মুফতী হাফিজুর রহমান
একজন মুসলিম তার যাপিত জীবনে দীনী অনুশাসন মেনে চলবে- এটিই তার সহজাত জীবনচিত্রের দাবি। প্রবৃত্তির তাড়নায় কখনো সে বিধান পালনে শিথিল হলেও অনুশাসনিক বিধান-নীতির ব্যাপারটিতে তার বিশ্বাস থাকবে চিরসবুজ, অমলিন। এর ব্যত্যয় ঘটলে মুসলিম তালিকায় তার নামটি খুঁজে পাওয়া বেশ দুরূহ হয়ে পড়বে। উযহিয়্যা কিংবা কুরবানী চিরায়ত একটি মুসলিম অনুশাসনিক বিধান। যুগ যুগ ধরে ফি বছর মুসলিম সমাজে বিধানটি পালিত হয়ে আসছে। উযহিয়্যা বিধানটি মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকদের নিকট এমন কোনো লঘু মানের বিষয় নয় যার অস্তিত্ব কিংবা সত্যাসত্যি নিয়ে তারা মতবৈচিত্রের নিগড়ে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পাবেন। কুরআন, হাদীস এবং সাহাবা ও তাবেয়ীদের বাণী-সমগ্রে এ সংক্রান্ত প্রচুর পরিমাণ নীতি-বিধান বিবৃত হয়েছে। ইসলামী শরীয়ার একটি স্বীকৃত নীতি হলো, ইসলামী বিধান সংক্রান্ত বিদ্রুপাত্মক আচরণ ব্যক্তিকে ঈমানের গণ্ডি থেকে দূর সীমানায় নিক্ষেপ করে দেয়। ইসলামের গণ্ডির সাথে তার আর সাক্ষাৎ মেলে না। বাৎসরিক কুরবানী উৎসবের নিগূঢ় তাৎপর্য হলো, নিজের ভিতরকার যাবতীয় পাশবিকতাকে সমূলে অপসারণ করে দেহমনকে আল্লাহ সমীপে সঁপে দেয়া। সুতরাং এটি কুরবানী উৎসবের অতি প্রয়োজনীয় কাঙ্ক্ষিত একটি ফল। বৃক্ষ বিনে যেমন ফলের দেখা মেলে না তেমনি কুরবানী বিধান পালন ব্যতিরেকে এর ফল অর্জনে নিরত হওয়াটা এক প্রকার বাতিকগ্রস্ততা কিংবা ভীমরতি বৈ কিছুই নয়। আজকাল কুরবানী ঈদের সময় ঘনিয়ে এলে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে রং চড়ানো এক শ্রেণীর বুলি বেশ চাউর হয়ে উঠে। যথা : পশুত্বের কোরবানী চাই, মনের পশুরে করো জবাই, প্রভৃতি। আপাত দৃষ্টিতে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন এ জাতীয় ব্যাপারগুলোতেই كلمة حق أريد بها باطل বাগধারাটি প্রচলিত হয়। বাংলা বাগধারায় এর তরজমা দাঁড়ায় ‘কথা সত্য মতলব খারাপ’। ৩৭ হিজরী সনে হযরত আলী রা. রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা সমাধানে সালিসী ব্যাবস্থায় সম্মতি জ্ঞাপন করলে ‘আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহ্ব হারামী’ নামক জনৈক ব্যক্তি বলে উঠে لا حكم إلا لله -‘বিধান একমাত্র আল্লাহর; মানুষের কোন সালিস সমাধান গ্রহণযোগ্য নয়।’ অথচ সমাধান ইসলামী নীতিমালা সমর্থিত হলে তা অবশ্যই পালনীয়। এ পরিপ্রেক্ষিতেই আলী রা. বলেছিলেন, كلمة حق أريد بها باطل (ইমাম ইবনে হিব্বান, কিতাবুস সিকাত ২/২৯৫)
বুলি রচয়িতারা কখনো তাদের মনের প্রচ্ছন্ন ব্যাপারটিকে খানিকটা উন্মুক্ত করেই প্রকাশ করে ফেলেন-‘পশু নয় পশুত্বের কোরবানী চাই’। একসময় তারা স্থান-কালের ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রেখে একটু লুকিয়ে-চুরিয়ে তাদের মনের বাসনাকে প্রকাশ করতেন। প্রযুক্তির অপার সম্ভাবনা আর পরিবেশের আনুকূল্যে এখন তারা আর লুকোচুরির আশ্রয় নেন না। নেট মিডিয়াতে এ ব্যাপারে তারা তাদের বাকস্বাধীনতাকে মনের সবটুকু মাধুরী মিশিয়ে প্রয়োগ করেন। এক্ষেত্রে অবশ্য আমাদের আর উপরস্থ বাগধারাটির দ্বারস্থ হতে হয় না। কারণ তারা এবার তাদের মনের কথা এবং কলমের কথাকে এক করে দিয়েছেন। মতলবটি যেমন কদর্য ছিল কথাটিকেও তেমন কদর্য করে দিয়েছেন। মতলবের মত কথাটিও সত্যতার আঁচড় মুক্ত। মুক্তমনের এসব মানব সন্তানেরা আদৌ ভেবে দেখেন না, তারা পশুর পরিবর্তে নিছক পশুত্বের নিধন করার নামে হাজারো পশুত্বের জন্ম দিচ্ছেন। এ নয়া পশুত্বের নিধনযজ্ঞ কি করে হবে তা কি তারা কদাচিৎ ভেবে দেখেন?
আমরা এবার কুরবানী বিষয়ক তাদের বক্তব্য নিয়ে কিছুটা পর্যালোচনার চেষ্টা করবো। জনৈক ব্লগার ‘আমার ব্লগ’ নামের একটি ব্লগে ‘পশু কোরবানী : মুদ্রার অপর পিঠ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন। নিবন্ধটি ক’ বছরের পুরনো হলেও নেট সার্চে এখনো খুব সহজে হাতের নাগালে চলে আসে। ব্লগার মহোদয় তার নিবন্ধটি সূচনা করেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে প্রচলিত একটি কবিতা দিয়ে। কবিতার শব্দগাঁথুনি নিম্নরূপ-
দিওনাকো পশু কোরবানী,
বিফল হবেরে সবখানি।
মনের পশুরে করো জবাই,
পশুরাও বাঁচে বাঁচে সবাই।
কবিতাটি সত্যিই কবি নজরুল ইসলামের কিনা তা নজরুল গবেষক কিংবা কাব্য-কবিতা নিয়ে যারা নিরন্তর সাধনা করেন তারা বলতে পারবেন। কবি নজরুল ইসলাম জীবনে অনেক কবিতা লিখেছেন। বিশ্বাসের নিগড়ে তার জীবনটি নানা অধ্যায়ে বিভক্ত। তিনি তার জীবনকে আলোচনা সমালোচনার নানা পর্বে বিভক্ত করে গিয়েছিলেন। তো তিনি তার জীবনের কোন পর্বে আলোচিত কবিতাটি রচনা করেছিলেন এবং এর পরে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অনুকূলে কোনো কবিতা রচনা করেছিলেন কিনা? উল্লেখিত কবিতাটিকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করার পূর্বে এ বিষয়গুলো সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা লাভ করা জরুরী। তাছাড়া কবি সাহেব নিছক একজন কবিই বটে। কোনো কবি যদি কখনো বিশ্বাসের নিগড়ে আবদ্ধ থাকতে না পারেন তবে তার কবিতাকে প্রমাণ-সূত্রের মানদণ্ডে উন্নীত করা যায় না। সাধারণত কবিদের কাব্যিক ভাবনায় সত্য-অসত্যের অফুরন্ত সমাবেশ ঘটে। তারা কল্পনার জগতকে শব্দবন্দি করে কবিতার রূপ দেন। যুক্তি তর্কে কিংবা অনুসন্ধানী বিবরণে কবিতা সচরাচর প্রমাণ-সূত্র হিসেবে স্থান পায় না। সুতরাং কবি নজরুল মুসলিম হতে পারেন, তার কবিতা তো ইসলাম নয়। তার কবিতাকে ইসলামী নীতি বিধানের মাপকাঠিতে যাচাই করতে হবে। এতে যতটুকু টিকবে ততটুকুই প্রমাণসূত্র হিসেবে গণ্য হবে। এরপর ব্লগার মহোদয় নিবন্ধটির ছোট্ট একটি গৌরচন্দ্রিকা টেনেছেন। গৌরচন্দ্রিকাটির শেষ প্রান্তে এসে তিনি বলেন, একদিনে লাখ লাখ গরু হত্যা করে পৈশাচিক উল্লাস পালন করে যে মোহাবিষ্ট মুসলমানরা, আর অজুহাত দেখায় ধর্মীয় নির্দেশের, ঐশী বাণীর, এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ আর কতদিন চলবে… এমন প্রশ্ন তাড়িত করে নিশ্চয়ই প্রতিটি বিবেকবান মানুষের!!
যে ব্লগার ভাইটি এমন জঘন্য মন্তব্য করলেন, জানি না তিনি কোনো ধর্মীয় পরিচয় বহন করেন কি না। কোরবানী বিধানটি দু শ্রেণীর মানুষের লেখনি আগ্রাসনের শিকার।
(১) আস্তিকতার সীমানা মাড়িয়ে যারা নাস্তিকতার মুক্ত (?) প্রান্তরে প্রবেশ করেছেন।
(২) মুনকিরীনে হাদীস (হাদীস অস্বীকার কারী) = মুস্তাশরিকীন (প্রাচ্যবিদ) = ওয়ারিয়েন্টালিস্ট (প্রগতিবাদী)।
ব্লগার মহোদয় যদি দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত হয়ে থাকেন (নিবন্ধটির সরল পাঠে মনে হয় তিনি এ শ্রেণীভুক্ত।) তবে তো তার সাথে বিতর্কের বিষয়টি নিছক কুরবানীর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং এক ধাপ এগিয়ে হাদীসের অস্তিত্ব ও সত্যতা বিষয়েই তার সাথে বিতর্কে জড়াতে হবে। কারণ কুরবানীর প্রামাণিকতা বিষয়ে কুরআনের মূলসূত্র বিদ্যমান থাকলেও তাতে অপব্যাখ্যা গ্রহণের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। তাই বিশুদ্ধ হাদীসের মাধ্যমে উদ্ভূত সে অপব্যাখ্যার অপনোদন ঘটিয়ে কুরবানী বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা গ্রহণ করতে হয়। এখন যে ব্যক্তি হাদীসের অস্তিত্বকে স্বীকার করে না তার সাথে নিছক কোরবানীর অস্তিত্ব প্রমাণে বিতর্ক করার অবকাশ আপাতত নেই। দ্বিতীয়ত যারা হাদীসের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বিতর্কটা কি শিরোনামে হবে? মুসলিমের সাথে মুসলিমের বিতর্ক নাকি অমুসলিমের সাথে মুসলিমের বিতর্ক? এটি একটি সমাধান সাপেক্ষ ব্যাপার। যারা কুরআনের ব্যাখ্যায় হাদীসকে অচ্ছুৎ এবং অপাংক্তেয় মনে করেন তারা কি আদৌ ঈমানের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে পারেন? সারকথা এ শ্রেণীর মানুষের মন্তব্যের জবাবে নাতিদীর্ঘ একটি নিবন্ধের প্রয়োজন পড়বে। যার জন্য এ সময় এবং এ স্থান উপযোগী নয়। আর যদি ব্লগার মহোদয় প্রথম শ্রেণীভুক্ত হন তবে বিতর্কটা হবে আস্তিক-নাস্তিক, মুসলিম -কাফের, মুসলিম-মুরতাদ শিরোনামে। তো যারা এ শ্রেণীভুক্ত তারা তো পূর্ণ দীনে ইসলামটিকে পূতিগন্ধময় একটি পাগাড় জ্ঞান করে থাকে। আর কুরবানী তো তার ক্ষুদ্র একটি শাখা মাত্র। সুতরাং কুরবানীর অস্তিত্ব নয় দীনের অস্তিত্ব বিষয়েই তাদের সাথে প্রাথমিক বিতর্ক হতে পারে। যা স্বতন্ত্র নিবন্ধ নয়; স্বতন্ত্র গ্রন্থ সাপেক্ষ। তবে এ আসরে এতটুকু বলা যায়, ব্লগার মহোদয় আপনি যে শ্রেণীভুক্তই হোন না কেন আপনি বা আপনার শ্রেণীভুক্তরা কিন্তু বৌদ্ধ সমাজের মত নিরামিষভোজী নন। আপনার গৃহে অতিথি এলে আপনিও মাছ, মুরগী, কবুতর জাতীয় প্রাণীর গলে ছুরি চালিয়ে দেন। তখন কিন্তু আপনার আনন্দকে শিকেয় তুলে রাখেন না। তখন কিন্তু ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ শ্লোগানে আপনার কপোল বেয়ে মমতার অশ্রু ঝরে না। পশ্চিমা বিশ্বে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ শুকর হত্যা করা হচ্ছে, প্রতিটি কসাইখানায় হাজার হাজার পশু জবাই হচ্ছে। এজন্য তো আপনার মায়া কান্নায় চোখ ভেজে না। তাহলে কুরবানী নামক ইবাদত নিয়ে আপনার এতো উদ্বেগ উৎকণ্ঠার গোড়াসূত্র কী? মহোদয়! গরু হত্যা করে পৈশাচিক কেন মানবিক উল্লাসও ইসলামে কাম্য নয়। উযহিয়্যার পশুকে ভালোবাসার মাধুরী মিশিয়ে আপন হাতে প্রতিপালন করে অসীম মমতা সৃষ্টি করে তারপর আল্লাহর সন্তুষ্টির সামনে নিজের মায়া-মমতাকে বিসর্জন দিয়ে অশ্রুসজল বেদনা বিধুর আবহ সৃষ্টি করাই হলো উযহিয়্যা বিধানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। আর আল্লাহর বিধান সম্পন্ন করার চেয়ে মুমিনের জন্য আনন্দের বিষয় আর কি হতে পারে। সুতরাং উযহিয়্যার দিনে মুমিনের আনন্দ ‘গোহত্যা’ কেন্দ্রিক নয়; আল্লাহর বিধানকে সন্তুষ্টচিত্তে সম্পন্ন করতে সক্ষম হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই এ আনন্দ উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ। এজন্য ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশÑ যখন কেউ তার পশুকে জবাই করে সে যেন তার ছুরি ভালোভাবে ধারিয়ে নেয়। যাতে পশুর কোন রকম বাড়তি কষ্ট না হয়। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ১৯৫৫) ধারহীন ভোঁতা ছুরি দিয়ে পশু জবাই নিষিদ্ধ। পশুর সামনে ছুরি ধার দেয়া নিষিদ্ধ। এক পশুর সামনে অন্য পশু জবাই করা নিষিদ্ধ। (শরহু মুসলিম ১৩/১১০) যদি কুরবানীতে পৈশাচিক উল্লাসই উদ্দেশ্য হয় তাহলে এতো এতো বিধি-নিষেধের স্বার্থকতা কী?!
কোনো বিষয়ে মন্তব্য করার পূর্বে সে বিষয় নিয়ে প্রচুর অধ্যয়ন করতে হয়। জানি না ব্লগার মহোদয় কি পরিমাণ সময় এ খাতে ব্যয় করেছেন। নাকি তিনি তার উপরস্থদের লেখালেখিতে একপেশে কিছু অধ্যয়ন করেই কর্মজগতে নেমে পড়েছেন। আল্লাহ আমাদের যাবতীয় পদস্খলন থেকে নিরাপদ রাখুন। ব্লগার মহোদয় এরপর তার চিন্তাগত মুক্ত অভিমতের পক্ষে চারটি প্রমাণ-সূত্র (?) উপস্থাপন করেছেন। অবশ্য ব্লগার মহোদয় এ সূত্রগুলোকে ‘ভাবনা’ বলে স্বীকার করেছেন। এ ভাবনাগুলো কি বস্তুত মুক্ত মনের ভাবনা নাকি উন্মত্ত মনের ভাবনা তা উপলব্ধি করা বেশ দুরূহ। এবার তাহলে ক্রমানুসারে ভাবনাগুলোর সাক্ষাৎ লাভ করা যাক।
(১) আশিক্কীনে আউলিয়া ঐক্য পরিষদ বাংলাদেশের সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ সাদেক নূরীর অভিমত : প্রয়োজনে পশু জবাই করা, এর গোশত খাওয়া খাওয়ানো বৈধ; কিন্তু কোনো বিশেষ দিনে যত্রতত্র ও যথেচ্ছা পশু জবাই করে গোশত খাওয়া উৎসবকে কোরবানি আখ্যা দেয়া কোরআন সম্মত নয়। বস্তুতঃ কোরবানি শব্দের সাথে ঈদ শব্দের বন্ধন অর্থাৎ কোরবানির ঈদ তথা পশু জবাইর আনন্দ বাকধারার প্রচলন কোরবানির উপরে বর্ণিত কোরানিক ধারণা ও শিক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করেছে। কারণ, তর্কের খাতিরে, কোরবানির তুচ্ছতম প্রতীক হিসাবে প্রচলিত পশু জবাইকে আল্লাহর প্রেমে হযরত ইব্রাহীমের সন্তান জবাই করার আর সন্তানের জবাই হওয়ার বিকল্প (?) যদি মেনেও নেয়া হয়, অপরদিকে ঈদ সর্বসম্মত অর্থে আনন্দ; তা হলেও কোরবানির ঈদ অর্থ দাঁড়ায় পশু জবাইয়ের আনন্দ। বলা বাহুল্য যে, প্রয়োজনে পশু জবাই বৈধ হলেও আনন্দের জন্য পশু জবাই করা অথবা আনন্দ করে পশু জবাই করা অথবা পশু জবাইর আনন্দ কোরআন তো নয়ই, কোন সুস্থ বিবেকের কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়। …মালয়েশিয়াতে মালদারগণ জীবনে একবার হজ্জ করেন এবং একবারই আলোচ্য সামাজিক যৌথ অনুষ্ঠানে পশু জবাইতে অংশগ্রহণ করেন। অপরদিকে ব্রুনাইর বাদশাহ ঐ বিশেষ দিনে সকলের পক্ষ থেকে একটি পশু জবাই দিয়ে থাকেন। আসলে যৌথ সামাজিক আনন্দ অনুষ্ঠান উপলক্ষে পশু জবাই করার ঐচ্ছিক বিষয়টি এরূপ হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে, এটাকে কোন মতেই কোরবান বলা সংগত নয়।
মাওলানা সাহেব তার দীর্ঘ মন্তব্যে একবারের জন্যেও হাদীস শব্দটি উল্লেখ করলেন না। তবে কি তিনি প্রাচ্যবিদদের অনুগামী? নাকি তিনি নিছক আশিকে আউলিয়া? আশিকে নবী নন? নতুবা তো নবীর হাদীসের ব্যাপারে এমন বিমাতাসুলভ আচরণ হওয়ার কথা নয়। আপনি একজন মাওলানা সাহেব। যে ধারারই হোক আপনি মাদরাসায় কিছু সময় লেখাপড়া করেছেন। আপনার শিক্ষাকালীন মাদরাসার শিক্ষা কারিকুলামে কুতুবে সিত্তাহ তথা হাদীসের প্রসিদ্ধ গ্রন্থষষ্ঠক অন্তুর্ভুক্ত ছিল। সেসব গ্রন্থগুলোর পাঠ নিশ্চয় আপনি গ্রহণ করেছেন। তো সেসব গ্রন্থে কি কুরবানী বিষয়ক কোনো বাণী বা আলোচনা স্থান পায়নি? তো কেমন করে আপনার ক্ষেত্রে এমন কিম্ভূৎকিমাকার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো? মাওলানা সাহেব বললেন, পশু জবাই করে গোশত খাওয়া উৎসবকে কোরবানী আখ্যা দেয়া কোরআন সম্মত নয়। আমরা এ কথা বলি যে, গোশত খাওয়ার উৎসবকে কুরবানী আখ্যা দেয়া কুরআন কেন ইসলাম সম্মতও নয়। ইসলামী পরিভাষায় গোশত খাওয়ার উৎসব কুরবানী নয়; কুরবানী হল নিজের হাতে পালিত প্রিয় প্রাণীকে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং নির্দেশের সামনে সঁপে দেয়া। সুতরাং এ আনন্দ পশু হত্যার কিংবা গোশত খাওয়ার আনন্দ নয়; বরং ইবাদত পরিপালনের আনন্দ। উপরন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দিবসগুলোকে ঈদুল আযহা তথা ত্যাগ বা উৎসর্গের আনন্দ বা উৎসব বলে অভিহিত করেছেন। কুরবানীর ঈদ বা পশু জবাইয়ের আনন্দ বাগধারার প্রচলন যদি কুরবানী বিষয়ক কুরআনিক ধারণা বা শিক্ষাকে ম্লান বা বিনষ্ট করে দেয় তবে সে দায়ভার (আল্লাহর আশ্রয় কামনা করছি) তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর বর্তায়! তিনিই তো এ দিবসকে ঈদুল আযহা বলে অভিহিত করে গেছেন। মাওলানা সাহেব বলেছেন, …মালয়েশিয়াতে মালদারগণ জীবনে একবার হজ্জ করেন এবং একবারই আলোচ্য সামাজিক যৌথ অনুষ্ঠানে পশু জবাইতে অংশগ্রহণ করেন।
মাওলানা সাহেব মালয়েশিয়া ও ব্রুনাইয়ের কুরবানী পদ্ধতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। সেখানের সামগ্রিক বাস্তবতার বিশ্লেষণে আমরা না-ই গেলাম। কিন্তু সারা দুনিয়ার এতো এতো কুরবানী পদ্ধতির মধ্যে এ দু’টি পদ্ধতি মাওলানার পছন্দ তালিকায় ঠাঁই পেল কোন গুহা-রহস্যের ভিত্তিতে! তার বক্তব্য ‘কুরবানীর নামে পশু জবাইয়ের আনন্দ কুরআন তো নয়ই কোন সুস্থ বিবেকের কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়’ এর দাবী তো এটাই যে, পশু একটা জবাই করা হোক কিংবা একবার; আনন্দের জন্য পশু জবাই করা হলে সুস্থ বিবেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাহলে উপরোক্ত দুই দেশের কুরবানী পদ্ধতি পছন্দ হল কেন? তবে কী মাওলানার সুস্থ বিবেক আচমকা অসুস্থ হয়ে গেল। ফলে এই পদ্ধতিতে আনন্দ গ্রহণযোগ্য হয়ে গেল! নাকি বিভ্রান্তির বেড়াজালে মোচড়ামোচড়ি করতে করতে হঠাৎ তিনি পাগলই হয়ে গেলেন!! নামের শুরুতে সুন্দর বিশেষণ মাওলানা লাগিয়েছেন। মাওলানা হতে হলে যে অল্প-বিস্তর হাদীসও জানতে হয় মাওলানা সাহেব সম্ভবত এ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নন। তাই কুরআনের দাবী ব্যাখ্যা করে সরাসরি মালয়েশিয়া আর ব্রুনাই চলে এলেন। মাওলানা সাহেব হাদীসের নিম্নোক্ত বক্তব্য ‘যে কুরবানী করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানীর হুকুম পালন করল না সে যাতে ঈদগাহের ধারে কাছেও না আসে’ (মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ৮২৭৩) এর আশপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরির সুযোগ পর্যন্ত পেলেন না।
এরপর ব্লগার মহোদয় বিতর্কিত আরেকজন মানুষের কুরবানী বিষয়ক একটি বিবরণী তুলে ধরেছেন। বিবরণটি নিম্নরূপ-
(২) নয়া কৃষি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা জনাব ফরহাদ মজহার বলেছেন : … প্রাণী হত্যা দেখানো হয়েছে ধর্মের নামে। ইসলামের নামে। এই প্রাণী হত্যার মাধ্যমে এটাই প্রমাণ করা হয়েছে যে, ঠাণ্ডা মাথায় একটি প্রাণী জবাই করাই ইসলামের শিক্ষা। শুধু খেয়াল রাখতে হবে খুন হয়ে যাওয়া প্রাণীটির রক্ত যেন ধুয়ে গর্তে ফেলা হয় এবং ছালের ভাল দাম পাওয়ার জন্য প্রাণীটিকে পানি খাইয়ে ঠিক মতো ছাল ছিলে নেওয়া হয়। একবারও কেউ ব্যাখ্যা করে বলেনি যে, কোরবানি ও প্রাণী হত্যা এক কথা নয়। আল্লা মানুষ যেমন পয়দা করেছেন, পশুকেও পয়দা করেছেন। ইসলামের যে আল্লাকে জানি তিনি তাঁর সৃষ্ট জীবকে এইভাবে জবাই হতে দেখবেন এটা আমি বিশ্বাস করি না। কণ্ঠনালী ফেঁড়ে যাওয়া প্রাণীর কষ্টে তাঁর আরশ কেঁপে ওঠার কথা। কিন্তু এই আল্লার নামেই জবাই করা হয় এবং এক শ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ী এই হত্যাকেই কোরবানি আখ্যা দেয়। এদের যদি প্রশ্ন করা হয়, জবাই করা আর কোরবানির মধ্যে তফাৎ কি? তার কেউই উত্তর দিতে পারবে না। (উৎস : দৈনিক ভোরের কাগজ, ৩০-১০-৯৪)
ফরহাদ মজহার বামধারার একজন কলামিষ্ট। আর বামধারার দর্শন হলো কমিউনিজম। কমিউনিজমের প্রধান গুরু কার্লমার্কস বলেছেন, ‘পৃথিবী বস্তুর নিয়মের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এজন্য কোনও সার্বজনীন সত্তা বা খোদার প্রয়োজন নেই।’ কমিউনিজমের দ্বিতীয় গুরু লেনিন বলেন, ‘নাস্তিকতা মার্কসবাদের স্বাভাবিক এবং অপরিহার্য অঙ্গ। নাস্তিকতা ছাড়া মার্কসবাদ কিছুতেই বোঝা যেতে পারে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘মার্কসবাদী হতে হলে তাকে জড়বাদী হতেই হবে, অর্থাৎ তাকে হতে হবে ধর্মের শত্রু।’-মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দীন, ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ ৬১৬।) সুতরাং কমিউনিজমে যারা আস্থাশীল ধর্ম বিশেষত ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে তাদের বিশ্বাস বা মন্তব্য কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। মজহার সাহেবদের জ্ঞাতার্থে বলছি, ঠাণ্ডা মাথায় শুধু প্রাণী হত্যা কেন ক্ষেত্র বিশেষে ইসলামী বিধান মতে মানব হত্যাও আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। জিহাদ, কিসাস প্রভৃতি পবিত্র অঙ্গনে মানব হত্যা তখন আর নিছক মানব হত্যা থাকে না পবিত্র ইবাদত-উপাসনার রূপ পরিগ্রহ করে। আর মজহার সাহেবরা যে ধারার রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন সেখানে রাজনীতির চূড়ান্ত ফল পেতে অন্যায়ভাবে মানব হত্যাকে অন্যতম অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তখন তাদের নিকট এসব রাজনৈতিক হত্যালীলা বৈধতার স্বীকৃতি পেয়ে যায়। মজহার সাহেবের উপস্থাপনাগত দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে হয় তিনি মশা-মাছির গায়েও টোকা মারেন না। ব্যক্তি জীবনে কি তিনি প্রাণীর প্রতি এমন মমতাবোধকে সদা জাগ্রত রাখতে সক্ষম হন? তিনি কি শাক সবজি আহার করেই জীবনের পড়ন্ত বিকালের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন? বিজ্ঞান বলে উদ্ভিদেরও নাকি প্রাণ আছে। তবে তো মজহার সাহেবদের জল পান করেই জীবনের ইতি টানতে হবে। এর বিপরীত পথে চললে তো প্রাণীকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা ছাড়া কোনো উপায়ন্তর থাকবে না।
ব্লগার মহোদয় তথ্যসূত্রের তৃতীয় ধাপে এসে স্বশিক্ষিত একজন মাতুব্বর সাহেবের কিম্ভূতকিমাকার একটি উদ্ধৃতি এনেছেন। উদ্ধিৃতিটি পাঠ করুন।
(৩) আরজ আলী মাতুব্বর তাঁর সত্যের সন্ধানে গ্রন্থের জীবহত্যায় পুণ্য কি প্রবন্ধে বলেছেন : কোরবানি প্রথার মূল উৎস সন্ধান করিলে মনে কয়েকটি প্রশ্নের উদয় হয়। প্রশ্নগুলো এমন– (ক) হযরত ইব্রাহীম এর স্বপ্নাদেশ তাঁহার মনের ভগবদ্ভক্তির প্রবণতার ফল হইতে পারে না কি? (খ) খোদাতালা নাকি স্বপ্নে বলিয়াছেন, হে ইব্রাহীম, তুমি তোমার প্রিয়বস্তু কোরবানি কর। এই প্রিয়বস্তু কথাটির অর্থ হযরত ইব্রাহীম তাঁহার পুত্র ইসমাইলকে বুঝিয়াছিলেন এবং তাই তাহাকে কোরবানি করিয়াছিলেন। হযরত ইব্রাহীমের প্রিয়বস্তু তাঁহার পুত্র ইসমাইল না হইয়া তাঁহার প্রাণ হইতে পারে না কি? … (গ) কোরবানি কথাটির অর্থ বলিদান না হইয়া উৎসর্গ হইতে পারে কিনা। ঈসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্তান উৎসর্গের নিয়ম আছে। কোন সন্তানকে তাহার পিতামাতা মহাপ্রভুর নামে উৎসর্গ করিতে পারেন। ঐরূপ উৎসর্গ করা সন্তানের কর্তব্য হয়- সর্বস্বত্যাগী হইয়া আজীবন ধর্মকর্ম ও মন্দির-মসজিদের সেবা করা।… (ঘ) যাঁহারা স্বপ্নতত্ত্ব আলোচনা করেন, তাঁহারা জানেন যে, স্বপ্নদ্রষ্টা স্বপ্নে যাহা কিছু দেখে তাহার মধ্যে অধিকাংশই থাকে রূপক। হযরত ইব্রাহীমের স্বপ্নের কোরবানির দৃশ্যটি রূপক হইতে পারে কিনা? উপরিউক্ত বিষয়সমূহ পর্যালোচনা করিলে মনে হয় যে, কোরবানির প্রথার ভিত্তিমূল সুদৃঢ় নয়। একটি স্বপ্নের উপর ভিত্তি করিয়া প্রতি বৎসর লক্ষ লক্ষ পশুর জীবন নষ্ট হইতেছে। উপন্যাসকে ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করিলে যেরূপ ভুল করা হয়, স্বপ্নের রূপককে বাস্তব বলিয়া গ্রহণ করিলে সেইরূপ ভুল হইতে পারে না কি?
আরজ আলী মাতুব্বর সাহেব স্বশিক্ষিত একজন ভূমি বিশেষজ্ঞ। তিনি বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাস করতেন। বস্তুবাদ আর ধর্মবাদ হলো নেগেটিভ পজিটিভ ব্যাপার। একজন ধার্মিক আদৌ বস্তুবাদী হতে পারে না। অন্যদিকে একজন বস্তুবাদী আদৌ ধর্মবাদী হতে পারে না। তো একজন বস্তুবাদী মাতুব্বর সাহেবের কলম থেকে ধর্মীয়মূল্যবোধ আদৌ আশা করা যায় না। মাতুব্বর সাহেব এক ধাপ এগিয়ে শেখর থেকে শিকড়ে গিয়ে আঘাত হেনেছেন। ইসলামী স্বীকৃত নীতি হলো, কুরআনের ব্যাখ্যায় মতবৈচিত্রের অবকাশ থাকতে পারে। কিন্তু এর মূলপাঠে কারো প্রশ্ন বা দ্বিধা সংশয় থাকলে তার নামটি আর মুসলিম তালিকায় বিদ্যমান থাকে না। মাতুব্বর সাহেবের প্রশ্নগুলো বস্তুত তার স্বশিক্ষার পরিণত ফল। প্রথমত মাতুব্বর সাহেবের মনে প্রশ্ন উদয় হয়েছে, ইবরাহীম আ. এর প্রতি স্বপ্নাদেশ কি তার মনের ভগবদ্ভক্তির প্রবণতার ফল হতে পারে কি না? অথচ নবী হওয়ার প্রধান এবং অত্যাবশ্যক শর্ত হলো, ভগবদ্ভক্তি তথা প্রভুভক্তি। প্রভুভক্তির চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের পরেই আসে নবুওয়াতের সুমহান গুরুভার দায়িত্ব। আর সহীহ বুখারীর বিবরণ মতে নবীদের স্বপ্ন তো নিছক স্বপ্নাদেশ নয়; বরং তা প্রত্যাদেশ। সুতরাং ইবরাহীম আ. এর স্বপ্নাদেশ তাঁর প্রভুতপস্যার আবশ্যিক ফল ছিল এতে সংশয় সন্দেহের ন্যুনতম অবকাশ নেই। মাতুব্বর সাহেব দ্বিতীয় ধাপে ইবরাহীম আ. এর স্বপ্নের অস্তিত্বের উপরই প্রশ্নাগ্রাসন চালিয়ে দিয়েছেন। সাথে ইবরাহীম আ. এর স্বপ্নের প্রিয় বস্তুটি তার সন্তান কি না এ ব্যাপারেও তার পর্বত প্রমাণ সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বিষয় দুটি ব্যাখ্যায় নয়; কুরআনের মূলপাঠেই উপস্থিত রয়েছে। আল্লাহর বাণীতেই যার অবিশ্বাসের প্রশ্ন জাগে তাকে উত্তর দেয়ার মত তো কিছু থাকে না।
তৃতীয় ধাপে এসে মাতুব্বর সাহেব কুরবানীর মূলানুগ অর্থ পরিত্যাগ করে রূপক অর্থ গ্রহণ করতে চাইছেন। মাতুব্বর সাহেবের এ দর্শনই কবি নজরুলের উক্ত কবিতা ও অন্যান্য বুলিতে নগ্নভাবে ফুটে উঠেছে। মাতুব্বর সাহেব এ দর্শনটিকে শক্তিময় করে তোলার জন্য খৃস্টান সমাজের ধর্মনীতিকে মডেল হিসেবে টেনে এনেছেন। সর্বশেষে মাতুব্বর সাহেব একজন নবীর স্বপ্নকালীন প্রত্যাদেশে কাল্পনিক চরিত্রের কালিমা এঁকে দিতে নিরত হয়েছেন। মাতুব্বর সাহেব বুঝাতে চাচ্ছেন, নিছক একটি স্বপ্নীল কল্পনাকে বাস্তবতার রূপ দিয়ে ধর্মতাত্ত্বিকগণ যুগযুগ ধরে ভুলের ইতিহাস রচনা করছেন। উন্মাদনারও শ্রেণীভাগ রয়েছে। মাতুব্বর সাহেবের এ অদ্ভুত দর্শন কোন শ্রেণীতে ভুক্ত হবে তাই বিবেচ্য বিষয়। মাকাল বৃক্ষে যেমন মিষ্ট ফলের আশা করা যায় না তেমনি মাতুব্বর সাহেবের বস্তুবাদী দর্শন থেকে ধর্মের সত্যতা আশা করা যেতে পারে না।
ব্লগার মহোদয় চতুর্থ ধাপে এসে আরেক জন গবেষকের (?) একটি বিবরণ এনেছেন। বিবরণটি নিম্নরূপ-
…কোরবানি যাতে আইয়ামে জাহেলিয়াতের মতো পশু নিধন অনুষ্ঠানের মহোৎসবে পরিণত না হয় এমন আশঙ্কা থেকেই সম্ভবত হযরত আবু বকর (রা.), হযরত ওমর (রা.) বা হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর মতো সাহাবীগণ কখনো পশু কোরবানি দিতেন না। (দ্রষ্টব্য : ইমাম সাফি, কিতাব-উল-ঊম্মা, ভল্যুম-২, পৃষ্ঠা ১৭৯)। সেসময় সাধারণত একটি গোত্রের সকল মানুষের পক্ষ থেকে একটি মাত্র পশু কোরবানি দেয়া হত। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)ও পুরো বনী হাসেম গোত্রের পক্ষ থেকে একটি পশু কোরবানি দিতেন। (দ্রষ্টব্য : নাহেল আল-আউতার, ভল্যুম-৫, পৃষ্ঠা ১৭৭)। দোহাই : বেনজীন খান সম্পাদিত পশু কোরবানি : একটি বিকল্প প্রস্তাব (সংস্কার আন্দোলন, ১ম সংস্করণ, প্রকাশ ২০০৫)।
গবেষক মহোদয় যে বর্ণনাটির দিকে ইঙ্গিত করেছেন সে বর্ণনাটিতে স্পষ্টভাবেই উল্লেখিত হয়েছে, মানুষ আবশ্যক জ্ঞান করে বসবে এ শঙ্কায় আবু বকর এবং উমর রা. কুরবানী করতেন না। -ইমাম নববী, শারহুল মুহাযযাব ৯/৩৭৬, সুনানে বাইহাকী কুবরা, হাদীস ১৯৫০৭। তো হাদীসটির মধ্যে স্পষ্ট করে তাঁদের আশঙ্কার কথাটি ব্যক্ত হয়েছে। তো গবেষক মহোদয় কোন উদ্দেশ্যে নতুন আশঙ্কার মহোৎসবে মেতে উঠলেন। কোনো বিষয়ে মন্তব্য করার পূর্বে বিষয়টির সবগুলো সূত্রপাঠ সম্বন্ধে ধারণা লাভ করতে হয়। এরপর মন্তব্য করার মত ঝুঁকিপূর্ণ ময়দানে অবতরণ করতে হয়। হাদীসটির অন্য সূত্রে একই বর্ণনাকারী সাহাবী হুযাইফা ইবনে আসীদ রা. বেশ স্পষ্ট করেই বলেছেন,
لَقَدْ رَأَيْتُ أَبَا بَكْرٍ وعُمَرَ رَضِىَ اللّهُ عَنْهُمَا ومَا يُضَحّيَانِ عَنْ أَهْلِهِمَا خَشْيَةَ أَنْ يُسْتَنّ بِهِمَا
অর্থ, আমি আবু বকর এবং উমর রা. কে দেখেছি, তাঁরা তাঁদের অনুকরণ করা হবে এ আশঙ্কায় নিজেদের পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী করতেন না। সুনানে বাইহাকী কুবরা, হাদীস ১৯৫০৮। হাদীসটিতে প্রচ্ছন্নতা নেই। তাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, তারা নিজেদের পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে কুরবানী করতেন না। তারা নিজেরা নিজেদের পক্ষ থেকে কুরবানী করতেন না এমন কথা হাদীসটিতে নেই। এরপর গবেষক মহোদয় মুহাম্মদ ইবনে আলী শাউকানী রাহ. এর নাইলুল আউতার গ্রন্থ থেকে দুটি উদ্ধৃতি টেনেছেন। উদ্ধৃতি দুটি যেভাবে গবেষক মহোদয় নিজস্ব সরল ভাষায় উদ্ধৃত করেছেন ওভাবে মূল গ্রন্থে উদ্ধৃত হয় নি। গবেষক মহোদয় সংশ্লিষ্ট আলোচনার খণ্ডিত অংশ নিজস্ব ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। এতে বিভ্রান্তির যথেষ্ট উপাদান রয়ে গেছে। বস্তুত গবেষক মহোদয় যে বিষয়ে কলম ধরেছেন বিষয়টি ফিকহ ও হাদীসের শাস্ত্রীয় আলোচনা সাপেক্ষ। সে আলোচনা গবেষক মহোদয়ের জন্য উপযোগী কিনা সে সম্বন্ধে আমাদের স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে তার লেখার উপস্থাপনা দৃষ্টে মনে হয় না তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মোটামোটি পর্যায়ের ধারণা রাখেন। তার উদ্ধৃত গ্রন্থের নামটি দেখেও তা কিছুটা অনুমান করা যায়। তিনি লিখেছেন ‘নাহেল আল -আউতার’। এ নামে কোনো গ্রন্থ আছে বলে আমাদের জানা নেই। বস্তুত আলোচ্য গ্রন্থটির নাম হলো ‘নাইলুল আউতার’ যা পেছনেও উল্লেখ করেছি।
সফিউদ্দিন আহমাদ নামের আরেকজন ব্লগার মহোদয়ও ‘কোরবানি ও আমাদের ধর্মপালন’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন। তাতেও তিনি উপরোক্ত ব্লগার মহোদয়ের ন্যায় এ ধরনের অদ্ভুতুড়ে উদ্ধৃতির সমাহার ঘটিয়েছেন। তবে তিনি বাড়তি একটি উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে বলেন, ‘স্যার সৈয়দ আলীগড় ক্যাম্পাসে ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি নিষিদ্ধ করেছিলেন।’ স্যার সৈয়দ আহমদ তো একজন ন্যাচারাল ম্যান। তার জন্য কুরবানী নিষিদ্ধ করা তো নিতান্তই সাহজিক এবং তুচ্ছ একটি ব্যাপার। কারণ তিনি মালাইকা (ফেরেশতা), শয়তান, কবর জগতের শাস্তি, কিয়ামত, পুনরুত্থান, হুর-গিলমান, ভাগ্যলিপিসহ ইসলামী শরীয়তের অসংখ্য স্বতঃসিদ্ধ এবং অকাট্য বিষয়গুলোকে আয়েশী ভঙ্গিতে অস্বীকার করতেন। তার অবস্থানকে তিনি নিজেই পরিষ্কার করে গেছেন। সুতরাং এমন একজন স্বঘোষিত ব্যক্তির উদ্ধৃতিতে কুরবানীর মত ওয়াজিব বিধান তো নিষিদ্ধ হবেই! আল্লাহ আমাদেরকে দীন হীনতার যাবতীয় বিষবাষ্প থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার তাওফীক দান করুন। আমীন!