বাইতুল্লাহর কড়চা (শেষ পর্ব)

মুফতী হাফিজুর রহমান


সকাল ৯.৪৮, শুক্রবার, ১৬.০৮.১৯

আজ আরবের ভূমিতে শেষ শুক্রবার। আগামী পরশু বাইতুল্লাহকে বিদেয় জানাবো। জানি না, জীবনে আর কখনো আসা হবে কি না। তবে আমি আবারো আসবো। আল্লাহ আমাকে আনবেন। পবিত্র স্বপ্ন লালনে সমস্যা কিসের? স্বপ্নের ধরণ দেখেই তো আল্লাহ ব্যবস্থা নিবেন। স্বপ্নটার সবটুকু পুস্পিত হোক।

মিনা, মুযদালিফা ও আরাফার দিনগুলো আজ এ মক্কা ভূমিতেই স্মৃতি হতে চলেছে। জীবনের শ্রেষ্ঠ কষ্টগুলো কেমন যেন পুরনো মনে হচ্ছে। গা শিউরে উঠে, এমন পবিত্র কষ্ট তবে আমরাও বরণ করতে পারি! অদৃশ্য অনুগ্র না হলে এমন চাপ বয়ে নেয়া সত্যিই সাধ্যাতীত ছিলো।

আরাফার বিস্তির্ণ প্রান্তর। সূর্যের প্রচণ্ড তাপদাহ বয়ে চলছে অবিরাম। হঠাৎ আকাশ ভেঙ্গে সে কি ঝুম বৃষ্টি! পবিত্র ভূমিতে নেমেই বৃষ্টিভেজা সুখময় একটি দিনের প্রতীক্ষায় ছিলাম। বৃষ্টি ঝরছে। চোখের অশ্রু আর বৃষ্টির পবিত্র ধারায় ভিজে একাকার হচ্ছি। বায়ুপ্রবাহ ধীরে ধীরে প্রচণ্ডতর হলো। চার পাশ জুড়ে ভীতিকর ভয়াবহতা ছেয়ে গেলো। তাবুতে ফিরে যাওয়াটাই নিরাপদ মনে হলো। তাবুতে প্রবেশ করতেই ঝড়ের মাত্রা প্রচণ্ড রূপ ধারণ করলো। কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। জীবন প্রদীপ এই বুঝি নিভে যাচ্ছে। এই বুঝি জীবন সায়াহ্ন ঘনিয়ে আসছে। আহ! পাথেয় তো এখনো সংগ্রহ হয় নি। বার বার তাবু উড়ে যাবার উপক্রম হচ্ছে। স্টিলের পাতগুলো পট পট করে ছুটে যাচ্ছে। এসিবক্সগুলো সশব্দে ছিটকে পড়ছে।আমরা পাতগুলো শক্ত করে আকড়ে ধরে আছি। সবটুকু শক্তি দিয়ে স্বরবে দুআ দরূদ পড়ছি। বিকট আওয়াজে থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। একেকটি বজ্র মনে হচ্ছে আমাদের মাথার উপর আছড়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। ‘এতোটা ভীতু হওয়া বোধ হয় ঠিক হলো না। এমন সরব দুআর আয়োজনটাই বা কেন করা হলো? শেষ বিদায়টা না হয় পবিত্র ভূমিতেই হতো!’ কে জানে অনুভূতিটা কতোটা শুদ্ধ?

মুযদালিফার তারাভরা রজনীটাও বেশ মুগ্ধতায় কেটেছে। হজ্বব্রতের পাটে পাটে কত শত দীক্ষাবার্তা ছড়িয়ে রয়েছে তা উপলব্ধি করাটাও দুষ্কর।

দিনলিপিগুলোতে কোনোরকম জড়তা ছাড়াই অনেক কথা বলা হয়ে গেছে। যে কথাগুলো সাধারণত কেউ বলে না। সবাই হারামাইনের ভালো দিকগুলো নিয়ে কথা বলেন। মানব সৃষ্ট ত্রুটিগুলো এড়িয়ে যান। অবশ্য এটারও একটা ভালো দিক আছে। আমার অজান্তেই লেখাগুলো সংস্কারধর্মী হয়ে গেছে। এ কথা সত্য, ‘ফুলবাগানে গিয়ে ফুলের সৌন্দর্য-সৌরভ ও পাখীদের কলরব উপভোগ করতে হয়। পশু পাখীর বিষ্ঠা অনুসন্ধান করতে নেই।’ তবে একথাও সত্য, ফুলবাগানে যদি মনুষ্য প্রজাতি বিষ্ঠাকর্ম করে তবে সে মানুষগুলোকে ছেড়ে দিতে নেই। দিনলিতে যে অসঙ্গতিগুলো উঠে এসেছে তা মনুষ্যকৃতি; পক্ষীকৃতি নয়।

পবিত্র জায়গাগুলোর যে বিষয়টা আমাকে সবচে বেশি পীড়া দিয়েছে তা হলো দ্বিধাহীন ধূমপান। ধূমপান বৈধ কি বৈধ নয় তা জানতে কোনো ইসলামিক আইনবিদের দ্বারস্থ হবার প্রয়োজন নেই। সুস্থ রুচি ও স্বাস্থ্যবিদ্যাই এ ব্যাপারে ফতওয়া দেবার জন্য যথেষ্ট। এ নিয়ে আমি ভিনদেশী অনেকের সাথে বিবাদ করেছি। ঠিক বিবাদ নয়; নাহি আনিল মুনকার-অসৎ কর্মের দমন। চরম মাত্রার হারাম ও নিষিদ্ধ কর্মটি পরিত্যাগ করার যোগ্যতা অর্জন করেই তবে এখানে আসা প্রয়োজন ছিলো। মিনা-মুযদালিফায় অবস্থান চলছে। সাথে চলছে মরণঘাতী সুখটান। এ যেন নামাজে দাঁড়িয়ে মদের বোতলে সুখের চুমুক। মদীনার একটি শ্লোগান আমাকে বেশ মুগ্ধ করেছে। শ্লোগানটির আরবীপাঠ ছিলো এমন, لاتؤذ نفسك واخاك بالتدخين। ধূমপান করে নিজেকে এবং তোমার ভাইকে কষ্ট দিয়ো না। অবৈধতার মাত্রা বেশি হবার কারণটা এখানেই নিহিত। ঘৃণিত এ ধূমপানে ব্যক্তি নিজেই ক্ষতিগ্রস্থ হয় না; বরং তার আশপাশকেও ক্ষতিগ্রস্থ করে।

সৌদী প্রশাসেনর অবশ্য করণীয় ছিলো, এ ব্যাপারটিতে চরম মাত্রার কঠোরতা আরোপ করা। সৌদী প্রশাসন তো নিজেই মহা ব্যধিতে আক্রান্ত। সে আবার কার ব্যধি নিরাময় করবে? সৌদী প্রশাসনের নবীন ছেলেটা সবকিছুতেই তার পূর্বপুরুষকে টেক্কা দিচ্ছে। বুকের পাটা শক্ত বলেই মনে হয়!? সে পবিত্র আরব ভূমিটাকে ইউরোপ আমেরিকার আদলে সাজাতে চাচ্ছে। ছেলেটার বোধোদয় হোক। যুব মানুষটার সুন্দর মুখটার মত হৃদয়টাও সুন্দর হয়ে উঠুক।

আমার পাশে একজন তুর্কী বসে আছে। আমাকে অদ্ভূত রকমের একটা ভাষায় লিখতে দেখে বেশ বিস্মিত হচ্ছে। তুর্কী ভাষায় আমাকে কি যেন একটা জিজ্ঞেস করে বসলো। আমি তাকে আরবী ভাষায় বুঝালাম, আপনার ভাষাটা আমি বুঝতে পারছি না। তার চেহেরা দেখে বুঝলাম, সে আরবী বুঝে না। ইংলিশে বুঝালাম, আমি বাংলাদেশী। যা লিখছি তা বাংলা ভাষার বর্ণ-শব্দ। এবার সে মুচকি হেসে জানিয়ে দিল, হ্যা, এবার বুঝতে পেরেছি। নিজেকে তুর্কী পরিচয় দিয়ে বেশ মুগ্ধতা প্রকাশ করলো। এবার শুরু হলো আপ্যায়নের পালা। ব্যাগ থেকে ছোলা বুট ও বাদামের মত এক ধরনের ফল বের করে এক প্রকার জোর করে আমার হাতে তুলে দিলো। ফল হাতে তো আর বসে থাকা যায় না। মাইন্ড করার একটা ব্যাপার তো আছেই। তাই চট জলদি মুখে পুরে নিলাম। বেশ স্বাদের মনে হলো। কিছু সময় পর আরেক প্রজাতির ফল। দেখতে পোকা মাকড়ের মত অনেকটা। নিতেই হবে। তাই হাতে নিয়ে খেয়ে নিলাম। এটাতে স্বাদের মাত্রা আরো বেশি মনে হলো। আমার ছোট্ট ব্যাগটায় আপ্যায়ন করাবার কত কিছু নেই। তাই খাওয়াই হলো। দেয়া হলো না। আকস্মিক এ ভোজন কর্মে লেখার মত বিষয়গুলো সব হারিয়ে গেলো। কিছুই খুঁজে পেলাম না। তাই কলম বন্ধ।
সকাল ১১.১৪

জেদ্দা বিমানবন্দরে বিদায় কড়চা -৭

রাত ১০.১২, বুধবার, ১৮.০৮.১৯, জেদ্দা বিমানবন্দর

জিদ্দা বিমানবন্দরে বসে আছি। এখন রাত দশটা বেজে পনের মিনিট। ভোর পাঁচটার দিকে বিমান আকাশে উড়বে। অনেক সময়। ঘুম নির্ঘুমেই পার করে দিতে হবে। গত মাসের ছয় তারিখে এসেছিলাম। আজ এ মাসের আঠারো তারিখ। যখন বিমান আকাশে উড্ডয়ন করবে তখন উনিশ তারিখ। অনেকগুলো মুখ এক সাথে জড়ো হয়েছিলাম। মনের অজান্তেই পবিত্র এক মায়ার বাধনে জড়িয়ে পড়েছিলাম। সে বাধনে আজ চির ধরতে যাচ্ছে। মনটা বেদনাবিধুর হয়ে আছে। চেহারায় অবশ্য এর ছাপ-রেখা নেই। হাসি মুখেই সবার সাথে বাকবিনিময় হচ্ছে। বেদনাগুলো মনের মাঝেই লুকিয়ে রাখার কসরত করছি। কোনো কোনো মুখ হয়তো চির তরে হারিয়ে যাবে। জীবনে আর কখনো দেখা হবে না। মূল কাফেলায় আমরা মোট সাতাইশ জন ছিলাম। অগোছালোভাবে নামগুলো স্মরণে আনার চেষ্টা করছি। সাথে অনুমানভিত্তিক ঠিকানা পরিচিতিটাও।
১। মামুন ভাই, আদাবর, ঢাকা
২। মুমিনুল হক সাহেব, আদাবর, ঢাকা
৩। জাহাঙ্গীর ভাই ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তান, ঢাকা
৪। জাহাঙ্গীর ভাই, ঢাকা উদ্যান, ঢাকা
৫। রাসেল ভাই, বরিশাল
৬। আলী আহমাদ সাহেব, জিঞ্জিরা, ঢাকা
৭। আলী আহমাদ সাহেবের মামা, জিঞ্জিরা, ঢাকা
৮। দুলাল ভাই, বরিশাল
৯। খালেকুজ্জামান সাহেব, নরশিংদি
১০। স্যার শামসুল হক সাহেব, রংপুর
১১। ফজলে রাব্বী ভাই, সাভার, ঢাকা
১২। আরিফ ভাই, জিগাতলা, ঢাকা
১৩। আশরাফ ভাই, বসিলা, মোহাম্মাদপুর, ঢাকা
১৪। উসামা ভাই, মগবাজার, ঢাকা
১৫। নাসীম ভাই, বসিলা, মোহাম্মাদপুর, ঢাকা
১৬। ওয়ালিউল্লাহ রাব্বিল ভাই, বসিলা, মোহাম্মাদপুর, ঢাকা
১৭। রাকিব ভাই, বসিলা, মোহাম্মাদপুর, ঢাকা
১৮। মুজিবুর রহমান সাহেব, শাহজাহানপুর, ঢাকা
১৯। হাফিজুর রহমান, শিবচর, মাদারীপুর

মহীয়সীদের মধ্য থেকে ছিলেন
২০। ফজলে রাব্বী ভাইয়ের আম্মা, সাভার, ঢাকা
২১। ফজলে রাব্বী ভাইয়ের শাশুড়ি, সাভার, ঢাকা
২২। ফজলে রাব্বী ভাইয়ের বোন, সাভার, ঢাকা
২৩। ওয়ালিউল্লাহ রাব্বিল ভাইয়ের আম্মা, বসিলা, মোহাম্মাদপুর, ঢাকা
২৪। মামুন ভাইয়ের আম্মা, আদাবর, ঢাকা
২৫। মুজিবুর রহমান সাহেবের স্ত্রী, শাহজাহানপুর, ঢাকা
২৬। রাকিব ভাইয়ের খালাতু বোন, আদাবার, ঢাকা
২৭। হাফিজুর রহমানের আম্মা, শিবচর, মাদারীপুর
তৃতীয় পর্বে আমাদের সাথে সংযুক্ত হয়েছিলেন, সজীব ভাই ও বারিধারার এক মাওলানা সাহেব। আর মূল দায়িত্বে ছিলেন ফয়সাল ভাই। সব মিলিয়ে ত্রিশ জন।

ব্যক্তিগত মূল্যায়ন
সব বিষয়েই দুটি দিক থাকে। বৈষয়িক ও পরজাগতিক। আমাদের পবিত্র ভ্রমণেও দুটি দিক ছিলো। মূল লক্ষ হিসেবে পরজাগতিক বিষয়টাই আমাদের সকলের মনে জাগ্রত ছিলো। তবে এখানে আবশ্যিক প্রসঙ্গক্রমে বৈষয়িক দিকটাও বিরাজমান ছিলো। কেউ কেউ বৈষয়িক দিকটার প্রতি তেমন দৃষ্টি দেয় নি বা দিতে পারে নি। তাই এর সুবিধা অসুবিধাগুলো তেমন লক্ষ্যগোচর হয় নি। কেউ কেউ বৈষয়িক দিকটার প্রতিও আলতোভাবে দৃষ্টি বুলাবার চেষ্টা করেছেন। ফলে এর সুবিধা অসুবিধাগুলো ফুটে উঠেছে। আমার ব্যক্তিগত অনুভূতিটা ছিলো এমন, ‘আমি আল্লাহর ঘরে এসেছি। আল্লাহ নিয়ে এসেছেন। ব্যাস। আমি সফল। সবটুকু প্রাপ্তিই আমার হাতের মুঠোয়।’ পবিত্র এ অনুভূতিটাকে সব সময় লালন করার চেষ্টা করেছি। তাই বৈষয়িক কোনো অসঙ্গতি হয়ে থাকলে সেগুলো চোখে পড়ে নি বা সেগুলোকে বড় প্রাপ্তির কাছে বড় তুচ্ছ জ্ঞান করার চেষ্টা করেছি। উপরন্ত আমি ছিলাম নতুন অভিযাত্রী। সুবিধা-অসুবিধা বিষয়ক জানা শোনাটাও ছিলো সীমাবদ্ধ। তাই সেবার তুলনামূলক মান যাচাইয়ের সক্ষমতা আমার ছিলো না। আমাদের কাফেলার সদস্যদের অনুভূতিগুলোও ছিলো মিশ্র। কারো অনুভূতি, তুলনামূলক মানসম্পন্ন সেবা পেয়েছি। কারো অনুভূতি, সময়গুলো বেশ চমৎকার কেটেছে। কারো নিকট সেবাটা তেমন মানসম্পন্ন হয় নি। কারো নিকট একদম বাজে সেবা দেয়া হয়েছে। কারো অনুভূতিটা মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে। সামগ্রিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে মূল্যায়নটা ছিলো বেশ আপেক্ষিক। তবে মূল বিষয়টাতে আল্লাহ আমাদের সফলতা দিয়েছেন বলেই বিশ্বাস করতে পারি। এজন্য আল্লাহ সমীপে অসংখ্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *