দারুত তাসনীফ, মা’হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়া
সফর ১৪৪২ হিজরীর ১ তারিখ। মাগরিবের একটু পর। চাঁদের হিসেবে তখন শনিবার হয়ে গেছে। প্রায় একশ’ বছরের বর্ণাঢ্য ইলমী, আমলী ও আন্দোলনমুখর জীবন শেষে ক্ষণস্থায়ী এ জগত থেকে চলে গেলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহমাতুল্লাহি আলাইহি।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
আল্লামা শাহ আহমদ শফী চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার পাখিয়ারটিলা গ্রামে ১৯১৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বরকত আলী ও মায়ের নাম মেহেরুন্নেছা।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা মাদ্রাসায় তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। এরপর পটিয়ার আল জামিয়াতুল আরবিয়াতুল ইসলামিয়া জিরি মাদ্রাসায় কিছুদিন লেখাপড়া করেন। দশ বছর বয়সে তিনি হাটহাজারীর আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে দীর্ঘদিন অধ্যয়ন করার পর উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতে যান এবং দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় ভর্তি হন।
সেখানে শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. এর কাছে সহীহ বুখারী, শায়েখ ইবরাহীম বেলওয়াবী রহ. এর কাছে সহীহ মুসলিম, শায়েখ এজাজ আলী রহ. এর কাছে সুনানে আবু দাউদ, শায়েখ ফখরুল হাসান রহ. এর কাছে সুনানে নাসায়ী, জহুরুল হক দেওবন্দী রহ. এর কাছে মুয়াত্তায়ে মালেক এবং শায়েখ আব্দুজ জলিল রহ. এর কাছে মুয়াত্তায়ে মুহাম্মাদ এর দরস গ্রহণ করেন।
শাইখুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানীর কাছ থেকে তিনি শুধু দরসী পাঠ গ্রহণ করেই ক্ষান্ত থাকেননি; বরং তাঁর কাছ থেকে আধ্যাত্মিক শিক্ষাও গ্রহণ করেন ও খিলাফত লাভ করেন।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবন
আল্লামা আহমদ শফী ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন এবং আল- জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলামে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে মাদরাসাটির মজলিশে শূরা তাকে মহাপরিচালক বা মুহতামিম নিযুক্ত করে। পরবর্তীতে তিনি মাদরাসাটির শাইখুল হাদীসের দায়িত্ব পান। ২০০৮ সালে তিনি কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া’র চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি হাটহাজারী মাদরাসা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ গঠন করা হলে আল্লামা আহমদ শফীকে এর আমীর মনোনীত করা হয়। ২০১৭ সালে সরকার কওমী মাদরাসাগুলোর দাওরায়ে হাদীসের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান প্রদান করলে আইন অনুসারে কওমী মাদরাসার ৬টি বোর্ডের সমন্বয়ে আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ গঠন করা হয়। এর নেতৃত্বও আল্লামা আহমদ শফীর উপর ন্যস্ত করা হয়। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে নাস্তিক বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি সারা বিশ্বের সাধারণ মানুষের মাঝেও পরিচিত হয়ে ওঠেন।
এতো দায়িত্ব ও কাজের পাশাপাশি লেখালেখিতেও রয়েছে তাঁর বিশেষ অবদান। বাংলা ও উর্দূ ভাষায় তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৩০টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
হক্ব ও বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব, ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা, ইসলাম ও রাজনীতি, ইজহারে হাক্বীক্বত বা বাস্তব দৃষ্টিতে মওদূদী মতবাদ, তাক্ফীরে মুসলিম বা মুসলমানকে কাফির বলার পরিণাম, সত্যের দিকে করুণ আহ্বান, ধুমপান কি আশীর্বাদ না অভিশাপ, তাবলীগ একটি অন্যতম জিহাদ, ইছমতে আম্বিয়া ও মিয়ারে হক্ব, সুন্নাত-বিদআতের সঠিক পরিচয়, বায়আতের হাক্বীক্বত, আল বয়ানুল ফাসিল বাইনাল হক্কে ওয়াল বাতিল, আল হুজাজুল ক্বাতিয়াহ্ লিদাফয়িন নাহ্জিল খাতেয়াহ, আল-খায়রুল কাসীর ফী উসূলীত্ তাফ্সীর, ইসলাম ওয়া ছিয়াছত, বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ, মেশকাত শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইত্যাদি।
তার ইন্তিকালে বরেণ্যদের অভিব্যক্তি
আল্লামা আহমাদ শফী রহ. -এর মৃত্যুতে থমকে গেছে গোটা পৃথিবী। অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে মুসলিম বিশ্বের। আরবসহ মুসলিম বিশ্বের অনেক ইসলামী স্কলার তাঁর মৃত্যুতে আলাদা আলাদাভাবে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন।
বরেণ্য ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ড. আলী মুহাম্মাদ সাল্লাবী দা.বা. তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে আল্লামা আহমাদ শফী সম্পর্কে অনুভূতি প্রকাশ করেন। তিনি আহমদ শফীর ইন্তেকালকে ১৪৪২ হিজরীর সবচেয়ে বড় বিপর্যয় বলে উল্লেখ করেছেন।
বরেণ্য ইসলামী স্কলার শায়খ ইউসুফ আল কারযাভী দা.বা. তার শোকবার্তায় লেখেন, আল্লাহ তা‘আলা শায়েখ আহমাদ শফী রহ.এর উপর রহমত নাযিল করুন। যিনি ছিলেন আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম এর পরিচালক ও শাইখুল হাদীস। একই সাথে তিনি বাংলাদেশের প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি লেখেন, হে আল্লাহ! আপনি তাঁকে ক্ষমা করুন, তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করুন। এ মহান ব্যক্তিত্বকে সিদ্দীকদের মর্যাদা দান করুন, ইল্লিয়্যীনে তাঁকে উচ্চমর্যাদা দান করুন। ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি তাঁর অবদানের সর্বোচ্চ প্রতিদান দান করুন।
মুসলিম বিশ্বের প্রখ্যাত মনীষী আল্লামা তকী উসমানী দা.বা. তার অডিও বার্তায় বলেন, ‘‘হযরত মাওলানা আহমদ শফী সাহেবের ইন্তেকালের সংবাদটি ভীষণ বেদনার সৃষ্টি করেছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হযরত মাওলানা আহমদ শফী সাহেব- আল্লাহ তা‘আলা তার দারাজাত বুলন্দ করুন- তার খেদমত ও অবদানসমূহ শুধু বাংলাদেশেই নয়; বরং পুরো উপমহাদেশব্যাপী বিস্তৃত। তাঁর স্তরের আলেম এবং এমন আল্লাহওয়ালা খুবই কম জন্মগ্রহণ করেন। তার ব্যক্তিত্ব উম্মাহর জন্য অনেক বড় সম্পদ ছিল। আল্লাহ তা‘আলা নিজ ফযল ও করমে তার দারাজাত বুলন্দ করুন, জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। তার উত্তরসূরী ও পরিজনদের সবরে জামীল দান করুন। সব ধরনের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করুন। মাদরাসাকে আল্লাহ তা‘আলা হেফাযত করুন। তার ফুয়ূযকে সেভাবেই জারি রাখুন যেভাবে হযরত মাওলানা রহ.-এর যুগে ছিল।
সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানী দা.বা. আল্লামা আহমদ শফী রহ. এর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লেখেন, প্রায় দীর্ঘ অর্ধশতাব্দী ব্যাপী তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক। মরহুমের ইন্তিকালে আমি গভীরভাবে শোকাহত। তাঁর খেদমতের ময়দান ছিল অনেক ব্যাপক। দেশ ও জাতির জন্যে তিনি বিভিন্ন অঙ্গন থেকে খেদমত করেছেন। তিনি উম্মতের দরদে দরদী একজন আলেম ছিলেন। সাদামাটা জীবনযাপন ছিল তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
ভারতের বিখ্যাত দ্বীনী প্রতিষ্ঠান নদওয়াতুল উলামা লখনৌর মহাপরিচালক, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের সভাপতি মাওলানা রাবে হাসানী নদবী দা.বা. বলেন, ‘মাওলানা আহমদ শফী সাহেবের ইন্তেকাল অনেক বড় শূন্যতা। হাদীসের তালিম এবং মাদরাসার খেদমত বিবেচনায় অনেক বড় ক্ষতি হলো। কিন্তু পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে, সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ব-নির্ধারিত। আল্লাহর নিকট যা মনজুর হয়, সেটাই হয়।’ মাওলানা রাবে আরো বলেন, ‘আল্লাহ তার ভাগ্যে যেটুকু হায়াত রেখেছেন তিনি সেটা পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তার দারাজাত বুলন্দ করুন। হাদীসের যেই খেদমত তিনি আঞ্জাম দিয়েছেন তার উত্তম বিনিময় আল্লাহ তাকে দান করুন।’ অডিও শোকবার্তায় তিনি আরো বলেন, ‘তার যারা শাগরিদ- যারা তার নিকট থেকে ইস্তেফাদা করেছেন- তারা এই আমানতকে পরবর্তী প্রজন্মের নিকট পৌঁছে দিন এবং এই সিলসিলা কায়েম রাখুন। তিনি যেভাবে খেদমত করেছেন দীনের এবং হাদীস শরীফের, সেই মোতাবেক মানুষ আমল করার চেষ্টা করুক। ইনশাআল্লাহ কামিয়াব হবে এবং এর দ্বারা দীনের হেফাযতে মদদ আসবে। আল্লাহ কবুল করুন।’
শেষ কথা
একজন আলিম মানে শুধু একজন মানুষ নয়; বরং তার কাজের পরিধি, তার থেকে অসংখ্য অগণিত মানুষের উপকৃত হওয়ার বিচারে তিনি একটি জগত সমতুল্য। সে হিসেবে একজন আলিমের মৃত্যু হওয়া মানে একটি জগতের মৃত্যু হওয়া।
আল্লামা আহমদ শফী রহমাতুল্লাহি আলাইহির ইন্তিকালে আরো একটি বিস্তৃত জগতের মৃত্যু হলো।