আবেগপ্রবণ বাঙ্গালীর তীর্থস্থান মাজার দরগা

মুফতী হাফিজুর রহমান


মাজার চর্চার সুরতহাল

চিন্তা চেতনার প্রতিবিম্ব হলো মানুষের কর্ম। চেতনা বিশ্বাসে খাদ তৈরি হলে তা থেকে বিকলাঙ্গ কর্মের প্রসব হবে। তাই প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য হলো, পবিত্র চেতনাকে যাবতীয় অজ্ঞতা ও প্রান্তিকতা থেকে সমুন্নত রাখা। চেতনা বোধ যেন থাকে স্বচ্ছ সুন্দর এবং সর্বরকমের আবীলতা মুক্ত- এজন্য তাকে নিতে হবে সদা চৌকস জাগ্রত প্রহরীর ভূমিকা। কারণ বিকলাঙ্গ চিন্তা চেতনা ও কর্মতৎপরতার মাধ্যমেই সমাজে প্রাদুর্ভাব ঘটে নানা রকম কুসংস্কারের। শিরক বিদাত হলো, সমাজের সবচেয়ে মারত্মক ব্যধি ও কুসংস্কার। যথার্থ জ্ঞানের অভাবে এসব অনাচারের প্রাবাল্য ঘটে। সুতরাং সুস্থ চেতনাবোধ জাগ্রত করার জন্য যাবতীয় মিথ্যা বিশ্বাস এবং অসুস্থা চেতনার সকল ছিদ্রপথ বন্ধ করে দিতে হবে। কোনো ব্যক্তি, বস্তু কিংবা কোনো স্থান বা কাল সম্বন্ধে অলীক বিশ্বাস পোষণ করার অবকাশ ইসলামে নেই। তদ্রূপ কল্পনাপ্রসূত কোনো ধারণাকে কেন্দ্র করে ভক্তি নিবদনে সীমা লঙ্ঘনের সুযোগও ইসলামী শরীয়াতে রাখা হয় নি। পবিত্র কুরআনে যেমন সত্যবিমুখ অবিশ্বাসীদের মর্মন্তুদ পরিণামের কথা বলা হয়েছে তেমনিভাবে ধর্মের নামে ভিত্তিহীন কর্ম ও বিশ্বাসের প্রচারণাকারীদেরকে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মাজারকেন্দ্রিক যেসব অনাচার আমাদের সমাজে সংঘটিত হয় তার অধিকাংশই রিপুতাড়িত কর্মযজ্ঞ। নারী-পুরুষের বাধভাঙ্গা সংসর্গ, উন্মাতাল গান-বাদ্য, মদ-জুয়া ও গাঁজার আসর এসবি মাজারকেন্দ্রিক পূজা আর্চনার অন্যতম অনুষঙ্গ। সাথে থাকে জৈবিক চাহিদা পূরণের অবারিত সুবিধা। দ্বিতীয়ত মাজারকেন্দ্রিক আয়োজনকে কেন্দ্র করে চলে সিন্ডিকেট গ্রুপের কমার্শিয়াল আয়োজন। তারা বৈষয়িক চাহিদা পূরণের লক্ষে মাজারে আগত নারী পুরুষের দান-দক্ষিণা, নজর-মানত হাতিয়ে নিয়ে থাকে। এবং ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবচের রমরমা বাণিজ্যের হাট বসায়। তৃতীয়ত মাজারকে কেন্দ্র করে চলে শিরক বিদাতের রমরমা আয়োজন। মাজারের মাটিতে শায়িত ব্যক্তিকে অলৌকিক পাওয়ারের অধিকারী, কামানা-বাসনা পূরণকারী এবং বিপদাপদে উদ্ধার কারী জ্ঞান করে তাকে খোদার আসনে সমাসীন করে দেয়। চিন্তাগত এসব শিরকী ধারণাকে পুজি করে শায়িত ব্যক্তির উদ্দেশে মানত মানা, সেজদায় লুটিয়ে পড়া, পশু বলি দেয়া, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, সুস্থতা ও স্বচ্ছলতা প্রার্থনা করাসহ হাজারো রকমের কর্মগত শিরকের অনুশীলন হয়। চতুর্থত সেখানে এক শ্রেণীর টুপি শ্মশ্রুধারী গুরু কর্তৃক কুরআন-সুন্নাহ এবং দীন-ইসলামের বিকৃত সাধনের কর্ম সাধন করা হয়। তারা মাজার কেন্দ্রিক যাবতীয় কার্যকলাপের সপক্ষে সাম্প্রদায়িতাধর্মী জেদ ও হঠকারিতা সৃষ্টির লক্ষে নানা রকমের কল্পিত ধারণা প্রচার করে থাকে। এবং দ্বিধাহীনভাবে কুরআন সুন্নাহর অপব্যাখ্যায় মত্ত থাকে।

মাজারপূজার সাথে মূর্তিপূজার সংশ্লিষ্টতা

মাজারপূজার সাথে মূর্তিপূজার সংশ্লিষ্টতা বেশ গভীর। কারণ উভয় ক্ষেত্রেই সৃষ্টির উপসানা করা হয়; স্রষ্টার নয়। আর এ মূর্তিপূজার জননীই হলো এ মাজারপূজা। মাজারপূজার গর্ভেই মূর্তিপূজা জন্ম লাভ করেছে। তবে প্রচলিত মাজারপূজা এবং মূর্তিপূজার সম্পর্ক আরো গভীর এবং আরো নিবিড় আকার ধারণ করেছে। কারণ-

১. আজকের সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের মূর্তিকে কেন্দ্র করে বড় আয়োজন করে বাৎসরিক এক দুটি উৎসব করে থাকে।

২. তারা নিয়মিত তাদের মূর্তির সম্মুখে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে।

৩. মূর্তিকে কেন্দ্র করে তারা মানত বা পশু বলি দিয়ে থাকে।

৪. মূর্তির সম্মুখে তারা মাথা নত করে।

মাজার পথিক ভাইয়েরাও-

১. তাদের মাজারকে কেন্দ্র করে বেশ ঘটা করে এক দুবার উরশ উৎসবের আয়োজন করে থাকে।

২. তারা তাদের মাজারে মোমবাতি, আগর বাতি থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক বাতি জ্বালিয়ে থাকে।

৩. তারা তাদের মাজারকে কেন্দ্র করে মানত-নিয়াজ করে থাকে।

৪. তারা তাদের মাজারের সম্মুখে মাথা নত করে, মাজারের চৌকাঠে চুমু খায়।

আর কিছু না হোক মূর্তিপূজার সাথে এসাদৃশ্যগুলোই তো মাজারপূজা নিষিদ্ধ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। অথচ মাজারকেন্দ্রিক কীর্তিকলাপ নিষিদ্ধ হওয়ার অসংখ্য অগণিত তথ্যসূত্র ও প্রমাণপঞ্জি কুরআন সুন্নাহ এবং ফিকহের গ্রন্থগুলোতে নানা আঙ্গিকে বিবৃত হয়েছে। 

মাজার তাপসদের অভিসন্দর্ভ ‘জাআল হাক্ব’

অপরাধ করে যদি তার সপক্ষে যুক্তির পা-িত্ব দেখানো হয় তখন তাকে বাংলা বাগধারায় বলা হয় চুরির উপর সিনা জুরি। অর্থাৎ তাস্কর্যের গর্হিত অপরাধ সম্পাদন করে আবার বীরত্ব প্রদর্শনি! কারো হৃদয়ে যদি কবর বিষয়ে সত্য গ্রহণের সদিচ্ছা থাকে এবং সে ইচ্ছা বাস্তবায়নে এতদ সংক্রান্ত হাদীসে রাসূলের মূলপাঠগুলো জড়তা মুক্ত হয়ে উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পাঠ করে তবে সে আদৌ কবর বা মাজার বিষয়ক বাড়াবাড়ি বা প্রান্তিকতামূলক আচরণে লিপ্ত হতে পারে না। পৃথিবীতে দীনে ইসলামের যতগুলো বর্জিত শাখা রয়েছে সকল শাখার ধারক বাহকগণ কুরআন হাদীসের মাধ্যমেই তাদের বিভ্রান্তি প্রতিষ্ঠিত করে থাকে। এ পৃথিীবতে কোনো মতবাদ দাঁড় করাতে হলে যুক্তির কোনো অভাব হয় না। বর্তমান বিশ্বে বিবস্ত্রবাদ বলে একটি মতবাদ রয়েছে। তারা দেহে কোনো বস্ত্র ব্যবহার করে না। এটাই তাদের কনসেপ্ট। তাদের যুক্তি হলো এ বাড়তি বস্ত্র ব্যবহারে অর্থের অপচয় ঘটে। আর মানুষের ন্যাচার হলো, তারা নিষিদ্ধ এবং অদৃশ্য গুপ্ত বস্তুনিচয়ের প্রতি বেশি আকর্ষণবোধ করে। অতিরিক্ত এ আকর্ষণবোধের কারণেই বিশ্বে জবরদস্তিমূলক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে এবং নারি ঘটিত নানা অনাচার সংঘটিত হয়। যদি এ অন্তরালকে তুলে দেয়া হয় তবে স্বভাবতই ধীরে ধীর নারী পুরুষের গুপ্ত অঙ্গের প্রতি মানুষের আকর্ষণবোধ কমে যাবে। এতে করে নারী ঘটিত যাবতীয় অনাচার সমূলে উৎপাটিত হবে। সাশ্রয় হবে শত শত কোটি ডলার। তাদের এ বিবস্ত্রবাদ প্রচারে ইতিমধ্যে তারা সম্মেলনও সম্পন্ন করে ফেলেছে। এবং সম্মেলনের সকল বক্তা শ্রোতাই ছিল জন্মদিনের পোষাক পরিহিত। তো এ মতবাদ দাঁড় করাতে তাদের যুক্তি খাতে কোনো ঘাটতি দেখা দেয় নি। তবে কি যুক্তির সমৃদ্ধতায় সে বর্জিত বিষয়টি বিবেকগ্রাহ্য হয়ে যায়? এবং মহা মহীমের দরবারে কি তা চূড়ান্ত স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে? আদৗ নয়। বাঁকা পথে যুক্তির অন্বেষা করে কোনো জিনিস প্রতিষ্ঠিত করে আর যাই হোক রাব্বুল আলামীন সমীপে গ্রহণযোগ্যতার স্বীকৃতি লাভ করা যায় না। মুফতী আহমদ ইয়ার খান নাঈমী। তিনি দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। আমরা উদারতার বিস্তীর্ণ বেলা ভূমিতে দাঁড়িয়ে দুআ করি আল্লাহ তাআলা তার সাথে ক্ষমার আচরণ করুক। তিনি একখানা গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। গ্রন্থখানা পাঠে উপলব্ধ হবে, মানুষ কি করে কুরআন, হাদীস এবং ফিকহের জ্ঞান-ধারণার মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে। তিনি গ্রন্থটির নাম দিয়েছেন ‘জাআল হাক্ব’। মানে সত্য এসেছে। শিরক-বিদাতের প্রতিষ্ঠা কি সত্য প্রতিষ্ঠা? তবে কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবিয়ীন, তাবে তাবিয়ীন আইম্মায়ে আসলাফ কবরের উপর স্থাপনা তৈরি করতে নিষেধ করে, তাতে আলোক সজ্জা করতে বারণ করে, তাতে উৎসব করতে এবং তাকে সেজদার স্থল বানাতে নিষেধ করে (আল্লাহর আশ্রয় চাই) মিথ্যা ছড়িয়ে ছিলেন?! এখন সে মিথ্যাকে বিলুপ্ত করে প্রচলিত মাজার কেন্দ্রিক সত্য আনয়ন করা হলো? গ্রন্থটি পাঠে উপলব্ধ হবে তাতে কি পরিমাণ সত্যের অপলাপ করা হয়েছে। বিভিন্ন হাদীস এবং ফিকহের মূলপাঠের খ-িত অংশ উদ্ধৃতি করে শিরক বিদাত প্রতিষ্ঠা করার দুঃসাহস দেখানো হয়েছে। দীনে ইসলামের যাবতীয় ঝাল্লাত-জঞ্জালের সমাবেশ ঘটেছে গ্রন্থটিতে। বলা চলে এটি একটি জঞ্জাল-আবর্জনার সঞ্চয়পত্র কিংবা শিরক বিদাতের অভিসন্দর্ভ। এ গ্রন্থটি পাঠে কি পরিমাণ মানুষ যে তাদের শিরকী চেতনাকে শানিত করে নিচ্ছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বিচার দিবসে কি নাঈমী সাহেব এত মানুষের অনাচারের দায়ভার বহন করতে পারবেন?

সবুজ গম্বুজের স্থাপনা প্রসঙ্গ

একটি কবর মাজারের স্বীকৃতি লাভ করে কখন? যখন কবরটির চারি ধারে শক্ত দেয়ালের গাঁথুনি হবে, উপরে হৃদয়গ্রাহী স্থাপনা হবে, কবরের উপরের মাটিতে বালু সিমেন্টের প্রলেপ পড়বে, ফ্যান বাতির সংযোজন হবে, মোম আগরের প্লাবন হবে। এসব আবশ্যিক আয়োজনেই একটি নীরব নিস্তব্ধ কবর প্রকৃত মাজারের মর্যাদা (?) লাভ করে। মাজারের এসব আয়োজন প্রমাণে মাজার উৎসাহী ভাইদের তথ্য-যুক্তির অভাব নেই। তাদের বুকের পাটা এতটাই মজবুত, তারা এসব প্রমাণে কুরআন হাদীস এবং ফিকহ-ফাতওয়ায় ঢু দিতেও শিহরিত হন না। মাজারের উপর স্থাপনা তৈরির ব্যাপারে তাদের বড় যুক্তি হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওযার উপরে সবুজ স্থাপনা রয়েছে। তার কবরের চারিধারসহ উপরস্থ ভূমিতে বালু সিমেন্টের আস্তর রয়েছে। এবং তার উপরে দামি কাপড়ের আচ্ছাদনও রয়েছে। এ যুক্তিতে তারা তাদের মাজার সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধতর করে চলেছে। প্রশ্ন হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবর কেন্দ্রিক এ বাড়তি আয়োজন কে বা কারা করেছে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি নিজে করেছেন বা করতে বলেছেন? সাহাবায়ে কেরাম করেছেন? কোনো তাবিয়ী করেছেন? তাবে তাবিয়ী করেছেন? স্বর্ণ যুগের কেউ এসব করেন নি। কবরকেন্দ্রিক এসব আয়োজনের ব্যাপারে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি কি ছিল এব্যাপারে তাদের মন্তব্য শোনা যাক।  

১. জাবের রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর পাকা করতে, তার উপর বসতে এবং তার উপর সমাধি সৌধ নির্মাণ করতে নিষেধ করেছেন। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ২২৮৯)

২. আবু বুরদা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন আবু মুসা আশআরী রা. মুত্যু শয্যায় শায়িত তখন তিনি বলেছিলেন,…এবং তোমরা আমার কবরের উপর কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করো না। সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩১৫০

৩. ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর যিয়ারতকারী নারী, এবং কবরকে সেজদার স্থলে পরিণতকারী এবং তাতে বাতি প্রদান কারীর উপর অভিশম্পাদ করেছেন। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩২৩৮

৪. আবু সাঈদ খুদরী রা. এবং আবু হুরাইরা রা. উভয়ই ওয়াসিয়ত করে গেছেন, তাদের কবরে যেন শামিয়ান না টানানো হয়। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ, হাদীস ১১৮৭০, ১১৮৭১

বর্তমানে যদিও দেখা যাচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাল্লাম এর রওযা মুবারক মসজিদে নববীর মাঝে অবস্থিত। কিন্তু এমনটি সাহাবাদের যুগে ছিল না। সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাল্লাম কে আয়িশা রা. এর ঘরে কবরস্থ করেছিলেন যাতে পরবর্তীতে কেউ এ জায়গাকে সেজদার স্থলে পরিণত করতে না পারে। কিন্তু পরবর্তীতে যা সংঘটিত হয়েছে তা সাহাবায়ে কেরামের চিন্তায় আসে নি। ৮৮ হিজরীতে ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালিক মসজিদে নববী সংস্কার এবং সম্প্রসারণের নির্দেশনা জারি করে। এ সম্প্রসারণের সময়ই রওযা মুবারক মসজিদে নববীর মাঝে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তখন বারণ করার মত কোনো সাহাবী জীবিত ছিলেন না। ইসআদুল আখসা বিযিকরি সাহীহি ফাযাইলিশ শাম ওয়াল মাসজিদিল আকসা ২/৫৪

অতপর উমর ইবনে আব্দুল আযীয রাহ. তার খিলাফত কালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাল্লাম এর রওযা প্রাচীরকে এক কোণের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ করার নির্দেশ দেন। যাতে করে নামাজ আদায়ের সময় রওযা মুবারক কেবলার মত না হয়ে যায়। আল ইসতিযকার ৮/২৪৪

এরপর ৬৭৮ হিজরী সনে সুলতান মানসূর কালাউন সালেহী খিলাফতে সমাসীন হয়ে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রুচি ও মনোবাসনার প্রতি কোনোরূপ ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের মনমত রওযা মুবারকের উপর গম্বুজের স্থাপনা তৈরি করে দেন। আলহাবী লিল ফাতাওয়া লিস সুয়ূতী ৩/৪০

বস্তুত অপ্রয়োজনীয় উঁচু স্থাপনা নির্মাণ ইসলামী শরীয়ার রুচির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা কি প্রতিটি উঁচু স্থানে নিরর্থক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করছো? আর প্রাসাদ নির্মাণ করছো এ মনে করে যে, তোমরা চিরস্থায়ী হবে। সূরা শুআরা ১২৮-১২৯

আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা বাহিরে বের হলেন। তখন পথিমধ্যে উঁচু একটি গম্বুজ দেখতে পেলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা কি? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, এটা অমুকের (এক আনসার সাহাবীর)।  আনাস রা. বলেন, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু বললেন না। নীরব রইলেন। কিন্তু বিষয়টি তার মনে গেঁথে রইল। এরপর যখন গম্বুজ স্থাপনার মালিক সাহাবী অন্যান্য সাহাবীদের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসল তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কয়েকবার তার সাথে এরূপ করলেন। এতে করে সাহাবী বুঝতে পারলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উপর মনঃক্ষুণœ হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ফলে সে তার বন্ধুদের সাথে তার মনঃকষ্টের কথা ব্যক্ত করতে লাগলেন। তখন সাহাবায়ে কেরাম তাকে বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা বাহিরে বের হয়েছিলেন। তখন তোমার নির্মিত গম্বুজ দেখেছিলেন। একথা শুনে সাহাবী তার বাড়িতে গিয়ে গম্বুজটিকে ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলেন। এরপর একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন গম্বুজটি দেখতে না পেয়ে জানতে চাইলেন গম্বুজটির কি হলো? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, এ গম্বুজের মালিক আপনার আত্মবিমুখতার কারণে খুব ব্যথিত হয়েছিল। এবং তার মনঃকষ্টের কথা আমাদেরকে বলেছিল। তখন আমরা তাকে মূল কারণটি জানিয়ে দিয়েছিলাম। ফলে সে তৎক্ষণাত এসে গম্বুজটিকে ভেঙ্গে দিয়েছে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, প্রতিটি স্থাপনাই তার মালিকের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। তবে যেগুলো একান্ত আবশ্যকীয় সেগুলোর কথা ভিন্ন। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২৩৯

আলী রা. সম্বন্ধে বর্ণিত হয়েছে, তিনি আবুল হাইয়াজ আসাদী রা. কে বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে যে উদ্দেশে প্রেরণ করেছিলেন আমি কি তোমাকে সে উদ্দেশে প্রেরণ করবো না? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন, যেখানেই জীবচিত্র দেখবে নিশ্চিনহ করে ফেলবে এবং যেখানেই উঁচু সমাধি দেখবে সমান করে ফেলবে। সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৬০।

প্রশ্ন হলো তবে কেন আজো এসব বাড়তি সংযোজন যথাস্থানে বর্তমান আছে? এর উত্তর হলো, বর্তমানে বাইতুল্লাহর যে অবকাঠামো আমরা দেখছি তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মনপুত অবকাঠামো ছিল না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চেয়েছিলেন, বাইতুল্লাহকে ভেঙ্গে হাতীমে কাবাকে বাইতুল্লাহর মাঝে অন্তর্ভুক্ত করে দিতে। কিন্তু তিনি মানুষের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় কাবা সংস্কারের কাজে হাত দেন নি। তবে আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা. কাবা সংস্কার করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মনোবাসনা পূরণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী শাসক এসে সেটাকে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা মনে করে কাবাকে ভেঙ্গে আবার পূর্বের মত করে নির্মাণ করে দেয়। এরপর উলামায়ে কেরাম ঐকমত্য পোষণ করলেন, কাবা বর্তমানে যে অবকাঠামোতে আছে সে অবকাঠামোতেই থাকবে। তাতে কোনোরূপ সংযোজন বিয়োজন করা যাবে না। এবং আল্লাহর ঘরকে রাজনৈতিক কুৎসিত খেলনায় পরিণত করতে দেয়া যাবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কায় মুনাফেকদেরকে কাফের জেনেও হত্যা করতে বারণ করেছিলেন। সুতরাং রওযা মুবারকের উপর স্থাপনা নির্মাণ যদিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশনার পরিপন্থী কাজ কিন্তু যুদ্ধ বিগ্রহ এড়াতে এবং মানুষের ভিতর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কায় রওযা মুবারকের উপর নির্মিত অবকাঠামোতে হাত দেয়া হয় নি। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাকো। সূরা হাশর ৭। সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের যা করতে বলেছেন তাই আমাদের করতে হবে। এবং যা কিছু থেকে বারণ করেছেন তা থেকে বিরত থাকতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওযায় কে বা কারা কি করল না করল তা আমাদের জন্য দলীল নয়। এবং সেগুলো দিয়ে দলীল দাঁড়া করানোরও কোনো অবকাশ নেই।

শেষকথা পরিশুদ্ধ জীবন চর্চাই হলো দীন-ইসামের মূল প্রতিপাদ্য। দীনের অশুদ্ধ অনুশীলনে ধর্মীয় জীবন সফলতার আলো দেখবে না। তাই দীনের নামে কোনো কিছু চর্চা করার আগে তার পরিশুদ্ধতা নিয়ে আমাকে ভাবতে হবে। এটা বিবেকের অপরিহার্য দাবি। নতুবা অর্থ শ্রম সময় এবং অতি সাধের ঈমানসহ সবকিছুর সলীল সমাধি হবে। অন্তত এটা তো চির সত্য, কোনো মাজার মুখী না হলে আমাকে শেষ বিচারের দিনে এ নিয়ে কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। কিন্তু মাজার চর্চায় শেয়ার করলে (কিছু মানুষের ধারণায়) সৃষ্টি কর্তার তুষ্টি কিংবা ক্ষমাহীন প্রবল অসন্তোষÑএদুটির একটি অবশ্যই অর্জিত হবে। কোনো বিবেকবান মানুষ এধরণের সুনিশ্চিত ঝুঁকির দিকে কখনো পা বাড়াতে পারে না। কোনো মৃত ব্যক্তির Ñচাই সে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যত বড় ব্যক্তিত্বের অধিকারীই হোক না কেনÑসমাধি আমাদের মুক্তির মাইলফলক হতে পারে না। আমাদের এত কি দায় পড়েছে দেয়াল স্থাপনা দিয়ে কোনো সমাধিকে আজীবন কর্মমুখর এবং স্মৃতিময় রাখতে হবে? মৃত ব্যক্তির সম্মান দেখানোর ব্যাপারটি শরীয়ত স্বীকৃত বিষয়। কিন্তু আলোকসজ্জা, মস্তকাবনতিসহ বর্জিত নানা আচরণের মাধ্যমে যে সম্মানি আমরা তাদের প্রদান করে থাকি তাতে কি তারা সম্মানবোধ করেন? নাকি উল্টো অসন্তোষ প্রকাশে বেদনাহত হন? প্রশ্নগুলো নিয়ে আমাদের গভীর করে ভাবা প্রয়োজন। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বিশুদ্ধ দীন চর্চার তাওফীক দান করুন।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *