মৃত্যুকেন্দ্রিক সংস্কৃতি : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

মাওলানা এনামুল হক


অবতরণিকা

মৃত্যু চির সত্য একটি অমোঘ বিধান। প্রাণ সঞ্চারিত কোনো কিছুই মৃত্যুর আওতা মুক্ত নয়। এই একটি বিষয়ে পৃথিবীর তাবৎ মানুষ এক ও অভিন্ন অভিমত লালন করে। পৃথিবীর সৃষ্টি লগ্ন থেকে জীবন মৃত্যুর এ বাস্তব সত্যটির চর্চা হয়ে আসছে অদৃশ্য এক হাতের ইশারায়। মানুষ সংস্কৃতি প্রিয় জাতি। কোনো একটি বিষয়ের অবতারণা হলেই মানুষের মাঝে আচার আনুষ্ঠানিকতার রকমারি আয়োজন দেখা দেয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষই এ বিষয়টিতে প্রচণ্ড রকমের উৎসাহ প্রদর্শন করে। মৃত্যুর মতো কঠিন ও জটিলতম বিষয়টিও আবেগপ্রবণ মানুষের আচার আনুষ্ঠানিকতা থেকে মুক্ত নয়। মৃত্যুকে কেন্দ্র করে মানুষ অবিধানিক ও অপসাংস্কৃতিক নানা রকম ছায়া জালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কিন্তু ইসলাম লাগামহীন এ গড্ডালিকা প্রবাহকে সমর্থন করে না। ইসলাম একটি সুনিয়ন্ত্রিত ও শাশ্বত জীবন বিধান। এখানে অবাধ আচার ব্যবহারের উন্মুক্ত সুবিধা রাখা হয়নি। তাই মুসলিম নামে অভিষিক্ত মানবসমাজকে জীবন চর্চায় হতে হবে পঙ্কহীন সুনিয়ন্ত্রিত। অনুশাসন পালনে হতে হবে চৌকস সতর্ক। কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য, আজ মুসলিম সমাজ মৃত্যু-কেন্দ্রিক এসব অপসংস্কৃতির মরণ ছোবল থেকে নিরাপদ নয়। তারা জেনে বা না জেনে কিংবা স্বার্থ উদ্ধারের অসৎ উদ্দেশে ভিন জাতীয় এসব অবিধানিক সংস্কৃতির জালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আমরা বক্ষমান নিবন্ধে মৃত্যু-কেন্দ্রিক তেমনি কয়েকটি বিষয় সম্বন্ধে আলোকপাত করার প্রয়াস পাবো। ইনশাআল্লাহ।

পুষ্পস্তবক অর্পণ

পুস্পস্তবক অর্পণের বিভিন্ন দিক রয়েছে। সমাহিত করার পূর্বে মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে একটি ফুলেল আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। তবে সেখানে পুস্পস্তবক অর্পণ হয় না; পুস্প প্রক্ষেপণ হয়। মৃত ব্যক্তির খাটে কিংবা মরদেহের কফিনে ফুল ছিটিয়ে দেয়া হয়। নেতা বা ব্যক্তি যত বড়ো হয় তার দেহে ফুলের স্রোত তত গতি পায়। অন্যদিকে মৃত ব্যক্তিকে যখন কবরস্থ করা হয় তখন সেখানে আর পুস্প প্রক্ষেপণ হয় না। তখন সেখানে পুস্প ডালার সমাবেশ ঘটে। আর তখন এ ফুলেল আয়োজনের নামকরণ হয় পুস্পস্তবক অর্পণ, শ্রদ্ধাঞ্জলি কিংবা পুস্পাঞ্জলি নিবেদন ইত্যাদি। পুস্পস্তবক অর্পণের কয়েকটি দিক রয়েছে। ১. নিছক শ্রদ্ধা নিবেদন। ২. শ্রদ্ধা নিবেদনের পোশাকি রূপায়ণ। এক্ষেত্রে নাম শ্রদ্ধা নিবেদন হলেও বস্তুত এর আড়ালে রাজনৈতিক স্বার্থসহ নানা স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে। তখন শ্রদ্ধা নিবেদনের বিষয়টি রূপায়িত হয় একটি মেকি চরিত্রে। পুস্পস্তবক অর্পণের এ দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি আজ ৯৫% ক্ষেত্রে চরিতার্থ হচ্ছে।

৩. ধর্মাচারে রূপায়ণ। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পুস্পস্তবক অর্পণের ধর্মীয় রূপটির চর্চা কোথাও হয় কি না বা হলেও তা পার্সেন্টিজের আওতায় পড়ে কি না জানা নেই। তবে মাজার কেন্দ্রিক সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে পুস্প চর্চার ধর্মীয় দিকটি পরিলক্ষিত হয়। মাজার কেন্দ্রিক সাধারণ আবেগী মানুষগুলো মাজারস্থ ব্যক্তির ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদনকে ধর্মীয় কর্তব্য জ্ঞান করে থাকে। অন্যদিকে যারা এক আধটু ধর্মীয় জ্ঞান রাখে তারা এ ফুলেল আয়োজনের কুরআন হাদীস কেন্দ্রিক একটি দালিলিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চায়। পুষ্পস্তবক অর্পণের এ ধর্মীয় দিকটি নিয়ে সামনে বিস্তারিত আলোচনা আসবে।

পুস্প নিবেদনের শ্রদ্ধালু দিক

মানুষকে সম্মান করা, শ্রদ্ধা করা এবং মর্যাদা দেয়া অসামান্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মান সম্মানের বিষয়টি মানবাধিকারের অন্যতম একটি উপাদানও বটে। মানবজীবনে এ জায়গাটি উপেক্ষিত হলে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সুরম্য প্রাসাদ ঝর ঝর শব্দে ভেঙে পড়বে। সম্মান ও শ্রদ্ধা নিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ এ দিকটি শুধু বুদ্ধিমান মানব শ্রেণী কিংবা প্রাণময় জীবজগতের ভিতরেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিটি জিনিসেরই মর্যাদা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর টেবিলটি একটি জড় পদার্থ। তাই বলে যে কেউ ইচ্ছা করলেই তার উপর পা তুলে দিতে পারে না। বই-পুস্তক নির্জীব পদার্থ হলেও তার সাথে যেমন তেমন আচরণ করা যাবে না। তবে শ্রেণিভেদে প্রতিটি বস্তুর মর্যাদার ধরন ভিন্ন হয়ে থাকে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে একটি মৃতদেহেরও মর্যাদা রয়েছে। তার মাঝে প্রাণের স্পন্দন নেই বলে তার সাথে অমর্যাদাকর কোনো আচরণ করা যাবে না। ইসলামে একজন মৃত ব্যক্তিকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। তাই মৃত ব্যক্তিকে গোসল দানসহ কাফন, দাফন এবং জানাযার সুন্দরতম ব্যবস্থা প্রবর্তন করে তাকে মর্যাদার সুমহান আসনে সমাসীন করা হয়েছে। কিন্তু মরদেহের গায়ে ফুল ছিটালে কিংবা তার সমাধিতে গতানুগতিক নিয়মে নির্দিষ্ট কিছু দিনে ফুলের ডালা বিছিয়ে দিলে তার কি সম্মান হবে? বিশেষ পদ্ধতির এ সম্মান আয়োজন কি তার কাম্য? একজন মানুষের কাক্সিক্ষত চাহিদা পূরণই হলো তার সর্বোত্তম মর্যাদা দান। জঠর জ্বালায় বিধ্বস্ত একজন ক্ষুধার্ত মানুষের গায়ে ফুলের ঝাঁপি ঢেলে দিলে কি তার মর্যাদা হবে না কি তার সাথে উপহাস করা হবে? তার মুখে এক মুঠো খাবার তুলে দেয়াই হবে তার প্রাপ্ত মর্যাদা ও যথাযথ অধিকার রক্ষার সর্বোত্তম প্রয়োগ।

বস্তুত মৃত্যু জিনিসটা কি? মৃত্যু নিয়ে আমাদের দ্বিধা সংশয়ের শেষ নেই। মূলত মৃত্যু মানে চিরলীন কিংবা নিঃশেষ হয়ে যাওয়া নয়। মৃত্যু অর্থ স্থানান্তরিত হওয়া। এক জগত থেকে অন্য জগতে প্রস্থান করা। তাই আরবী ভাষায় মৃত্যুবরণ বুঝাতে الانتقال (আল-ইন্তিকাল) শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আর ইন্তিকাল শব্দের অর্থ হলো স্থানান্তরিত হওয়া। নশ্বর এ পৃথিবীটা মূলত একটি উপার্জন স্থল। এ জগতে যে যত বেশি নেকী আয় করে যেতে পারবে পরজগতে সে তত বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। পক্ষান্তরে যার পূণ্য উপার্জন যত কম হবে তার দুরাবস্থার পরিমাণও তত বৃদ্ধি পাবে। ফুল ছিটালে কিংবা সমাধিতে ফুলের পসরা সাজিয়ে দিলে সে দুরাবস্থা বিদূরীত হবে না। একজন মানুষ যখন পৃথিবী থেকে চলে যায় তখন তার যাবতীয় উপার্জনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। (সহীহ মুসলিম, হা.নং ৬৯৯৫) সে বড়ো অসহায়, নিঃস্ব এবং নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। তখন সে একটুখানি পূণ্য লাভের আশায় ছটফট করতে থাকে। যেভাবে নিমজ্জমান জাহাজের যাত্রীকুল অথৈ সাগরের মাঝে বাঁচার আশায় ছটফট করতে থাকে। মৃত ব্যক্তির একমাত্র ক্ষুধা পুণ্য লাভের ক্ষুধা। তার চাওয়া-পাওয়ার শেষ অবলম্বন হয় একটুখানি সওয়াব। এ জগতের বস্তুগত ভোগ-বিলাস ও মান-সম্মান সে আদৌ কামনা করে না। এ যদি হয় একজন পরবাসীর চাওয়া-পাওয়ার রূপরেখা তাহলে তার নির্জীব মরদেহে ফুল ছিটানো এবং তার সমাধিতে ফুলের ডালি সাজানো কি তার সাথে উপহাস নয়? যারা ধরা বাধা নির্দিষ্ট কিছু দিবসে এ পুস্প সংস্কৃতিতে বিভোর হয়ে থাকেন তারা কি হলফ করে বলতে পারবেন এতে কবরস্থ নিঃসঙ্গ ব্যক্তিটির মঙ্গল বা কল্যাণ হয়? এতে তার বিদেহী আত্মা তৃপ্তি বোধ করে? তবে এত ফুলেল আয়োজনের সার্থকতা কি? অসহায় নিঃস্ব একজন মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে আপন স্বার্থ উদ্ধারই কি এ আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়? এটা কি ‘ঘর পোড়ায় আলু পুড়ে খাওয়া’ নয়? এ সংস্কৃতিতে যদি শ্রদ্ধা নিবেদন উদ্দেশ্য হয় তবে কি সে মৃত ব্যক্তিটি শ্রদ্ধান্বিত হয়? না কি অপমানিত? যার যে অধিকার প্রাপ্য, যার যে মর্যাদা প্রাপ্য তাকে সে অধিকার ও মর্যাদা না দিয়ে অকার্যকর কিছু দিয়ে তার অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার চেষ্টা করা হলে কি তার মানহানি হয় না? তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তার সাথে উপহাস করা হয় না? বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে প্রশ্নগুলোর উত্তর অনুসন্ধান করা হলে আশা করি প্রশ্নগুলোর নির্মোহ ও পরিচ্ছন্ন উত্তরমালা বেরিয়ে আসবে।

ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

মৃত্যু কেন্দ্রিক এ ফুলেল সংস্কৃতি মূলত কোনো মুসলিম সংস্কৃতি নয়। এর সাথে ইসলামী আচার আনুষ্ঠানিকতার ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। ইসলামী জ্ঞানের সুবিস্তৃত অঙ্গনে এর কোনো যৌক্তিক সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। এটি বস্তুত বিধর্মীদের থেকে ইম্পোর্ট করা যুক্তিহীন একটি সংস্কৃতি। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের মৃত ব্যক্তিদের সমাধিতে ফুল নিবেদন করে থাকে। তদ্রƒপ ইয়াহুদী খ্রিস্টানরাও তাদের মৃত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ফুলেল আনুষ্ঠানিকতা পালন করে থাকে। একজন মুসলিম চাইলেই যা ইচ্ছা তা করতে পারে না। তার জীবনধারা পরিচালিত হবে বিধিবদ্ধ একটি নিয়মের অধীনে। একজন মুসলিমের ইন্তেকাল হলে তার সাথে কি কি আচরণ করতে হবে, তাকে কেন্দ্র করে কি কি আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হবে তার বিশদ বিবরণ ইসলামী শরিয়ায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। বিবৃত এসব কার্যবিধির বাইরে গিয়ে অন্য কিছু করার সুযোগ ইসলামে রাখা হয় নি। কুরআন হাদীস বহির্ভূত কোনো কাজের অবতারণা হলে তা হবে বিদ‘আত এবং অত্যন্ত গর্হিত ও ঘৃণিত গুনাহের কাজ।

শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশে পুস্পস্তবক অর্পণের বিষয়টি যদি আমরা গভীরভাবে পর্র্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখা যাবে এতে শিরকের মতো অমার্জনীয় পাপ পঙ্কিলতার যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে এটি প্রত্যক্ষ শিরকের রূপ পরিগ্রহ করে। আবার কখনো তা দৃশ্যমান শিরক না হলেও সাদৃশ্যপূর্ণ শিরকের রূপ গ্রহণ করে। কারণ এ নিয়মেই পৌত্তালিকেরা পূজা অর্চনা পালন করে থাকে। আর শিরকের ব্যাপারটি কতটা ভয়ঙ্কর তা কুরআনের একটিমাত্র আয়াতেই সার্থকভাবে ফুটে উঠে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না; এটা ব্যতীত সবকিছু যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন, এবং কেউ আল্লাহর শরীক করলে সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়। (‘সূরা নিসা’- ১১৬)

শিরকের সাংঘাতিকতার মাত্রা এতটা তীব্র কেন? কারণ শিরক করার অর্থই হলো, ঈমান নামক বৃক্ষমূলে কুঠারাঘাত করা। শিরকের কুঠারাঘাতে ঈমান নামক পবিত্র বৃক্ষের অপমৃত্যু ঘটে।

আজ নির্দিষ্ট কিছু দিবসে শহীদ মিনার এবং স্মৃতিসৌধগুলোর চত্তর জুড়ে ফুলে ফুলে সুশোভিত হয়। বড়ো বড়ো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মাজার, কবর ও সমাধিতে ফুলের ঢল নামে। তো যাঁদেরকে কেন্দ্র করে আমরা ফুল নিবেদন করছি তাঁরা যদি সত্যিকারার্থে শহীদ হয়ে থাকে কিংবা ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করে থাকে তবে তাঁদের পবিত্র আত্মা সবুজ পাখি রূপে বিচরণ করছে জান্নাতের অনিন্দ্য সুন্দর নির্মল বাগিচায়। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

আল্লাহ তা‘আলা শহীদগণের বিদেহী আত্মাকে সবুজ পাখির দেহে প্রবিষ্ট করিয়ে দিবেন। পাখিগুলো প্রবাহমান নদীর উপর দিয়ে বিচরণ করতে থাকবে এবং বাগানের ফলমূল আহার করতে থাকবে। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ২৫২০)

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে,

মুমিনের আত্মা পাখি হয়ে জান্নাতের বৃক্ষরাজিতে বিচরণ করতে থাকবে। পুনরুত্থান দিবসে তার মূল দেহে আত্মা ফিরিয়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত এভাবেই মুমিনের পবিত্র আত্মাটি বিচরণ করতে থাকবে। (মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ১৫৭৯২)

সহীহ মুসলিমের অন্য এক বর্ণনায় এসেছে,

শহীদদের আত্মার প্রতি আল্লাহ তা‘আলা দৃষ্টি দিবেন এবং বলবেন, তোমরা কি কামনা করো? তারা বলবেন, আমরা আর কি কামনা করবো? আমরা তো জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা সেখানে বিচরণ করতে পারছি। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ৪৯৯৩)

পরজগতে শহীদদের অবস্থান সম্বন্ধে উপরোক্ত হাদীসগুলো খোলামেলা বার্তা বহন করছে। শহীদরা সেখানে সুখ সম্ভারের আতিশায্যে আল্লাহর কাছে অন্য কিছু কামনা করারও আগ্রহ প্রকাশ করছেন না। তো এক্ষেত্রে আমাদের এসব মূল্যহীন পুস্পস্তবক গ্রহণের জন্য কি তাঁরা মুখিয়ে থাকবেন? এটা কি আদৌ কল্পনা করা যায়? প্রকৃত অর্থে শহীদ ও মৃত ব্যক্তিদের জন্য হৃদয়ে মায়া-মমতা ও ব্যথা-বেদনা থাকলে এবং তাঁদের ত্যাগের বিনিময় দেয়ার সদিচ্ছা থাকলে এমন একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে যে উপায়ে তাঁরা সত্যিকারার্থেই উপকৃত হবেন। আর সে উপায় ও পথ পন্থাটি হলো শরীয়ত স্বীকৃত পথ। শহীদ এবং মৃত ব্যক্তিদের যদি সত্যিকারার্থেই সম্মান এবং কল্যাণ চান তবে তাঁদের উদ্দেশ্যে নিরন্নকে অন্ন দান করুন, নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দান করুন, জনস্বার্থে জনকল্যাণমূলক কাজ করুন। দীনী স্বার্থে দীনী প্রকল্পে সহায়তার হাত প্রসারিত করুন। এতে তাঁরা আল্লাহর কাছে শত কোটি পুষ্প, অফুরন্ত আশীষ প্রাচুর্য এবং ফুলে ফলে ভরা পুষ্প উদ্যানের স্বত্বাধিকারী হবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

যে ব্যক্তি একবার سبحان الله العظيم وبحمده বলবে জান্নাতে তার জন্য একটি খর্জূর বৃক্ষ রোপণ করা হবে। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ৩৫৩১)

অন্যত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

তোমাদের প্রেরিত পুণ্যময় কার্যাবলি তোমাদের আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীদের কবরে তাদের নিকট উপস্থাপন করা হয়। যদি আমলগুলো নিখাদ ও নির্মল হয় তাহলে তারা এতে প্রফুল্লতা বোধ করে। পক্ষান্তরে যদি তাতে নির্মলতাজনিত ঘাটতি থাকে তাহলে তারা বলে, হে আল্লাহ! তাদের অন্তরে তোমার আনুগত্যের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে দাও। (মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী; হা.নং ১৭৯৪)

এ সকল হাদীস দ্বারা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, ইহজগতে থেকে সৎকর্মের মাধ্যমে পরজগতে নিজের জন্য কিংবা কোনো মৃত ব্যক্তির জন্য স্বাচ্ছন্দ্যময় কিছু করা সম্ভব। সুতরাং পরজগতবাসীদের জন্য যদি কিছু করতে হয় তাহলে এমন কিছু করতে হবে যা তাদের জন্য কল্যাণকর হয়। আর তা হলো পুণ্যকর্ম। এই পুণ্যকর্মে তারা আনন্দিত হয় এবং উপকৃত হয়। হাদীসের ভাষ্য মতে কবরবাসী লোকগুলোকে কেন্দ্র করে যদি কোনো পাপাচার বা অনাচারের আয়োজন করা হয় তাহলে তারা এতে যন্ত্রণা এবং বেদনা বোধ করে। তাদের জন্য ব্যাপারগুলো বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সে মতে তারা পুষ্পস্তবক অর্পণ দ্বারা সম্মানিত হয় না; উলটো তারা এতে সীমাহীন কষ্ট এবং দুঃখ অনুভব করে। কারণ এটা তো পুণ্যের কাজ নয়। এটি একটি গর্হিত এবং অবিধানিক কাজ। আজ আমাদের দেশে ওপারবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নামে যেসব কর্মযজ্ঞের আয়োজন করা হয় তাতে মনে হয় তারা দেশ জনগণের জন্য প্রাণ দিয়ে মারাত্মক অপরাধ করে গেছেন। এসব কর্মকাণ্ড তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রতি উপহাস বৈ আর কি হতে পারে। ইট, সিমেন্ট আর রড দিয়ে কিছু একটা তৈরি করে সেখানে কিছু ফুল রেখে আসলে কি তা কবরস্থ লোকগুলো পেলেন? না কি ঐ ইট সিমেন্টগুলোকেই দেয়া হলো সেই ফুলের সওগাত।

বস্তুত পুষ্পস্তবক অর্পণ মূর্তি পূজারই একটি অংশ। হিন্দুরা তাদের দেব-দেবীদের উদ্দেশ্যে শুধু প্ষ্পুস্তবক অর্পণই করে না সাথে মিষ্টি, সন্দেশ এবং দুধ কলার স্তবকও অর্পণ করে থাকে। পবিত্র কুরআনে ইবরাহীম আ.-এর ঘটনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,

তিনি তাদের দেবালয়ে প্রবেশ করলেন এবং মূর্তিগুলোকে সম্বোধন করে বললেন, তোমরা আহার করছো না কেন? তোমাদের কি হলো যে তোমরা কথা বলছ না! অতঃপর তিনি প্রবল আঘাতে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তখন লোকজন তার দিকে ভীত সন্ত্রস্ত পদে ছুটে এল। তিনি বললেন, তোমরা কি স্বহস্তে নির্মিত পাথরের পূজা করছো? অথচ আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে এবং তোমরা যা সৃষ্টি করেছ সবই সৃষ্টি করেছেন। (‘সূরা সাফফাত’- ৯১-৯৬)

হিন্দুরা এটাকে ইবাদত হিসেবেই পালন করে থাকে। সুতরাং প্রচলিত পুষ্পস্তবক অর্পণ স্পষ্ট পূজা না হলেও পূজার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ তো অবশ্যই। এতে শহীদ বা মৃত ব্যক্তিদের কোনোই উপকার হয় না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর ভাষায় বিধর্মীদের সাদৃশ্য গ্রহণ করতে বারণ করেছেন। তিনি বলেন,

যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করে সে তাদের দলভুক্ত হয়ে যায়। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ৪০৩১)

কফিনে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন

মৃত ব্যক্তির কফিনে ফুল ছিটানো কিংবা ফুলের তোড়া দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করাও একটি বিজাতীয় সংস্কৃতি। ইসলামী শরীয়াতে এর কোনো সূত্র ভিত্তি নেই। কোনো নবী রাসূল, সাহাবায়ে কেরাম, তাবিয়ীন আইম্মায়ে মুজতাহিদীন কেউই মৃত ব্যক্তিকে এভাবে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নি। এ পুষ্প নিবেদনে যদি মৃত ব্যক্তিদের কোনো উপকার হতো তাহলে অবশ্যই নবী রাসূল কিংবা সাহাবায়ে কেরাম এ ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করতেন।

উপরন্তু ভিন জাতীয় কালচার গ্রহণের ব্যাপারে কুরআন হাদীসে কঠোর ভাষায় নিষেধাজ্ঞা এসেছে। সুতরাং মুসলমানের জন্য বিধর্মীদের যাবতীয় কৃষ্টি কালচার ও সভ্যতা সংস্কৃতি সম্পূর্ণ রূপে পরিহার করা আবশ্যক। আর মৃত ব্যক্তিদের কল্যাণার্থে যদি কিছু করতে হয় তাহলে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা, কুরআন পাঠ ইত্যাদি পুণ্যময় কাজ করে তাদের আত্মাকে সিক্ত করবে। এটাই তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উত্তম এবং একমাত্র পদ্ধতি। এছাড়া অন্য কোনো উপায়ে জীবিত এবং মৃত কারো জন্য কল্যাণ এবং উপকারিতা নেই।

পুষ্পস্তবক অর্পণের ধর্মীয় রূপ

অনেকে ফুলের এ সংস্কৃতিটাকে ধর্মীয় রূপ দিতে চেষ্টা করেন। তারা বিষয়টিকে যেনতেন ধর্মীয় বিধি রূপে দেখতে আগ্রহী নন। তারা বলেন, এটি হলো নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ বা আদর্শ। মৃত ব্যক্তিদের কবরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবুজ সতেজ বৃক্ষশাখা গেঁথে দিয়ে উম্মাহর জন্য মৃতদের মাজারে সতেজ সবুজ উপাদান রাখার উত্তম আদর্শ রেখে গেছেন। তাদের স্বপক্ষের প্রামাণ্য (?) সূত্রটি হলো, ইবনে আব্বাস রাযি. হতে বর্ণিত একটি হাদীস, তিনি বলেন,

একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। কবর দুটিতে আযাব হচ্ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কবর দুটিতে সমাহিত ব্যক্তিদ্বয়ের উপর আযাব হচ্ছে। এদের দুজনকে বড়ো ধরনের কোনো কারণে শাস্তি দেয়া হচ্ছে না। এদের একজন প্রশ্রাবের অপবিত্রতার ব্যাপারে উদাসীন ছিল। অপরজন পরনিন্দা করত। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাঁচা একটি বৃক্ষশাখা হাতে নিলেন এবং শাখাটিকে দু’টুকরো করলেন। এরপর শাখা অংশ দুটিকে দুটি কবরে গেঁথে দিলেন। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর রাসূল! এমনটি করলেন কেন? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সম্ভবত শাখা অংশ দুটি শুষ্ক হওয়া পর্যন্ত তাদের শাস্তি লাঘব হবে। (সহীহ বুখারী; হা.নং ২১৮)

ড. হুসামুদ্দীন আফ্ফানা বলেন,

কেউ কেউ কবরে ডাল রোপণ করার বৈধতার ব্যাপারে উপরোক্ত হাদীসটি প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন। কিন্তু এ প্রমাণ উপস্থাপনা স্বীকৃত নয়। বস্তুত পুষ্পস্তবক অর্পণ বৈধ হওয়ার সাথে এ হাদীসটির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। ইমাম খাত্তাবী রহ. বলেন,

সংশ্লিষ্ট হাদীসটিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক সতেজ বৃক্ষশাখা গেঁথে দেয়ার মাধ্যমে শাস্তি লাঘবের সম্ভাব্যতা সৃষ্টির বিষয়টি ছিল মূলত তাঁর প্রভাবের বরকত এবং কবরস্থ ব্যক্তিদ্বয়ের জন্য দু‘আ প্রার্থনা। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাখা দুটির আর্দ্রতার সময়কে শাস্তি লাঘবের একটি সীমা পরিধি হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ব্যাপারটি এমন নয় যে, কাঁচা ডালে যে প্রভাব রয়েছে শুষ্ক ডালে সে ধরনের প্রভাব নেই। বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়, মানুষ কবরে খর্জূর ডালা গেঁথে দেয়। আমার মনে হয়, তারা হাদীসটিকে প্রমাণ সূত্র বানিয়ে এ ধরনের প্রথা পালন করে থাকে। মূলত প্রচলিত এ প্রথার সাথে হাদীসটির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

ইবনুল হাজ্জ রহ. বলেন,

সংশ্লিষ্ট ব্যাপারটি মূলত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ধৃত কাঁচা ডালের মাধ্যমে সৃষ্ট বরকতের পরিণতি ফল। ইমাম তরাসুসী রহ. সংশ্লিষ্ট হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, এটা ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতের বরকত।

আল্লামা আজিমাবাদী ইমাম খাত্তাবী রহ.-এর অভিমতকে সমর্থন করে বলেন, ইমাম মুসলিম রহ. জাবের রাযি. হতে বর্ণিত উক্ত দুই কবরবাসী সংক্রান্ত দীর্ঘ হাদীসে উল্লেখ করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

আমি আশা করি, আমার সুপারিশের ফলে তাদের দু’জনের আযাবকে স্থগিত করা হবে যতক্ষণ ডাল দুটি সতেজ থাকবে। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ৭৭০৫)

শায়খ আহমদ শাকের রহ. ইমাম খাত্তাবী রহ.-এর কথার সূত্র ধরে বলেন,

ইমাম খাত্তাবী রহ. যথার্থ বলেছেন। আজ মানুষ প্রচলিত এ প্রথাটির দিকে ব্যাপকভাবে ঝুঁকে পড়ছে। এবং এ ব্যাপারে মাত্রাতিরিক্ত রকমের বাড়াবাড়ি করছে। মিশর এদিক দিয়ে অন্যতম। এ সবই পালিত হচ্ছে খ্রিস্টানদের অন্ধ অনুকরণে। ফলে তারা কবরে ফুল দিচ্ছে। পরস্পরের মাঝে ফুল বিনিময় করছে। আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিত জনদের বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে তাদের কবরে ফুল দিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় আচার আনুষ্ঠানিকতায় ব্যাপারটি এখন প্রথাগত বিষয়ের রূপ লাভ করেছে। আপনি লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, মুসলিম নেতৃবৃন্দ যখন ইউরোপীয় কোনো রাষ্ট্রে সফর করে তখন তারা সেখানকার প্রয়াত নেতাদের সমাধিতে গিয়ে পুষ্প নিবেদন করে। কেউ কেউ আবার কৃত্রিম ফুলও নিবেদন করে থাকে। এ সবই ইংরেজ এবং তাদের পূর্বপুরুষদের অনুসরণে করে থাকে। সাধারণ মানুষের মতো উলামায়ে কেরামও এ ব্যাপারে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। বরং কতক আলেমকে দেখতে পাবেন তারা নিজেরাই সমাধিতে গিয়ে এ ধরনের অপসংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়ছে। মূলত এ সবই প্রত্যাখাত এবং বিদ‘আত। দীনে ইসলামে এর কোনো ভিত্তি নেই। কুরআন ও হাদীসে এর কোনো প্রমাণ সূত্র নেই। উলামায়ে কেরামকে এ ব্যাপারে তৎপর হতে হবে এবং এসব অপসংস্কৃতি দূরীকরণে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।

শায়খ আহমদ শাকের রহ. আরো বলেন,

প্রকৃত কথা হলো, ডাল পোঁতার ব্যাপারটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথেই সম্পৃক্ত ছিল। তার প্রমাণ হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে এ কাজটি একবারই করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় কিংবা তাঁর ইন্তিকালের পর এমন কাজ করেন নি। অথচ দীন সম্বন্ধে তাঁদের বোধ উপলব্ধি ছিল অনেক উঁচু মানের এবং কল্যাণকর কাজে তাঁরা ছিলেন সবচাইতে বেশি আগ্রহী।

শায়খ মাহমুদ খাত্তাব সুবকী বলেন,

দুটি কবর ছাড়া অন্য কোনো কবরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃক্ষশাখা গেঁথেছেন বলে প্রমাণ নেই। এতে প্রতীয়মান হয়, এটা নিছক একটি সাময়িক বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল এবং বিশেষ একটি সুপারিশ ছিল। এটা ব্যাপক ভিত্তিক অনুকরণীয় কোনো আদর্শিক বিষয় ছিল না। একমাত্র বুরাইদা রাযি. ব্যতীত অন্য কোনো সাহাবী থেকে এমনটি করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। বিশেষত খুলাফায়ে রাশিদীনের কেউ কবরে বৃক্ষশাখা গাঁথেন নি। যদি এ বিষয়টি সুন্নাত হতো তাহলে এসব মহা মনীষীবৃন্দ এ কাজটি আদৌ পরিত্যাগ করতেন না। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

তোমাদের জন্য আমার সুন্নাহ এবং খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাহ গ্রহণ করা আবশ্যক। এটাকে তোমরা মাড়ি দাঁত দিয়ে শক্তভাবে আকড়ে ধরো। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ২৬৭৬)

আর বুরাইদা রাযি.-এর উক্তিটি অন্যদের ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হবে না। এটি একটি সর্ব স্বীকৃত নীতি। সুতরাং ইমাম খাত্তাবী এবং অন্যান্য উলামায়ে কেরাম যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তাই শিরোধার্য। তাছাড়া কবরে ডাল গাঁথাকে কেন্দ্র করে আপামর জনসাধারণ এমন সব আকিদা বিশ্বাস পোষণ করে যা ইসলামী শরীয়ত আদৌ সমর্থন করে না। সুবকী রহ. বুরাইদা রাযি.-এর যে উক্তিটির দিকে ইঙ্গিত করেছেন সে উক্তিটি ইমাম বুখারী রহ. সহীহ বুখারীতে সূত্র বিহীন উল্লেখ করেছেন। উক্তিটি হলো,

বুরাইদা রাযি. অন্তিম নির্দেশ প্রদান করেছিলেন, তার কবরে যেন দুটি বৃক্ষশাখা রেখে দেওয়া হয়। (সহীহ বুখারী; হা.নং ১৩৬১)

ইবনে হাজার আস্কালানী রহ. বলেন,

বুরাইদা রাযি.-এর উক্তিটি ইবনে সা’দ রহ. সূত্রসহ উল্লেখ করেছেন। বুরাইদা রাযি. মূলত আলোচিত হাদীসটিকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করে ছিলেন। তিনি হাদীসটিকে কবরস্থ দুই ব্যক্তির সাথেই সম্পৃক্ত মনে করেন নি।

ইবনে রশীদ বলেন,

ইমাম বুখারী রহ.-এর উপস্থাপনা শৈলীতে প্রমাণিত হয়, বিষয়টি উক্ত দুই ব্যক্তির সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিল। এ কারণেই তিনি এরপর ইবনে উমর রাযি.-এর নিম্নোক্ত বক্তব্যটি এনেছেন,

একদা ইবনে উমর রাযি. আব্দুর রহমান রাযি.-এর কবরের উপর একটি তাবু দেখতে পেলেন। তখন তিনি বললেন, হে ছেলে! তাবুটি সরিয়ে ফেলো। তার সৎকর্মই তাকে ছায়া প্রদান করবে। (প্রাগুক্ত)

আল্লামা আইনী রহ. বলেন,

ইবনে উমর রাযি. মনে করতেন ডাল রোপণ করার ব্যাপারটি ঐ দুই ব্যক্তির সাথেই সম্পৃক্ত ছিল।

মুহাম্মদ রশীদ রেজা রহ. বলেন,

বিষয়টি ছিল দুর্বোধ্য একটি অদৃশ্য বিষয়ের তাৎক্ষণিক ক্রিয়া। এটা শতসিদ্ধ কথা যে, এসব বিষয় সাধারণত নবী-রাসূলদের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত হয়ে থাকে।

নাসীরুদ্দীন আলবানী রহ. বলেন,

যদি গ্রথিত ডালার আর্দ্রতাই উদ্দেশ্য হতো তাহলে বিষয়টি আমাদের সালাফগণ উপলব্ধি করতেন এবং তদানুযায়ী আমল করতেন। ফলে কবরে বৃক্ষ-শাখা ইত্যাদি রোপণ করতেন। আর প্রকৃত অর্থেই যদি তাঁরা এ কাজগুলো করে থাকতেন তাহলে লোকসমাজে তা জানাজানি হতো এবং যুগ পরম্পরায় বিশ্বস্ত সূত্রে আমাদের পর্যন্ত চলে আসত। কারণ এটি এমন একটি বিষয় যার দিকে সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় এবং বর্ণনা সূত্রে উঠে আসার দাবি রাখে। সুতরাং এ প্রথা পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের ব্যর্থ চেষ্টা করা বিদ‘আত এবং নিতান্তই গর্হিত কাজ বৈ কিছুই নয়। (ড. হুসামুদ্দীন আফফানা, কাওয়ায়িদু ওয়া উসুসুন ফিস সুন্নাহ ওয়ালবিদ‘আহ ১/১২২-১২৭)

ওয়ালীদ ইবনে রশীদ এ প্রসঙ্গে বলেন,

বস্তুত কবরে ডালা রোপণের ব্যাপারে মৃদু দ্বিমত থাকলেও সর্বজন স্বীকৃত ও গৃহীত বক্তব্য হলো, এটি একটি নব আবিষ্কৃত রীতি এবং বিদ‘আতের পর্যায়ভুক্ত। কারণ-

(এক) আমাদের জানা মতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাত্র দুটি কবরের ক্ষেত্রে এ কর্মপন্থা অবলম্বন করেছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কবরের পাশ দিয়ে যেতেন সে কবরেই ডালা রোপণ করে দিতেনÑ এমন কোনো তথ্য প্রমাণ নেই। যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটি করতেন তাহলে তা অতিশয় গুরুত্ব সহকারে বর্ণিত হয়ে আসত। আর এ ডালা রোপণের ব্যাপারটি ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ বৈশিষ্টের অন্তর্গত। এটা সর্বজন অনুকরণীয় কোনো বিষয় ছিল না। এটি ছিল কারণ আশ্রিত একটি তাৎক্ষণিক ঘটনা। আর সে কার্যকারণটি ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ বৈশিষ্টের অন্তর্গত। কারণ মৃত ব্যক্তিদের শাস্তি সম্বন্ধে অবগতি লাভ করাটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অলৌকিক বিষয়াবলীর অন্যতম একটি বিষয় ছিল। যখন কার্যকারণটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ বিষয় বলে প্রমাণিত হলো তখন সে কারণপ্রসূত ঘটনাটিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য হবে।

(দুই) সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্মপন্থাটি প্রত্যক্ষ করেছেন। এতদসত্ত্বেও খুলাফায়ে রাশিদীন, আশারা মুবাশশারা এবং ফিকহ ফতওয়া শাস্ত্রের খ্যাতিমান সাহাবায়ে কেরামের মধ্য হতে কারো ব্যাপারে প্রমাণিত নেই, তাদের কেউ এ কাজটি করেছেন। যদি ব্যাপারটি শরীয়ত সিদ্ধ বিষয় হতো তাহলে সাহাবায়ে কেরাম রাযি. এ ব্যাপারে সীমাহীন আগ্রহ প্রদর্শন করতেন। কারণ তাঁরা সৎকর্ম এবং হিদায়াতের ব্যাপারে আমাদের তুলনায় অনেক বেশি তৎপর ছিলেন। এ কাজটির প্রতি তাঁদের অনাগ্রহের বিষয়টিই প্রমাণ করে যে তাঁরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, এটা হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সম্পর্কিত বিশেষ একটি ঘটনা। আর তাঁদের বোধ উপলব্ধি আমাদের জন্য প্রমাণ হিসেবে গৃহীত। কারণ দীনের ভিত্তি হলো কুরআন-হাদীস এবং সালাফের বোধ উপলব্ধি।

হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, সাহাবী বুরাইদা রাযি. মৃত্যু কালে ওয়াসিয়ত করে গিয়েছিলেন, তাঁর কবরে যেন দুটি বৃক্ষ ডালা রেখে দেয়া হয়। তো কবরে বৃক্ষ শাখা রোপণ করা সুন্নাহ বিরোধী হয় কি করে?

এর উত্তরে বলবো, হ্যাঁ, ব্যাপারটি প্রমাণিত সত্য। তবে উলামায়ে কেরাম মনে করেন, ডালা রাখার ব্যাপারটি ছিল তাঁর চিন্তাপ্রসূত একটি অভিমত মাত্র। আর এ ধরনের ইজতিহাদ কখনো শুদ্ধ হয় আবার কখনো প্রমাদপূর্ণও হয়ে থাকে। উপরন্তু খুলাফায়ে রাশিদীনের ব্যাখ্যা জ্ঞান বুরাইদা রাযি.-এর ব্যাখ্যা জ্ঞান থেকে বহু গুণে উর্ধ্বে ছিল। তাছাড়া বুরাইদা রাযি.-এর আলোচিত উক্তিটি বক্ষমান আলোচনার বিপরীত কোনো বার্তা বহন করে না। কারণ ১. বুরাইদা রাযি. ওয়াসিয়ত করেছিলেন, তাঁর কবরে যেন দুটি ডাল রেখে দেয়া হয়। যদি তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুকরণের ইচ্ছায় এমনটি বলে থাকতেন তাহলে তাঁর কবরের উপরে ডাল রোপণ করার ব্যাপারে ওয়াসিয়ত করতেন। কবরের ভিতরে ডাল রেখে দেওয়ার ওয়াসিয়ত করতেন না। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো কবরের ভিতরে ডাল রাখেন নি; তিনি কবরের উপরাংশে ডাল রোপণ করে দিয়ে ছিলেন। ২. বুরাইদা রাযি. কবরে দুটি ডাল রাখার ওয়াসিয়ত করেছিলেন। যদি তাঁর অনুকরণই উদ্দেশ্য হতো তাহলে তিনি একটি ডাল রাখার ব্যাপারে ওয়াসিয়ত করতেন। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি কবরে দুটি করে ডাল রোপণ করেন নি; একটি করে ডাল রোপণ করে ছিলেন। ৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি ডালাকে দু টুকরো করে রোপণ করে ছিলেন। আর বুরাইদা রাযি. আলাদা আলাদা দুটি ডাল রেখে দেয়ার ব্যাপারে ওয়াসিয়ত করে ছিলেন। এতে প্রতীয়মান হয়. বুরাইদা রাযি.-এর ওয়াসিয়তটি ছিল মূলত একটি ইজতিহাদ বা ব্যক্তিগত চিন্তাধারা। সংশ্লিষ্ট হাদীসের সাথে এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

এ প্রশ্নও হতে পারে, আবু বারযা রাযি.ও তো ওয়াসিয়ত করছিলেন তার কবরে দুটি ডাল রেখে দেয়ার জন্য। এর উত্তরে কি বলবেন?

এর উত্তর হলো, ওয়াসিয়ত সংক্রান্ত আবু বারযা আসলামী রাযি.-এর উক্তিটি বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। সুতরাং উক্তিটি দালিলিক ক্ষেত্রে যথার্থ মানসম্পন্ন নয়। আলোচনার খাতিরে যদিও সাময়িকের জন্য উক্তিটিকে মানসম্পন্ন রূপে গণ্য করা হয় তবে এক্ষেত্রে ঐ একই কথা প্রযোজ্য যা বুরাইদা রাযি.-এর উক্তির ব্যাপারে আলোচিত হয়েছে।

(তিন) যারা কবরে ডাল রোপণ করাকে বৈধ বা সুন্নাহ বলেন তারা মনে করেন শাস্তি লাঘবের ব্যাপারটি নিছক ডালার ভিতরকার আর্দ্রতাজনিত। তাদের এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। বস্তুত শাস্তি লাঘবের মূল কারণ ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশ। জাবের রাযি. হতে বর্ণিত উক্ত দুই কবরবাসী সংক্রান্ত দীর্ঘ হাদীসে উল্লেখ রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

আমি আশা করি, আমার সুপারিশের ফলে তাদের দুজনের আযাবকে স্থগিত করা হবে যতক্ষণ ডাল দুটি সতেজ থাকবে। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ৭৭০৫)

এ হাদীসটি ইবনে আব্বাস রাযি.-এর হাদীসের ব্যাখ্যামূলক হাদীস। মূলত ডালের আর্দ্রতার ব্যাপারটি উল্লেখ করা হয়েছে শাস্তির সময় সীমা নির্ধারণ করার জন্য। তাছাড়া শাস্তি লাঘবের কারণ যদি ডালের আর্দ্রতা হতো তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডালটিকে দু’ টুকরো করতেন না। কারণ এতে তো ডালের শুষ্ক ক্রিয়া গতিসম্পন্ন হয় এবং অতি দ্রুত শুকিয়ে যায়।

(চার) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর দুটিতে ডাল রোপণ করেছিলেন। কারণ তিনি জানতে পেরে ছিলেন, কবরে তাদের শাস্তি হচ্ছে। আর শাস্তি বিষয়ে ধারণা লাভ করাটা ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এখন এ হাদীসকে কেন্দ্র করে ডাল রোপণ করার অর্থ হলো, মৃত ব্যক্তি সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা পোষণ করা। অথচ আমাদের জন্য করণীয় হলো একজন মুমিন সম্বন্ধে ভাল এবং স্বচ্ছ ধারণা পোষণ করা। আমরা কল্পনাপ্রসূত একটি অস্পষ্ট ধারণার আশ্রয় নিয়ে কবরগুলোতে ডালা গুঁজে দেই। আমরা তো জানি না কবরে কি হচ্ছে না হচ্ছে। অথচ কবরে ডাল রোপণ করে ঘোষণা করে দিচ্ছি এ কবরে শাস্তি হচ্ছে। কবরে শাস্তির ব্যাপারটি তো একটি অন্তর্নিহিত অদৃশ্য বিষয়। যেখানে বোধ বুদ্ধির কোনো কার্যকারিতা নেই।

আরবের বিশিষ্ট আলেমে দীন আব্দুল্লাহ বিন বায রহ. বলেন,

এভাবে কবরে বৃক্ষ রোপণ করা বিধিসম্মত নয়। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খুলাফায়ে রাশিদীন এসব করেন নি। তবে দুটি কবরের ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কাজটি করেছেন তা একান্তভাবে তাঁর সাথেই সম্পৃক্ত ছিল। তার প্রমাণ হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য কোনো কবরের ক্ষেত্রে এমনটি করেননি। সুতরাং মুসলিমদের জন্য নতুন ইবাদত সৃষ্টি করার কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

না কি তাদের শরীক রয়েছে যারা তাদের জন্য দীন প্রবর্তন করে যে ব্যাপারে আল্লাহ কোনো অনুমতি দেন নি? (‘সূরা শূরা’- ২১)

ইবনে উসাইমিন রহ. বলেন,

কবরে ডাল, পাতা জাতীয় তরতাজা কোনো বস্তু রেখে দেয়া কোনো সুন্নত নয়; স্পষ্ট বিদ‘আত। এবং মৃত ব্যক্তি সম্বন্ধে বিরূপ ধারণার নামান্তর। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বাভাবিক নিয়মে কবরে ডালা রোপণ করেন নি। কেবল দুটি কবরের ক্ষেত্রে এমনটি করেছিলেন যে কবরবাসীর শাস্তি সম্বন্ধে তিনি অবগতি লাভ করতে পেরেছিলেন। সুতরাং কবরে ডালা রোপণ করা মারাত্মক অপরাধ এবং গর্হিত কাজ। ইসলামী শরীয়তে এর কোনো স্থান নেই। (ওয়ালিদ বিন রাশিদ, নাসরুশ শুরআ বিকুমইল বিদ‘আ ১/১৫৩-১৫)

উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল, কবরে ডালা রোপণ করার ব্যাপারটি নিতান্তই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সম্পৃক্ত একটি তাৎক্ষণিক ঘটনা। সেটা সার্বজনীন অনুকরণীয় কোনো আদর্শ ছিল না। তাই বিচ্ছিন্ন এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কবরে ডালা রোপণকে সুন্নাহ বলার কোনো সুযোগ নেই। এটাই অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের অভিমত। তো যেখানে কবরে ডালা রোপণের ব্যাপারটি অনুমোদিত নয় সেখানে কবরে ফুল দেয়ার ব্যাপারটি অনুমোদনযোগ্য হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এমন কি যেসব উলামায়ে কেরাম কবরে ডালা রোপণের ব্যাপারে অবকাশ দিয়ে থাকেন তাঁরাও কবরে ফুল দেয়াকে জায়েয বলেন না। আল্লাম আইনী রহ. বলেন,

… তেমনিভাবে সাধারণ মানুষের মাঝে কবরে সুরভিত সতেজ ফুল, গুল্ম-লতা ইত্যাদি রাখার যে প্রথা পালিত হচ্ছে তার কোন সূত্র ভিত্তি নেই। (উমদাতুল কারী ১/৮৭৯)

আল্লামা কিরমানী রহ. বলেন,

মূলত বৃক্ষশাখার মাঝে শাস্তি লাঘবের কোনো শক্তি বা উপাদান নেই। শাস্তি লাঘবের বিষয়টি ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাতের বরকত এবং অলৌকিক বিষয়।

হানাফী মাসলাকের খ্যাতিমান আলেম আল্লামা ফয়জুল্লাহ তুরিবিশতি রহ. বলেন,

বৃক্ষডালা শুষ্ক হওয়া পর্যন্ত শাস্তি লাঘবের সীমা নির্ধারণ করার কারণ হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাখা দুটি সতেজ থাকা পর্যন্ত ঐ কবর দু’টির শাস্তি লাঘবের সুপারিশ করেছিলেন। আর যারা বলেন, ‘শাস্তি লাঘবের কারণ হলো, বৃক্ষ ডালার সতেজতা। কারণ ডালগুলো যতক্ষণ সতেজ থাকবে ততক্ষণ আল্লাহর মহত্ত্ব ও পবিত্রতা বর্ণনা করতে থাকবে। আর সতেজ ডালার পবিত্রতা বর্ণনাই কবরের শাস্তি লাঘব করবে’ তো এটা নিতান্তই অগভীর ও অর্থহীন একটি কথা। (আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলবী, লুম‘আতুন তানকীহ ২২/৪৪, আল্লামা ইউসুফ লুধিয়ানবী, ইখতেলাফে উম্মত আওর সিরাতে মুস্তাকিম ১৭২-১৭৩)

তাছাড়া ডালে সজীবতা থাকলে কিংবা তাতে প্রাণের সঞ্চার থাকলে আল্লাহর পবিত্রতা ও মহত্ত্ব বর্ণনা করবে আর শুষ্ক হয়ে জড় পদার্থের রূপ ধারণ করলে আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করবে না এমনটি তো কোথাও উল্লেখ নেই। পবিত্র কুরআন বলছে,

সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এবং তাদের অন্তর্বর্তী সবকিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এ মহাজগতে এমন কিছু নেই যা তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না। তবে তোমরা তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা অনুধাবন করতে পারো না। নিশ্চয় তিনি সহনশীল এবং ক্ষমাপরায়ণ। (‘সূরা বনী ইসরাইল’- ৪৪)

অন্য দিকে সত্যিই যদি ডাল এবং ফুলের সজীবতা শাস্তি লাঘবের কারণ হয়ে থাকে তবে তো সবুজ সজীব দণ্ডায়মান বৃক্ষ তলায় মৃত ব্যক্তিকে সমাহিত করা হলে কবরস্থ ব্যক্তি পরকালীন শাস্তি থেকে চিরমুক্তি লাভ করতে পারবে। এমন অভিমত কি কেউ ব্যক্ত করেছেন? এমনটি কি আদৌ কল্পনা করা যায়? এমনটি হলে তো গোর আযাব বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকত না। কারণ সমস্ত মানুষ তখন আজীবন পাপ পঙ্কিলতায় মগ্ন থেকে মরণের কালে গাছের তলায় গিয়ে শুয়ে যেত। আর তখন বর্তমান ফুলেল সংস্কৃতি সেবীদের জন্য শাহবাগের ফুল স্টলগুলোতে ভিড় জমাতে হতো না। এবং অর্থ কড়ি খরচ করে ফুলের ডালা সাজানোরও প্রয়োজন পড়ত না। তাদের নেতা-নেত্রীদের সবুজ শ্যামল কোনো বাগানে শুইয়ে দিলেই তাদের সাধ মিটে যেত।

বিশেষ ভঙ্গিতে নীরবতা পালন

মৃত ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে নীরবতা পালনের অর্থটা কি? যারা এ সংস্কৃতিটা পালন করেন তারা কী উদ্দেশ্যে তা পালন করেন? এতে কার লাভ? মৃতদের না জীবিতদের? এসব প্রশ্নের উত্তর কি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মাথায় থাকে? নাকি বিষয়টি নিতান্তই গড্ডালিকা প্রবাহ? একটি ভেড়া একদিকে ছুটল তো বাকিরাও সেদিকে ছুটল। প্রথম ভেড়াটি কেনো কী উদ্দেশ্যে সেদিকে ছুট দিলো অন্য ভেড়াগুলো কিছুই জানে না। এটা তো বোধ বুদ্ধিহীন একটি প্রাণীর ক্ষেত্রে মানানসই হতে পারে। কিন্তু বিবেক বুদ্ধির ধারক মানুষের ক্ষেত্রে এটা কীভাবে সম্ভব? এটা তো চির সত্য কথা, নীরবতা পালনের বিষয়টি মুসলমানের কোনো সংস্কৃতি নয় এবং কোনো মুসলমান এ জিনিসটিকে প্রবর্তনও করে নি। তাহলে এটা কোথা থেকে এল? নিশ্চয় কারো থেকে ধার করা। সে এক্সপোর্টার কারা? তো অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সে এক্সপোর্টার হলো খ্রিস্টান জগৎ। এটি নিখাদ একটি ইংরেজি ধর্মীয় সংস্কৃতি। তাদের বিশ্বাস হলো, মৃত ব্যক্তির স্মরণে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলে সে নীরব পরিবেশে যিশু খ্রিষ্টের আগমন ঘটে। তিনি এসে মৃত ব্যক্তির মুক্তির একটা ব্যবস্থা করে দেন। এ হলো নীরবতা পালনের নিগূঢ় বাস্তবতা। সুতরাং একজন মুসলিম যদি এ নীরব সংস্কৃতি পালন করে তাহলে এক্ষেত্রে প্রচণ্ড রকমের আপত্তি রয়ে গেছে। কারণ মুসলিমরা ঈসা আ. সম্বন্ধে ইয়াহুদি খ্রিস্টানদের মতো সীমাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ছাড়াছাড়ির প্রবক্তা নয় এবং কোনো অনুষ্ঠানে একজন ব্যক্তির অদৃশ্যগত আগমন সম্বন্ধেও একজন মুসলিমের বিশ্বাসী হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তো নীরবতা পালনের বিষয়টি কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো আমরা কি লক্ষ্য করেছি? এটা তো স্পষ্ট একটি কুফুরী সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হলে একজন মুসলিম আর মুসলিম থাকবে না। তাকে নতুন করে ইসলাম গ্রহণ করতে হবে।

যারা মৃত ব্যক্তির স্মরণে নীরবতা পালন করে তারা মূলত এটিকে শোক পালনের অনুসঙ্গ হিসেবে পালন করে থাকে। শোক পালন এটি একটি ইসলামী বিধান এবং ইবাদতও বটে। এটা কোনো দেশজ রীতি বা নিছক স্বভাবজাত কোনো বিষয় নয় যে এতে সহনীয়তা এবং ব্যাপকতার অবকাশ থাকবে। কারণ কে কখন কি নিয়মে শোক পালন করবে এবং এর রূপরেখা এবং স্থান কাল কি হবে তার বিস্তারিত বিবরণ ইসলামী শরীয়তে রয়েছে। কিন্তু বিশেষ পদ্ধতিতে কৃত্রিম নীরবতা পালন করে শোক পালনের কথা ইসলামী শরীয়তে নেই। তাই এটি একটি সাংঘাতিক পর্যায়ের বিদ‘আত এবং ঘৃণিত কাজ। তাছাড়া শোকের ব্যাপারটি নিতান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। এটাকে আনুষ্ঠানিকতার রূপ দেয়া নিতান্তই লৌকিকতা ও পোশাকি চরিত্রের রূপায়ন। মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে কৃত্রিমতা ও লৌকিকতার মঞ্চায়ন করা নিতান্তই বেমানান, দৃষ্টিকটু এবং চক্ষু লজ্জার বিষয়। আপনজন কিংবা পরিচিত কারো মৃত্যু হলে শোকে মুহ্যমান হওয়া, বেদনা ব্যথায় নির্বাক হওয়া একান্ত স্বভাবজাত একটি ব্যাপার। এবং এটি ভিতর থেকে সৃষ্টি হওয়ার মতো একটি বিষয়। এখানে মেকি চরিত্রে অভিনয় করা অত্যন্ত ঘৃণিত বিষয়। মৃত ব্যক্তির নামে বিশেষ পদ্ধতিতে নীরবতা পালন করা যে একটি পোশাকি চরিত্রের মঞ্চায়ন এতে কারো সামান্যতম সন্দেহ হওয়ার কথা নয়।

আসলে নীরবতাকে ধর্মাচারে রূপদান করা আইয়ামে জাহিলিয়্যাত তথা মূর্খতার যুগের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। সে যুগে মানুষ নীরবতা অবলম্বন করে নানা রকম ধর্মীয় প্রথা পালন করত। কাইস বিন আবু হাযিম রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

একদা আবু বকর রাযি. যয়নাব নামক আহমাস গোত্রীয় এক নারীর কাছে গেলেন। তখন তিনি দেখলেন, নারীটি কথা বলছে না। তখন তিনি লোকদের জিজ্ঞেস করলেন, এ নারীর কী হয়েছে? এ নারী কথা বলছে না কেন? লোকেরা বলল, এ নারী নীরবতার হজ পালন করছে। তখন আবু বকর রাযি. নারীকে সম্বোধন করে বললেন, তুমি কথা বলো। তোমার এ নীরবতা পালন অনুমোদিত নয়। এটি জাহেলী যুগের একটি প্রথা। এরপর নারীটি কথা বলা শুরু করে। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৩৬২২)

নীরবতা পালনের এ সংস্কৃতিটি খ্রিস্টানদের একটি ধর্মীয় প্রথা। আর ধর্মীয় বিধি পালনের ক্ষেত্রে বিধর্মীদের সাদৃশ্য গ্রহণের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর ভাষায় নিষেধ করেছেন।

সমুচ্চারিত প্রশংসা আদায়

প্রশংসা কোনো আদায় করার বিষয় নয়; এটা নিজ থেকে করার মতো একটি বিষয়। কিন্তু বর্তমানে প্রশংসা আদায় করার মতো একটি প্রথা বেশ ঘটা করেই প্রচলিত হচ্ছে। তাও একজন মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। জানাযার পূর্বে বা পরে হুট করে একজন ব্যক্তি সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন। উপস্থিত জনতাকে সম্বোধন করে উঁচু আওয়াজে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, আমার ভাই কেমন ছিলেন? উপস্থিত জনতা কি বলবেন? ব্যক্তিগত জীবনের রেকর্ড ভালো না হলেও কি নিথর এ মৃত ব্যক্তিটিকে খারাপ বলবেন? উপস্থিত লোকগুলো ধাঁধাঁয় পড়ে যান। বস্তুত তাদেরকে ধাঁধাঁয় ফেলে দেয়া হয়। ক্ষেত্র বিশেষে অনিচ্ছায় কিংবা চক্ষু লজ্জায় পড়ে হলেও ভালো ছিলেন বলে হাত উঁচু করে দিতে হয়। প্রশংসা গ্রহণের এ পদ্ধতিটি একটি নব আবিষ্কৃত বিষয় এবং গর্হিত বিদ‘আত। ইসলামী শরীয়তে এর কোনো স্থান নেই। এ প্রথাটির স্থান কাল যেটাই হোক সর্বক্ষেত্রেই সেটা বিদ‘আত। বস্তুত একটি হাদীসের ভুল ব্যাখ্যার সূত্র ধরে এ বিদ‘আতটির উদ্ভব হয়েছে। হাদীসটি হলো, উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

যে ব্যক্তির ভালো হওয়ার ব্যাপারে চার জন ব্যক্তি সাক্ষ্য দিবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবিষ্ট করাবেন। আমরা বললাম, যদি তিন জন সাক্ষ্য দেয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তিন জন সাক্ষ্য দিলেও। আমরা বললাম, যদি দুই জন সাক্ষ্য দেয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দুই জন সাক্ষ্য দিলেও। উমর রাযি. বলেন, এরপর আমরা একজনের সাক্ষ্যের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আর জিজ্ঞেস করলাম না। (সহীহ বুখারী; হা.নং ১৩৬৮)

হাদীসটিতে স্বেচ্ছায় এবং বাস্তবতার নিরিখে সাক্ষ্য দান বা স্বেচ্ছা উক্তির কথা বলা হয়েছে। কৌশলে লোকদের থেকে ভালো হওয়ার সাক্ষ্য গ্রহণ করার কথা বলা হয় নি। তাছাড়া একজন মানুষ ভালো হলে তার ভালোর কথা এমনিতেই লোক মুখে চাউর হয়ে যায়। তার জন্য কোনো কূট কৌশল গ্রহণের কোনো প্রয়োজন হয় না। উপরন্তু প্রচলিত প্রশংসা গ্রহণ পদ্ধতিতে মানুষ চক্ষু লজ্জায় পড়ে ভালো ছিল বলতে কিংবা প্রশংসা বক্তব্য দিতে বাধ্য হয়। এটা তো প্রকৃত অর্থে ভালো হওয়ার সাক্ষ্য প্রদান নয়। বাস্তবতা বিবর্জিত এ মিথ্যা প্রশংসা জ্ঞাপনে মৃত ব্যক্তির জান্নাত অর্জিত হবে না। বাস্তবে এ ধরনের পোশাকি প্রশংসার প্রয়োজন এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রেই সৃষ্টি হয় ব্যবহারিক জীবনে যার নেকির পাত্র শূন্য প্রায়। সুতরাং এ ধরনের মেকি প্রশংসা পরিহার করা ইসলামী শরীয়ার অপরিহার্য দাবি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এ ধরনের প্রশংসা গ্রহণ এবং প্রশংসা প্রদান থেকে বিরত থাকার তাওফীক দান করুন।

লেখক

ছাত্র, মাহাদুল বুহুসিল ইসলামিয়া (১৪৩৪-৩৫হি. শিক্ষাবর্ষ)

শিক্ষক, কস্তুরীপাড়া মাদরাসা, কালিহাতি, টাঙ্গাইল

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *