করোনা ও প্রাণঘাতী বালা-মুসীবত : কারণ ও আমাদের করণীয়

মুফতী মাহমূদুল আমীন

বিপদাপদের কারণ

বর্তমান বিশ্ব নানাবিধ বিপদে আক্রান্ত। নিত্যনতুন মহামারীতে গোটা বিশ্ব আতঙ্কিত। এক একটি মহামারীতে মানুষের উন্নত প্রযুক্তি, শক্তি ও দম্ভোক্তি ধূলায় মিশে যাচ্ছে।  মানবজাতির এ অসহায়ত্ব মহান রাব্বুল আলামীনের বাণীরই সত্যায়ন- (তরজমা) মানুষকে অতি দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে। (সূরা নিসা; আয়াত ২৮)

করোনা, ইবোলা, ডেঙ্গু, এইড্সসহ ভয়ঙ্কর যেসব রোগ-ব্যাধিতে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত এর জন্য মানুষই দায়ী। কেননা আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতিকে তাঁর উপর ঈমান আনয়ন ও তাঁর হুকুম মান্য করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) আমি মানুষ ও জিন জাতিকে শুধুমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য (আমাকে চেনার জন্য) সৃষ্টি করেছি। (সূরা যারিয়াত; আয়াত ৫৬)

কিন্তু বর্তমান বিশে^র অধিকাংশ মানুষ তাকে সৃষ্টি করার এ উদ্দেশ্য ভুলে গেছে। তারা আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী ও আনুগত্যের পরিবর্তে আল্লাহর নাফরমানীতে আকণ্ঠ ডুবে আছে। তারা শুধু নিজেরা অবাধ্য হয়েই ক্ষান্ত নয়; বরং মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ, যারা মুসলিম, যারা আল্লাহর অনুগত, আল্লাহর হুকুম মানতে চায় তাদের পথও ওরা আগলে দাঁড়ায়। জুলুম, নির্যাতন আর চরম নিপিড়নে আল্লাহর অনুগত মুসলিমদের নাম-নিশানা আল্লাহর যমীন থেকে মুছে ফেলতে চায়।

তাইতো আজ চোখ মেললেই ভেষে ওঠে উইঘুর মুসলিমদের উপর জালিম চাইনিজদের নির্যাতনের করুণ চিত্র। কান পাতলেই শোনা যায় মগদস্যুদের নিপিড়নে সম্ভ্রমহীন মুসলিম মা-বোনদের বুকফাটা আর্তচিৎকার। আমাদের প্রতিবেশী দেশের রাজধানীতে মালউন হিন্দুদের পাশবিক আগ্রাসন ও নিহত মুসলিম ভাই-বোনের লাশের উপর জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিয়ে পৈশাচিক উল্লাসে লম্ফঝম্ফ করার দৃশ্যতো এখনো স্যোসাল মিডিয়ায় ভেষে বেড়াচ্ছে। আল্লাহর ঘর মসজিদে আক্রমণ এবং তার মিনারে হনুমান পতাকা উড্ডয়ণের মত ভয়ানক অন্যায়ও প্রকাশ্য দিবালোকে সংঘটিত হচ্ছে। কাশ্মীর, ফিলিস্তীন, চেচনিয়া, বসনিয়া, সিরিয়াসহ গোটা বিশ্ব যেন আল্লাহর অনুগত বান্দাদের তাজা খুনের রক্ত পলাশে পরিণত হয়েছে। মুসলিম নামধারী অনেক ক্ষমতাধরও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কুফুরী শক্তিকে সমর্থন করে মুসলিম খুনে নিজেদের আমলনামাকে রক্তলাল করছে।

আর যারা মুসলিম। যারা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত হিসেবে দাবি করে থাকে, তাদেরও অধিকাংশ অহরহ আল্লাহর নাফরমানী করে যাচ্ছে। নামায-রোযার পাবন্দী নেই। হজ-যাকাতের গুরুত্ব নেই। আল্লাহর নামারমানী থেকে বাঁচার প্রচেষ্টা নেই। সুদ-ঘুষ, জুলুম-নির্যাতন, ধোঁকা-প্রতারণা, ধর্ষণ-লুন্ঠনসহ সকল প্রকার গুনাহই মুসলিম সমাজে বিদ্যমান। অধিকাংশ মুসলমানের বাহ্যিক দেহাবয়বে ইসলামের কোন ছাপ নেই। মুসলিম দেশের বেশিরভাগ শিক্ষালয়েও কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা নেই, আল্লাহর আনুগত্যের দীক্ষা নেই, আর এজন্য অভিভাবকদের অনুশোচনাও নেই। ফলে তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীদের অশ্লীলতায় পথে-ঘাটে চোখ মেলাও দায়। তাদের ধর্মহীনতায় আঁতকে ওঠে মুমিন হৃদয়।

এতসব অন্যায়, অবাধ্যতা ও সীমালংঘনের পরও আল্লাহ তা‘আলা যে মানবজাতিকে বাঁচিতে রেখেছেন, আসমান যমীন ঠিক রেখেছেন, পৃথিবীর আলো-বাতাস বহাল রেখেছেন এটা মহান রাব্বুল আলামীনের অপার করুণা বৈ কিছুই নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ

অর্থ : তোমাদের উপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গুনাহ ক্ষমা করে দেন। (সুরা শূরা; আয়াত ৩০)

আল্লাহ তা‘আলা যদি মাফ না করতেন তাহলে পুরো ধরাপৃষ্ঠ মানবশূন্য হয়ে পড়তো। তবে কোন সম্প্রদায় যদি সীমালংঘনের চরমে পৌঁছে যায় তখন আল্লাহ তা‘আলা আযাব দিয়ে তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা আ‘দ, সামুদ, ফিরআউন ও লূত সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছিলেন। কুরআনের বিভিন্ন সূরায় যে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সূরা হা-ক্কাহ’র শুরু দিকে তাদের ধ্বংসের বিবরণ এভাবে রয়েছে,

(তরজমা) আদ ও সামুদ গোত্র মহাপ্রলয়কে মিথ্যা বলেছিলো। অতঃপর সামুদ গোত্রকে ধ্বংস করা হয়েছিলো এক প্রলয়ঙ্কর বিপর্যয় দ্বারা। আদ গোত্রকে ধ্বংস করা হয়েছিলো এক প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবায়ূ দ্বারা যা তিনি প্রবাহিত করেছিলেন তাদের উপর সাত রাত্রি ও আট দিবস পর্যন্ত অবিরাম। আপনি তাদেরকে দেখতেন যে, তারা অসার খর্জুর কাণ্ডের ন্যায় ভূপাতিত হয়ে রয়েছে। আপনি তাদের কোন অস্তিত্ব দেখতে পান কি?

ফিরআউন, তার পূর্ববর্তীরা এবং উল্টে যাওয়া বস্তিবাসীরা গুরুতর পাপ করেছিলো। তারা তাদের পালনকর্তার রাসূলকে অমান্য করেছিলো। ফলে তিনি তাদেরকে কঠোরহস্তে পাকড়াও করলেন। যখন জলোচ্ছ্বাস হয়েছিলো, তখন আমি তোমাদেরকে চলন্ত নৌযানে আরোহণ করিয়েছিলাম। যাতে এ ঘটনা তোমাদের জন্যে স্মৃতির বিষয় এবং কান এটাকে উপদেশ গ্রহণের উপযোগী রূপে গ্রহণ করে। (সূরা হা-ক্কাহ; আয়াত ৪-১২)

কখনো আবার আল্লাহ তা‘আলা কিছুটা শাস্তি ও বিপদাপদ দিয়ে মানুষকে সতর্ক করেন এবং তওবা করে দ্রুত তাঁর আনুগত্যে ফিরে আসার সুযোগ দেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ

অর্থ : স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুণ বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে। (সূরা রূম; আয়াত ৪১)

বিপদাপদে এবং মহামারী অবস্থায় আমাদের করণীয়

এক. তওবা করা ও ইসলামের অনুশাসন পরিপূর্ণ মেনে চলা

করোনা, চিকুনগুনিয়া, এইড্সসহ সকল রোগ-ব্যাধি ও বিপদাপদ যেহেতু মানুষের গুনাহের ফল। এজন্য সর্বপ্রথম করণীয় হলো, সকল প্রকার গুনাহ বর্জণ করা। যে সকল অমুসলিম স্থায়ীভাবে বিপদ থেকে বাঁচতে চায় তাদের জন্য উচিত হলো দ্রুত ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করা। আর মুসলমানদের জন্য জরুরী হলো দ্রুত সকল গুনাহ ছেড়ে দিয়ে খালেস দিলে তওবা করা এবং পরিপূর্ণ ইসলামী জীবনযাপনে শপথ নেয়া। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ

অর্থ : হে মুমিন সকল! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাঙ্কানুসরণ করো না। নিশ্চিতরূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা বাকারা; আয়াত ২০৮)

সুতরাং ইবাদত-বন্দেগী, লেন-দেন, আচার-আচরণ, বিবাহ-শাদীসহ সকল কাজ ইসলামের নির্দেশনা মোতাবেক সম্পাদন করতে হবে। নিজের ভিতর-বাহিরকে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সাজাতে হবে।

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

وَمَا كَانَ رَبُّكَ لِيُهْلِكَ الْقُرَى بِظُلْمٍ وَأَهْلُهَا مُصْلِحُونَ

অর্থ : আর তোমার পালনকর্তা এমন নন যে, জনবসতিগুলোকে অন্যায়ভাবে ধ্বংস করে দেবেন, সেখানকার লোকেরা সৎকর্মশীল হওয়া সত্ত্বেও। (সূরা হুদ; আয়াত ১১৭)

ভবিষ্যতে সকল গুনাহ থেকে বিরত থাকার দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ হয়ে তওবা করতে হবে। তাহলেই সফলতা আসবে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

অর্থ : মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহ্র সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সূরা নূর; আয়াত ৩১)

তওবার মাধ্যমে অত্যাসন্ন বিপদও দূর হয়ে যায়। যেমন- হযরত ইউনুস আলাইহিস সালামের কওমের ক্ষেত্রে হয়েছিলো। আল্লাহর আযাব যখন কালো হয়ে গোটা আকাশ ছেয়ে ধেয়ে আসছিলো তখন তারা তওবা করেছিলো এবং ঈমান আনয়ন করেছিলো। ফলে আল্লাহ তাদের উপর থেকে আযাব উঠিয়ে নিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

فَلَوْلَا كَانَتْ قَرْيَةٌ آمَنَتْ فَنَفَعَهَا إِيمَانُهَا إِلَّا قَوْمَ يُونُسَ لَمَّا آمَنُوا كَشَفْنَا عَنْهُمْ عَذَابَ الْخِزْيِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَمَتَّعْنَاهُمْ إِلَى حِينٍ

অর্থ : সুতরাং কোন জনপদ কেন এমন হলো না যা ঈমান এনেছে অতঃপর তার সে ঈমান গ্রহণ হয়েছে কল্যাণকর? অবশ্য ইউনুসের সম্প্রদায়ের কথা আলাদা। তারা যখন ঈমান আনে তখন আমি তুলে নিই তাদের উপর থেকে অপমানজনক আযাব পার্থিব জীবনে এবং তাদেরকে কল্যাণ পৌঁছাই এক নির্ধারিত সময় পর্যন্ত। (সূরা ইউনুস; আয়াত ৯৮)

দুই. তাকওয়া অবলম্বন, সুন্নাতের অনুসরণ এবং ইস্তিগফার করা

আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে করীমে ইরশাদ করেন,

وَمَا كَانَ اللهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيهِمْ وَمَا كَانَ اللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ

অর্থ : অথচ আল্লাহ কখনই তাদের উপর আযাব নাযিল করবেন না যতক্ষণ আপনি তাদের মাঝে অবস্থান করবেন। তাছাড়া তারা যতক্ষণ ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে আল্লাহ কখনও তাদের উপর আযাব দিবেন না। (সূরা আনফাল; আয়াত ৩৩)

এই আয়াতে আল্লাহর আযাব না আসার দু’টি কারণ ব্যক্ত করা হয়েছে। (১) প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে থাকা। (২) ইস্তিগফার করতে থাকা (গুনাহ হলে মাফ চাইতে থাকা)।

এ যামানায় প্রথমটি প্রত্যক্ষভাবে পাওয়া তো সম্ভব নয়; কিন্তু উলামায়ে কেরাম বলেছেন, যে ব্যাক্তি তাকওয়া অবলম্বন করলো এবং প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ করলো সেও যেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথেই আছে। সুতরাং সেও আযাব থেকে বেঁচে থাকবে।

হযরত মু‘আয বিন জাবাল রাযি. যখন ইয়ামান যাচ্ছিলেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে কিছুপথ পায়ে হেঁটে চললেন। অতঃপর বললেন, মু‘আয! এরপর হয়তো আমার সাথে তোমার আর দেখা হবে না/এরপর যখন মদিনায় আসবে হয়তো আমার মসজিদ ও আমার কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে। একথা শুনে হযরত মু‘আয রাযি. কাঁদতে লাগলেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন এবং বললেন,

ان أولى الناس بي المتقون من كانوا وحيث كانوا

অর্থ : নিশ্চয়ই আমার কাছের মানুষ হলেন মুত্তাকীগণ সে যেই হোক, যেখানেই থাকুক। (মুসনাদে আহমাদ; হাদীস ২২৯৫১)

সুতরাং এই হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হলো যারা মুত্তাকী তারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছেই আছে। তারা আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা পাবে ইনশা-আল্লাহ। আর মুত্তাকীগণ আল্লাহ তা‘আলার বন্ধুও। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِنْ أَوْلِيَاؤُهُ إِلَّا الْمُتَّقُونَ

অর্থ : কেবল মুত্তাকীগণই আল্লাহর বন্ধু। (সূরা আনফাল; আয়াত ৩৪)

সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বন্ধুদেরকে আযাব দিবেন না।

সূরা আনফালের ৩৩নং আয়াতে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচার দ্বিতীয় উপায় বলা হয়েছে ইস্তিগফার তথা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

مَنْ لَزِمَ الاِسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللهُ لَهُ مِنْ كُلِّ ضِيقٍ مَخْرَجًا وَمِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِبُ

অর্থ : যে ব্যক্তি ইস্তিগফার (গুনাহ থেকে মাফ চাওয়া) কে অপরিহার্য করে নিবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে প্রত্যেক সঙ্কট থেকে মুক্তি দিবেন, প্রত্যেক পেরেশানী থেকে উদ্ধার করবেন এবং তাকে অকল্পনীয় স্থান থেকে রিযিক দান করবেন। (সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ১৫১৮)

এজন্য জালালুদ্দীন রূমী রহ. বলেছেন,

گم چوں بینی زود استغفار کن، گم بامر خالق آمد کار کن۔

গম চুঁ বীনী যূদ ইস্তিগফার কুন, গম বাআমরে খালেক আ-মাদ কা-র কুন।

অর্থ : যখনই কোন পেরেশানী দেখ সাথে সাথে ইস্তিগফার করো। কেননা এই পেরেশানী আল্লাহর হুকুমে এসেছে, সুতরাং তার হুকুম মত আমল করো।

তিন. নাহী আনিল মুনকার বা অসৎ ও অন্যায় অবিচার বন্ধে সচেষ্ট হওয়া

আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচার জন্য শুধু নিজে পাপাচার থেকে বিরত থাকাই যথেষ্ট নয়; বরং নাহী আনিল মুনকার (নিষিদ্ধ ও অন্যায় কাজ থেকে অন্যকে বারণ করাও আবশ্যক। অবিচার ও পাপাচার বন্ধে সচেষ্ট হওয়াও জরুরী। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, (তরজমা) নিশ্চয়ই মানুষ যখন কাউকে জুলুম করতে দেখেও তাকে বাধা দেয় না, তখন আল্লাহ তা‘আলা হয়তো তাদের উপর আযাবকে ব্যাপক করে দিবেন। (সুনানে তিরমিযী; হাদীস ২১৬৮, সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ৪৩৩৮)

কুরআনে কারীমে হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের যামানার একটি ঘটনা উল্লেখ করে আমাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম যখন শনিবার আল্লাহর কিতাব যাবূর তিলাওয়াত করতেন, সমুদ্রের মাছগুলোও সে তিলাওয়াত শুনতে সমুদ্র তীরবর্তী পানির উপর আসতো। এজন্য শনিবার আল্লাহর পক্ষ হতে মাছ শিকার করা নিষিদ্ধ ছিলো। কিন্তু একদল অসাধু জেলে কৌশলে মাছগুলো আটকে রেখে রবিবার সেগুলো ধরতো। একদল লোক তাদেরকে এই অন্যায় কাজ থেকে বারণ করলেন। আরেক দলের অন্তরে তাদের এই অসৎ কাজের প্রতি ঘৃণা ছিলো ঠিক কিন্তু তারা তাদেরকে এ কাজে বাধা দিলো না; বরং বারণকারী দলকে বললো, কেন সে লোকদের সদুপদেশ দিচ্ছে, যাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিতে চান কিংবা আযাব দিতে চান-কঠিন আযাব?

এরপর আল্লাহ তা‘আলা আযাব দিয়ে যারা অন্যায় করেছে এবং যারা অন্যায় থেকে বারণ করেনি উভয় দলকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। শুধুমাত্র বারণকারী দলকে নাজাত দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) আর তাদের কাছে সে জনপদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো যা ছিলো নদীর তীরে অবস্থিত। যখন শনিবার দিনের নির্দেশের ব্যাপারে সীমাতিক্রম করতে লাগল। যখন আসতে লাগল মাছগুলো তাদের কাছে শনিবার দিন পানির উপর। আর যেদিন শনিবার হত না, আসত না। এভাবে আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছি। কারণ, তারা ছিলো অবাধ্য। আর যখন তাদের মধ্যে থেকে এক সম্প্রদায় বলল, কেন সে লোকদের সদুপদেশ দিচ্ছে, যাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিতে চান কিংবা আযাব দিতে চান- কঠিন আযাব? তারা বলল, তোমাদের পালনকর্তার সামনে দোষ ফুরাবার জন্য এবং এজন্য যেন তারা ভীত হয়। অতঃপর যখন তারা সেসব বিষয় ভুলে গেল, যা তাদেরকে বোঝানো হয়েছিলো, তখন আমি সেসব লোককে মুক্তি দান করলাম যারা মন্দ কাজ থেকে বারণ করত। আর পাকড়াও করলাম, গুনাহগারদেরকে নিকৃষ্ট আযাবের মাধ্যমে তাদের অবাধ্যতার দরুণ। তারপর যখন তারা এগিয়ে যেতে লাগল সে কর্মে যা থেকে তাদের বারণ করা হয়েছিলো, তখন আমি নির্দেশ দিলাম- তোমরা লাঞ্চিত বানর হয়ে যাও। (সূরা আ’রাফ; আয়াত ১৬৩-১৬৬)

সুতরাং আযাব থেকে বাঁচার জন্য শুধু অন্তরের ঘৃণা যথেষ্ট নয়; বরং সাধ্যানুযায়ী নাহী আনিল মুনকার করাও জরুরী। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, (তরজমা) তোমাদের মধ্য হতে কেউ কোন অন্যায় হতে দেখলে সে যেন হাত (শক্তি) দ্বারা পরিবর্তন (প্রতিহত) করে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে মুখ দ্বারা বারণ করবে। যদি তাও না পারে তাহলে অন্তর দিয়ে পরিবর্তন (পরিবর্তনের চিন্তা) করবে। আর এ (অন্তর দিয়ে পরিবর্তণের ফিকির করা) দুর্বলতম ঈমান। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ৪৯)

এ জাতীয় বহু সংখ্যক আয়াত ও হাদীসের আলোকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই সাধ্যানুযায়ী অন্যকেও পাপাচার থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে।

চার. ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা

বিপদাপদে অধৈর্য্য না হওয়া। অস্থির না হওয়া ও বিলাপ না করা। বরং আল্লাহর উপর ভরসা রেখে পরম ধৈর্য্যরে সাথে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকা। নামায ও ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করতে থাকা। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ

অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন। (সূরা বাকারা; আয়াত ১৫৩)

ফযীলত : প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সম্মুখীন হলে নামায পড়তেন। (সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ১৩১৯)

পাঁচ. বালা-মুসীবত থেকে বাঁচার মাসনূন দু‘আ ও আমলসমূহ গুরুত্বের সাথে করতে থাকা

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিপদাপদ ও বলা-মুসীবত থেকে রক্ষা পাওয়ার অনেক দু‘আ ও আমল শিক্ষা দিয়েছেন। করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে এবং বালা মুসীবত থেকে রক্ষা পেতে সে দু‘আ ও আমলগুলো আমাদের নিয়মিত করতে হবে। এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ দু‘আ ও আমল নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

১. প্রতিদিন বাদ ফজর ও বাদ মাগরিব তিনবার করে নিম্নোক্ত দুআ পাঠ করা-

بِسْمِ اللَّهِ الَّذِى لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَىْءٌ فِى الأَرْضِ وَلاَ فِى السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ.

অর্থ : (আমি শুরু করছি) আল্লাহর নামে যাঁর নামের সঙ্গে আসমান যমীনের কোনো কিছুই কোনো ক্ষতি করতে পারে না। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।

ফযীলত : হযরত উসমান রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যা তিনবার করে এই দু‘আটি পাঠ করবে সে আকস্মিক কোন বিপদে পতিত হবে না। (সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ৫০৮৮)

২. নিচের সূরা তিনটি তিনবার করে পাঠ করা-

قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌ. اللهُ الصَّمَدُ. لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُوْلَدْ. وَلَمْ يَكُنْ لَّه كُفُوًا اَحَدٌ

অর্থ : বল, তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি এবং তার সমতুল্য কেউ নেই।

قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ. مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ. وَمِنْ شَرِّ غَاسِقٍ اِذَا وَقَبَ. وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ. وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ اِذَا حَسَدَ

অর্থ : বল, আমি শরণ নিচ্ছি ঊষার স্রষ্টার তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট হতে, রাত্রির অন্ধকারের অনিষ্ট হতে যখন তা গভীর হয়, সমস্ত নারীদের অনিষ্ট হতে যারা গ্রন্থিতে ফুৎকার দেয় এবং হিংসুকের অনিষ্ট হতে যখন সে হিংসা করে।

قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاسِ. مَلِكِ النَّاسِ. اِلٰهِ النَّاسِ. مِنْ شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ. الَّذِيْ يُوَسْوِسُ فِيْ صُدُوْرِ النَّاسِ. مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ

অর্থ : বল, আমি শরণ নিচ্ছি মানুষের প্রতিপালকের, মানুষের অধিপতির, মানুষের ইলাহের, আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট হতে, যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে জিনের মধ্য হতে এবং মানুষের মধ্য হতে।

ফযীলত : হযরত খুবাইব রাযি. বলেন, একদা আমরা প্রকট অন্ধকারাচ্ছন্ন বৃষ্টি ভেজা রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্ধানে বের হলাম, এ উদ্দেশ্যে যে, তিনি আমাদের নিয়ে নামায পড়বেন। ইত্যবসরে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেয়ে গেলাম। তিনি আমাকে বললেন, বলো। আমি কিছুই বললাম না। এপর আবার বললেন, বলো। আমি এবারও কিছুই বললাম না। এরপর আবার বললেন, বলো। এবার আমি বললাম, আমি কি বলবো? বলো, قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌ (সূরা ইখলাস) এবং মু‘আউওয়াযাতাইন (সূরা ফালাক এবং সূরা নাস)। এ সূরাগুলো সকাল-সন্ধ্যা তিনবার পাঠ করবে। সবকিছু থেকে এগুলো তোমার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। (সুনানে তিরমিযী; হাদীস ৩৫৭৫)

৩. নিম্নের দুআটি সাতবার পাঠ করা-

حَسْبِىَ اللهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ

অর্থ : আল্লাহ আমার জন্য যথেষ্ট। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। আমি তাঁর ওপরই ভরসা করি এবং তিনি মর্যাদাবান আরশের মালিক।

ফযীলত : হযরত আবূ দারদা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, প্রত্যহ সকাল-সন্ধ্যা যে ব্যক্তি এ দু‘আটি সাতবার পাঠ করবে আল্লাহ তা‘আলা তার ইহকাল পরকাল বিষয়ক দুশ্চিন্তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবেন। (আ’মালুল ইয়াউমি ওয়াল-লাইলাহ, ইবনুস সুন্নী; হাদীস ৭১)

৪. নিম্নের দুআটি বেশি বেশি পাঠ করা-

لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ

অর্থ : আপনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই; আপনি নির্দোষ; আমি গুনাহগার। (সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৮৭)

ফযীলত : হযরত ইউনুস আ. এই দু‘আর মাধ্যমে দু‘আ করে মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, এবং মাছওয়ালার কথা স্মরণ করুন, তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিলেন, অতঃপর মনে করেছিলেন যে, আমি তাঁকে ধৃত করতে পারব না। অতঃপর তিনি অন্ধকারের মধ্যে আহ্বান করলেন- لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ। অতঃপর আমি তাঁর আহ্বানে সাড়া দিলাম এবং তাঁকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলাম। আমি এমনিভাবে বিশ্ববাসীদেরকে মুক্তি দিয়ে থাকি। (সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৮৭-৮৮)

৫. মাঝে মাঝে এ দুআটি পাঠ করা-

اَللّٰهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَالْجُنُوْنِ وَالْجُذَامِ وَمِنْ سَيِّئِ الْاَسْقَامِ

অর্থ : হে আল্লাহ! অবশ্যই আমি আপনার নিকট ধবল, মস্তিষ্ক বিকৃতি, কুষ্ঠরোগ এবং সকল প্রকার দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

ফযীলত : হযরত আনাস রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত দু‘আটি পাঠ করতেন। (সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ১৫৫৪)

৬. কাউকে বিপদাক্রান্ত কিংবা রোগাক্রান্ত দেখলে পাঠ করা-

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِيْ عَافَانِىْ مِمَّا ابْتَلَاكَ بِه وَفَضَّلَنِىْ عَلٰى كَثِيْرٍ مِّمَّنْ خَلَقَ تَفْضِيْلًا

অর্থ : আমি আল্লাহ তা‘আলার প্রসংশা জ্ঞাপন করছি যিনি তুমি যে বিপদে বা রোগে আক্রান্ত হয়েছো তা হতে আমাকে নিরাপদ রেখেছেন এবং আমাকে অনেক সৃষ্টজীব হতে ভালো অবস্থায় এবং সসম্মানে রেখেছেন।

ফযীলত : হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি কোনো বিপদাক্রান্ত ব্যক্তিকে দেখে দু‘আটি পাঠ করবে সে কখনো ওই বিপদে আক্রান্ত হবে না। (সুনানে তিরমিযী; হাদীস ৩৪৩২)

৭. অসুস্থ ব্যক্তিকে ঝাড়-ফুঁক করার দুআ-

(ক)

اَللّٰهُمَّ رَبَّ النَّاسِ اَذْهِبِ الْبَأْسَ وَاشْفِ اَنْتَ الشَّافِىْ لَا شِفَاءَ اِلَّا شِفَاؤُكَ شِفَآءً لَّا يُغَادِرُ سَقَمًا

অর্থ : মানবজাতির প্রতিপালক হে আল্লাহ! রোগকে দূর করে দাও; আরোগ্য দান করো। তুমিই আরোগ্যদাতা। তোমার আরোগ্য ছাড়া অন্য কেউ রোগমুক্তি দিতে পারে না। এমন আরোগ্য দান করো যা সকল ব্যধিকে দূরীভূত করে দেয়।

ফযীলত : হযরত আয়িশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যেতেন তখন উপরোক্ত দু‘আটি পাঠ করতেন। (সহীহ বুখারী; হাদীস ৫৬৭৫, সহীহ মুসলিম; হাদীস ২১৯১)

(খ) সূরা ফাতিহা নিয়মিত পাঠ করা। সুরা ফাতেহা পাঠ করে পানিতে ফুঁ দিয়ে সে পানি নিজে পান করা ও অসুস্থ ব্যাক্তিকে পান করানো। সূরা ফাতেহা পাঠ করে অসুস্থ ব্যাক্তিকে ফুঁ দেয়াতেও ফায়েদা হয়।

ফযীলত : হযরত আবূ সঈদ খুদরী রাযি. হতে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের একটি জামাআত আরবের একটি গ্রামে আসলেন। কিন্তু গ্রামবাসীরা তাদেরকে মেহমানদারী করলো না। ইত্যবসরে ঐ গ্রামের সর্দারকে সাপে দংশন করলো। ফলে তারা সাহাবায়ে কেরামের কাছে এসে বললো তোমাদের কাছে ঔষুধ আছে কি?/ তোমাদের কেউ ঝাঁড়ফুঁক করতে পারে কি?  সাহাবাগণ বললেন, তোমরা তোম আমাদের মেহমানদারী করো নি তাই আমাদেরকে বিনিময় না দিলে আমরা  চিকিৎসা করবো না। তখন তারা বিনিময়ে এক পাল ছাগল দিতে সম্মত হলো। ফলে এক সাহাবী সূরা ফাতেহা পাঠ করে (আক্রান্ত ব্যাক্তির উপর) থুথু মিশ্রিত দম করলেন (ফুঁ দিলেন)। ফলে সে সুস্থ হয়ে গেলো। তখন ঐ সাহাবী একপাল ছাগল নিয়ে আসলেন। কিন্তু সবাই বললো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে না জিজ্ঞেস করে এই ছাগল আমরা গ্রহণ (ভক্ষণ) করবো না। অতঃপর তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি হাসলেন এবং বললেন তোমরা কিভাবে জানলে যে সূরা ফাতেহা দ্বারা চিকিৎসা হয়? তোমরা এই ছাগল গ্রহণ করো এবং আমাকেও একটি অংশ দাও। (সহীহ বুখারী; হাদীস ৫৭৩৬)

৮. রোগী দর্শনের দুআ-

(ক)

اَسْئَلُ اللهَ الْعَظِيْمَ رَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ اَن يَّشْفِيَكَ

অর্থ : আমি মহান আরশের প্রতিপালক মহামহিম আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি আপনাকে সুস্থতা দান করুন।

ফযীলত : হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, যখন কেউ কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যায় এবং তার পাশে উপরোক্ত দু‘আটি সাতবার পড়ে; যদি সে মৃত্যুমুখে পতিত না হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে অবশ্যই সুস্থতা দান করবেন। (সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ৩১০৬, সুনানে তিরমিযী; হাদীস ২০৮৩)

(খ)

لَا بَأْسَ طَهُوْرٌ اِنْ شَآءَ اللهُ

অর্থ : ঘাবড়ানোর কোন কারণ নেই। (আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন) ইনশাআল্লাহ। এ রোগ পবিত্রতা সাধনকারী।

ফযীলত : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোগী দর্শনে গিয়ে দু‘আটি পাঠ করলেন। (সহীহ বুখারী; হাদীস ৩৬১৬)

উপসংহার

বিপদাপদ বালা মুসীবত মানুষের গুনাহের ফল। কাফের ও গুনাহগারদের জন্য আল্লাহর আযাব এবং আল্লাহর দিকে ফিরে আসার সবাব (উপায়)। আর মুমিনের জন্য গুনাহ মার্জণার কারণ ও মর্তবা উন্নিত হওয়ার সোপান। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লাম ইরশাদ করেন, মুমিনের বিষয়টি বড় বিস্ময়কর, প্রত্যেক হালতই তার জন্য কল্যাণকর। সে যদি ভালো অবস্থায় থাকে তাহলে আল্লাহর প্রশংসা করে ও শুকরিয়া আদায় করো, এটা তার জন্য কল্যাণকর। আর যদি কোন খারাপ হালতে পতিত হয় তাহলেও সে আল্লাহর প্রশংসা করে ও ধৈর্যধারণ করে, এটাও তার জন্য কল্যাণকর। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৯৯৯)

বিশেষ করে মুমিন যদি মহামারি বা এজাতীয় কোন মুসীবতে মারা যায় তাহলে তার শহীদী মর্তবা লাভ হয়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লাম ইরশাদ করেন, শহীদ পাঁচ প্রকার ১. যে মহামারিতে মৃত্যু বরণ করে। ২. যে পেটের পীড়ায় মারা যায়। ৩. যে পানিতে ডুবে মারা যায়। ৪. যে ধসে মারা যায়। ৫. যে আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়। (সুনানে তিরমিযী; হাদীস ১০৬৩) তাই আসুন আমরা বিপদাপদে অস্থির ও বে-সবর না হয়ে এখনই সকল গুনাহ থেকে তওবা করি। আল্লাহর ফয়সালায় রাজি থেকে উল্লিখিত আমলগুলো করতে থাকি। আল্লাহর উপরই ভরসা রাখি। দু‘আ ও রোনাযারীর মাধ্যমে তাঁকে রাজি করার চেষ্টা করি। অবশেষে আমরাতো তাঁর কাছেই ফিরে যাবো। তিনিইতো আমাদের মহান মালিক।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *