মাওলানা হিফযুর রহমান মুমিনপুরী
পৃথিবীর মানুষ আজ শান্তি চায়। সবাই হণ্যে হয়ে ফিরছে শান্তির আশায়। শান্তি অন্বেষণে মানুষ বস্তুর উৎকর্ষ সাধনে সর্বশক্তি নিয়োগকরছে। পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যপক বিস্তৃতির মাধ্যমেমানব সমাজ থেকে অশান্তির উপাদানগুলো উপড়ে ফেলার চেষ্টা চলছে। তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটিয়ে গোটা বিশ্বকে মানুষের হাতের মুঠোয়এনে দিচ্ছে। কিন্তু এতকিছুর পরও কি পৃথিবীবাসী শান্তি পাচ্ছে?।
বাস্তব কথা হলো ‘বিজ্ঞান-প্রযুক্তি মানুষের জীবন যাপনকে সহজ করলেও শান্তিময় করেনি’। বিভিন্ন মিডিয়ায় ইদানিং যে সকল জনমত জরিপ করেছে তার মধ্যে একটি হল ‘ বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ বিবাহ ভেঙ্গে যাওয়ার পিছনে মোবাইল, ফেইসবুক ইত্যাদি যোগাযোগ মাধ্যমগুলো দায়ি।
মূলতঃ শান্তি হলো আত্মিক বিষয়, বৈষয়িক উন্নয়ন আত্মাকে প্রশান্ত করতে পারেনা। ‘নাও এ নগরসভ্যতা ফিরিয়ে দাও সে অরণ্য জীবন’ এ শ্লোগান এমনিতেই হৃদয় জয় করেনি।
সাইয়েদ আবূল হাসান আলী নদভী রহ, তাঁর এক ভাষণে বলেছেন‘ইউরোপ আমাদের কাছ থেকে চরিত্র এবং আত্মিক মূল্যবোধ ছিনিয়ে নিয়েছে। এক্ষেত্রে স্বয়ং তারা ছিলো শূন্যহস্ত। এখন আমাদেরও তারা দেউলিয়া বানিয়ে দিয়েছে। তরা তথ্যজ্ঞান ও শিল্প দিয়ে আমাদের পূর্ণ করে দিয়েছে। আমাদের রাত্রিগুলো তারা প্রদীপ দিয়ে আলোকোজ্জ্বল করে দিয়েছে, বিদ্যুতের চমক দিয়ে উজালা করে দিয়েছে। আমাদের কিন্তু প্রয়োজন ছিল হৃদয়ের প্রদিপের। তারা হৃদয়ের প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে গেছে। মুবারক ছিলো সেই সময়, যখন হৃদয়ে আলো ছিল, বিদ্যুতের আলো ছিলনা। আাপনি নিজেই ভাবুন, কোন যুগটা আপনার পছন্দ হয়? যে যুগে মনুষ্যত্বের মর্যাদা ও সহানুভূতি ছিলো ও সমবেদনা ছিল সেই যুগ? নাকি সেই যুগ, যে যুগে মানবতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই, আছে প্রেস, মেশিন, বিদ্যুতের পাখা। (আল্লাহর পথের ঠিকানা। অনুবাদ, মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ। মাকতাবুতুল আশরাফ, বাংলাবাজার, ঢাকা। )
সুতরাং শান্তি পেতে হলে হৃদয়ের পরিশুদ্ধি আবশ্যক। দুনিয়া-আখিরাতে সুখ, সফলতা লাভ করার জন্য ‘তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধি’ অপরিহার্য। এজন্যই তো আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন, (তরজমা)
১) শপথ সূর্যের ও তার কিরণের
২) শপথ চন্দ্রের যখন তা সূর্যের পশ্চাতে আসে,
৩) শপথ দিবসের যখন সে সূর্যকে প্রখরভাবে প্রকাশ করে,
৪) শপথ রাত্রির যখন সে সূর্যকে আচ্ছাদিত করে,
৫) শপথ আকাশের এবং যিনি তা নির্মাণ করেছেন, তাঁর।
৬) শপথ পৃথিবীর এবং যিনি তা বিস্তৃত করেছেন, তাঁর,
৭) শপথ প্রাণের এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন, তাঁর,
৮) অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন,
৯) যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয়।
১০) এবং যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়।
(সূরা শামস, আয়াত ১-১০)
আল্লাহ তা‘আলা সাত সাতটি কসম খেয়ে বলেছেন, যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয় এবং যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে শুদ্ধ হয় তার পালনকর্তার নাম স¥রণ করে, অতঃপর নামায আদায় করে। বস্তুত তোমরা পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দাও, অথচ পরকালের জীবন উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী। এটা লিখিত রয়েছে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে; ইবরাহীম ও মূসার কিতাবসমূহে। (সূরা আ’লা, আয়াত ১৪-১৯)
স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলার এমন স্পষ্টভাবে আত্মশুদ্ধিকে সুখ-সাফল্য লাভের উপায় হিসাবে ব্যক্ত করার পর তাযকিয়ার গুরুত্ব বুঝানোর জন্য আর কোন উদ্ধৃতি নিষ্প্রয়োজন।
আত্মশুদ্ধির পথ ও পদ্ধতি
দেহ এবং আত্মার সম্মিলিত রূপই মানুষ । আত্মাহীন দেহকে মানুষ নয়, লাশ বলা হয়। আবার দেহবিহীন আত্মাকে রূহ বলা হয়, মানুষ নয়। দেহ এবং আত্মার মধ্য হতে আত্মা রাজা, দেহ প্রজা। আত্মা শাসক, দেহ শাসিত। আত্মা চালক, দেহ চালিত।
শাসক এবং চালক যেমন চালায়, দেশ এবং বাহন তেমনই চালায়। আত্মা যদি দ্বেষ, ক্লেশ ও পঙ্ক মুক্ত হয়, তাহলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে ভালো আমল প্রকাশ পায়। আর যদি আত্মা দ্বেষ, ক্লেশ ও পঙ্ক আবিলতামুক্ত না হয়, তাহলে তার থেকে মন্দ আমল প্রকাশ পায়। কর্ম থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই দেহে এক টুকরো গোস্ত আছে, সে গোস্তের টুকরো যখন ভালো হয়ে যায় তখন গোটা দেহ ভালো হয়ে যায়। আর যদি তা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে গোটা দেহ নষ্ট হয়ে যায়। জেনে রাখো সে টুকরোটি হল, ‘ক্বলব, তথা ‘আত্মা’। -সহীহুল বুখারী, হা:নং-৫২,
সতরাং বুঝা গেল দেহে যেমন রোগ হয় আত্মায়ও রোগ হয়। আত্মার কয়েকটি রোগ নিম্নে তুলে ধরা হল,
১.লোভ-লালসা। ২.অধিক কথা বলার আগ্রহ ( মিথ্যা, গীবত, চোগলখোরীর মত মারাত্মাক অপরাধ গুলো এর থেকেই সৃষ্টি)। ৩.অযথা ও অন্যায় ক্রোধ। ৪.হিংসা বা পরশ্রীকাতরতা। , ৫. বখিলী বা কার্পণ্য। ৬.সম্মান কামনা ও প্রভুত্বপ্রিয়তা। ৭. দুনিয়ার মহব্বত। ৮. তাকাব্বুর বা অহংকার। ৯. খোদ-পছন্দি (নিজেকে নিজে ভালো মনে করা)। ১০. রিয়াকারী (লোক-দেখানো ভাব)।
এই রোগগুলো সম্পর্কে ইমাম গাযালী রহ. ‘তাবলীগে দ্বীন’ নামক কিতাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং এগুলোর প্রতিষেধকও সংক্ষেপে বলে দিয়েছেন। এমদাদিয়া লাইব্রেরী (চকবাজার ঢাকা) কর্তৃক কিতাবটির বঙ্গানুবাদও প্রকাশ করা হয়েছে। পাঠকবৃন্দ কিতাবটি পাঠ করলে উপকৃত হবেন বলে আশা করি।
শুধু কিতাব পড়ে নেয়াই যথেষ্ট নয় বরং কোন হক্কানী বুযুর্গের সাহচর্য অবলম্বন এবং অন্তরের এক একটি রোগ সম্পর্কে তাকে অবহিত করে চিকিৎসা গ্রহণও জরুরী। নিজে নিজে শুধু চিকিৎসার বই পড়ে শারীরিক রোগের চিকিৎসা যেমন অসম্ভব, অনরূপ আত্মিক রোগের চিকিৎসাও নিজে নিজে শুধু কিতাব পড়ে করা অসম্ভব।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ
হে ঈমানদারগণ তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাক। ( সুরা তাওবা, আয়াত:১১৯)
সুতরাং প্রতিভাত হলো যে, শুধুমাত্র কিছু যিকির-আযকারের ওযীফা আদায় করলেই আত্মশুদ্ধি হাসিল হয়ে যায় না; বরং মুত্তাকী হতে হলে মুত্তাকীদের সাহচর্য অবলম্বন করা অপরিহার্য।
দরবারে, দরবারে কিংবা মাজারে, মাজারে ঘুরে বেড়ানো আত্মশুদ্ধির উপায় তো নয়ই; বরং ভণ্ডামী।
উল্লেখিত গুনাহ্ সমূহ থেকে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার পর বিনয়-ন¤্রতা, ধৈর্য, তাওয়াক্কুল, তাক্ওয়া-ত্বহারাত, আল্লাহর প্রতি মহব্বত ইত্যকার নেক-গুণাবলী দ্বারা অন্তরকে সুসজ্জিত করতে হবে।
যখন একজন মানুষ প্রকৃত অর্থে আত্মশুদ্ধি করতে সমর্থ হবে, তখন তাঁর আমল-আখলাক সব কিছু আল্লাহর বিধান মুতাবিক হবে। তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, চিত্ত, বিত্ত সবই আল্লাহ সমীপে সমর্পিত হবে। এমন মানুষের হৃদয় রাজ্যে শান্তির ফল্গুধারা প্রবাহিত হবে। অশান্তির কাঁটা ভরা পৃথিবীতেও তাঁর অন্তর থাকবে প্রশান্ত। মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী রহ. বলেন,
اگر عالم سرار خار باشد
دل عاشق گل وگلزار باشد
যদি গোটা পৃথিবী কাঁটায় ভরে যায়,
তবুও মাওলা প্রেমিকের দিল ফুলেল পুষ্পোদ্যান রয়।
তাই, অশান্তির অনল প্রবাহে দগ্ধ পৃথিবীবাসীকে হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে আহবান করছি, ‘এসোশান্তীর পথে, এসো কুরআন-হাদীস নির্দেশিত অনাবিল ভুবনে।
দুনিয়ার মায়াজাল ছেঁদিয়া আবদ্ধ হও ‘আল্লাহর প্রেমের বাঁধনে’।
সবশেষে আমার পীর-মুর্শিদ মুহিউস্সুন্নাহ শাহ্ আবরারুল হক রহ. এর একটি উদ্ধৃতিতে শেষ করছি, একটি মাহফিলে তিনি বয়ান করছিলেন। সমবেত শ্রোতামন্ডলীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, প্রখর রোদে একব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে। তীব্র গরমে হাসফাস করছে। পিপাষার প্রচণ্ডতায় পানি পানি বলে চিৎকার করছে। কিন্তু কেউ তাকে ছায়ায় ডাকলে সে ছায়া গ্রহণে অস্বীকার করে। বাতাস দিতে চাইলে সে নিষেধ করে। শীতল পানি পেশ করলেও সে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তথা রোদ ও গরম থেকে বাঁচার এবং তৃষ্ণা নিবারণের কোন উপকরণ গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। এমন ব্যক্তিকে আপনারা কি বলবেন?। শ্রোতাবৃন্দ উত্তর দিল, ‘পাগল’ বলবো। হযরত বললেন, ‘আজ আমরা শান্তি চাই; কিন্তু শান্তির পথে চলতে রাজি নই। প্রশান্তি চাই; কিন্তু অশান্তির বাহক-গুনাহ বর্জনে প্রস্তুত নই। তাহলে আমরাও কি…?
লেখক
খলিফা, মুহিউস্ সুন্নাহ শাহ আবরারুল হক রহ.
মুহতামিম, জামি‘আ রাহমনিয়া আরাবিয়া সাতমসজিদ মুহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭