হযরত মাওলানা খলীলুর রহমান রাজনগরী
(গত ১৯শে সেপ্টেম্বর ২০১২ খ্রি. রাত ১০.১৫ টায় মা’হাদের আঙ্গিনায় তাশরীফ রেখেছিলেন মৌলভীবাজার জেলার বিখ্যাত আলেম হযরত মাওলানা খলীলুর রহমান রাজনগরী ছাহেব দা.বা.। তিনি মা’হাদের ইলমী-আমলী পরিবেশ দেখে খুবই আনন্দিত হন এবং আবেগ ও উচ্ছ্বাসের উদ্দেশে নসীহতমূলক আলোচনা পেশ করেন। সে আলোচনার নির্বাচিত অংশ নিম্নে পত্রস্থ করা হলো। -সম্পাদক)
ان هذا العلم دين فانظروا عمن تأخذون دينكم
অর্থ: নিশ্চয়ই এই ইলম হলো দ্বীন। সুতরাং তোমরা দেখ কার থেকে দ্বীন গ্রহণ করবে। (সহীহ মুসলিম শরীফ ২৬)
আমি এই মুহূর্তে আপনাদের সামনে যে হাদীসটা পাঠ করেছি তা তিরমিযীশরীফের শেষ হাদীস। এই হাদীসটি মুসলিম শরীফেও আছে। হাদীসটির একজন রাবী হলেন বিখ্যাততাবেঈ আল্লামা ইবনে সীরীন রহ.। বিশ্বের সমস্ত উলামায়ে কিরাম একমত যে, তিনি খাবের তা’বীর সবচাইতে ভালো বলতেন। আল্লামাইবনে সীরীনের (রহ.) সমকালীন যুগের আরেকজন বিখ্যাত তাবেঈ হলেন ইমাম মালিক বিন আনাস রহ.। যাকে ‘ইমামু দারিল হিজরত’ বলা হতো।
তাঁর অন্তরে প্রিয়নবীজীর মদীনার প্রতি এত গভীর ভালোবাসা ছিল যে, তিনি মদীনায় থাকা অবস্থায় কোনো দিন পায়ে জুতা পরিধান করেন নাই।মদীনার উত্তপ্ত গরমে পায়ের নিচে ঠোশা পড়ে যেত। লোকেরা জিজ্ঞাসা করত, মালিক, আপনি জুতা পরিধান করেন না কেন? তিনি বলতেন, যে মাটিতে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম) শুয়ে আছেন সেই মাটিতে আমি মালিকের পক্ষে জুতা পরিধান করে হাঁটাসম্ভব নয়।
আমাদের আকাবিরদের মাঝেও এমন অনেক ঘটনা আছে। দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা কাসিম নানুতবী রহ. যখন মদীনায় যেতেন মদীনার তিন মাইল দূরত্বে অবস্থিত বীরে আলী নামক স্থান থেকে জুতা খুলে ফেলতেন। আল্লাহ তা‘আলা আমাকেও সোনার মদীনায় হাজির হওয়ার তাওফীক দিয়েছিলেন। মদীনার উপকণ্ঠে যখন আমাদের গাড়ি পৌঁছল তখন আমি কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম। ড্রাইভার আমাকে বললো ايها الشيخ هذه قبة خضراء (হে শাইখ! এইতো সবুজ গম্বুজ) একথা শুনে আমার গোটা শরীর শিউরে উঠল। চক্ষুদ্বয় থেকে অঝোর ধারায় অশ্র“ ঝরতে লাগল।
বৃদ্ধ বয়সে ইমাম মালিক রহ.-এর মনে আরেক বার আল্লাহর ঘর দেখারসাধ জাগল। কিন্তু তাঁর চিন্তা হলো, আমি তো বৃদ্ধ মানুষ যদি মক্কা শরীফে গিয়ে সেখানে ইন্তিকাল হয়েযায়, তাহলে তো আমার লাশ আর মদীনায়আসবে না। অথচ আমার একান্ত কামনা- ‘মদীনায় আমার দাফন হবে’। এই ইতস্ততার মধ্যে রাতে তিনিঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখছিলেন- আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরসাথে তিনি খোশ আলাপ করছেন।
তখন সুবর্ণ সুযোগ মনে করে তিনি বললেন- ‘ইয়া আল্লাহর রাসূল! আমার তোমনের তামান্না ছিল, আমি শেষ বয়সে আরেক বার হজ্জকরতে যাব। কিন্তু মনে ভয় যে, সেখানে গিয়ে যদি ইন্তিকাল হয়ে যায় মদীনায় তো আমার লাশ আসবে না। আপনি যদি মেহেরবানীকরে বলতেন আমি আর কয় দিন বাঁচব, তাহলে আমি আরেকটা বার তাওয়াফে যেতাম।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম যাওয়ার পথে হাত উঠিয়ে পাঁচ আঙুলের ইশারা করলেন।
ঘুম থেকে উঠে ইমাম মালিক রহ. পেরেশান হয়ে গেলেন এই ভেবে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঁচ আঙুল দেখিয়েছেন। তাহলে কী আমি পাঁচ দিন বাঁচবো, না পাঁচ বছর, না পঁঞ্চাশ বছর? পেরেশানি বেড়ে গেল। এই পেরেশানির মধ্যে তাঁর খাদেমকে বললেন, যাও, এই যুগের সবচেয়ে বড়ো আলেম আল্লামা ইবনে সীরীন রহ.-এর কাছে যাও। এবং এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা জেনে আস। খাদেম ইবনে সীরীন রহ.-এর কাছে গিয়ে সকল বৃত্তান্ত খুলে বলল। তিনি খাদেমকে বললেন, ইমাম মালিককে আমার সালাম দিয়ে বলো- আল্লাহর রাসূল হাত উঠিয়ে দেখিয়েছেন পাঁচটা জিনিসের জ্ঞান আল্লাহ পাক কারো হাতে দেন নাই। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
إِنَّاللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِوَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُإِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
এত বড়ো স্বপ্নবেত্তা ইবনে সীরীন থেকে একটা রেওয়ায়েত আমি আপনাদেরকেবলেছি। এ কথাটুকু প্রাসঙ্গিক বিধায় এসেছে। ان هذا العلم دين এই কুরআন আর হাদীস عين قرآنআর عين حديث কার নিকট হতে অর্জন করবেন? فانظروا عمن تأخذون دينكم -এই দ্বীন তোমরা কার নিকট হতে সংগ্রহ করবে? সেই ব্যক্তিকে আগে নির্বাচন করো। সুতরাং তুমি যে উস্তাদের কাছেপড়বে সেই উস্তাদ সম্পর্কে তোমার এই আক্বীদা থাকতে হবে যে, আমার উস্তাদ সুন্নাতের অনসারী।
প্রিয় বৎসগণ! তোমাদের দেখে আমার অন্তর খুশি হয়ে গেছে। যেমন বাগানে গাছের ফল দেখলে মালিক খুশি হয়। আমাদের আকাবিরগণ গাছ লাগিয়ে গেছেন আর সেই গাছের ফল হলেন আপনারা। এবং আমি বিশ্বাস করি, আমার একীন আপনারা সহীহ নায়েবে রাসূল রূপে গড়ে উঠছেন। একটা প্রবাদ আছে
العنوان الظاهر تدل على الباطن
‘মানুষের চেহারা দেখলেই ভিতরের অবস্থা বুঝা যায়।’
আমি আপনাদের কাছে একটা আবদার করব যাকে অনুরোধও বলতে পারেন। তাহলো-আপনারা তো এখন মাওলানা হয়ে গেছেন। কিন্তু যদি তাযকিয়ায়ে নফস না থাকে তাহলে এ শুধু মাওলানাসাহেব দিয়ে কী হবে? ইসলাহে বাতেনী না থাকে, নামাযে দাঁড়াইলে যদি লায্যাত না আসে, আল্লাহর কথা শুনলে যদি ইশক না আসে, রাসূলের কথা শুনলে যদি ইশক না আসে, আমলের ময়দানে যদি ফিট করতে না পারে সেই ইলম আপনাকে জাহান্নামে নিবে।
আর ঐ ইলম দ্বারা যদি আমলের পরিবর্তন হয়ে যায়, যেমন আল্লামা তাকী উসমানী দা.বা. ‘দরসে তিরমিযী’-এর মুকাদ্দামার মধ্যে লিখেছেন হাদীস পড়ার মাকসাদ যদি জ্ঞানার্জন হয় তাহলে জীবনটা বেকার। আর যদি হাদীস পড়ার মাকসাদ হয়, একটা হাদীস পড়লাম সাথে সাথে আমল করলাম, তাহলে আপনার জীবন ধন্য হবে। ইলমে যাহিরের সাথে ইলমে বাতিন চলে আসবে।
আপনাদের কাছে আরেকটা আবেদন, যদি সময় থাকে তাবলীগে চিল্লায় যান। যারা বলে তাবলীগে চিল্লার মধ্যে সময় দিলে প্রেসার হবে, ইলম নষ্ট হবে, তাদের ইসলাহের জন্য যান।
আমাদের আকাবিরে দ্বীন সুন্নাতের অনুসারী ছিলেন। সুতরাং আপনাদের প্রতি আমার সর্বশেষ অনুরোধ, যাকে আপনাদের পছন্দ লাগে তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। আপনারা সকলে তো জায়্যিদ বরং তার থেকেও ঊর্ধ্বে। ঐ ধারালো ছুরিটাকে একটু লাগাইয়া দেন। ছুরিটা আপনার হাতেই থাকবে। শুধুমাত্র আরেক জন ডিরেকশন দিবে যে, মুরগিটার কোন দিকে কাটবে ? পায়ের দিক দিয়ে কাটবে না গলার দিক দিয়ে কাটবে ? মোটকথা ঐ ছুরিটার নিয়ন্ত্রণ আরেক জনের হাতে থাকবে। নিজে ডাক্তার হওয়া যায় না, নিজে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায় না। ইঞ্জিনিয়ার হতে হলে ইঞ্জিনিয়ারের কাছে যেতে হয়, ডাক্তার হতে হলে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। তদ্রুপ আল্লাহকে পেতে হলে আল্লাহওয়ালার কাছে যেতে হয়।
আলেম হলে কিছু শান হয়, তাকাব্বুর আসে। ঐটাকে দমন না করতে পারলে ابى واستكبر। হযরত থানভী রহ. এক স্থানে লিখেছেন- শয়তানের চারটা عين এর তিনটার উপস্থিতি ছিল। কিন্তু একটি عين ছিল না। সে বিশ্ববিখ্যাত ‘আবিদ’ (عابد) ছিল, সে ‘আরিফ’ (عارف) ছিল, (সে জানত আল্লাহর কোনো প্রতিক্রিয়া নাই) সে বড়ো ‘আলিম’ (عالم) ছিল, (মু‘আল্লিমুল মালাইকা)। সবচেয়ে বড়ো আলিম ছিল, সবচেয়ে বড়ো আরিফ ছিল, সবচেয়ে বড়ো আবিদ ছিল কিন্তু একটা عين তার মধ্যে নাই। সেটা হলো সে ‘আশিক’ (عاشق) ছিল না। সে যদি আশিক হতো তাহলে বিনা যুক্তিতে সিজদা করে কামিয়াব হতে পারতো।
তাই আপনাদের কাছেও বিনীত নিবেদন আপনারা ইলম অর্জনের সাথে সাথে আল্লাহর খাঁটি আশিক হতে চেষ্টা করবেন। তাহলেই ইলম অর্জন সার্থক হবে।
অনুলেখক
মাওলানা মাহমূদুল হাসান
শিক্ষক, মা‘হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়া।