আবূ আইমান
ঈমানের শাব্দিক অর্থ হলো বিশ্বাস করা। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর পূর্ণ আস্থার ভিত্তিতে ইসলামকে তার সকল অপরিহার্য অনুষঙ্গসহ মনেপ্রাণে মেনে নেয়া। এ মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে কোনরূপ আপত্তি, সন্দেহ, সংশয়, দ্বিধা, দোদুল্য ও শৈথিল্যের সুযোগ নেই। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ
অর্থ : রাসূল বিশ্বাস রাখেন ঐ সমস্ত বিষয় সম্পর্কে যা তাঁর পালনকর্তার পক্ষ থেকে তাঁর কাছে অবতীর্ণ হয়েছে এবং মুমিনগণও সবাই বিশ্বাস রাখে। সবাই বিশ্বাস রাখে আল্লাহ্র প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর গ্রন্থসমূহের প্রতি এবং তাঁর পয়গম্বরগণের প্রতি। তারা বলে, আমরা তাঁর পয়গম্বরদের মধ্যে কোন তারতম্য করি না। তারা বলে, আমরা শুনেছি এবং কবুল করেছি। আমরা তোমার ক্ষমা চাই, হে আমাদের পালনকর্তা! তোমারই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। (সূরা বাকারা- ২৮৫)
বিশুদ্ধ ঈমানের জন্য অপরিহার্য হলো, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু নিয়ে এসেছেন এবং যা কিছু তাঁর আনীত বলে অকাট্যরূপে প্রমাণিত সে সমুদয়ের উপর সুদৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা। অন্তরে বিশ্বাসের সাথে সাথে মুখেও সত্যের সাক্ষ্য দেয়া। কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোন বোধ-বিশ্বাস অন্তরে লালন না করা। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে শিরোধার্য মনে করা।
তাই একজন প্রকৃত মুমিন কখনই কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোন মতবাদ, দর্শন বা কালচারকে উত্তম, ভালো বা পালনীয় বলে বিশ্বাস করতে পারে না। কুরআন-সুন্নাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয়াবলীকে সে নিষিদ্ধ হিসাবেই বিশ্বাস করে। সে এ কথাও বিশ্বাস করে যে, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে যেটা নিষিদ্ধ সেটা সর্বত্রই নিষিদ্ধ; চাই তা নাটক-সিনেমার অভিনয়ের হোক বা সাহিত্যের বাতাবরণে হোক কিংবা হোক চেতনার ছদ্মাবরণে। একজন মুমিন কর্মগত ভুল-ভ্রান্তির শিকার হয়ে যেতে পারে কিন্তু বিশ্বাসের ভ্রান্তিতে নিপতিত হতে পারে না। বিশ্বাসের ভ্রান্তিতে আক্রান্ত হলেই সে মুমিন নামক স্বর্ণঅভিধার অযোগ্য হয়ে পড়ে। কেননা কর্মগত ভুল ক্ষমাযোগ্য কিন্তু আকীদাগত ত্রুটি আদৌ ক্ষমাযোগ্য নয়। বিষয়টি স্পষ্ট করণার্থে নিম্নে কয়েটি উদাহরণ পেশ করা হলো।
এক. আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
অর্থ : হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কার্য বৈ কিছুই নয়। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাকো, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। (সূরা মায়িদা- ৯০)
এখন মুমিন যদি উল্লিখিত বিষয়গুলোকে হারাম বিশ্বাস করতঃ শয়তানের প্ররোচনায় কখনো মদ-জুয়া ইত্যাদিতে লিপ্ত হয়ে যায় বা জীবমূর্তিতে ঘর, আঙ্গিনা বা চত্বর সাজায় তাহলে যদিও সে মারাত্মক পর্যায়ের ফাসেক ও গুনাহগার হবে কিন্তু কাফের বিশেষণ তার ব্যাপারে তখনো প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু সে যদি উল্লিখিত বিষয়গুলো যে শরীয়ত বিরোধী ও নাজায়েয, এ কথা বিশ্বাসই না করে তাহলে সে ঈমানের বলয় পেরিয়ে কুফুরীর গ-িতে পৌঁছে যায়।
দুই. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ
অর্থ : তোমাদের যদি নবী-পতœীদের কাছ থেকে কোনো জিনিসপত্র চাওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে পর্দার আড়াল থেকে চেয়ে নিবে। (সূরা আহযাব- ৫৩)
অন্য আয়াতে বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ
অর্থ : হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা এবং মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের চাদর বা ওড়না নিজেদের উপর টেনে দেয়। (সূরা আহযাব- ৫৯)
অন্যত্র ইরশাদ করেন,
وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا
অর্থ : হে নবী! আপনি মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নি¤œগামী করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হিফাযত করে। তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে না বেড়ায়। তবে (শরীরের) যে অংশ (এমনিতেই) প্রকাশ হয়ে যায় তার কথা ভিন্ন। (সূরা নূর- ৩১)
এছাড়াও অনেক আয়াত ও সহীহ বুখারী (হা.নং ৪১৪১), সুনানে আবূ দাউদ (হা.নং ১৮৩৩) এবং সুনানে তিরমিযী (হা.নং ১৭৩১)-সহ বহুসংখ্যক সহীহ হাদীসের আলোকে পর্দা-বিধানকে ফরয করা হয়েছে। কিন্তু এখন যদি কোন মা-বোন পর্দাকে ফরয বিশ্বাস করা সত্ত্বেও জীন ও মানুষ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে পর্দা বিধানকে লঙ্ঘন করে তাহলে সে মারাত্মক কবীরা গুনাহের কারণে পাপাচারিণী হলো ঠিক; কিন্তু তাকে কাফের বলা যাবে না। তবে কেউ যদি পর্দা-বিধানকেই অস্বীকার করে বা একে নারী উন্নয়ন, প্রগতির অন্তরায় বা সেকেলে বলার ধৃষ্টতা দেখায় কিংবা পর্দা বিধান নিয়ে উপহাস করে তাহলে তাকে নারীবাদী, প্রগতিশীল বা বুদ্ধিজীবি ইত্যাদি বলা যাবে; কিন্তু মুমিন বলা যাবে না।
তিন. কুরআন-হাদীসের বহুসংখ্যক অকাট্য প্রমাণের আলোকে নামায-রোযাকে ফরয করা হয়েছে। এখন কেউ যদি নামায-রোযার ফরয হওয়াকে বিশ্বাস করে; কিন্তু গাফলতের কারণে বা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে নামায না পড়ে বা রোযা না রাখে তাহলে সে মারাত্মক গুনাহে গুনাহগার হল ঠিক, তবে সে সম্পূর্ণ ঈমানহীন হয়েছে বলে ফতওয়া দেয়া যাবে না। কিন্তু সে যদি নামায-রোযার ফরয হওয়াকেই অস্বীকার করে তাহলে তার উপর কুফরের হুকুম প্রযোজ্য হবে। শুধু ফরয নয় প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন সুন্নাত নিয়ে উপহাস করলেও ঈমান চলে যায়। যেমন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
خَالِفُوا الْمُشْرِكِينَ وَفِّرُوا اللِّحَى وَأَحْفُوا الشَّوَارِبَ
অর্থ : তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধাচরণ করো, দাড়ি পূর্ণ করো (সহীহ মুসলিমে রয়েছে লম্বা করো) এবং মোঁচ খাটো করো। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৫৮৯২, সহীহ মুসলিম; হা.নং ৬২৩)
এই হাদীস দ্বারা বোঝা গেলো দাড়ি রাখা জরুরী। এখন কেউ যদি দাড়ি রাখার অপরিহার্যতাকে বিশ্বাস করে কিন্তু নফসের তাড়নায় ও শয়তানের ধোঁকায় দাড়ি না রাখে তাহলে সে কবিরা গুনাহে গুনাহগার হবে ঠিক, তবে তাকে বে-ঈমান বলা যাবে না। কিন্তু যদি দাড়ি নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করে তাহলে তার ঈমান চলে যাবে।
উপরোক্ত উদাহরণগুলো শুধু এ কথা বোঝানোর জন্য উল্লেখ করা হল যে, কুরআন-হাদীসের আদেশ-নিষেধের বিপরীত বিশ্বাস পোষণকারী বা এগুলোকে অবজ্ঞা বা উপহাসকারী মুখে যতই ঈমানের দাবী করুক প্রকৃত অর্থে সে মুমিন নয়। কুরআনের উপর ঈমান আর এর বিধানের ব্যাপারে সংশয়, আপত্তি বা অবজ্ঞা কারো মধ্যে একত্র হতে পারে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ঈমান আর তাঁর সুন্নাত ও আদর্শের প্রতি অনাস্থা, আপত্তি বা উপহাসের মেল-বন্ধন অসম্ভব। আল্লাহর একত্ববাদের উপর ঈমান আর ত্রিত্ববাদ বা বহুত্ববাদের দর্শন-সংস্কৃতি ও উৎসব-পার্বণে সন্তোষ প্রকাশের সহ অবস্থিতি অচিন্তনীয়।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কারীমের বিভিন্ন স্থানে হযরত ইবরাহীম আ. এর ঈমানকে উসওয়া (আদর্শ) হিসাবে পেশ করেছেন। যিনি গোত্রীয়, দেশীয় ও দলীয় ভ্রান্ত-বিশ্বাস ও অপসংস্কৃতির বাঁধন ছিঁড়ে এক আল্লাহতে বিশ্বাসী হয়েছিলেন। ইরশাদ হয়েছে,
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ … وَإِلَيْكَ أَنَبْنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ.
অর্থ : তোমাদের জন্যে ইবরাহীম ও তাঁর সঙ্গীগণের মধ্যে চমৎকার আদর্শ রয়েছে। তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর, তার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের মানি না। তোমরা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করলে তোমাদের মধ্যে ও আমাদের মধ্যে চিরশত্রুতা থাকবে। কিন্তু ইবরাহীমের উক্তি তাঁর পিতার উদ্দেশে এই আদর্শের ব্যতিক্রম। তিনি বলেছিলেন, আমি অবশ্যই তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব। তোমার উপকারের জন্যে আল্লাহর কাছে আমার আর কিছু করার নেই। হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা তোমারই উপর ভরসা করেছি, তোমারই দিকে মুখ করেছি এবং তোমারই নিকট আমাদের প্রত্যাবর্তন। (সূরা মুমতাহিনা- ৪)
অন্য আয়াতে হযরত ইবরাহীম আ. এর প্রশংসায় আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
وَإِنَّ مِنْ شِيعَتِهِ لَإِبْرَاهِيمَ (৮৩) إِذْ جَاءَ رَبَّهُ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ (৮৪)
অর্থ : আর নূহপন্থীদেরই একজন ছিল ইবরাহীম। যখন সে তার পালনকর্তার নিকট ক্বলবে সালীম (শিরকমুক্ত অন্তর) নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। (সূরা সাফ্ফাত- ৮৩-৮৪)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. সহ অধিকাংশ মুফাসসির ক্বলবে সালীমের ব্যাখ্যা করেছেন, যে অন্তর শিরক ও কুফর তথা ঈমান বিরোধী বিশ্বাস থেকে মুক্ত। (তাফসীরে মা‘আরেফুল কুরআন; পারা ১৯, পৃষ্ঠা ৬৯-৭০)
হযরত ইবরাহীম আ. এর একটি বিখ্যাত দু‘আও কুরআনে করীমে উল্লেখিত আছে,
وَلَا تُخْزِنِي يَوْمَ يُبْعَثُونَ . يَوْمَ لَا يَنْفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ . إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ
অর্থ : আমাকে অপদস্থ করবেন না পুনরুত্থান দিবসে। যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান কোন কাজেই আসবে না। তবে যে ক্বলবে সালীম (পরিচ্ছন্ন অন্তর) নিয়ে আসবে। (তার সন্তান, সম্পদ তার উপকারে আসবে।) (সূরা শু‘আরা- ৮৭-৮৯) আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে ক্বলবে সালীম দান করেন এবং বিশুদ্ধ ঈমান নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হওয়ার তাওফীক নসীব করেন। আমীন।