নারীর কর্মসংস্থান : শরয়ী দৃষ্টিভঙ্গি

মাওলানা সাইফুল্লাহ


মহান আল্লাহর নিপুণ হাতে তৈরি অন্তহীন এ বিশ্বচরাচর। তিনি বিচিত্র সৃষ্টির অনুপম সৌন্দর্যে সাজিয়েছেন মহাজগতের দেহসৌষ্ঠব। সৃষ্টিজগতের মধ্য হতে মানব শ্রেণীকে আল্লাহ তা‘আলা অতিশয় শ্রেষ্ঠত্ব দান করে সৃষ্টি করেছেন। এরপর তাদের মাঝে দায়িত্বকর্ম বণ্টন করে দিয়ে সে দায়িত্ববোধ সম্বন্ধে তাদের সচেতন ও সজাগ করে দিয়েছেন। এ সম্বন্ধে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তুমি তোমার সুমহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর, যিনি সৃষ্টি করেন ও সুঠাম করেন এবং যিনি পরিমিত বিকাশ সাধন করেন ও পথনির্দেশ করেন। (‘সূরা আ’লা’- ১-৩)

এ মহাজগতের স্থাপত্য শৈলিতে সবটুকু সৌন্দর্যই তিনি ব্যবহার করেছেন। এতে সামান্যতম খুঁত ধরার সুযোগ কারো জন্য রাখা হয় নি। তেমনিভাবে মানব জাতির শ্রেণীর বিন্যাস কি হবে, কার মাঝে কি স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট নিহিত থাকবে, কার জন্য কি কি বিষয় উপযোগী হবে, দায়বদ্ধতার শ্রেণী বিন্যাসের ক্ষেত্রে কি কি বিষয় অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হবে মানব সৃষ্টির সময় ইত্যকার বিষয়গুলোর প্রতি মহামহিমের মনোনিবেশে সামান্যতম ঘাটতি ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা মানব শ্রেণীর মাঝে গঠনগত এবং গুণগত স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টির পাশা পাশি তাদের মাঝে বিধানগত বৈচিত্রও এনে দিয়েছেন। বিত্তশালী একজন মানুষের উপর হজ্বব্রত ও যাকাত বিধান আবশ্যক করা হলেও বিত্তহীন মানুষটিকে এ দায়বদ্ধ থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে। দৈহিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ সবল একজন মানুষের উপর যে দায়বদ্ধতা আরোপিত হয়েছে বিকলাঙ্গ বা প্রতিবন্ধি একজন মানুষের ক্ষেত্রে হুবহু সে দায়বদ্ধতা আরোপিত হয়নি। তাদের বিধি-নিষেধে বেশ শিথিলতা এসেছে। এটিই মূলত স্বভাবজাত এবং বিশ্বজনীন ধর্মাদর্শের মাপকাঠি।

মানবজাতি নারী পুরুষÑ প্রধানতম এ দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত। এ বিভক্তি শুধু মানব শ্রেণীর মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়; প্রাণ সঞ্চারিত প্রতিটি জীব এমন কি উদ্ভিদ জগতেও সমভাবে বিদ্যমান। এ বিভক্তি বিন্যাসকে কেন্দ্র করে উদ্ভিদ, বৃক্ষরাজি এবং অন্যান্য প্রাণীকুলের কার্যকারিতা ও কর্মপন্থায়ও বেশ ব্যবধান ও বৈচিত্র লক্ষণীয়। কুদরতী এ বৈষম্য ও বৈচিত্র বিশ্ব ব্যবস্থার জন্য অতি আবশ্যকীয় একটি উপাদান হিসেবে গৃহীত। নতুবা অধিকারগত এবং কর্মপন্থাগত জীবন যাত্রায় ব্যবধান বৈচিত্রের সীমানা প্রাচীরকে ধূলোয় মিশিয়ে দেয়া হলে মহাজাগতিক বিশ্বব্যবস্থা অতি আবশ্যিকভাবে অকেজো হয়ে পড়বে। আল্লাহ তা‘আলা নারী পুরুষকে যেভাবে স্বভাবগত এবং গঠনগত স্বাতন্ত্র দিয়ে সৃষ্টি করেছেন তেমনিভাবে জাগতিক ও ধর্মীয় জীবনে তাদের কর্মপন্থা ও দায়বদ্ধতায়ও বৈচিত্র তৈরি করে দিয়েছেন। এটা সৃষ্টির প্রতি মহামহিমের অতিশয় দয়াদ্র আচরণ বৈ কিছুই নয়।

আজ নারী পুরুষের আধিকারিক সমতার ব্যাপারে বেশ উচ্চ বাচ্চ হচ্ছে। এ উচ্চ বাচ্চের সূতিকাগার কোথায়? কারা কেন কি স্বার্থে এ সমবিধানের আওয়াজ তুলেছে? পৃথিবীতে আজকের সভ্যতাই প্রথম এবং একমাত্র সভ্যতা নয়। এর আগে বহু সভ্যতার অতীত হয়েছে। সেসব সভ্যতার কাছে আজকের প্রযুক্তিগত সভ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই মস্তকাবনত করতে বাধ্য হচ্ছে। তো সেসব সভ্যতা কি সমধিকারের আদলে রচিত হয়েছিল? কিংবা তখনো কি এ জাতীয় কীম্ভুতকীমার আওয়াজ উচ্চকিত ছিল? না কি তারা এ একটি বিষয়ে অসভ্য জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল? আজকের পৃথিবীটাকে নাস্তিক্যবাদের আওয়াজে মুখরিত মনে হলেও উচ্চারকদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। তো এ পৃথিবীর বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, ইয়াহুদী, সনাতন (হিন্দু) নামের যে প্রধান ধর্মগুলো রয়েছে সমধিকারের ব্যাপারে এসব ধর্মগুলোর বিশুদ্ধ অবিকৃত মূল বক্তব্য কি? আজকাল মিডিয়াতে ‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা’ নামের একটি শব্দের বেশ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে ‘নারীতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা’র স্থানকাল কোন শতাব্দিতে কোন সভ্যতায় গত হয়েছে? পৃথিবীর ইতিহাসে অসংখ্য আইন ব্যবস্থা প্রণিত হয়েছে। কোন আইন ব্যবস্থায় ‘নারীতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা’র জয়জয়কার ছিল? আমরা বক্ষমান নিবন্ধে সমঅধিকারের মূলধারার সাথে সংযুক্ত নারীর কর্মসংস্থান বিষয়ে ইসলামী আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে কিছুটা আলোচনা করার প্রয়াস পাবো।

ইসলামী আইনে নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য

নারীর গঠনগত ও মনস্তাত্তিক কিছু ব্যবধান বিবেচনায় ইসলামী আইনে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যপ্রণালীতেও বিধানগত কিছু বৈচিত্র রাখা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা নারীদের উদ্দেশ্য করে বলেন,

তোমরা গৃহাভ্যান্তরে অবস্থান করো। (‘সূরা আহযাব’- ৩৩)

আয়াতটিতে পর্দা বিধানের সাথে সাথে নারীর দায়িত্বের সীমা রেখা সম্বন্ধেও সুষ্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আর তা হলো সে তার সংসারের প্রধান কন্ট্রোলার। পুরুষরা ক্ষেত খামার, অফিস আদালত, চাকরি বাকরি এবং ব্যবসা বণিজ্যসহ নানা কায়িক শ্রম ব্যয় করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সংসার পরিচালনার কাচামাল সংগ্রহ করবে। আর নারী সে কাচামালের সুন্দর ব্যবহারে সংসারকে সুখময় করে তুলবে। নারী যখন বাবার ঘরে থাকবে তখনও তার সংসার পরিচালনার আর্থিক দায়িত্ব তার উপর আরোপিত হয় নি। ঘরোয়া পরিবেশে থেকেই সে তার শিক্ষা দীক্ষাসহ যাবতীয় যোগ্যতা অর্জনে মনোযোগী হবে। স্বামীর গৃহে গিয়েও সে তার সংসারের নতুন রাজ্যকে সবটুকু গুণ বৈশিষ্ট দিয়ে সুখী ও সমৃদ্ধ করে তুলবে। এটিই তার প্রধানতম দায়িত্ব। এর বাইরে তার উপর অতিরিক্ত কোনো তার দায়িত্বারোপ করা হয়নি। কোনো স্বামীর জন্য তার স্ত্রীকে বাহিরের কাজে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করার কোনো সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

প্রত্যেক নারী তার স্বামীর গৃহের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। আর কিয়ামতের দিন সে তার এ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (সহীহ বুখারী, হা.নং ৮৯৩)

ইসলামী আইনের গ্রন্থগুলোতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে,

নারীর প্রধানতম কর্তব্য হলো, তার ঘর সংসারকে পরিচালনা করা, তার পরিবারের সার্বিক দিক লক্ষ্য রাখা, তার ছেলে সন্তানদের প্রতিপালন পরিচর্যা করে শিক্ষা দীক্ষাসহ সার্বিকভাবে উপযোগী করে তোলা এবং তার স্বামীর সাথে সদ্ভাব বজায় রাখা। (আল মাউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুয়ইতিয়্যাহ, ৭/৮২)

অন্যদিকে নারীর খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানসহ ব্যক্তিগতপ্রয়োজনীয় ব্যায়, সংসার পরিচালনা ও সন্তান সন্ততিসহ পারিবারিক ও সামাজিক অন্যান্য ব্যয়ভার থেকে নারীকে সম্পূর্ণরূপে দায়মুক্ত রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে তার উপরকোনো দায়বদ্ধতা নেই। যাবতীয় দায়ভার স্বামী বা পিতার উপর আরোপিত হয়েছে। ইসলামী ফিকহেরগ্রন্থগুলোতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে,

নারীর যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করা পিতা অথবা স্বামীর উপর আবশ্যক। (প্রাগুক্ত)

নারীর এত দায়মুক্তি এত স্বাধীনতা কেন? কেন সমাজ সংসারের যাবতীয় দায়ভার পুরুষে ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে? এর কারণ হলো শক্তি ক্ষমতা বুদ্ধি বিবেচনাসহ কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট দিয়ে পুরুষকে নারীর সেবক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নেতৃত্বের প্রধান উৎস-উপাদান হলো সেবাব্রত। সেবার যাবতীয় দায়িত্ব দিয়ে পুরুষকে নারীর অভিভাবক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

পুরুষ নারীর ব্যবস্থাপক। কারণ আল্লাহ তাদের এককে অপরের উপর মাহাত্ম্য দান করেছেন। এবং তারা তাদের ধনসম্পদ (নারীদের উপর) ব্যয় করে। সুতরাং সতী সাধ্বী নারীরা হয় অনুগতা এবং আল্লাহ তা‘আলা যেসব বিষয় হিফজতযোগ্য করেছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে তারা তার হিফাজত করে। (‘সূরা নিসা’- ৩৪)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

জনকের কর্তব্য যথাবিধি তাদের (স্ত্রীদের) ভরণ-পোষণ করা। কাউকেও তার সাধ্যাতীত কার্যাভার দেয়া হয় না। (‘সূরা বাকারা’- ২৩৩)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্ত্রীর প্রতি পুরুষের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন,

যখন তুমি আহার করবে তখন তাকেও (স্ত্রী) আহার করাবে, যখন তুমি বস্ত্র পরিধান করবে তখন তাকেও বস্ত্র পরিধান করাবে। (সুনানে আবু দাঊদ; হা.নং ২১৪২)

অন্য এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করো। কারণ তোমরা তাদেরকে আল্লাহর নিরাপত্তা সূত্রে গ্রহণ করেছো। এবং তোমরা তাদের সতীত্বকে আল্লাহর বিধানের বিনিময়ে বৈধ করে নিয়েছো। তোমাদের উপর তাদের সঙ্গত ভরণ পোষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ১২১৮, সুনানে তিরমিযী; হা.নং ১১৬৩)

বাহ্যত স্বামীর এ শ্রেষ্ঠত্ব অতিরিক্ত ক্ষমতা কিংবা দাপটের বিষয় নয়; বরং এটা তার দায় ও কর্তব্যের বিষয়, হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রিয় জীবনসঙ্গিনীকে আগলে রাখার নিখাদ বিবরণ। নারী জীবনের কোমল বিকাশে পুরুষকে দেয়া হয়েছে অভিভাবকত্বের ভার। আর শীতল ছায়ায় বসে ঘর গোছানো এবং সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার তুলনামূলক সাহজিক দায়ভার তুলে দেয়া হয়েছে নারীর হাতে। পুরুষের জন্য দায়িত্বপূর্ণ মাহাত্ম্যকে পেশী শক্তির ক্ষমতা ভাবার কোনোই সুযোগ নেই। হাদীসের ভাষ্য এ ব্যাপারে বেশ স্পষ্ট। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

তোমার উপর তোমার স্ত্রীর পূর্ণ অধিকার রয়েছে। (সহীহ বুখারী; হা.নং ১৯৭৪)

অন্যদিকে নারীদেরকে পুরুষের সততা ও শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ডরূপে ঘোষণা করা হয়েছে।  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

তোমাদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর নিকট শ্রেষ্ঠ সেই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ৩৮৯৫)

নারীর কর্মসংস্থান

কর্মসংস্থান অর্থ এমন কর্মব্যবস্থাপনা যাতে অংশ গ্রহণ করে একজন মানুষ তার আর্থিক প্রবৃদ্ধি ঘটাতে সক্ষম হয়। তো এ জাতীয় কষ্টসাধ্য কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয়তা কখন দেখা দেয় বা এর প্রতি মানুষ কখন আগ্রহী হয়? এটা শতসিদ্ধ কথা, খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান, শিক্ষা চিকিৎসাসহ জীবনের একান্ত প্রয়োজনীয় খাতের ব্যয় নির্বাহ করার জন্যই মানুষ কর্মসংস্থানের প্রতি মনোযোগী হয় বা হতে বাধ্য হয়। কিন্তু ইসলামী আইনে বিশেষ প্রয়োজন ব্যতিরেকে নারীর উপর ব্যয় নির্বাহের কোনো দায়বদ্ধতা চাপিয়ে দেয়া হয় নি। নারীর যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করবে পুরুষ। সুতরাং নারীর কর্মসংস্থানের কোনো প্রয়োজন নেই এবং থাকার কথাও নয়। স্বভাবজাত এবং প্রাকৃতিকভাবেই নারীরা সংসারী। ঘরোয়া কাজের সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতা ও আগ্রহবোধ একান্তই সৃষ্টিগত। সে হিসেবে তারা নিজ আগ্রহেই সংসার পরিচালনা করে থাকে। এক্ষেত্রে যদি তাদেরকে সাংসারিক এবং প্রাসঙ্গিক ব্যয় নির্বাহের উদ্দেশে কর্মসংস্থানে যেতে বাধ্য করা হয় তবে এটা হবে তাদের উপর নিতান্তই বৈষম্যমূলক আচরণ। তাই ইসলামী আইন মতে নারীদেরকে কর্মসংস্থানমুখী করতে বাধ্য করার কোনো সুযোগ নেই।

তবে নারী সমাজের কর্মতৎপরতা কেবলমাত্র বিদ্যা শিক্ষা, জ্ঞান অর্জন ও চিন্তা-গবেষণার ক্ষেত্র পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে ইসলাম এমন কথা বলেনি; বরং বাস্তব কাজে যথার্থ ভূমিকা পালনের জন্যে ইসলাম এক বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র তাদের জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষা লাভে অগ্রসর হতে পারে, তেমনি কৃষি ও ব্যবসায়ের কাজে পরোক্ষ অংশগ্রহণ করারও সম্পূর্ণ অধিকার রাখে। জীবিকার জন্যে বিভিন্ন কাজ কারবার, শিল্প-কারখানা স্থাপন, পরিচালনা বা তাতে কাজ করার ও অধিকার রয়েছে নারীদের। সেই সঙ্গে সমাজ ও জাতির কল্যাণমূলক বহুবিধ সামষ্টিক কাজ আঞ্জাম দেয়াও তাদের জন্যে কিছুমাত্র নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, নারীদের এসব কাজে নেমে যেতে হবে এবং এসব করা তাদের জন্য একান্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। নারীরা এসব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়–ক ইসলামে তা কাম্য নয়। তবে পরিবার বা সমাজে এমন কিছু পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যার কারণে নারীদেরও কর্মসংস্থানের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তখন যথাসাধ্য শরঈ বিধান পালন সাপেক্ষে নারীদের জন্যও কর্মসংস্থানের অনুমতি ইসলাম দিয়েছে। এমনকি নারীরা যদি দায়িত্ব ও কতর্ব্যরে বাহিরে গিয়ে কর্মসংস্থান করতে আগ্রহ বোধ করে তবে পিতা বা স্বামীর অনুমোদন এবং শরঈ বিধান পালন সাপেক্ষে তারও অনুমতি রয়েছে। সে ক্ষেত্রে কাউকে নিরুৎসাহিত করাও রীতি নয়। তবে তাদের আলাদা কর্মক্ষেত্রের ব্যবস্থা করতে হবে, এটাই ইসলামের দাবী।  নারী-পুরুষের স্বাধীন ও অবাধ মেলামেশার ফলে সামাজিক জীবনে নৈতিক অধঃপতনের যে মারাত্মক ব্যধি দেখা দিয়েছে তা থেকে সমাজকে মুক্ত করার উদ্দেশেই ইসলামে পর্দা বিধান আরোপ করা হয়েছে। আজকের নারীরা পর্দাকে অবরোধ মনে করে বসে আছে। অথচ ইসলাম নারীকে শৃঙ্খলিত করে নি। পর্দার মাধ্যমে তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। তাকে বলেছে সংযত হতে, নিজেকে খোলা-খুলিভাবে প্রকাশ না করতে। শরীয়তের বিধি-নিষেধ মেনে প্রয়োজনে নারীরা গৃহের বাইরের কাজও আঞ্জাম দিতে পারে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে একজন নারী সাহাবী তালাকপ্রাপ্তা হয়ে ঘরের বাইরে গিয়ে নিজের বাগানের খেজুর সংগ্রহ করার অনুমতি চাইলে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনুমতি প্রদান করেন। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাযি. বলেন,

আমার খালা তালাক প্রাপ্তা হলে নিজেদের খেজুর বাগানে গিয়ে খেজুর সংগ্রহ করার ইচ্ছা করেন। তখন এক ব্যক্তি তাকে বের হতে নিষেধ করে। ফলে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ তুমি তোমার খেজুর সংগ্রহ করতে পার। আশা করি তুমি সদকাহ করবে অথবা সৎ কাজ করবে’। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ১৪৮৩)

এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বাহিরে গিয়ে কাজ করার অনুমতি দিলেন। সাথে সাথে তাকে মানবতার স্বার্থে কল্যাণকর কাজ করার ব্যাপারেও উৎসাহ প্রদান করলেন। এর তাৎপর্য হলো, ইসলামী শরীয়তে নারী সমাজকেও মানবতার সেবা ও কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত দেখতে চায়। কিন্তু তাতে যেন সীমালঙ্ঘন না হয় সে ব্যাপারেও ইসলামের সতর্ক বার্তা রয়েছে।

হযরত আবু বকর রাযি. এর কন্যা আসমা রাযি. বলেন,

যখন যুবায়ের রাযি. আমাকে বিবাহ করেন, তখন তার না ছিল সম্পত্তি, না ছিল চাকর-বাকর। একটা উট আর একটা ঘোড়াই ছিল তার সম্বল। ঘোড়াটাকে আমি ঘাস-পানি খাওয়াতাম। সাথে সেলাই ও গম ভাঙ্গার কাজও করতাম। আমি রুটি তৈরি করতে জানতাম না, আমার কয়েকজন ভাল আনসার প্রতিবেশী মহিলা আমাকে রুটি বানিয়ে দিতেন। কিছুদিন পরে রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবায়ের রাযি. কে একখণ্ড জমি দান করেন। সে জমি থেকে আমি শুকনো খেজুরের বীচি সংগ্রহ করে মাথায় বহন করে আনতাম। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৫২২৪)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. এর স্ত্রী নিজে ঘরে বসে শিল্পকর্ম করতেন এবং তা বিক্রি করে ঘর-সংসারের খরচাদি চালাতেন। একদিন তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন,

আমি একজন কারিগর মেয়েলোক। আমি তৈরি করা দ্রব্যাদি বিক্রি করি। এছাড়া আমার ও আমার স্বামীর এবং আমার সন্তানদের জীবিকার অন্য কোনো উপায় নেই। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এভাবে উপার্জন করে তুমি তোমার সংসারের প্রয়োজন পূরণ করছো। এতে তুমি বিরাট সওয়াবের অধিকারী হবে।’ (মুসনাদে আহমদ; হা.নং ১৬১৩০, ১৬০৮৬)

ফিকহী বিশ্বকোষ আলমাউসূআতুল ফিকহিয়্যায় বলা হয়েছে,

ইসলাম নারীদেরকে কর্মসংস্থান গ্রহণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। তার জন্য ক্রয় বিক্রয় ব্যবসা বাণিজ্য প্রতিনিধি নিয়োগসহ যাবতীয় লেনদেনে অংশগ্রহণ করার অনুমতি আছে। যাবত সে এ জাতীয় কারবারে অংশগ্রহণ করে শরঈ বিধান ও আচরণ বিধির ব্যাপারে যতœবান থাকবে ততক্ষণ তাকে এ থেকে নিবৃত্ত করার অধিকার কারো নেই। (আল মাউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুয়াইতিয়্যাহ ৭/৮২)

উপরোক্ত কুরআন ও হাদীসের আলোকে বুঝা যায় যে, ইসলামী শরীয়ত নারী সমাজকে মানবতার সেবা ও কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। উপার্জনের জন্য কাজ করা এবং প্রয়োজনের মুহূর্তে সেজন্য গৃহের বাইরে যাওয়া নারীদের জন্য নিষিদ্ধ নয়। তবে তাতে নারী-পুরুষের অবাধ মেলমেশা ও বন্ধুত্ব সখ্যতা করে ইসলামী বিধান লঙ্ঘন করা সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ।

মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ.وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى  আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন,

যদি কারো জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় সামান বা অন্য কোন পন্থা না থাকে, তবে সাজ-সজ্জা ছাড়া পর্দার সাথে চাকুরী ও কর্মসংস্থানের উদ্দেশে বের হওয়াও নারীদের প্রয়োজনে বাইরে বের হওয়ার অন্তর্ভূক্ত। তবে শর্ত হলো সৌন্দর্য প্রকাশার্থে বের না হওয়া, বরং বোরকা বা জিলবাব তথা বড় চাদর গায়ে দিয়ে বের হওয়া। (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন ৭/১৩ )

আল মাউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে,

নারীরা ৩টি শর্তে নিজ গৃহের বাইরে চাকুরি বা কাজ করতে যেতে পারবে,

(১) ألا يكون العمل معصية (২) ألا يكون عملها مما يكون فيه خلوة بأجنبي (৩) ألا تخرج لعملها متبرجة متزينة بما يثير الفتنة

অর্থ : (১) কাজটি গুনাহের না হওয়া (২) নারীর কাজটি এমন স্থানে না হওয়া যেখানে পরপুরুষের সাথে একত্রে কাজ করতে হয় (৩) কাজের জন্য এমন সাজসজ্জা সহকারে বের না হওয়া, যা ফিতনা-ফ্যাসাদের দিকে প্ররোচিত করে। (আল মাউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ ৭/৮৩-৮৪)

মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানভী রহ. বলেন,

নারীর ভরণ-পোষণ স্বামীর দায়িত্বে। কিন্তু কোনো নারীর যদি উপার্জনে সক্ষম অভিভাবক না থাকে তাহলে নিরুপায় অবস্থায় অর্থ উপার্জনের জন্য তার কর্ম বা চাকুরি করার অনুমতি আছে। তবে এ জন্য শর্ত হল, তার ভাবগাম্ভীর্যতা এবং অনুকূল পরিবেশ ও পর্দার ব্যবস্থা থাকতে হবে। পরপুরুষের সঙ্গে একত্রে দায়িত্ব পালন করা জায়েয নেই। (আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল ৬/৩৮)

বস্তুত ইসলামী আইনে নারী জীবনের প্রতিটি ধাপে তার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তার প্রতি যতœশীল করে তোলা হয়েছে বাবা ভাই স্বামী ও ছেলেকে। এ যতœ ও সচেতনতাকে করা হয়েছে পরকালীন মুক্তির অবলম্বন। তাই এখানে নারী খুঁজে পায় মুক্তির তৃপ্তি, শান্তিময় জীবনের স্বাদ। আর যদি এদের কেউ না থাকে তাহলে এ সকল নারীর ব্যয় নির্বাহ করা হবে সরকারী কোষাগার তথা বাইতুল মাল থেকে। নারীর সার্বিক দিক বিবেচনা করেই পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে নির্দেশনা এসেছে

তোমরা তোমাদের ঘরে অবস্থান করো। আর জাহেলী যুগের মেয়েদের মতো রূপ প্রদর্শন করে ঘুরে বেড়িও না। (‘সূরা আহযাব’- ৩৩)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন নারীদের উদ্দেশে বলেন,

নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য প্রয়োজনে বাহিরে বের হওয়ার অনুমতি আছে। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৪৭৯৫, সহীহ মুসলিম; হা.নং ৫৭৯৬)

ইসলামী আইনে নারীর অবস্থান

আজ নারী অধিকারের নামে নানা রকম শ্লোগানে মুখরিত হচ্ছে রাজপথ ও মিডিয়া পাড়া। এসব শ্লোগানের সার বক্তব্য হলো,

আবহমান কাল থেকে চলে আসা ইসলামী আইনের অবাঞ্ছিত শেকড় উপড়ে ফেলো। তবেই নারী অধিকারের পথ সুগম হবে। প্রতিষ্ঠা পাবে নারীত্বের পূর্ণ মর্যাদা। নারী ফিরে পাবে তার হারানো অধিকার।

অন্যভাবে বলতে গেলে,

ইসলামী আইন একটি বৈষম্যমূলক সেকেলে আইন। আধুনিকতার এ যুগের সাথে এ আইন সঙ্গতিপূর্ণ নয়। নারীদেরকে এ আইনের বাধন ছিড়ে উন্মুক্ত প্রান্তরে বেরিয়ে আসতে হবে। (নাউযুবিল্লাহ)

কিন্তু প্রশ্ন হলো, নারী অধিকারের এ বুলিগুলো আমাদের কে শিখিয়েছে? তাদের পরিচয় কি আমরা জানি? তারা কোন স্বার্থে আমাদের মুসলিম নারীদের মুখে অদ্ভুত এ বোল ফুটিয়ে দিল? আজকের যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। আজকের যুগ অনুসন্ধিৎসা ও যুক্তিবাদের যুগ। আজজের যুগ বিজ্ঞানময় যুগ। আমার মুখে এ জাতীয় শ্লোগান উচ্চারিত হবার আগে আমাকে ভাবতে হবে, আমি কি মুসলিম? কুরআন কি সত্য? বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি সত্য? তার আনীত ধমাদর্শ কি সত্য? ইসলাম ধর্মÑ এটা কি কোনো মেয়াদী ধর্ম? এ ধর্মের কার্যকারিতা কি কোনো যুগ কালের সাথে সম্পৃক্ত? ইসলামী আইনের ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য করার আগে আমাকে এ প্রশ্নগুলোর ব্যাপারে পরিষ্কার ধারনা লাভ করতে হবে। উত্তরগুলো যতি নেতিবাচক হয় তবে সে ব্যাপারে আপাতত আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। পক্ষান্তরে যদি ইতিবাচক হয় তবে আমাকে পরবর্তী ধাপে ইসলামী আইন এবং নারী অধিকার সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে হবে। কিন্তু এ ধারনা আমি কিভাবে লাভ করবো? নেট ঘেটে, বই পুস্তক পাঠ করে ব্যক্তিগত অধ্যয়নের মাধ্যমে? ইসলামী বিধান লাভের এটা কোনো যথার্থ এবং বিধানগত পদ্ধতি নয়। শাস্ত্রীয় বিধান লাভের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অধ্যয়ন মারাত্মক ক্ষতির কারণ। এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে হলে ইসলামী আইন শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের দ্বারস্থ হতে হবে। বিশেষজ্ঞ পরিচয়ের মাপকাঠিও আমাকে জেনে নিতে হবে। ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞের ব্যবহারিক জীবন ইসলামী আইনের আলোকে নিয়ন্ত্রিত কি না তা জেনে বিশেষজ্ঞ নির্ণয় করতে হবে।

বিভিন্ন ধর্মের নারী অধিকার বিষয়ে যদি তুলনামূলক অধ্যয়ন করা হয় তাহলে ইসলামী আইনে নারীকে কতটুকু অধিকার দেয়া হয়েছে তার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠবে। প্রাক ইসলামী যুগে নারীদের অবস্থান কোথায় ছিল এ ব্যাপারে যদি আমরা সম্যক ধারণা লাভ করি তবে ইসলামী নারী অধিকারের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ইসলামী আইনে একজন মা কে যে পরিমাণ মর্যাদা ও সম্মান দেয়া হয়েছে তার কিয়দাংশ কি একজন বাবাকে দেয়া হয়েছে?

আজ আমরা পর্দা বিধানকে নারী অধিকারের অন্তরায় মনে করছি। কিন্তু এ পর্দা বিধানে কার স্বার্থকতা নিহিত রয়েছে তা কি ভেবে দেখেছি কখনো? নারীর ইজ্জত আবরুর রক্ষাকবচ হিসেবেই পর্দা বিধান প্রণীত হয়েছে।

নারীর কর্মসংস্থান : বিশিষ্টজনের দৃষ্টিভঙ্গি

ক্ষেত্র বিশেষে শরয়ী আইন পরিপালন সাপেক্ষ ইসলামী আইনে নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে অনুমতি দেয়া হলেও তা ইসলামী শরীয়তের রুচির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কিন্তু জাগতিকভাবে খ্যতির শীর্ষে আরোহণকারী বিশিষ্টজনেরাও নারী কর্মসংস্থানের ব্যাপারটিকে ভাল চোখে দেখেন না। আমরা নিম্নে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মন্তব্য তুলে ধরছি।

১. রবীন্দ্রনাথ বলেন,

পুরুষের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়া অর্থোপার্জন স্ত্রীলোকের কার্য নহে। আজকাল একদল মেয়ে ক্রমাগত নাকি সুরে বলছে আমরা পুরুষের আশ্রয়ে আছি, আমাদের অবস্থা অতি শোচনীয়। তাতে করে কেবল এই হচ্ছে যে, স্ত্রী-পুরুষের সম্বন্ধ বন্ধনহীণতা প্রাপ্ত হচ্ছে। তাতে স্ত্রীলোকের অবস্থা উন্নতি হওয়া দূরে থাক তাদের সম্পূর্ণ ক্ষতি হবে। আজকাল পুরুষাশ্রয়ের বিরুদ্ধে যে একটা কোলাহল হচ্ছে সেটা আমার অসঙ্গত এবং অমঙ্গলজনক মনে হয়।

২. মুসলিম রমণীদের লক্ষ্য করে কবি ইকবাল বলেন,

তোমাদের স্থান কিন্তু হৈ-হাঙ্গামায় তাড়িত মাঠ প্রান্তর নয়। কল-কারখানা তোমার নির্বাস নয়। তুমি যদি পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবিকার সন্ধানে লেগে যাও তাহলে জাতির সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা হয়ে যাবে। মানবতার প্রতি অবিচার হয়ে যাবে। ‘হে নারী তোমার সৌভাগ্য তো এখানে, তুমি নবী নন্দিনী ফাতিমার পথে চলবে। স্বামীর ঘর আবাদ করবে। স্বামীকেই বানাবে চাওয়া-পাওয়ার লক্ষবিন্দু। স্বামীর ঘরে বসে এমন সন্তান গড়ে তুলবে, যারা মুসলমানদের দুর্দিনের কান্ডারী হবে। ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য জীবন বিলিয়ে দিবে অকুন্ঠ চিত্তে। এখন ইসলাম বড় অসহায়। ইসলামের জন্য কিছু হাসান-হোসাইন রাযি. প্রয়োজন। আর এই প্রয়োজন পূরণ করতে পারে কেবল মুসলিম জননীরা।’

৩. বিশিষ্ট ও বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক সোলসায়মন রিভিউ অব রিভিউজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেন,

নারীর নারীই থাকা উচিত। হ্যাঁ, অবশ্যই নারীকে নারীই থাকতে হবে। তাতেই তাদের কল্যাণ এবং এই একমাত্র  বৈশিষ্ট্যই তাদের কল্যাণের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। প্রকৃতির এটাই বিধান এবং এভাবেই প্রকৃতি তাদের পথের নির্দেশ দিয়েছে। তাই তারা যতখানি প্রকৃতির সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে চলবে, ততখানি তাদের সাফল্য ও মর্যাদা সুস্পষ্ট ভাবে বেড়ে চলবে। আর যতই তারা প্রকৃতির ব্যবস্থা থেকে দূরে সরে থাকবে, ততই বিপদ বেড়ে যাবে। কোন কোন দার্শনিক মানব জীবনে পবিত্রতার বালাই রয়েছে বলে স্বীকার করেন না। আমি বলছি, মানব জীবনে মনোমুগ্ধকর পবিত্রতার ব্যাপক অস্তিত্ব বিরাজমান। হ্যাঁ, তা শুধু তখনই দেখা দিতে পারে যখন নর ও নারী নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র ও দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ থাকবে এবং তা একনিষ্ঠভাবে সম্পাদন করে চলবে।’ অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যে নারী স্বীয় গৃহ ছেড়ে বাইরের কাজে মত্ত হতে চায়, সন্দেহ নেই যে, সে পুর্ণাঙ্গ কর্মী হিসেবেই দায়িত্ব সম্পাদন করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে তখন আর নারী থাকেনা।

৪. খ্যাতিমান লেখক অধ্যাপক জিওম ফ্রেয়ারো বলেন,

যেসব নারী সমাজ জীবনের মূল ভিত্তি দাম্পত্য জীবনের প্রতি তীব্র ঘৃণা রাখছে, স্রষ্টা যে জন্য তাদের সৃষ্টি করেছেন আর যে প্রয়োজনে তাদের এ ধরণের দৈহিক ও মানসিক রূপদান করেছেন, তারা তাকেই বেমালুম ভুলে গেছে। তাদের মেজাজে স্রষ্টার দেয়া সেই বৈশিষ্ট্য আর অবশিষ্ট নেই, যা সেই বয়সের নারীদের ভিতরে স¦ভাবত পাওয়া যায়। তারা আজ এমন এক স্তরে এসে পৌঁছেছে, যাদের ‘নপুংসক’ ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। বস্তুত তাদের পুরুষ বলবার যেরূপ জো নেই, তেমনি নারী বলবার ও সাধ্য থাকেনা। উপরন্তু, তারা উভয় প্রকৃতির সংমিশ্রণে তৃতীয় এক আজব জীব হয়ে পড়েছে। পুরুষ হওয়া তো তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা এজন্য যে, প্রকৃতি তাদের দেহ ও মন এরূপে গড়ে ফেলেছে, যার সংশোধন তাদের সাধ্যাতীত ব্যাপার। আর নারী ও এজন্য থাকছে না যে, তাদের কাজ কর্ম, হাবভাব ও চালচলন সবই পুরুষের, নারীর গন্ধ ও তাতে নেই।

৫. বিশিষ্ট দার্শনিক প্রুধোঁ বলেন,

প্রকৃতির বিধানই নারীকে মানবের সাংস্কৃতিক জীবনের উম্মুক্ত ময়দানে অংশগ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছে। সে শিক্ষার দুর্গম পথ অতিক্রম করতে চায়, কিন্তু শিক্ষা তাকে সহায়তা করতে নারাজ। তাই তাদের বর্তমান পদক্ষেপের ভয়াবহ পরিণতির আশংকায় আমরা দিন গুনছি। মানব সভ্যতার ইতিহাসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিত্য নতুন আবিষ্কারের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে তাদের কোনই অবস্থান নেই। নারীদের  কোনোরূপ সহযোগিতা না নিয়েই মানব জাতি সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শনৈঃ শনৈঃ এগিয়ে চলছে। পরিষ্কার ভাষায় বলা চলে, একমাত্র পুরুষ জাতিই গবেষণা ও আবিষ্কারের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রয়েছে। সেগুলোকে তারা যুগে যুগে পূর্ণতায় পৌঁছিয়ে চলছে। সে সবের যথাযোগ্য প্রয়োগ তাদেরই হাতে হচ্ছে। তার থেকে শুভাশুভ ফল যা কিছু তারা উৎপাদন করছে, তার থেকেই তারা নারীদের ভরণ পোষণ ও সুখ-শান্তির ব্যবস্থা করে চলছে।

৬. দার্শনিক অগাস্ট কোঁতে বলেন,

পুরুষের ক্ষেত্রে নারীদের চর্চার ফলে ভয়াবহ পরিণাম ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে চলছে। এর প্রতিকার হচ্ছে, পুরুষের ব্যাপারে স্ত্রী জাতির স্বাভাবিক যে বৈষয়িক দায়িত্ব রয়েছে, তা বিশেষভাবে সীমিত ও নির্দিষ্ট করে দেয়া।

৭. উনিশ শতকের খ্যাতনামা মনীষী স্যামুয়েল স্মাইলস বলেন,

প্রাচীন রোমকদের দৃষ্টিতে শালীন মেয়েদের সবচেয়ে প্রশংসনীয় উঁচুস্তরের কাজ হচ্ছে ঘরকন্না চালানো এবং বাইরের টানা হেঁচড়া থেকে মুক্ত থাকা। আমাদের এ যুগেও বলা হয়, নারীদের ভূগোল শিক্ষা এ জন্য অপরিহার্য যে, তারা নিজ নিজ ঘরের দরজা জানালা গুলো যথাযথ স্থানে বসাবার ব্যবস্থা করতে সমর্থ হবে। রসায়ন শিক্ষা তাদের এ জন্য শেখা দরকার যে, হাঁড়ির রান্নার সামগ্রি উথলে উঠলে যেন যথা সময়ে সামলে নিতে পারে। লর্ড বায়রণ নারীর প্রতি অতি মাত্রায় আসক্ত হয়েও অভিমত পেশ করেছেন- মেয়েদের লাইব্রেরীতে ধর্মগ্রন্থ ও পাকপ্রণালী ছাড়া আর কোন বই থাকা অনুচিৎ।

এ জাতীয় অসংখ্য বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক থিউরি রয়েছে যা নারী-পুরুষের কর্মক্ষেত্রের ভিন্নতারই প্রকৃষ্ট বার্তা বহণ করে। সুতরাং এসব কুরআনের বাণী, বৈজ্ঞানিক থিউরী ও প্রাকৃতিক বিধি থেকে প্রতীয়মান হয়, নারী-পুরুষের কর্মক্ষেত্র এক ও অভিন্ন না হয়ে ভিন্ন হওয়াই যুক্তিসঙ্গত। উপরন্ত, নারীর উন্নতির একমাত্র ক্ষেত্রফল হলো তার সংসার। সংসারেই নারীর নারীত্ব যথারূপে বিকশিত হয়। কিন্তু আজকের নারী সমাজ এসব থিউরিতে আগ্রহবোধ করছে না। তারা আজ সংকীর্ণ বুদ্ধি বিবেচনায় তাড়িত হয়ে নীতিবিরুদ্ধ অধিকারের কথা বলে। নারী-পুরুষের কর্মক্ষেত্র অভিন্ন হবার যুক্তিহীন দাবী তোলে। এক্ষেত্রে মূলত পুরুষ নামের কিছু স্বার্থান্ধ মহল নারীত্ব প্রচারের উপাদান যোগায়। নারীকে তারা প্রগতির ব্যানারে স্বনির্ভরতার লোভ দেখায়। এক্ষেত্রে প্রধানতম দুটি স্বার্থকে সামনে রেখে তারা নারীবাদ প্রচারে ভূমিকা রাখছে। ১। স্বভাবজাত প্রবৃত্তিগত চাহিদা পূরণে সার্বক্ষণিকভাবে নারীত্বের নৈকট্য প্রয়োজন। ২। স্ত্রী, মা, বোন, মেয়েদের ব্যয় নির্বাহের মত ঘাম ঝরানো বন্দিশালা থেকে অবমুক্তি প্রয়োজন। এ দুটি স্বার্থ উদ্ধারে তাদের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ালো নারীকে গৃহ ত্যাগে আগ্রহী করে তোলা। কিন্তু আবহমান কালের সংসারী নারীকে গৃহবিমুখ করা একটি কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই তারা হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার মত নারী প্রগতি, নারী স্বাধীনতা এবং নারী অধিকারের বাশি বাজিয়ে নারীদেরকে দলে দলে ঘরের বাহিরে নিয়ে এলো। সহজ-সরল, আত্মভোলা নারীরা পুরুষের পাতা ফাঁদে আটকে গেল। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে নারীরা আজ অবধি সেই পাতা ফাঁদ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। প্রগতির মূলো দেখিয়ে তারা নারীদেরকে ঘর থেকে টেনে বের করে আনল। তাদেরকে ঠেলে দিল ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ এক দুর্গম পথে। মেয়েকে পৃৃথক করে দিল পিতা থেকে, বোনকে ভাই থেকে, স্ত্রীকে স্বামী থেকে, মাকে ছেলে থেকে। সেই সাথে সংসারের সুখ-শান্তি, মায়া-মমতার অপমৃত্যু ঘটল করুনভাবে। শারীরিক এবং মানসিকভাবে তুলনামূলক দুর্বল নারীদের পক্ষে ঘরে বাহিরÑ দুটো জগতকে সামাল দেয়া কি করে সম্ভব হবে? এক দিকে সাংসারিক দায়িত্ব অপর দিকে গৃহবহির্ভূত পুরুষের ন্যায় হাড়ভাঙ্গা খাটুনি।

গৃহবিমুখ নারী : পরিপ্রেক্ষিত সামাজিক অবক্ষয়

নারী যখন গৃহকর্মকে উপেক্ষা করে বহির্জাগতিক কাজে মনোযোগী হবে তখন তার অশুভ প্রভাব পরিবারের গণ্ডি ছাপিয়ে ধীরে ধীরে সমাজের উপর গিয়ে পতিত হবে। পারিবারিক ব্যবস্থা হলো সভ্যতা ও সংস্কৃতির সূতিকাগার। সমাজের পারিবারিক অবকাঠামো যদি বিধ্বস্ত হয় তাহলে সে দেশের মাটি স্বর্ণ প্রসব করলে বা কলকারখানা-মিলফ্যাক্টরী মনি-মুক্তা উৎপাদন করলেও মানুষ সুখ শান্তির নাগাল পাবে না। শান্তি নামক সোনার হরিণ অধরাই থেকে যাবে আজীবন। ইউরোপ আমেরিকায় পারিবারিক জীবন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার কারণে সেখানকার সমাজ জীবনে অশান্তি ও অস্থিতিশীলতার চরম অবস্থা বিরাজ করছে। মানুষ অশান্তির অনলে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। অথচ তারা পশ্চাদপদ এমনকি উন্নয়নশীল দেশের জন্য রাজনৈতিক ও অর্র্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঈর্ষণীয় স্থান দখল করে আছে। কিন্তু সম্পদের প্রাচুর্য ও বস্তুগত উন্নতি সত্ত্বেও মানুষ এক অজানা অস্থিরতায় ভুগছে। এই অস্থিরতা লাঘবে কেউ মাদকাসক্ত হচ্ছে, আর কেউ ঘুমের ট্যাবলেট গিলে শান্তি অন্বেষণ করছে। অবশেষে এগুলোও যখন অস্থিরতা লাঘবে ও প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয় তখন সর্বশেষ হাতিয়ার হিসেবে আত্মহত্যাকে বেছে নেয়া হয়। আর এ জন্যই সেখানে আত্মহত্যার হার দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাস্টিস মুফতী তক্বী উসমানী সাহেব বলেন,

কিছুদিন আগে আমি সুইজারল্যান্ডে সফরে গিয়েছিলাম। নিমন্ত্রণকারীরা আমার ব্যবহারের জন্য যে গাড়িটির ব্যবস্থা করেছিল তার ড্রাইভার ছিল ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত এক শিক্ষিত লোক। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই এ লোকটি অনায়াসে ইংরেজী বলতো। এখনো সে বিবাহ করেনি। সফরকালীন কয়েকদিন সে আমার সাথেই থাকে। আমি তার খোঁজ খবর নেই। বিবাহ না করার কারণ সম্পর্কে সে বলল, ‘আমাদের সমাজে বিবাহ-শাদী অর্থহীন হয়ে পড়েছে। বিবাহত্তোর স্বামী-স্ত্রীর মাঝে স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে উঠে না। বিবাহ এখন অস্থায়ী ও কৃত্রিম সম্পর্কের অপর নাম। অনেক ক্ষেত্রেই এখন বিবাহের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, একে অপর থেকে আর্থিক সুবিধা লাভ করা। এ জন্য বহু নারীদের দেখা যায় তারা বিবাহের পর দ্রুত ডিভোর্স দিয়ে দেয়। আর সরকারি আইনের সুবাদে স্বামীর সম্পদের বিশাল অংশ হাতিয়ে নিয়ে তাকে দেউলিয়া বানিয়ে দেয়। এ সমাজে বুঝা দুস্কর যে, কে স্বামীর সম্পদ হাতিয়ে নেয়ার জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে; আর কে বিশ্বস্ততার সাথে জীবন কাটানোর জন্য অটুট বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে।’ বেদনাভরা কণ্ঠে সে কথাগুলো বলে শেষ করলো। পরে আক্ষেপ ও আফসোসের সুরে সে একথাও বললো ‘আহ! আপনাদের এশিয়ান রাষ্ট্রগুলোতে বিবাহের বন্ধন কতোইনা অর্থবহ। বিবাহের সুবাদে এক চমৎকার স্থায়ী পারিবারিক জীবন অস্তিত্ব লাভ করে। একে অপরের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়। আমরা এমন পারিবারিক জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছি।’ আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার বাবা-মা, ভাই-বোনেরা কি একজন ভালো স্ত্রীর সন্ধানে তোমাকে সাহায্য করে না? সে আমার কথা শুনে আশ্চার্য বোধ করে বললো, আমার পিতা-মাতা তো বেঁচে নেই। ভাই-বোন আছে কিন্তু তাদের সাথে আমার বিবাহের কি সম্পর্ক! প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত। অপরের এ বিষয়ে চিন্তা করার সুযোগ কোথায়? প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ সমস্যার সমাধান নিজেই করে থাকে। আমার তো তাদের সাথে সাক্ষাত হতেই বছরের পর বছর পার হয়ে যায়।’

এ হলো একজন ড্রাইভারের মন্তব্য। এ থেকে সহজেই অনুমিত হয়, পশ্চিমা বিশ্বের পারিবারিক এবং সামাজিক অস্থিরতার গতি প্রকৃতি। এ সবই নারী স্বাধীনতার অশুভ পরিণতি। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্ভাচেভ বলেন,

আমরা আমাদের কঠিন বাস্তবতা সম্পন্ন দুঃসাহসিক ইতিহাসের অতীত বছরগুলোতে নারীদের যেসব অধিকার ও প্রয়োজনের প্রতি মনোযোগ আরোপ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি তা হলো মা ও গৃহিণী হিসেবে, তেমনি সন্তানদের আদব-শিষ্টাচার প্রশিক্ষণ ও প্রতিপালনের ক্ষেত্রে নারীদের করণীয় বিষয়। নারীদের করণীয় এ সুফল থেকে সমাজ চরম ভাবে বঞ্চিত হয়েছে। নারীরা যেহেতু বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেছে, ভবন নির্মাণের তদারকি, বিভিন্ন উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে, এ ছাড়া অন্যান্য শ্রমনির্ভর কাজে ব্যস্ত থাকছে তাই তারা এতটুকু সময়ই বের করতে পারছে না, যার দ্বারা পারিবারিক দৈনন্দিন কাজ সামলাবে এবং সন্তান পালন ও পারিবারিক উন্নত পরিবেশ সৃষ্টিতে অবদান রাখবে। এখন আমাদের নিকট এ তত্ত্ব বড় পরিষ্কারভাবে উন্মোচিত হয়েছে, আমাদের বহু সমস্যা যা শিশু ও তরুণদের জীবন পদ্ধতি কেন্দ্রিক; নীতি-নৈতিকতা, সভ্যতা-সংস্কৃতি ও উৎপাদন সংক্রান্ত। এগুলো এ কারণেই  দেখা দিয়েছে যে, আমাদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে গেছে। পারিবারিক কর্ম ব্যস্ততা পালনে সবাই দায়দায়িত্বহীন ও উদাসীন হয়ে গেছে। আমরা নারীদের প্রত্যেক বিষয়ে পুরুষের সমকক্ষ দাঁড় করার যে রাজনৈতিক যথার্থ ও নিষ্ঠাপূর্ণ চেষ্টা করেছি এটা সে চেষ্টার বিপরীতমুখী ফলাফল।

এ জন্যেই এখন আমরা সমাজ পূর্ণগঠনে এ ত্রুটি সামলানোর চেষ্টা শুরু করে দিয়েছি। আর এ কারণেই মিডিয়া, জনসংগঠন, বিভিন্ন কর্মস্থল এমনকি নিজ নিজ বাড়িতে এমন জোরালো আলোচনা পর্যালোচনা চালানো হচ্ছে যে নারীদের নিরেট নারীত্বের মিশনের প্রতি কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায় এবং তার জন্য আমাদের কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ। (চবৎংংঃৎড়রপধ; পৃষ্ঠা ১১৭, মুদ্রণ ১৯৮৭)

এটি হল, এমন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তি, যার সমাজ ব্যবস্থায় পারিবারিক জীবন বা নারী-পুরুষের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে কোন ধরনের ধর্মীয় মূল্যবোধের দখল নেই। সে সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধের ধারণাই নেই। অতএব পারিবারিক ব্যবস্থা বিধ্বস্ত হওয়ার উপর তার আক্ষেপ কোন প্রত্যাদেশগত নির্দেশনার প্রতিফলন নয়; বরং নিরেট বস্তুবাদী জীবন দর্শন সচক্ষে প্রত্যক্ষকরণ ও সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতালব্ধ প্রতিক্রিয়া।

এ তো হলো, নারীর গৃহবিমুখ বা কর্মস্থলমুখিতার অশুভ পরিণতি একটি দিক। অন্যদিকে নারীরা আপন কর্মস্থলে গিয়ে কি পরিমাণ লাঞ্ছনা ও যৌন হয়রানীর শিকার হচ্ছে তার পরিসংখ্যান দিতে গেলে বড় সড় একখানা অভিসন্দর্ভ প্রস্তুত হয়ে যাবে। বস্তুত বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থায় নারী বিবেচিত শুধু ভোগের বস্তু হিসেবে। এ বিষয়ে শিক্ষিত-অশিক্ষিতের মাঝে কোন প্রভেদ ও মতভেদ নেই। আধুনিক সমাজের গর্বিত সদস্যগণ মুখে মুখে নারীর মর্যাদা ও অধিকারের কথা বললেও বাস্তব ক্ষেত্রে তারা উপরোক্ত বিশ্বাসেরই প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকেন। দৈনিক পত্রিকার পাতা থেকে দু একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি।

গত ১১/০৮/২০১০ ইং তারিখে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র‌্যাব) এর সদস্যরা রাজধানির একটি বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে গ্রেফতার করেছে। র‌্যাব-৯ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের কমান্ডার কাওসার মাহমূদ জানিয়েছেন, ঐ শিক্ষক বিয়ের প্রলোভন দিয়ে একজন তরুণির সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং গোপন ক্যামেরায় সে দৃশ্য ধারণ করে। এর পরের কথা বলাই বাহুল্য। এক পর্যায়ে সে বিদেশে পিএইচডি করতে যাওয়ার কথা বলে মেয়েটির কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে এবং টাকা দিতে ব্যর্থ হলে ধারণকৃত ভিডিওচিত্র বাজারজাত হবে বলে হুমকি দেয়। নিরুপায় হয়ে মেয়েটি মামলা দায়ের করলে ঐ শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয় এবং তার বাসার কম্পিউটার থেকে ঐ সব ছবি ও ভিডিওচিত্র উদ্ধার করা হয়। মামলা দায়ের প্রসঙ্গে মেয়েটি বলেছে যে, ‘আর কোন মেয়ে যাতে এই ব্যক্তির দ্বারা প্রতারিত না হয় এজন্য মামলা দায়ের করেছি।’ (দৈনিক আমাদের সময়; ১৩ আগস্ট ২০১০ ইং)

ঘটনার শিকার মেয়েটি তো মূর্খ বা অসচেতন নয়। তাহলে কেন সে ‘প্রতারিত’ হল? তদ্রƒপ প্রতারক ও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো কোন ভাসমান ‘বখাটে’ নয়, তিনি রাজধানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রতিষ্ঠিত শিক্ষক, অতএব শিক্ষিত।

আইরিণ আক্তার (২২) একজন গার্মেন্টকর্মী। মিরপুরের একটি গার্মেন্টে কাজ করার সময় এক সহকর্মী তাকে উত্যক্ত করত। তাই মিরপুরের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে আদমজী একটি গার্মেন্টে চাকুরি নিয়েছিল। এদিকে ঐ সহকর্মী ও বিভিন্নভাবে খোঁজা-খুজি করে আদমজির ঐ গার্মেন্টে চাকুরি নেয় এবং মেয়েটিকে বিরক্ত করতে থাকে। গত ৪ মে আইরিন বাদী হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি জিডি করলেও পুলিশ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। গত ২২ আগস্ট সকালে ঐ সহকর্মী আইরিনের বাসায় গিয়ে তাকে না পেয়ে তার বোনকে মারধর করে। থানায় জানানো হলেও পুলিশ তাতে কর্ণপাত করেনি। নিরুপায় হয়ে আইরিন বাসায় ফেরে এবং গলায় ওড়না পেঁচিয়ে সিলিং-ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়ে। কিন্তু ভাগ্য ভালো যে, প্রতিবেশিরা টের পেয়ে দ্রুত ছুটে এসেছিল, ফলে সে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায়। ঘটনাটি নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। (আমার দেশ; ২৩ আগস্ট পৃষ্ঠা ২)

যখন থেকে আমাদের সমাজে পাশ্চাত্য চিন্তাধারার প্লাবন আছড়ে পড়েছে। বিশেষ করে টি, ভি, ভিডিও ইংলিশ ফিল্মের ছড়াছড়ি শুরু হয়েছে, বিধর্মীদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের গ্রাস করে নিয়েছে, তখন থেকে আমাদের কেউ অচৈতন্যে আর কেউ সচেতনভাবেই সেই পশ্চিমা বিশ্বের সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছি।

আলহামদুলিল্লাহ, এখনো আমাদের সমাজে পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েনি। কিন্তু যে গতিতে পশ্চিমা সভ্যতার আগ্রাসন আমাদের মাঝে বিস্তার করছে, আমাদের গ্রামে-গ্রামে, বাড়ি-বাড়ি তাদের নোংরা জীবন পদ্ধতি মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তা ভাবনাহীন চিত্তে নারীদের ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে। তাদের পুরুষের কাধেঁ কাঁধ মিলিয়ে সর্বক্ষেত্রে উৎপাদনের উপকরণ ভবপঃড় ঢ়ৎড়ফধপঃরড়হ বানানোর আত্মঘাতি অপচেষ্টা চলছে। পরিবার ও পারিবারিক জীবন থেকে যেভাবে দ্রুতগতিতে ইসলামী শিক্ষা বিদায় নিচ্ছে, তা আমাদের ভবিষ্যৎ পারিবারিক জীবন ব্যবস্থার জন্য মারাত্মক অশনি সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন থেকেই এর প্রতিবিধানে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। নতুবা পারিবারিক জীবনের সব সুখ-শান্তি, বিশ্বস্ততা ও পবিত্রতা ধূলোয় মিশে যাবে।

উপসংহার

পৃথিবীর অতীত ইতিহাসে নারীর মান সম্মান বলতে কিছু ছিল না। প্রাচীন পণ্ডিত এবং দার্শনিকরা দীর্ঘদিন যাবত বিতর্ক করে নিজেদের সময় ব্যয় করেছেন যে, নারীদের মাঝে কি রুহ বা আত্মা বলে কিছু আছে? আর যদি থেকেই থাকে-তাহলে তা কি মানুষের না কোন পশুর? আর যদি মানুষের আত্মা হয়ে থাকে তাহলে পুরুষের বিপরীতে তার সামাজিক অবস্থান কোথায়? নারীরা কি জন্মগতভাবে পুরুষের দাস? ইত্যাদি। গ্রীক এবং রোমান সমাজেও নারী ছিল নিগৃহীত, নির্যাতিত, শোষিত।

ইসলামী আইনে আদর্শিক, চারিত্রিক সংস্কারের ফলে নারীজাতি সামাজিক যে মর্যাদা ও সম্মান লাভ করেছে, এর দৃষ্টান্ত দুনিয়ার কোন সমাজ ব্যবস্থা, মতবাদ ও ধর্ম উপস্থাপন করতে পারেনি। ইসলামী আইনে নারীজাতি সত্তাগতভাবে জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক মর্যাদা ও উৎকর্ষতার ঐ শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম যেখানে পুরুষ আরোহণ করতে পারে। এ মর্যাদা বা সম্মান প্রাপ্তিতে নারীত্ব কোনো বাধা বা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না।

আজ বিশ্বব্যাপী নারী স্বাধীনতা ও নারী প্রগতির নামে নারীর নারীত্বকে বিনষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। অপরিণামদর্শী কিছু মানুষ নারীকে ভোগের উপকরণ ও ব্যবসায়ী পণ্য রূপে উপস্থাপন করছে। গৃহকর্ত্রী, স্বামীর জীবন সঙ্গিনী, সন্তানের জননী হিসেবে বর্তমান সমাজে নারীর কোনই মর্যাদা দেয়া হচ্ছে না। একমাত্র ইসলামই সার্বিকভাবে নারীকে তার স্বভাবজাত অবস্থানে রেখে যথাযথ মর্যাদা প্রদান করছে। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় নারী-পুরুষকে স্ব স্ব অবস্থানে রেখেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত করা হয়। এজন্য তাদের আলাদা আলাদা কর্মস্থলের ব্যবস্থা করেছে ইসলাম। ইসলামে নারী পুরুষ উভয়ই মানুষ হিসেবে সমান মর্যাদার অধিকারী। পুরুষত্বের কারণে সম্মান লাভ করবে, নারীত্বের কারণে লাঞ্ছনা ভোগ করবেÑ এরূপ আচরণ ইসলামে পরিত্যাজ্য।

আমাদের কর্তব্য হল নারীকে তার পূর্ণ অধিকার প্রদান করা। তার উপর যুলুম-নির্যাতন, অন্যায়-অবিচার করা হতে সম্পূর্ণ রূপে বিরত থাকা। ইসলামী আইনের নারী অধিকারগুলো যদি সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় তবে নারীর উপর যাবতীয় অনাচারের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। তখন কর্মসংস্থানের আবেদনও ফুরিয়ে যাবে। আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামী বিধান মতো জীবন পরিচালনা করার তাউফীক দান করুন।

তথ্যসূত্র : ১. কুরআনুল কারীম, ২. সহীহ বুখারী, ৩. সুনানে আবু দাউদ, ৪. সহীহ মুসলিম, ৫. সুনানে তিরমিযী, ৬. মুসনাদে আহমাদ, ৭. তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, ৮. আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ, ৯. আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল, ১০. Persstroica, ১১. দৈনিক আমাদের সময়, ১২. দৈনিক আমার দেশ

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য আছে “নারীর কর্মসংস্থান : শরয়ী দৃষ্টিভঙ্গি”

  1. অসাধারণ লিখেছেন স্যার।চিন্তার মানে অনেক পরিবর্তন এসেছে।

    একটি প্রশ্ন,, আমার মা,বোন বা স্ত্রী সহ আমি বাহিরে কোথাও আছি।এসময় আমার কোন পরিচিত জনের সাথে দেখা হলে আমার মা,বোন বা স্ত্রী কি উক্ত ব্যক্তির সাথে কথা বলা বা পরিচিত হতে পারবে?

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *