে প্রবেশকরেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ওই যুবকটি আল্লাহ তা‘আলার কাছে সবচে’ উত্তম ও মর্যাদাপূর্ণ শহীদ হিসেবে বিবেচিত হবে। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৯৩৮)
ইবনে সাইয়াদ; রাসূল যুগের সংশয়িত দাজ্জাল
দাজ্জাল আলোচনায় ইবনে সাইয়াদ বেশ প্রাসঙ্গিক। তাই তাকে নিয়ে এখানে কিছু আলোচনা প্রয়োজন। ইবনে সাইয়াদ একজন ইহুদী সন্তান। সে মদীনায় প্রতিপালিত হয়েছে। তার মূল নাম সাফী। জাদুবিদ্যা ও বিস্ময়কর বিষয়াদি সৃষ্টিতে সে ছিল সিদ্ধহস্ত। দাজ্জালের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব নিদর্শন বর্ণনা করেছেন তার সিংহভাগই ইবনে সাইয়াদের মাঝে পরিলক্ষিত হয়। এ কারণেই স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত থাকতেন। তদন্তের জন্য একাধিকবার চুপিসারে তার কথোপকথন শোনার চেষ্টা করেছেন। শেষ অবধি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কিছু বলে যাননি। উঁচু স্তরের বেশ কয়েকজন সাহাবী তাকে দাজ্জাল বলেও আখ্যায়িত করেছেন। নিচে ইবনে সাইয়াদ বিষয়ে কিছু হাদীস পরিবেশিত হলো।
ইবনে সাইয়াদের সাথে নবীজীর সংলাপ এবং ইবনে সাইয়াদের বিস্ময়কর উত্তর
১. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উমর রাযি. সাহাবায়ে কেরামের একটি প্রতিনিধি দলসহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ইবনে সাইয়াদ এর নিকট গমন করলেন। ইবনে সাইয়াদ তখন ইহুদী বসতি বনু মাগালা এর উতুম নামক স্থানে বন্ধুদের সাথে খেলা করছিলো। সে তখন বয়োপ্রাপ্তির নিকটবর্তী বয়সে উপনীত। ইবনে সাইয়াদ তাদেরকে দেখতে না পেয়ে স্বীয় খেলাধুলায় মগ্ন ছিলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গিয়ে তার পীঠে মৃদু আঘাত করলেন। ইবনে সাইয়াদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে মনোযোগ স্থাপন করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি বিশ্বাস করো আমি আল্লাহর রাসূল? প্রশ্ন শুনে ইবনে সাইয়াদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি বিশ্বাস করি যে, আপনি হলেন অশিক্ষিত নিরক্ষর মানুষের রাসূল। একথা বলেই ইবনে সাইয়াদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাল্টা প্রশ্ন করলো, আপনি কি মনে করেন আমি আল্লাহর রাসূল? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আচ্ছামত ধমকালেন এবং বললেন, আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করি। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, বল তো তুই কি কি দেখিস? অর্থাৎ অদৃশ্য বিষয়ে তোর কি কি জানা আছে? উত্তরে সে বললো, কখনো আমার নিকট সত্য সংবাদ আসে আবার কখনো মিথ্যা সংবাদ আসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোর ব্যাপারে সবকিছুই বিভ্রান্তিকর মনে হচ্ছে। অতঃপর পরীক্ষামূলক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, আমি তোর বিষয়ে একটি কথা মনের মাঝে লুকিয়ে রেখেছি; বল তো সেটা কি? (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনের লুকায়িত বিষয়টি ছিল কুরআনে আয়াত ‘যেদিন আকাশে প্রকাশ্য ধূম্রকুঞ্জ দেখা দিবে’) উত্তরে সে বললো, দুখ [دخ]। (দুখ [دخ] শব্দটি দুখান [دخان] আরবী শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ, এর অর্থ ধূম্রকুঞ্জ)। উত্তর শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দূর হয়ে যা। তুই তোর নির্ধারিত সময়ের পূর্বে কিছুই করতে পারবি না!! পরিস্থিতি দেখে উমর রাযি. বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমাকে অনুমতি দিন, আমি ওর গর্দান উড়িয়ে দেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ও যদি দাজ্জাল হয় তবে তুমি ওকে হত্যা করতে পারবে না (কারণ তার হত্যার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলা ঈসা ইবনে মারইয়া আ. এর হাতে লিখে রেখেছেন।) আর যদি দাজ্জাল না হয় তাহলে তাকে হত্যা করে কোনো লাভ নেই। (সহীহ বুখারী; হাদীস ১৩৫৪)
দাজ্জাল সন্ধানে গোয়েন্দা বেশে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
হযরত ইবনে উমর রাযি. বলেন, একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও উবাই ইবনে কা’ব রাযি. একটি খেজুর বাগানে গেলেন, যেখানে ইবনে সাইয়াদ অবস্থান করছিল। ওখানে গিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি খেজুর বৃক্ষের পেছনে লুকাতে চাইলেন। যাতে তার অজান্তেই তার কিছু কথা শুনতে পান। ইবনে সাইয়াদ তখন চাদর গায়ে জড়িয়ে শুয়ে ছিলো। চাদরের ভিতর থেকে কি যেন গুনগুন আওয়াজ ভেসে আসছিল। এমন সময় ইবনে সাইয়াদের মা এসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে খেজুর বৃক্ষের পেছনে লুকানো দেখে ইবনে সাইয়াদকে বললো, হে ছাফী! ওই তো মুহাম্মাদ এসে গেছে! এ কথা শোনামাত্রই ইবনে সাইয়াদ তার গুনগুন আওয়াজ বন্ধ করে দেয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, ওর মা এসে যদি বাধা না দিতো তাহলে সে আজ তার আসল চেহারা উন্মুক্ত করে দিতো। এ ঘটনার পর যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষণ দেয়ার জন্য লোক সম্মুখে দাঁড়ালেন তখন আল্লাহর প্রশংসা বর্ণনা করে দাজ্জালের আলোচনা তুলে ধরলেন। বললেন, আমি তোমাদেরকে দাজ্জাল থেকে সতর্ক করছি। নূহ আ. এর পর এমন কোনো নবী আবির্ভূত হননি যিনি স্বীয় জাতিকে দাজ্জাল সম্পর্কে সতর্ক করেননি। এমনকি নূহ আ.ও দাজ্জাল বিষয়ে স্বীয় জাতিকে সতর্ক করেছেন। তবে আমি তোমাদের সামনে দাজ্জাল সম্পর্কে এমন একটি কথা বর্ণনা করবো যা ইতিপূর্বে কোনো নবী বর্ণনা করেননি। জেনে রেখো! দাজ্জাল এক চোখে কানা হবে। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কানা নন। (সহীহ বুখারী; হাদীস ১৩৫৫, সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৯৩১)
সাহাবীর সাথে ইবনে সাইয়াদের সংলাপ এবং তার মাঝে দাজ্জালের প্রতীকী চিহ্নের বহিঃপ্রকাশ
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. বলেন, একদা পথ চলতে গিয়ে ইবনে সাইয়াদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হলো। তখন তার এক চোখ স্ফীত হয়ে উঠেছিল। জিজ্ঞেস করলাম, কিরে তোর চোখের এ অবস্থা কেন? উত্তরে বললো, জানা নেই। আমি বললাম, চোখ তোর মাথায় আর তুই জানিস না! সে বললো, প্রভু চাহেন তো তোমার লাঠির মাথায়ও চোখ তৈরি করে দিতে পারে। অতঃপর ইবনে সাইয়াদ নাক দিয়ে সজোরে গাধার মত একটি আওয়াজ করলো। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৯৩২)
সাহাবায়ে কেরামের সুনিশ্চিত বিশ্বাস, ইবনে সাইয়াদই হলো মাসীহে দাজ্জাল
১. হযরত ইবনে মুনকাদির রাযি. বলেন, আমি জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাযি. কে দেখেছি, তিনি শপথ করে বলতেন, ইবনে সাইয়াদই হচ্ছে দাজ্জাল। আমি বললাম, এ ব্যাপারে আপনি শপথ করছেন! তিনি বললেন, আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মুখে উমর রাযি. কে এভাবে শপথ করে বলতে শুনেছি যে, ইবনে সাইয়াদই হচ্ছে দাজ্জাল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কথাকে অস্বীকার করেননি। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৯২৯)
২. হযরত নাফে’ রহ. বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. প্রায়ই বলতেন, আল্লাহর শপথ! এ ব্যাপারে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, ইবনে সাইয়াদই হচ্ছে দাজ্জাল। (সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ৪৩৩২)
৩. হযরত আবূ বাকরা রাযি. বলেন, একদা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দাজ্জালের মাতা-পিতা ত্রিশ বছর পর্যন্ত দাম্পত্য জীবন কাটাবে। কিন্তু তাদের কোনো সন্তান হবে না। ত্রিশ বছর পর তাদের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হবে যার দাঁতগুলো বড় বড় হবে। তার মাধ্যমে কোনো উপকারী কার্য সাধিত হবে না। অন্যান্য ছেলে সন্তান যেমন ঘরের কাজে মাতা পিতার সহায়তা করে সে এমন কোনো সহায়তামূলক কাজ করবে না। তার দু’চোখ ঘুমাবে। কিন্তু অন্তর জাগ্রত থাকবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মাতা পিতার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তার দেহ অস্বাভাবিক দীর্ঘকায় এবং হালকা গড়নের হবে। তার নাসিকা মোরগের মত দীর্ঘ ও চিকন প্রকৃতির হবে। তার মা স্থুলকায় ও দীর্ঘ হাতবিশিষ্ট হবে। পরবর্তীতে একদিন আমরা শুনতে পেলাম, মদীনার ইহুদীদের মাঝে একটি বিস্ময়কর ও বিরল প্রকৃতির বালক রয়েছে। তখন আমি ও যুবাইর ইবনুল আওয়াম রাযি. মিলে তাকে দেখার জন্য তার বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাজ্জালের মাতা পিতা সম্বন্ধে যে গুণাগুণ বর্ণনা করেছিলেন হুবহু সেগুলো তাদের মাঝে বিদ্যমান রয়েছে। আমরা তাদের জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের কি কোনো সন্তান আছে? তারা বললো, আমরা ত্রিশ বছর যাবত বৈবাহিক জীবনযাপন করেছি, কিন্তু আমাদের কোনো সন্তান হয়নি। ত্রিশ বছর পর আমাদের ঘরে একটি কানা সন্তানের জন্ম হয়েছে, যার দাঁতগুলো প্রলম্বিত। তাকে দিয়ে কোনো ভালো কাজ করানো যায় না। তার চোখ ঘুমায় কিন্তু অন্তর ঘুমায় না। এ দম্পতির বর্ণনা শুনে ভয়ে আমরা ওখান থেকে ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলাম। হঠাৎ আমাদের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো সেই (ইবনে সাইয়াদ) ছেলেটির উপর। সে রোদের মাঝে চাদর পরে শুয়েছিলো। চাদরের ভিতর থেকে এক ধরনের গুনগুন আওয়াজ আসছিলো। বুঝা যাচ্ছিলো না, সে গুনগুন করে কি বলছে। আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে পরস্পরে কিছু একটা বলছিলাম। তৎক্ষণাৎ সে মাথা থেকে চাদর সরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কি বলাবলি করছো? বললাম, আমরা মনে করছি, তুমি ঘুমিয়ে আছো। তুমি কি আমাদের কথা শুনে ফেলেছো? সে বললো, হ্যাঁ। কারণ আমার চোখ ঘুমায়, কিন্তু আমার অন্তর সজাগ থাকে। (সুনানে তিরমিযী; হাদীস ২২৪৮)
দাজ্জাল অভিহিত করায় ইবনে সাইয়াদের দুঃখ এবং দাজ্জাল হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. বলেন, একদা মক্কা ভ্রমণকালে আমি আর ইবনে সাইয়াদ এক কাফেলায় ছিলাম। সে তার দুঃখের কথা আমাকে বলছিলো যে, লোকেরা আমাকে দাজ্জাল বলে। এটা শুনে আমি মনে খুব কষ্ট পাই। আবূ সাঈদ! তুমি কি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনোনি, দাজ্জালের কোনো সন্তান হবে না! অথচ আমার সন্তান আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বলে যাননি, দাজ্জাল কাফের হবে! অথচ আমি মুসলিম। তিনি কি বলে যাননি, দাজ্জাল মক্কা মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না! অথচ আমি মদীনা থেকে মক্কায় যাচ্ছি। অবশেষে ইবনে সাইয়াদ আমাকে বললো, জেনে রেখো! আল্লাহর শপথ করে বলছি, নিশ্চয় আমি দাজ্জালের জন্মকাল সম্বন্ধে অবগত আছি। তার জন্মস্থান সম্বন্ধে ভালো করেই জানি। এটাও জানি যে, বর্তমানে সে কোথায় অবস্থান করছে? তার পিতা-মাতাকেও ভালো করে চিনি। আমরা ইবনে সাইয়াদের এ কথাগুলো শুনে সন্দেহে পড়ে গেলাম। বললাম, তোর ধ্বংস অনিবার্য! এমন সময় কাফেলার অন্য একজন ইবনে সাইয়াদকে বললো, তোকে যদি দাজ্জাল বানিয়ে দেয়া হয় তবে তোর কেমন লাগবে? এ কথা শুনে ইবনে সাইয়াদ বললো, হ্যাঁ, অবশ্যই ভালো লাগবে। মানুষকে বিভ্রান্ত করতে যেসব অলৌকিক ও জাদুময় ক্ষমতা দাজ্জালকে দেয়া হবে সেসব যদি আমাকে দেয়া হয় তবে আমি দাজ্জাল হওয়াকে খারাপ মনে করবো না। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৯২৭)
ইবনে সাইয়াদ কি সত্যিকার অর্থেই মাসীহে দাজ্জাল?
১. ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, তামীম দারীর ঘটনাসম্বলিত হাদীস এবং ইবনে সাইয়াদ বিষয়ক হাদীসগুলোর মাঝে এভাবে সমন্বয় সাধন হতে পারে, তামীম দারী রাযি. যে দীর্ঘকায় মানবকে শিকলে বাঁধা অবস্থায় অজানা এক দ্বীপে প্রত্যক্ষ করেছিলেন সে হচ্ছে প্রকৃত দাজ্জাল। আর ইবনে সাইয়াদ ছিলো শয়তান। সে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ইস্পাহান চলে যাওয়া পর্যন্ত দাজ্জালের আকৃতিতে বিদ্যমান ছিলো। পরবর্তীতে সে স্বীয় বন্ধুদের নিয়ে ওখানে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। (ফাতহুল বারী ১৩/৩২৮)
২. আব্দুর রহমান রহ. বলেন, যখন আমরা ইস্পাহান বিজয় করি তখন আমাদের সেনাকেন্দ্র এবং ইয়াহুদিয়া এলাকার মাঝে এক ফারসাখ (৫.৮ কি.মি.) পরিমাণ দূরত্ব ছিলো। আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়ের জন্য প্রায়ই ইয়াহুদিয়া এলাকায় যাতায়াত করতাম। একদিন আমি সেখানে গিয়ে দেখি, ইহুদীরা তবলা বাজিয়ে নেচে গেয়ে উৎসব পালন করছে। ওখানে আমার পরিচিত এক ইহুদী ছিলো। তাকে গিয়ে উৎসব পালনের কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে, আজ আমাদের মুক্তিদাতা মহান স¤্রাটের আগমন হবে, যার নেতৃত্বে আমরা পুনরায় আরবদের উপর বিজয় অর্জন করবো। তার উত্তর শুনে আমি সে রাত্রটি পাশের পাহাড়ের উঁচু একটি টিলার উপরে কাটালাম। যখন ভোর হয়ে সূর্যোদয় হলো তখন আমাদের সেনাকেন্দ্রের দিক থেকে ধুলাবালি উড়তে দেখা গেলো। আমি দেখি, এক ব্যক্তি এগিয়ে আসছে, যার পরনে রাইহান সুগন্ধিযুক্ত পোশাক ছিলো। ইহুদীরা তখন আরো বেশি নাচছিলো। কিছুটা নিকটে আসার পর যখন আমি লোকটাকে ভালো করে প্রত্যক্ষ করলাম তখন দেখি সে হলো ইবনে সাইয়াদ। এরপর সে ইয়াহুদিয়া এলাকায় প্রবেশ করে। এখন পর্যন্ত সে ওখান থেকে ফিরে আসেনি। (ফাতহুল বারী ৩০/৪৩, তারিখে ইসফাহান ১/১৪)
শেষ অবধি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনে সাইয়াদের ব্যাপারে সন্দিগ্ধইছিলেন
আলোচনাটি এখানেই সমাপ্ত করে দেয়াকে সমীচীন মনে করছি। কারণ শেষ অবধি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যাননি। সুতরাং আমরা বলবো, এ সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন। আর এ ধরনের রহস্যপূর্ণ বিষয়কে গোপন রাখার মাঝে হয়তো আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ তাৎপর্য নিহিত রয়েছে।
ছোটো দাজ্জালের আবির্ভাব
১. হযরত হুযাইফা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার উম্মতের মাঝে ২৭ জন মিথ্যাবাদী দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। তন্মধ্য হতে ৪ জন হবে নারী। আর আমি হলাম শেষ নবী। আমার পর আর কোনো নবী আসবে না। (মুসনাদে আহমদ; হাদীস ২৩৪০৬)
২. হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যাবত দু’টি দল যুদ্ধে লিপ্ত না হবে তাবত কিয়ামত সংঘটিত হবে না। উভয় পক্ষের দাবি একই হবে। আর যতদিন প্রায় ত্রিশ জন মিথ্যাবাদী দাজ্জালের আবির্ভাব না ঘটবে ততদিন পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না। তাদের প্রত্যেকেই দাবি করবে, আমি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। (মুসনাদে আহমদ; হাদীস ৮১২১, ৮১২২)
৩. হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, শেষ যুগে মিথ্যাবাদী দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। তারা তোমাদের এমন কথা বলবে যা তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষের কেউ শোনেনি। সুতরাং তোমরা সতর্ক থেকো এবং তাদের ব্যাপারে নিজেদেরকে সতর্ক রেখো। তারা যেন তোমাদেরকে বিপথগামী না করতে পারে এবং বিভ্রান্তিতে না ফেলতে পারে। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ১৬)
কিয়ামতপূর্ব দশ নিদর্শনের অন্যতম হলো দাজ্জালের আবির্ভাব
হযরত হুযাইফা ইবনে আসীদ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যতদিন দশটি নিদর্শনের বহিঃপ্রকাশ না ঘটবে ততদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে না- (১) ধোঁয়া, (২) দাজ্জাল, (৩) মহাপ্রাণী, (৪) পশ্চিম দিগন্ত থেকে সূর্যোদয়, তিন ভূমিধস- (৫) প্রাচ্যে, (৬) পাশ্চাত্যে, (৭) আরববিশ্বে, (৮) ঈসা আ. এর অবতরণ, (৯) ইয়াজুয-মাজুযের মুক্তিলাভ ও (১০) আদন (এডেন) গহবর থেকে অগ্নি উদগীরণ; সে আগুন মানুষকে একটি ময়দানে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে। তারা যেখানে রাত্রিযাপন করবে সেখানে আগুন রাত্রিযাপন করবে। যেখানে তারা দিবানিদ্রা যাবে সেখানে সে আগুনও দিবানিদ্রা যাবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ; হাদীস ৩৮৬৯৭, সুনানে ইবনে মাজাহ; হাদীস ৪০৪৫, সহীহ মুসলিম; হাদীস ৭৪৬৮)
দুর্বল ঈমান দ্বারা দাজ্জালের সম্মোহনী ফিতনা থেকে পরিত্রাণ লাভ করা সম্ভব হবে না
হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যেদিন তিনটি জিনিসের আবির্ভাব ঘটবে সেদিন যে ব্যক্তি ইতিপূর্বে ঈমান আনয়ন করেনি কিংবা তার সে ঈমান দ্বারা ভালো কিছু অর্জন করতে পারেনি তার জন্য সে ঈমান কোনো উপকারে আসবে না- (১) পশ্চিম দিগন্ত হতে সূর্যোদয়, (২) দাজ্জালের আবির্ভাব ও (৩) দাব্বাতুল আরদ। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ৪১৭)
দাজ্জাল কখন আবির্ভূত হবে?
হযরত ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এমন এক প্রজন্মের আগমন ঘটবে যারা পবিত্র কুরআন পাঠ করবে। তবে তাদের কুরআন পাঠ তাদের কণ্ঠাস্থি অতিক্রম করবে না। এভাবে যখনই এক প্রজন্মের আবির্ভাব হবে তখনই তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। যখনই এক প্রজন্মের আবির্ভাব হবে তখনই তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। এক সময় তাদের বিশাল উপস্থিতিতে দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ; হাদীস ১৭০)
পৃথিবীর ইতিহাসে বৃহত্তম ও কঠিনতম দুর্যোগ হবে দাজ্জালের ফিতনা
১. হযরত ইমরান বিন হুসাইন রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আদম আ. এর সৃষ্টির পর থেকে নিয়ে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দাজ্জালের চেয়ে বড় কোনো জটিল কঠিন সৃষ্ট বিষয় নেই। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ৭৫৮২)
২. হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আদম আ. এর সৃষ্টি থেকে নিয়ে কিয়ামত অবধি সংঘটিত ফিতনাসমূহের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার নিকট সবচেয়ে বড় ফিতনা হলো দাজ্জালের ফিতনা। (মুসতাদরাকে হাকেম; হাদীস ৮৬১০, সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৯৪৬)
উম্মাহর দাজ্জাল পরিচয়ে রাসূলের আশঙ্কা !
হযরত উবাদাহ ইবনে সামিত রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি তোমাদেরকে দাজ্জালের ব্যাপারে বলছি। আমার ভয় হচ্ছে, না জানি তোমরা দাজ্জালকে চিনতে পারো কি না! দাজ্জাল হবে বামন প্রকৃতির, চলার সময় ওর দু’পদক্ষেপের মাঝে বিশাল ব্যবধান হবে, কোঁকড়া চুলো, একচক্ষুহীন, চক্ষু বিলুপ্ত; স্ফীত নয় এবং প্রস্তরীভূত কঠিনও নয়। তাকে চিনতে যদি তোমাদের সমস্যা হয় তাহলে জেনে রেখো, তোমাদের প্রতিপালক একচক্ষুহীন নয়। আর মৃত্যুর পূর্বে তোমরা তোমাদের প্রভুকে আদৌ দেখতে পাবে না। (সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ৪৩২২)
মি’রাজ রজনীতে ও স্বপ্নযোগে নবীজীর দাজ্জাল দর্শন ও তার বিবরণ
১. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, জেনে রেখো! মাসীহে দাজ্জাল ডান চোখে কানা হবে। তার চক্ষু স্ফীত আঙ্গুরের মত হবে। আমাকে কা’বার সন্নিকটে স্বপ্নে দেখানো হয়েছে, পিঙ্গল বর্ণের একজন পুরুষ, যে তাম্রবর্ণের মানুষের মধ্যে সুন্দরতম। তার কেশগুচ্ছ দু’কাঁধের মাঝে ঝুলে আছে। মাথার চুল আঁচড়ানো। তাঁর মাথা থেকে পানি ঝরছে। তাঁর দু’হাত দুই ব্যক্তির কাঁধে রক্ষিত। তিনি দুই ব্যক্তির মাঝে থেকে আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ ব্যক্তি কে? তারা বললো, ইনি হলেন মাসীহ ইবনে মারইয়াম। এরপর তাঁর পেছনে আরেকজন ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম। তার কেশ কোঁকড়ানো ও পরিপাটি। ডান চোখে কানা। দেখতে ইবনে কুতনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। তার দু’হাত এক ব্যক্তির কাঁধে রাখা। আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করছে। আমি বললাম, এ ব্যক্তি কে? তারা বললো, এ হলো মাসীহে দাজ্জাল। (সহীহ বুখারী; হাদীস ৩৪৪০)
২. হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
আমি সপ্তাকাশে ভ্রমণ রজনীতে দাজ্জালকে দেখেছি। (সহীহ বুখারী; হাদীস ৩২৩৯)
দাজ্জালের ললাটে ‘কাফের’ শব্দটি অঙ্কিত থাকবে
হযরত আনাস ইবনে মালেক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দাজ্জালের বাম চক্ষু হবে দলিত ও মর্দিত। তাতে স্থুল মাংসপি- দৃশ্যমান থাকবে। তার দু’চোখের মাঝে কাফের লেখা থাকবে। তা প্রত্যেক মুমিন এবং শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেই পাঠ করতে পারবে। (মুসনাদে আহমদ; হাদীস ১৩১০৩)
দাজ্জাল দেখতে কার মতো হবে?
১. নাওয়াস বিন সাম‘আন রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, … দাজ্জালকে আব্দুল উয্যা বিন কুতনের মতো দেখাবে। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৯৩৭)
২. হযরত আমের শা’বী রাযি. বলেন,
দাহইয়া কালবী দেখতে জিবরীল আ. এর মতো, উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফী ঈসা ইবনে মারইয়াম এর মতো এবং আব্দুল উয্যা ইবনে কুতন দাজ্জালের মতো। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা; হাদীস ৩২৯৯১)
দাজ্জাল হবে চরম ক্রোধান্বিত
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, চরম ক্রোধান্বিত অবস্থায় দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ৭৫৪৩)
পুরো পৃথিবী জুড়ে দাজ্জালের পদচারণা ঘটবে
হযরত আনাস ইবনে মালেক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পৃথিবীর সব জনপদেই দাজ্জালের পদচারণা ঘটবে। তবে মক্কা মদীনায় সে প্রবেশ করতে পারবে না। কারণ মক্কা মদীনর প্রতিটি সুড়ঙ্গ পথেই ফেরেশতাদের বেষ্টনী থাকবে। তারা এ দু’ শহরের প্রহরায় থাকবে। ফলে সে মদীনার নিকটবর্তী লবণক্ষেত্রে আসবে। এতে মদীনায় তিনটি ভূমিকম্প হবে। ফলে কাফের মুনাফেকরা মদীনা থেকে বের হয়ে দাজ্জালের কাছে চলে যাবে। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ৭৫৭৭)
দাজ্জাল হবে নিঃসন্তান
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দাজ্জালের কোন সন্তানাদি হবে না এবং সে মক্কা মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না। (মুসনাদে আহমদ; হাদীস ১১৪০৮)
সত্যের পক্ষে জিহাদে রত উম্মাহর সর্বশেষ কাফেলাটি দাজ্জালের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণহবে
হযরত ইমরান বিন হুসাইন রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার উম্মতের একটি দল সদা সর্বদা সত্যের পক্ষে যুদ্ধ করবে যারা তাদের বিরোধিতা করবে তাদের উপর বিজয় হয়ে। অবশেষে তাদের সর্বশেষ দলটি মাসীহে দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। (সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ২৪৮৬)
কনস্টান্টিনোপল বিজয় দাজ্জাল আগমনের পূর্বলক্ষণ
হযরত মু‘আজ ইবনে জাবাল রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বাইতুল মাকদিসের আবাদ সমৃদ্ধি মদীনা ধ্বংসের পূর্বলক্ষণ, মদীনা ধ্বংস মালহামা তথা মহা হত্যাকাণ্ডের পূর্বলক্ষণ, মহাযুদ্ধ কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পূর্বলক্ষণ আর কনস্টান্টিনোপল বিজয় দাজ্জাল আগমনের পূর্বলক্ষণ। (সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ৪২৯৬)
কে কোথায় দাজ্জালকে হত্যা করবে?
হযরত মাজমা ইবনে জারিয়া রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ঈসা আ. দাজ্জালকে সিরিয়ার লুদ্দ পর্বতের নিকট হত্যা করবে। (সহীহ ইবনে হিব্বান; হাদীস ৬৮১১)
উল্লেখ্য, লুদ্দ ইসরাইলের রাজধানী তেলআবিব থেকে ১৮ কি.মি. দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত একটি শহর। ইসরাইল এখানে বিশ্বের সর্বাধুনিক সিকিউরিটি গার্ড ব্যবহার করে লেস এয়ারপোর্ট নির্মাণ করেছে।
দাজ্জাল বিরোধী জিহাদে মুজাহিদদের বিজয় সুনিশ্চিত
হযরত নাফে’ ইবনে উতবা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা আরব উপদ্বীপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে বিজয় দান করবেন। তোমরা পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে পারস্যে বিজয় দান করবেন। এরপর রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে সেখানেও বিজয় দান করবেন। সর্বশেষে তোমরা দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। দাজ্জালের বিরুদ্ধেও আল্লাহ তোমাদেরকে বিজয় দান করবেন। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ৭৪৬৬)
দাজ্জালের অনিষ্টতা থেকে নবীজীর আশ্রয় প্রার্থনা
হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, আমি দাজ্জালের অনিষ্টতা থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (সুনানে নাসায়ী; হাদীস ৫৫০৫)
নামাযের মাঝেও দাজ্জালের অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনার নববী নির্দেশনা
হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,যখন তোমরা তাশাহহুদ পাঠ শেষ করবে তখন চারটি বিষয় থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে- (১) কবরের শাস্তি, (২) জীবনের ফিতনা, (৩) মরণের ফিতনা ও (৪) দাজ্জালের ফিতনা। (মুসনাদে আহমদ; হাদীস ৭২৩৬)
দাজ্জাল হত্যার প্রেক্ষাপট এবং তৎপরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতির ক্রমধারা
হযরত নাওয়াস বিন সামাআন কিলাবী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন সকালে দাজ্জালের কথা আলোচনা করলেন। তখন তিনি উচ্চস্বরে ও নিম্নস্বরে এমন গুরুত্ব দিয়ে দাজ্জাল বিষয়ে কথা বললেন যে, আমাদের মনে হলো, দাজ্জাল পাশের খেজুর বাগানে বিদ্যমান রয়েছে। তিনি আমাদের লক্ষ্য করে বলেন, আমি তোমাদের মাঝে থাকা অবস্থায় যদি দাজ্জালের আবির্ভাব হয় তবে তোমাদের পক্ষ থেকে আমিই তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেব। আর যদি এমন সময় তার আগমন ঘটে যখন আমি তোমাদের মাঝে থাকবো না তবে তোমরা প্রত্যেকই তার নিজের পক্ষ হয়ে তার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। আর প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আল্লাহ আমার খলীফা (স্থলাভিষিক্ত) থাকবেন। দাজ্জাল কোঁকড়া চুলো স্ফীত দৃষ্টির একজন যুবক। আমি যেন তাকে ‘আব্দুল উয্যা ইবন কাতান’ নামক লোকটির সাথে তুলনা করছি। তোমাদের কেউ যদি তার সাক্ষাৎ পায় তবে সে যেন তার কাছে সূরা কাহ্ফের প্রথম আয়াতগুলো পাঠ করে। সে সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যবর্তী স্থানে আবির্ভূত হবে এবং ডানে-বামে অশান্তি বিশৃঙ্খলা ছড়াবে। হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা সুদৃঢ় ও অটল থাকবে। আমরা বললাম, সে কতদিন পৃথিবীতে থাকবে? তিনি বলেন ৪০ দিন। প্রথম দিন এক বছরের মতো। দ্বিতীয় দিন এক মাসের মতো। তৃতীয় দিন এক সপ্তাহের মতো। আর অবশিষ্ট দিনগুলো তোমাদের সাধারণ দিনের মতো। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এক বছরের মতো যে দিন সে দিনে কি এক দিনের সালাত আদায় করলেই চলবে? তিনি বলেন, না, তোমরা তখন সালাতের জন্য সময় হিসাব করে নিবে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! পৃথিবীতে তার চলার গতি কিরূপ হবে? তিনি বলেন, ঝড়-তাড়িত মেঘের মতো। সে এক সম্প্রদায়ের নিকট এসে তাদেরকে তার দিকে আহ্বান করবে। তখন তারা তার উপর ঈমান আনবে এবং তার আহ্বানে সাড়া দিবে। তখন তার নির্দেশে আকাশ থেকে বৃষ্টিপাত হবে। জমিতে ফল-ফসল উৎপাদিত হবে। তাদের গৃহপালিত পশুগুলোর দৈহিক গঠন ও দুগ্ধ সবই অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাবে। অতঃপর সে অন্য একটি জনগোষ্ঠীর নিকট গমন করবে এবং তাদেরকে তার দিকে আহবান করবে। তারা তাকে প্রত্যাখ্যান করবে। তখন সে তাদের নিকট থেকে ফিরে যাবে। কিন্তু তাদের জমিগুলো অনুর্বর ফসলহীন ভূমিতে পরিণত হবে এবং তাদের হাতে তাদের সম্পদের কিছুই থাকবে না। সে পতিত ভূমির নিকট দিয়ে গমন করার সময় তাকে বলবে, তোমার সম্পদ-ভা-ার বের করে দাও। তখন মৌমাছিরা যেমন রাণী মাছির পিছে পিছে চলে তেমনি খনিজ সম্পদগুলো তার পিছে পিছে চলবে। এরপর সে পূর্ণ বয়স্ক এক যুবককে ডেকে তাকে তরবারি দ্বারা দ্বিখ-িত করে দিবে এবং তীর নিক্ষেপ পরিমাণ দূরত্বে ছুড়ে ফেলবে। এরপর তাকে ডাকবে। তখন সে হাস্যোজ্জ্বল মুখে তার দিকে এগিয়ে আসবে।
সে যখন এসব করবে তখন আল্লাহ মরিয়মের পুত্র ঈসা আ. কে প্রেরণ করবেন। তিনি দামেশকের পূর্ব দিকে অবস্থিত শুভ্র মিনারার উপর অবতরণ করবেন। তাঁর পরিধানে থাকবে দু’টি রঙিন কাপড়। তিনি তাঁর হাত দু’টি দু’জন ফেরেশতার পাঁখার উপর রেখে অবতরণ করবেন। তিনি মাথা নিচু করলে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরে পড়বে। আবার যখন মাথা উঁচু করবেন তখন মুক্তো দানা ঝরে পড়বে। কোনো কাফের তাঁর নিঃশ্বাস বায়ুর স্পর্শ পেলেই মৃত্যুবরণ করবে। আর তাঁর দৃষ্টি যত দূর যাবে তাঁর নিঃশ্বাসও ততো দূর যাবে। তিনি দাজ্জালকে খুঁজতে থাকবেন এবং ‘বাব লুদ্দ’ নামক স্থানে তাকে হাতের নাগালে পেয়ে বধ করবেন। এরপর আল্লাহ যাদেরকে দাজ্জাল থেকে রক্ষা করেছেন এমন মানুষের নিকট তিনি আগমন করবেন। তিনি তাদের মুখম-ল মুছে দিবেন এবং জান্নাতে তাদের মর্যাদার বিষয়ে কথা বলবেন।
এ অবস্থায় আল্লাহ মরিয়মের পুত্র ঈসা আ. এর নিকট প্রত্যাদেশ প্রেরণ করবেন যে, আমি আমার এমন একদল মাখলুককে প্রেরণ করেছি যাদের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষমতা কারো নেই। কাজেই আমার বান্দাদেরকে নিয়ে পাহাড়ে চলে যাও। তখন আল্লাহ ইয়াজুজ-মাজুজকে প্রেরণ করবেন। তারা প্রতিটি উঁচু ভূমি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে থাকবে। তাদের মধ্য থেকে যারা প্রথমে বের হবে তারা তাবারিয়া হ্রদে পৌঁছে হ্রদের সব পানি পান করে ফেলবে। সব শেষে যারা সে পথ দিয়ে যাবে তারা বলবে, এখানে এক সময় পানি ছিলো। আল্লাহর নবী ঈসা আ. ও তাঁর সাথীবর্গ অবরুদ্ধ হয়ে থাকবেন। সে সময় একটি ষাড়ের মাথা তাদের কাছে ১০০ স্বর্ণমুদ্রার চেয়েও উত্তম বলে গণ্য হবে। তখন আল্লাহর নবী ঈসা আ. ও তাঁর সাথীরা আল্লাহর কাছে দু‘আ করবেন। আল্লাহ ইয়াজুজ-মাজুজ বাহিনীর ঘাড়ে এক জাতীয় কীট প্রেরণ করবেন। ফলে তারা সকলেই একযোগে মহামারিতে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহর নবী ঈসা আ. ও তাঁর সাথীরা তখন পাহাড় থেকে লোকালয়ে নেমে আসবেন। কিন্তু সে সময় তাঁরা পৃথিবীর এক বিঘত জমিও তাদের গলিত পঁচা লাশ থেকে মুক্ত পাবেন না। তখন আল্লাহর নবী ঈসা আ. ও তাঁর সাথীবর্গ আল্লাহর কাছে দু‘আ করবেন। এরপর আল্লাহ সর্বব্যাপী বৃষ্টি দান করবেন, যা বাড়িঘর ও তাঁবুসহ পুরো পৃথিবী ধুয়ে আয়নার মত ঝকঝকে করে দিবে। এরপর যমীনকে বলা হবে, তোমার ফল-ফসল উৎপন্ন করো এবং তোমার প্রাচুর্য নির্গত করো। তখন একটি বেদানা একদল মানুষ ভক্ষণ করবে এবং তার খোসায় ছায়া গ্রহণ করবে। আল্লাহ সম্পদে বরকত প্রদান করবেন। এমনকি একটি উটের দুধ একদল মানুষের চাহিদা মেটাবে, একটি গরুর দুধ একটি গোত্রের চাহিদা মেটাবে এবং একটি মেষ একদল মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে। এ অবস্থা চলতে থাকবে। এমন সময় আল্লাহ একটি পবিত্র বায়ুপ্রবাহ প্রেরণ করবেন যা বগলের নিচ দিয়ে মানুষকে ধৃত করবে এবং সকল মুমিন-মুসলিম ব্যক্তির প্রাণ গ্রহণ করবে। এরপর শুধু খারাপ মানুষগুলোই জীবিত থাকবে। তারা দুনিয়াতে গর্দভের মতো অশ্লীলতায় মেতে উঠবে। এদের সময়ে কিয়ামত সংঘটিত হবে। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৯৩৭, সুনানে ইবনে মাজাহ; হাদীস ৪০৬৫)
দাজ্জাল থেকেও ভয়ঙ্কর হবে পথভ্রষ্টকারী শাসক!
হযরত আবূ যর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ গৃহে প্রবেশকালে একদিন আমি তাঁর কোমর ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন তাঁকে বলতে শুনলাম, আমার উম্মতের মাঝে দাজ্জাল ছাড়াও তার থেকে আরো ভয়ঙ্কর বিষয়ের আবির্ভাব ঘটবে। যখন আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে প্রবেশ করবেন বলে আশঙ্কা করলাম তখন জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর রাসূল! আপনার উম্মতের উপর দাজ্জাল থেকেও ভয়ঙ্কর কোন বিষয়টার আবির্ভাব ঘটবে? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, পথভ্রষ্টকারী শাসকগণ। (মুসনাদে আহমদ; হাদীস ২১২৯৭)
দাজ্জাল বিষয়টি কি রূপক না বাস্তবতা?
বর্তমানে কিছু মানুষ দাজ্জাল বিষয়ক হাদীসগুলোকে রূপক অর্থে গ্রহণ করে নানা প্রকার অযৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে। এ শ্রেণীটির অস্তিত্ব অতীতেও ছিল। এ প্রসঙ্গে কাযী ইয়ায রহ. বলেন, মুহাদ্দিসগণ দাজ্জাল বিষয়ক যে সকল হাদীস উদ্ধৃত করেছেন তা সত্যপন্থীদের পক্ষে প্রকৃষ্ট দলীল। তারা দাজ্জালের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। তারা বিশ্বাস করেন, দাজ্জাল বলতে একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিই উদ্দেশ্য। তার দ্বারা আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করবেন এবং তাঁর ক্ষমতাধীন কিছু বিষয়ের ক্ষমতা তাকে প্রদান করবেন। ঈসা আ. তাকে হত্যা করবে। এটিই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ, সকল মুহাদ্দিস, ফকীহ ও গবেষকদের অভিমত। খারিজী, জাহমিয়া এবং মু’তাযিলী সম্প্রদায়ের কেউ কেউ দাজ্জালের বাস্তব অস্তিত্বের বিষয়টিকে অস্বীকার করেছে। (শরহুন নববী আলা সহীহি মুসলিম ১৮/৫৮)
সুতরাং মুমিনের আবশ্যিক দায়িত্ব হলো, বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হাদীসগুলোকে সরল ও বাহ্যিক অর্থে বিশ্বাস করা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা অনুসারে দাজ্জালের মহা দুর্যোগ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য দু‘আ করা এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করা। বিভিন্ন হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাজ্জালের ফিতনা থেকে সুরক্ষা প্রাপ্তির দু‘আ শিখিয়েছেন এবং এর জন্য সূরা কাহ্ফ-এর প্রথম দশটি আয়াত মুখস্থ ও পাঠ করতেও নির্দেশনা দিয়েছেন।
দাজ্জালের ফিতনা থেকে মুক্তির উপায়
১. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেভাবে এ দু‘আটি শিক্ষা দিতেন যেভাবে কুরআনের সূরা শিক্ষা দিতেন-
اللهم انا نعوذ بك من عذاب جهنم واعوذ بك من عذاب القبر واعوذ بك من فتنة المسيح الدجال واعوذ بك من فتنة المحيا والممات.
অর্থ : তোমরা বলো, হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট জাহান্নামের শাস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, কবরের শাস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। মাসীহে দাজ্জালের সম্মোহিত বিপর্যয় থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং জীবন-মরণের পরীক্ষা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ১৩৬১)
২. হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন,
اللهم أني أعوذ بك من شر المسيح الدجال
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি দাজ্জালের অনিষ্টতা থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (সুনানে নাসায়ী; হাদীস ৫৫০৫)
৩. হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন তোমরা তাশাহহুদ পাঠ শেষ করবে তখন চারটি বিষয় থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে- (১) কবরের শাস্তি, (২) জীবনের ফিতনা, (৩) মরণের ফিতনা ও (৪) দাজ্জালের ফিতনা। (মুসনাদে আহমদ; হাদীস ৭২৩৬) ৪. হযরত নাওয়াস বিন সাম‘আন রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তোমাদের মধ্য হতে কেউ যদি দাজ্জালকে পেয়ে যায় তাহলে সে যেন সূরায়ে কাহ্ফের প্রথম দশটি আয়াত পাঠ করে নেয়। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৯৩৭)