মুফতী নূরুল আমীন
[হযরত মুফতী নূরুল আমীন সাহেব দা.বা.। আরেফ বিল্লাহ শাহ হাকীম মুহাম্মাদ আখতার সাহেব রহ.এর বিশিষ্ট খলীফা এবং খুলনার আলেমকুল শিরোমণি। তিনি বিগত বছর একাধিক বার মা’হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়ায় সদয় তাশরীফ রেখেছিলেন। এ সময় মা’হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়া ছাড়াও আশপাশের বেশ কয়েকটি মাদরাসায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বয়ান পেশ করেছেন। তন্মধ্য হতে একটি বয়ান নিম্নে তুলে ধরা হল। বয়ানটি তিনি আল-ইসলাহ উলামা পরিষদ কেরাণীগঞ্জ -এর উদ্যোগে আয়োজিত মাসিক ইসলাহী মাহফিলে করেছিলেন। বয়ানের স্থান ছিল শিকারীটোলা মাদরাসা। শ্রোতাগণের অধিকাংশই ছিলেন উলামায়ে কেরাম। বয়ানটি অডিও থেকে পত্রস্থ করার শ্রমসাধ্য কাজটি আঞ্জাম দিয়েছেন মা’হাদের উস্তাদ মুফতী মাহমূদ বিন ইলয়াস। -সম্পাদক]
হামদ ও সালাতের পর…
আল্লাহ তা‘আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উম্মতের ইসলাহের জন্য প্রেরণ করেছেন। কারণ ঈসা আ. এর পর ৫৭০ বছর কোন নবী-রাসূল আসেননি। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াতে আসার পরও ৪০ বছর নিয়মতান্ত্রিক দীনের কাজ হয়নি। এই ৬১০ বছরে মানবজাতির আত্মিক ও নৈতিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটেছিল। তাই আল্লাহ তা‘আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ত্রাণকর্তারূপে প্রেরণ করেন। যেমন কোন দেশ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ হলে বিভিন্ন দাতা দেশ ত্রাণবাহী জাহাজ পাঠায় যেন সে দেশ পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। ৬১০ বছরের নবী-রাসূল শূন্য সময়ে উম্মতের দিল তো দুর্গত দেশের চেয়েও ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গিয়েছিল। তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাঠালেন এবং তাঁকে প্রথমে একটি কাজ দিলেন। তাহল কুরআন তিলাওয়াত। প্রথমেই আল্লাহ তা‘আলা ওহী পাঠালেন- আপনি আপনার রবের নামে পড়ুন।
প্রশ্ন হতে পারে, কুরআন পাঠে উম্মতের ত্রাণ-সাহায্য কিভাবে হবে? অধঃপতনের অতল গহ্বর থেকে উম্মত কিভাবে উদ্ধার হবে? পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এ প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন,
আপনি পড়ুন, আপনার রব দানশীল। (সূরা আলাক-৩)
সুতরাং কুরআন বেশি বেশি তিলাওয়াত করতে হবে। তাহলে তিনিই সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিবেন।
কুরআনের এক নাম রশিবা ‘হাবলুল্লাহ’। কেউ যদি কূপে পড়ে যায় তাহলে তাকে উদ্ধার করার পন্থা হল, কোন মজবুত ব্যক্তি মজবুত রশি ফেলবে। অতঃপর পতিত ব্যক্তি সে রশি শক্তভাবে ধরবে। যদি সে শক্তভাবে ধরে তাহলে উঠে আসতে পারবে; উঠে আসবে। আর যদি নড়বড়ে বা ঢিলেঢালাভাবে ধরে তাহলে উঠে আসতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, হে নবী! এ জাতি তো অধঃপতনের অতল গহ্বরে পৌঁছে গেছে। এদেরকে উদ্ধার করার জন্য আমি আপনাকে কুরআন নামের এক মজবুত রশি দিয়েছি। এ রশি আপনিও মজবুত করে ধরুন এবং উম্মতকেও মজবুত করে ধরতে বলুন।
কুরআন অবতীর্ণ শুরু হওয়ার পর থেকে তেইশ বছর যিন্দেগীর কোন একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত ছাড়েননি। তিলাওয়াত ছেড়েছেন এমন দাবী কেউ করতে পারবে না। তিনি অনেক দিন আহার গ্রহণ করেননি এটা বলা যাবে; কিন্তু তিলাওয়াত ছেড়েছেন এটা বলা যাবে না। অতএব একথা বলা যায় যে, আল্লাহর নবীর আত্মগত এবং দায়েমী আমল হল, কুরআন তিলাওয়াত। কুরআন তিলাওয়াত সাহাবায়ে কেরামেরও দায়েমী আমল ছিল। সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফটোকপি সাদৃশ।
সর্বপ্রথম অবতীর্ণ আয়াতসমূহে আল্লাহ তা‘আলা দুইবার বলেছেন, পড়ুন। মুফাসসিরীনে কেরাম বলেন, নিশ্চিত করণের জন্য দুইবার পড়ার কথা বলা হয়েছে। এর ক’দিন পর আয়াত নাযিল হল,
يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ. قُمْ فَأَنْذِرْ. وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ. وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ. وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ.
অর্থ : হে চাদরাবৃত! উঠুন, সতর্ক করুন, আপন পালনকর্তার মাহাত্ম্য ঘোষণা করুন, আপন পোশাক পবিত্র করুন এবং অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকুন। (সূরা মুদ্দাসসির- ১-৫)
অর্থাৎ তাকওয়ার সাথে তিলাওয়াত করুন, গুনাহ থেকে বেঁচে থেকে তিলাওয়াত করুন তাহলে আল্লাহর সাহায্য আসতে থাকবে।
এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মসিবত আসতে শুরু করল। নবুওয়াত পূর্ব চল্লিশ বছরে তাঁর উপর কোন মসিবত আসেনি। যখনই কুরআন নাযিল হতে শুরু করল তখনই সকলে শত্রু হয়ে গেল। নেমে আসল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মসিবত। এতে তিনি মানসিকভাবে একটু দুর্বল হয়ে পড়লেন। ফলে তিনি কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমালেন। তখন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে ওহী আসল- হে কম্বলওয়ালা! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদ পড়ুন; তবে সামান্য সময় ব্যতীত। অর্থাৎ যে মসিবত এসেছে তা থেকে নিষ্কৃতি পেতে কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার ও তাহাজ্জুদ পড়তে হবে। তাহলেই এ মসিবত থেকে নিষ্কৃতি পাবেন। মসিবত আর আসবে না। সেদিন থেকেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনদিন তাহাজ্জুদ ছেড়ে দিয়েছেন এমনটি কেউ বলতে পারবে না। যাকে দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা উম্মতের ইসলাহ করাবেন তাকে দিয়ে আল্লাহ কুরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদ পড়াচ্ছেন এবং যিকির করাচ্ছেন।
মুহতারাম! আল্লাহ তাওফীক দিলে উলামায়ে কেরামই তো উম্মতের ইসলাহ করবেন। সাহাবাগণ করেছেন। আমাদের পূর্বসূরীগণ করেছেন। আমাদের দ্বারা কেন উম্মতের ইসলাহ হচ্ছে না? গ্রাম বাংলায় একটা প্রবাদ আছে- যাকে দিয়ে ভূত তাড়াবে তাকেই ভূতে পেয়েছে। যে সরিষা দিয়ে ভূত তাড়াবে সেই সরিষার মধ্যেই ভূত ঢুকে আছে।
উলামায়ে কেরাম উম্মতের ইসলাহ করবেন; অথচ তাদের অনেকেরই ইসলাহ নেই। ইসলাহ করার পূর্ব শর্ত হচ্ছে আগে নিজে ইসলাহ হওয়া। আজ আমাদেরই তো ইসলাহ নেই। যদি আমাদের মাঝে নবীওয়ালা দু’টি সিফাত তাহাজ্জুদ ও কুরআন তিলাওয়াত থাকে, আমরা যদি যিন্দেগীতে কখনো কুরআন তিলাওয়াত ও তাহাজ্জুদ না ছাড়ি তাহলে আমাদের দ্বারাও আল্লাহ তা‘আলা ইসলাহের মত মহান কাজ নিবেন। আপাতত আমরা এই প্রতিজ্ঞা করি যে, এক বছরের মধ্যে কখনো এ দুই আমল ছাড়ব না। তা না হলে কমপক্ষে ছয়মাস। তা না হলে চারমাস। তাও যদি হিম্মত না হয় তাহলে চল্লিশ দিন না ছাড়ার হিম্মত করি। এক চিল্লা পূর্ণ হলে দ্বিতীয় চিল্লা, এরপর তৃতীয় চিল্লা। তিন চিল্লা পূর্ণ হয়ে গেলে ইনশাআল্লাহ এ দুই আমল আর কখনো ছুটবে না।
কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার প্রারম্ভে আল্লাহ তা‘আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শুধুমাত্র পাঠ করার আদেশ দিয়েছেন। কিছুদিন পর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তারতীলের সাথে তিলাওয়াত করুন। (সূরা মুয্যাম্মিল- ৪) তথা কুরআন সহীহ-শুদ্ধভাবে পড়ুন। অতএব কুরআন বিশুদ্ধভাবে পড়া জরুরী। থানবী রহ. এর দরবারে কেউ গেলে তিনি যত বড় আলেমই হন, প্রথমে বলতেন, যান! কুরআন শরীফ পরীক্ষা দিয়ে আসেন। নাযেরা বিভাগে গিয়ে প্রথমে সূরা ফাতিহা শুনাতে হত। এরূপ হারদুয়ী হযরতের দরবারে সূরা ফাতিহার পরীক্ষা দিতে গিয়ে এক মুহাদ্দিস সাহেবের সাতটি লাল দাগ পড়ে। অবশ্য ভুলগুলো সিফাতগত ছিল। বড় কোন ভুল নয়।
ঐ মুহাদ্দিস এক সপ্তাহ লাগিয়ে সূরা ফাতিহার সেই ভুলগুলো সংশোধন করে নিলেন। আজ উলামায়ে কেরামের মধ্যে কুরআন সহীহভাবে পড়ার গুরুত্ব নেই। আমাদের দৈনন্দিন আমলের রুটিনে নির্ধারিত পরিমাণ তিলাওয়াতের আমল নেই। এমনকি আমরা যারা হিফয বিভাগে পড়াই তাদের মধ্যেও তিলাওয়াতের আমল নেই। ছাত্রদের তিলাওয়াত শুনা হয়; কিন্তু নিজের তিলাওয়াত হয় না। আর যারা মুহাদ্দিস তাদের তো সময়ই নেই; মুতালাআয় ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে এ ব্যস্ততা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যস্ততার দিকে তাকালে কিছুই নয়। অথচ আল্লাহ তা‘আলা নবীকে হুকুম দিচ্ছেন, যখন আপনি দাওয়াতী কাজ থেকে ফারেগ হবেন তখন কষ্ট করে ইবাদত করুন। فانصب বলা হয় কষ্ট করে ইবাদত করাকে। মুফতী শফী সাহেব রহ.লিখেন,
আলেমদের জন্য সারাদিনের সকল কাজকর্ম শেষ করে এ পরিমাণ যিকির ইবাদত করা উচিত যাতে কষ্ট অনুভূত হয়।
তিনি দলীল হিসেবে উপরোক্ত আয়াতই পেশ করেছেন। অর্থাৎ যখন আপনি তা’লীম, জিহাদ এবং দাওয়াতী কাজ থেকে অবসর হবেন তখন কষ্টের ইবাদত করুন। প্রশ্ন হয়, জিহাদ, দাওয়াত, তা’লীম এগুলোও তো ইবাদত তাহলে এ সকল ইবাদত শেষ করে আবার কী ইবাদত করবে? মুফতী শফী সাহেব রহ. এর জবাবে লিখেন, এগুলো হল ইনডাইরেক্ট ইবাদত। উম্মতের ভায়া হয়ে ইবাদত। আর কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার এবং তাহাজ্জুদ হল ডাইরেক্ট তথা সরাসরি ইবাদত। আর আল্লাহ তা‘আলা মূলত সরাসরি ইবাদতের জন্যই মানুষকে পাঠিয়েছেন।
وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَكَ عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُودًا.
অর্থ : রাত্রির কিছুঅংশ কুরআন পাঠসহ জাগ্রত থাকুন। এটা আপনার জন্যে অতিরিক্ত। হয়তবা আপনার পালনকর্তা আপনাকে মাকামে মাহমূদে পৌঁছাবেন। (সূরা ইসরা- ৭৯)
يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ. قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا. نِصْفَهُ أَوِ انْقُصْ مِنْهُ قَلِيلًا. أَوْ زِدْ عَلَيْهِ وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا.
অর্থ : হে বস্ত্রাবৃত! রাত্রিতে দণ্ডায়মান হোন কিছু অংশ বাদ দিয়ে; অর্ধরাত্রি অথবা তদপেক্ষা কিছু কম অথবা তদপেক্ষা বেশী এবং কুরআন তিলাওয়াত করুন সুবিন্যস্তভাবে ও স্পষ্টভাবে। (সূরা মুযযাম্মিল- ১-৪)
وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيلًا.
অর্থ : আপনি আপনার পালনকর্তার নাম স্মরণ করুন এবং একাগ্রচিত্তে তাতে মগ্ন হোন। (সূরা মুযযাম্মিল- ৮)
এসব আয়াতে সরাসরি ইবাদতই উদ্দেশ্য। অথচ আজ ইনডাইরেক্ট ইবাদতকে মূল মনে করা হয়। সরাসরি ইবাদতের গুরুত্ব কম দেখা যায়। এজন্য উলামায়ে কেরামই দায়ী। আমাদের নিজের কাজ, দাওয়াতের কাজ, জিহাদের কাজ, তা’লীমের কাজ এগুলোর মধ্যে নিজের কাজ হল আসল। অথচ এখন আমাদের অবস্থা বিপরীত। দাওয়াতী কাজ ও তা’লীমী কাজ তো কিছু করা হয়। কিন্তু নিজের কাজ (যিকির-আযকার, কুরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদ ইত্যাদি) হলে হল না হলে নেই; এতে কোন আক্ষেপ নেই। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজের কাজ ছিল মূল। কুরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদ, যিকির-আযকার এগুলোই ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিগত আমল। আর দাওয়াত হল প্রাসঙ্গিক। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, আপনি বেশি বেশি দাওয়াত দেন। তবে কেউ দাওয়াত গ্রহণ না করলে আপনাকে পাকড়াও করা হবে না। অথচ ব্যক্তিগত আমলের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
إِنَّ هَذِهِ تَذْكِرَةٌ فَمَنْ شَاءَ اتَّخَذَ إِلَى رَبِّهِ سَبِيلًا.
অর্থ : এটা উপদেশ। অতএব, যার ইচ্ছা সে তার পালনকর্তার দিকে পথ অবলম্বন করুক। (সূরা মুযযাম্মিল- ১৯)
অর্থাৎ আল্লাহকে পেতে হলে তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, তাহাজ্জুদের কোন বিকল্প নেই। পৃথিবীতে যারা বড় ওলী হয়েছেন, নফসের ইসলাহ করেছেন, তাদের একজনকেও এমন পাওয়া যাবে না যে, তাহাজ্জুদ পড়েননি। যার নফসের ইসলাহ হল না সে তো মানুষের কাতারেই পড়ে না। সে বোকার স্বর্গে বাস করছে। বুদ্ধিমান তো সে যে নিজের নফসকে দলিত মথিত করেছে। নফসকে দমন করার হাতিয়ার হল তাহাজ্জুদ। তাহাজ্জুদের উপকারিতাই অন্যরকম। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْئًا وَأَقْوَمُ قِيلًا.
অর্থ : নিশ্চয় ইবাদতের জন্য রাতে উঠা প্রবৃত্তি দলনে সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল। (সূরা মুযযাম্মিল- ৬)
সূরা মুযযাম্মিলে আল্লাহ তা‘আলা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, হে নবী! সারাদিন আপনি অনেক কাজ করবেন। আপনি বিশ্বনবী, সারা বিশ্বের উম্মতের ফিকির করবেন আপনি। দিনে আপনার কাজের রুটিন অনেক বেশি।
إِنَّ لَكَ فِي النَّهَارِ سَبْحًا طَوِيلًا.
অর্থ : নিশ্চয় দিবাভাগে রয়েছে আপনার দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা। (সূরা মুযযাম্মিল- ৭)
অর্থাৎ আপনি দাওয়াতের কাজ করবেন, তা’লীম দিবেন, ওয়ায করবেন, রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। বিরামহীনভাবে দীনের কাজ করতে থাকবেন। আর রাতের আমল হলো,
قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا.
অর্থ : রাতে দণ্ডায়মান হোন কিছু অংশ বাদ দিয়ে। (সূরা মুযযাম্মিল- ২)
সামান্য সময় বাদে পূর্ণ রাত দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদ পড়ুন, তিলাওয়াত করুন, যিকির করুন। রাতে আরাম কম, ইবাদত বেশি। এভাবে চলেছে মি’রাজ পর্যন্ত। এ যাবত কোন বিধান আসেনি। নামায আসেনি, রোযা আসেনি, জিহাদ আসেনি। কিন্তু তাহাজ্জুদ ও তিলাওয়াতের হুকুম এসেছে। এ থেকেও এ দুই আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হয়। এ রুটিন দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলকে এবং উম্মতকে যোগ্য বানিয়েছেন। অতঃপর মি’রাজে ডেকে নিয়ে গেছেন। মি’রাজ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়ে এসেছেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে নবী! এ যাবত আপনি ও আপনার সাহাবীগণ তাহাজ্জুদ পেয়ে যে কুরবানী করেছেন; না শীত, না গরম, না বর্ষা, সর্বদা রাত্রি জাগরণ করেছেন। আর এত বেশি কষ্ট করতে হবে না। আল্লাহ তা‘আলা হুকুম শিথিল করে দিয়েছেন। যে তাহাজ্জুদ ওয়াজিব ছিল সেটাকে সুন্নাত করে দিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হয়, তাহাজ্জুদ কি সুন্নাতে মুআক্কাদা না সুন্নাতে যায়েদা? এ ব্যাপারে বদরে আলম মীরাঠী রহ. তার পুস্তকে লিখেন, এ ব্যাপারে দু’রকম মত আছে। কারো মতে মুআক্কাদা, আর কারো মতে যায়েদা। এ দু’মতের সমাধান হল, যারা জীবনে একবারও তাহাজ্জুদ পড়েছে তাদের জন্য তাহাজ্জুদ সুন্নাতে মুআক্কাদা হয়ে গেছে। উলামা-ত্বলাবাদের এমন কেউ নেই যে একদিনও তাহাজ্জুদ পড়েনি। আর যারা জীবনে একবারের জন্যও তাহাজ্জুদ পড়েনি তাদের জন্য যায়েদা।
আল্লাহ তা‘আলা এক সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ফরয হিসেবে তাহাজ্জুদের আমল করিয়েছেন এবং পরবর্তীতে সুন্নাতে মুআক্কাদা হিসেবে আমল করিয়েছেন। আর সর্বকালে সাহাবাগণ, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, ওলী-আউলিয়া, গাউস-কুতুব, বুযুর্গানে দীন নির্দ্বিধায় তাহাজ্জুদ সুন্নাতে মুআক্কাদা হিসেবে পড়েছেন। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে লক্ষ্য করে বলেছেন,
عليكم بقيام الليل فإنه دأب الصالحين قبلكم وهو قربة إلى ربكم ومكفرة للسيئات ومنهاة للاثم.
অর্থ : তোমাদের উপর কিয়ামুল লাইল তথা তাহাজ্জুদ অপরিহার্য। কেননা তাহাজ্জুদ তোমাদের পূর্ববর্তী নেককারদের অভ্যাস, তোমাদের রবের নৈকট্য লাভের উপায়, পাপসমূহ মোচনকারী এবং গুনাহ থেকে বারণকারী। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ৩৫৪৯)
অথচ দেখা যায়, এ গুরুত্বপূর্ণ আমল আমাদের থেকে বেশিরভাগ সময় ছুটে যায়। কী করলে বেশিরভাগ সময় পড়া যাবে? অধিকাংশ সময় ছুটে যাবে না, তার পদ্ধতি কী হতে পারে? বিশেষ করে উলামায়ে কেরামের জন্য সর্বদা তাহাজ্জুদ পড়তে হবে। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. এর মাদরাসায় তো নিয়ম ছিল, যে বছরের ৩৬৫ দিন তাহাজ্জুদ পড়বে সেই এই মাদরাসার ছাত্র হিসেবে থাকতে পারবে। একদিনও কোন ছাত্র তাহাজ্জুদ ছেড়ে দিলে তাকে বহিস্কার করে দিতেন। করাচীর হযরত সহজ একটা পন্থা এ উম্মতকে স্মরণ করে দিয়েছেন। আর তাহল, ইশার নামাযের পর বিতিরের পূর্বে কমপক্ষে দুই রাকাআত তাহাজ্জুদ পড়ে নেয়া। বিতিরের পরেও পড়া যায়। এটা সকলের জন্য সম্ভব।
উলামা-ত্বলাবার ইসলাহের জন্য সকল মাদরাসায় কয়েকটি আইন করা যায়। যথা-
১. মাদরাসাগুলোতে ঘুমানোর পূর্বে কমপক্ষে দুই রাকাআত তাহাজ্জুদ বাধ্যতামূলক করা।
২. দৈনিক এক পারা কুরআন তিলাওয়াত বাধ্যতামূলক করা।
৩. সকল মাসনূন দু‘আ আমলে আনা।
যে সকল আলেম তাহাজ্জুদ, তিলাওয়াত, যিকির করেন তাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কমলার সাথে এবং যারা এ সকল আমল করে না তাদেরকে খেজুরের সাথে তুলনা করেছেন। এর হিকমত হল, কমলাতে যেমন সুন্দর আকর্ষণীয় রং আছে, স্বাদ আছে, রস আছে, তদ্রূপ যারা উপরোক্ত আমলগুলো করে তাদের ঈমানের রং আছে, তাদের ইলম ও আমলে স্বাদ আছে, রস আছে। আর যারা এ আমলগুলো করে না, তারা খেজুরের মত, যার কোন সুন্দর রং নেই, রস নেই, উস্কখুষ্ক। তাদের ইলমে কোন নূরানিয়াত, রূহানিয়াত নেই তাদের ইলম-আমল উস্কখুষ্ক।
সম্মানিত উপস্থিতি! দেখবেন, যে তালিবে ইলম বা যে উস্তাদ রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে, কুরআন তিলাওয়াত করে, দু‘আ, যিকির, ইশরাক আদায় করে দরসে বসে তার দরসের মধ্যে রূহানিয়াত থাকে। কথায় প্রভাব থাকে। তার দরস ছাত্রদের দিলকে প্রভাবিত করে। আর যার মধ্যে এ আমলগুলো নেই সে হয়ত ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকরীর করতে পারে, কিন্তু তার দ্বারা ছাত্রদের উপকার হয় না। তার আলোচনা অন্তরকে প্রভাবিত করে না।আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদ এবং যিকিরের পাবন্দী করার তাওফীক দান করুন। আমীন।