হিজাব : প্রসঙ্গ মুখমণ্ডল

মাওলানা মাহমূদ বিনইলিয়াস


ভূমিকা

الحمد لله الذى احل حلالا وحرم حراما وبين لنا تماما والصلاة والسلام على خير الانام وعلى اله واصحابه اجمعين، اما بعد

বর্তমান শতাব্দীতে ধর্মীয় অঙ্গনে একটি আলোচিত বিষয় হলো নারীদের চেহারার হিজাব প্রসঙ্গ। এ নিয়ে নানা ভাষায় পুস্তিকা রচনাসহ বিভিন্ন অঙ্গনে চলছে তুমুল বিতর্ক। বিগত শতাব্দীগুলোতে এ নিয়ে বিতর্ক চর্চার তেমন উপলক্ষ ছিল না। তের শতাব্দী পর্যন্ত এ বিষয়টি ফিকহ, হাদীস এবং তাফসীর গ্রন্থের দুই মলাটের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। ধর্মীয় অঙ্গনে এ নিয়ে কোনো বিতর্ক ছিল না। লোকসমাজে কেউ চেহারা অনাবৃত রাখা বৈধ হওয়ার অদ্ভুত দাবিও উত্থাপন করত না। বরং উলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে সর্বসম্মত মতামত উল্লেখ করেই ক্ষান্ত থাকতে পারতেন। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা বা প্রতিপক্ষের বক্তব্য খণ্ডনের সুযোগও তখন ছিল না। যেহেতু বর্তমানে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হচ্ছে তাই এ বিষয়ে প্রামাণিক নিবন্ধ রচনা এখন সময়ের দাবি। সে দাবি পূরণের লক্ষ্যেই এই রচনা।

মূলত মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ কি না? এ বিষয়ে উলামায়ে কেরামের দুটি বক্তব্য পাওয়া যায়।

হিজাব প্রসঙ্গে দুটি বক্তব্য

১. নবী-পত্নীসহ সকল নারী সমাজের মুখমণ্ডল আবৃত রাখা ওয়াজিব।

২. শুধু নবী-পত্নীদের জন্য মুখমণ্ডল আবৃত রাখা ওয়াজিব। অন্যান্য নারী সকলের জন্য শর্ত সাপেক্ষে মুস্তাহাব। শর্ত হলো, (ক) প্রবৃত্তিগত দুর্ঘটনা থেকে নিরাপদ হওয়া। আর রিপুগত দুর্ঘটনার মূল উপাদান হলো, নারীর যৌবন, তারুণ্য ও চেহারার রূপ সৌন্দর্য ইত্যাদি। (খ) দুরাচার বা অসৎ লোকদের আধিক্যতা। শর্ত দুটির কোনো একটিও যদি উপস্থিত হয় তাহলে সাধারণ নারীদের জন্যও মুখমণ্ডল আবৃত রাখা ওয়াজিব। এই ছিল নারী চেহারার হিজাব প্রসঙ্গে উলামায়ে কেরামের মত ভিন্নতার সারসংক্ষেপ। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হলো, বর্তমানে বিশেষ একটি মহল থেকে প্রচারণা চলছে, মুখমণ্ডল হিজাবেরই অংশ না। তারা সপক্ষে ‘মুখমণ্ডলের পর্দা বিধান মুস্তাহাব’ প্রবক্তা উলামায়ে কেরামের বক্তব্যকেই প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন। অথচ সে সকল উলামায়ে কেরাম যে শর্তারোপ করেছেন সেদিকে সামান্যও ভ্রুক্ষেপ করেন না। এই বিশেষ দলটি বলে থাকে, নারী জাতির পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ হলো, পর্দা প্রথা। পর্দাই তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে বড়ো অন্তরায়। সাথে সাথে তারা তাদের এ ভ্রান্ত মতাদর্শটিকে গণমাধ্যমে বেশ জোরে সোরে প্রচার করে বেড়াচ্ছে। তাই আলোচ্য বিষয়টি বিশেষভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে। সুতরাং সংশ্লিষ্ট বিষয়টির নিগূঢ় তত্ত্ব এবং এ বিষয়ে ইসলামের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী? তা এই নিবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে। والله الموفق والمعين

নারীদের জন্য মুখমণ্ডল আবৃত করা হিজাবেরই অংশ। ফলে দেহের অন্যান্য অঙ্গের ন্যায় চেহারাও ঢেকে রাখা আবশ্যক এবং তা পরপুরুষের সামনে প্রকাশ করা নিষিদ্ধ এবং হারাম। তবে যদি কখনো অনিচ্ছায় চেহারা অনাবৃত হয়ে যায় বা বিশেষ প্রয়োজনে চেহারা অনাবৃত করতে হয় তাতে কোনো অসুবিধা নেই। সুতরাং আদালতে মহিলার বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে তার চেহারার দিকে তাকিয়ে সাক্ষ্য প্রদান করা, বিচারক কোনো নারীর ব্যাপারে রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে তার চেহারার দিকে তাকিয়ে রায় প্রদান করা, তেমনিভাবে চিকিৎসার স্বার্থে ডাক্তার রোগীর রোগের স্থান পর্যবেক্ষণ করে দেখা বিশেষ প্রয়োজনের নিরিখে এ সবই বৈধ। তবে এ সকল ক্ষেত্রেও লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে প্রবৃত্তির চাহিদা নিয়ন্ত্রণে থাকে। (ইমদাদুল ফাতাওয়া ৪/১৭৮)

কুরআনের আলোকে মুখমণ্ডলের হিজাব প্রসঙ্গ

নারী চেহারা হিজাবের পর্যায়ভুক্ত। এ ব্যাপারে কুরআনের ভাষ্য :

এক. আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ

অর্থ : তোমাদের যদি নবী-পত্নীদের কাছ থেকে কোনো জিনিসপত্র চাওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে পর্দার আড়াল থেকে চেয়ে নিবে। (‘সূরা আহযাব’- ৫৩)

উক্ত আয়াতটি নারীদের চেহারাসহ সমগ্র শরীর আবৃত করা হিজাবের অংশ হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলীল। এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। তবে আয়াতের বিধানটি কাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। যারা মুখমণ্ডল আবৃত করা মুস্তাহাবের প্রবক্তা তারা বলেন, আয়াতের বিধানটি নবী-পত্নীদের ক্ষেত্রেই শুধু প্রযোজ্য। কারণ আয়াতে তাঁদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে। তবে তাদের এ বক্তব্য শরয়ী দলীলের আলোকে যথার্থ নয়। কারণ আয়াতটির সম্বোধক ভাষ্য ও প্রেক্ষাপট সংকীর্ণ হলেও তার বক্তব্য বিধান ব্যাপক ও বিস্তৃত। হিজাব বিষয়ে আয়াতটি সমগ্র নারী সমাজকে ব্যাপৃত করে।

কারণ, (ক) উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো, আত্মাকে পরিশুদ্ধকরণ যা আয়াতের পরবর্তী অংশে বিবৃত হয়েছে

ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ

অর্থ : আর এটা তোমাদের এবং তাঁদের আত্মার অধিক পবিত্রতার কারণ হবে। (‘সূরা আহযাব’- ৫৩)

আর আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জনের বিষয়টি সর্বকালের সকল মানুষের জন্য সমভাবে আবশ্যক। সুতরাং যেহেতু উক্ত বিধানটি অবতীর্ণ হওয়ার উপলক্ষটি সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তাই বিধানটিও সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।

(খ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ ছিলেন মুসলিম উম্মাহর সকল নারী সদস্য থেকে সর্বাধিক পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকরিণী। মুমিনদের অন্তরে তাদের প্রতি ছিল গভীর মর্যাদাবোধ এবং অকৃত্রিম ভালোবাসা। তাঁরা ছিলেন অন্যান্য পুরুষের জন্য সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ এবং হারাম। এতদসত্ত্বেও যখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে আত্মার পরিশুদ্ধির লক্ষ্যে পর্দা পালনের নির্দেশ দিলেন তখন অন্যান্য নারী সকল যে ঐ নির্দেশের আওতাভুক্ত হবে তা সামান্য বিবেচনাতেও উপলব্ধি হয়।

(গ) তাছাড়া যদি বলা হয় আলোচ্য আয়াতের পর্দা বিধানটি নবী-পত্নীদের সাথেই সম্পৃক্ত তাহলে এর অর্থ এই দাঁড়ায়, নবী পত্নীদের অন্তরের তুলনায় অন্যান্য নারীদের অন্তর অধিক পবিত্র ও পরিশুদ্ধ। অথচ নবী-পত্নীগণ অতি উচ্চ স্তরের সাহাবিয়া। আর একজন নন-সাহাবী যত বড়ো বুযুর্গই হোন না কেন সে কখনই সাহাবাদের সমতুল্য হতে পারে না।

(ঘ) যারা বলেন আয়াতের বিধানটি নবী-পত্নীদের সাথেই সম্পৃক্ত তারা এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন যে, নবী-পত্নীদের মর্যাদার কারণে তাদেরকে এ নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এর উত্তর হলো, মর্যাদার বিষয়টি তো নবী-কন্যাদের মাঝেও পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান রয়েছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আয়াতের বিধানটি আর নবী-পত্নীদের সাথে সম্পৃক্ত থাকল কোথায়?

(ঙ) আরব বিশ্বের আলোচিত আলেম নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. তার جلباب المرأة (জিলবাবুল মারআ) নামক গ্রন্থে (৭৫ পৃষ্ঠা) স্বীকার করেছেন, আলোচ্য আয়াতের বিধান সকল নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

(চ) আল্লাহ তা‘আলা হিজাবের আয়াতের পর বলেন,

لَا جُنَاحَ عَلَيْهِنَّ فِي آبَائِهِنَّ وَلَا أَبْنَائِهِنَّ وَلَا إِخْوَانِهِنَّ

অর্থ : নবী-পত্নীগণের তাদের পিতা-পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, সহধর্মিনী নারী এবং অধিকারভুক্ত দাস-দাসীগণের সামনে যেতে কোনো সমস্যা নেই। (‘সূরা আহযাব’- ৫৫)

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন,

لما أمر تعالى النساء بالحجاب من الأجانب، بيَّن أن هؤلاء الأقارب لا يجب الاحتجاب منهم.

অর্থ : যখন আল্লাহ তা‘আলা নারীদেরকে অপরিচিত পুরুষের থেকে পর্দা পালনের নির্দেশ দিলেন। এখন উক্ত আয়াতে ঐ সকল নিকটাত্মীয়দের উল্লেখ করেছেন যাদের সাথে তাদের পর্দা পালন করা ওয়াজিব নয়। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ৬/৪৭৬)

আর এ বিধানটি সকল নারীর ক্ষেত্রে সর্বসম্মতিক্রমে প্রযোজ্য। সুতরাং কীভাবে বলা যায়, হিজাবের আয়াতটি নবী-পত্নীদের সাথে সম্পৃক্ত? অথচ এর সাথে সম্পৃক্ত পরবর্তী আয়াতের বিধানটি সকল নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সুতরাং উপরোল্লিখিত আলোচনাসমূহ আয়াতটি ব্যাপক হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ়রূপে প্রমাণ বহন করে। আর যারা বলেন আয়াতটি নবী-পত্নীদের সাথেই সম্পৃক্ত তাদের বক্তব্যটি অসার বলে সাব্যস্ত হলো।

আয়াতটির ব্যাপকতা সম্পর্কে মুফাসসিরীনে কেরামের বক্তব্য

১. ইমাম ইবনুল আরাবী রহ. বলেন,

وهذا يدل على أن الله أذن في مساءلتهن من وراء حجاب في حاجة تعرض أومسألة يستفتى فيها؛ والمرأة كلها عورة؛ بدنها وصوتها، فلا يجوز كشف ذلك إلا لضرورة أو لحاجة، كالشهادة عليها

অর্থ : উক্ত আয়াতটি নির্দেশ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা নবী-পত্নীদের কাছ থেকে কোনো কিছু প্রার্থনা করার প্রয়োজন হলে বা দীনী কোনো বিষয় জানার প্রয়োজন হলে পর্দার আড়াল থেকে প্রার্থনা বা জেনে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। আর নারীর পূর্ণ দেহ-ই গুপ্ত বিষয়। তার শরীর, তার কণ্ঠস্বর এগুলো বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া প্রকাশ করা বৈধ নয়। (আহকামুল কুরআন ২/৪৬৮)

২. ইমাম জাস্সাস রহ. বলেন,

وهذا الحكم وإن نزل خاصا في النبي صلى الله عليه وسلم وأزواجه فالمعنى عام فيه وفي غيره إذ كنا مأمورين باتباعه والإقتداء به

অর্থ : উক্ত আয়াতের বিধানটি যদিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর স্ত্রীদের ব্যাপারে বিশেষভাবে অবতীর্ণ হয়েছে তবে এর অর্থ ব্যাপক। কেননা আমরা তাঁর অনুসরণ ও অনুকরণের ব্যাপারে আদিষ্ট। (আহকামুল কুরআন ৮/৪১৫)

৩. আল্লামা শানকীতী রহ. তার তাফসীর গ্রন্থ اضواء البيان فى ايضاح القران بالقران (আযওয়াউল বায়ান ফী ঈযাহিল কুরআনি বিল কুরআন)-এর ৩৬/১০৮ পৃষ্ঠায় আয়াতটি ব্যাপক হওয়া প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন।

৪. ইমাম কুরতুবী রহ. الجامع لاحكام القران (আল-জামে লিআহকামিল কুরআন)-এর ১৪ নম্বর খণ্ডের ২৮৮ পৃষ্ঠায় আয়াতটি ব্যাপক হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

দুই. আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ

অর্থ : হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা এবং মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের চাদর বা ওড়না নিজেদের উপর টেনে দেয়। (‘সূরা আহযাব’- ৫৯)

আয়াতের বাহ্যিক অর্থ হলো, নারীরা ওড়না দ্বারা দেহের অন্যান্য অঙ্গের ন্যায় চেহারাও ঢেকে রাখবে। আয়াতটির অর্থগত বিধান নবী-পত্নী ও নবী-কন্যাদের ন্যায় অন্যান্য সাধারণ নারীদের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। বিষয়টি বিভিন্নভাবে প্রমাণিত। যথা

(ক) আয়াতটি সুস্পষ্টভাবে এ বিষয়টি নির্দেশ করে, পর্দার বিধানটি নবী-পত্নী ও নবী-কন্যাদের ন্যায় অন্যান্য সাধারণ নারীদেরকেও সমভাবে ব্যাপৃত করে। কারণ আয়াতে নবী-পত্নী, নবী-কন্যা এবং সাধারণ মুমিন নারীদের আলোচনা সমভাবে একই সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এ কথা সর্বজন বিদিত, নবী-পত্নীদের মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ ছিল। সুতরাং নবী-পত্নী ও নবী-কন্যাদের ন্যায় অন্যান্য নারীদের মুখমণ্ডলও হিজাবের অংশ বলে গণ্য হবে।

(খ) ادناء (টেনে দেয়া) এর ব্যাখ্যায় যদি বলা হয়, মুখমণ্ডল খোলা রাখা যাবে তাহলে নবী-পত্নী, নবী-কন্যাসহ সকল নারীদের মুখমণ্ডল খোলা রাখা আবশ্যক হয়ে পড়ে। কারণ আয়াতের বিধানটি তো সকলের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। অথচ নবী পত্নীদের মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ হওয়ার ব্যাপারে কেউ দ্বিমত পোষণ করে না।

(গ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি.-এর এক বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে, (جلباب) ‘জিলবাব’ দ্বারা এমন ওড়না উদ্দেশ্য যাতে দেহের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত আবৃত হয়ে যায়। (ফিকহী মাকালাত ৪/৫০)

(ঘ) ইমাম ইবনে হাযম রহ. বলেন,

والجلباب في لغة العرب التي خاطبنا بها رسول الله صلى الله عليه وسلم هو ما غطى جميع الجسم، لا بعضه.

অর্থ : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ওড়না (جلباب) বিষয়ে আমাদের সম্বোধন করেছেন, আরবী পরিভাষায় তা ঐ ওড়নাকে বলে, যা আংশিক দেহ নয়, পুরো দেহকে ঢেকে নেয়। (আল মুহাল্লা বিল আসার ২/৩৪৬)

মুফাসসিরীনে কেরামের বক্তব্য

(১) قال أبو بكر في هذه الآية دلالة على ان المرأة الشابة مأمورة بستر وجهها عن الأجنبيين.

(১) ইমাম আবু বকর জাস্সাস রহ. يدنين (তারা টেনে দিবে) এর ব্যাখ্যায় বলেন, উক্ত আয়াতটি এ কথার প্রমাণ বহন করে, যুবতী নারীরা অপরিচিত পুরুষদের থেকে তাদের মুখমণ্ডল আবৃত করে রাখার ব্যাপারে আদিষ্ট। (আহকামুল কুরআন ৫/২৪৫)

(২) قال ابن عباس وأبو عبيدة: أمر نساء المؤمنين أن يغطين رؤوسهن ووجوهن بالجلابيب إلا عينا واحدة ليعلم أنهن حرائر.

(২) ইমাম বাগাবী রহ. বলেন, ইবনে আব্বাস এবং আবু উবাইদা রাযি. বলেছেন, মুমিন নারীদেরকে ওড়না দ্বারা তাদের মাথা এবং মুখমণ্ডল আবৃত করে রাখার ব্যাপারে আদেশ দেওয়া হয়েছে। তবে একটি চক্ষু খোলা রাখার অবকাশ দেওয়া হয়েছে, যাতে বুঝা যায় তারা স্বাধীন নারী। (তাফসীরে বাগাবী ৩/৪৬৯)

(৩) يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلابِيبِهِنَّ: أنهن يسترن بها جميع وجوههن، ولا يظهر منهن شىء إلا عين واحدة تبصر بها، وممن قال به: ابن مسعود، وابن عباس، وعبيدة السلماني وغيرهم.

(৩) আল্লামা শানকীতী রহ. বলেন, তারা ওড়না দ্বারা তাদের পুরো মুখমণ্ডল ঢেকে ফেলবে। শুধুমাত্র একটি চক্ষু খোলা রাখবে, যা দিয়ে তারা দেখবে। ইবনে মাসউদ, উবনে আব্বাস, ও উবাইদা রাযি. সহ অনেকের বক্তব্য এটাই। (আযওয়াউল বায়ান ফী ঈযাহিল কুরআনি বিল কুরআন ৩৬/১১১)

(৪) يدنين عليهن من جلابيبهن : أي يرخين على وجوههن الجلباب حتى لا يبدو من المرأة إلا عين واحدة تنظر بها الطريق إذا خرجت لحاجة.

(৪) জাবের ইবনে মূসা আল জাযায়েরী বলেন, নারীরা ওড়না তাদের চেহারার উপর টেনে দিবে যাতে তাদের একটি চক্ষু ছাড়া কিছুই প্রকাশ না পায়। একটি চক্ষু খোলা রাখবে যাতে তারা প্রয়োজনের সময় বাহিরে বের হলে পথ-ঘাট দেখতে পারে। (আইসারুত তাফাসীর লিকালামিল আলিয়্যিল কাবীর ৭/৪১)

(৫) يُدْنِينَ أي: يُرخين على وجوههنّ من جلابيبهن فيغطين بها وجوهَهن. والجلباب: كل ما يستر الكل، مثل الملحفة.

(৫) আল্লামা ইবনে আজীবা রহ. বলেন, নারীরা তাদের ওড়নার কিয়দাংশ মুখমণ্ডলের উপর টেনে দিবে। অতঃপর তা দ্বারা তাদের মুখমণ্ডল ঢেকে নিবে। ‘জিলবাব’ বলা হয় ঐ আচ্ছাদনকে যা কম্বলের ন্যায় পুরো দেহকে ঢেকে নেয়। (আল বাহরুল মাদীদ ফী তাফসীরি কুরআনিল মাজীদ ৯/৪০৪)

(৬) يا أيها النبي قل لأزواجك وبناتك ونساء المؤمنين يرخين على رؤوسهن ووجوههن من أرديتهن وملاحفهن؛ لستر وجوههن وصدورهن ورؤوسهن.

(৬) তাফসীরে মুয়াস্সারে বলা হয়েছে, হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা এবং সাধারণ মুমিন নারীদের বলে দিন, যেন তারা তাদের মুখমণ্ডল, বক্ষদেশ এবং মাথা ঢেকে নেয়ার লক্ষ্যে তাদের ওড়না বা চাদর তাদের মাথা এবং চেহারার উপর টেনে দেয়। (আত্তাফসীরুল মুয়াস্সার ২/১৬১)

(৭) وأخرج ابن المنذر وابن أبي حاتم عن محمد بن سيرين رضي الله عنه قال : سألت عبيدا السلماني رضي الله عنه عن قوله الله يدنين عليهن من جلابيبهن فتقنع بملحفة فغطى رأسه ووجهه وأخرج احدى عينيه.

(৭) আল্লামা সুয়ূতী রহ. বলেন, ইবনুল মুনযির এবং ইবনু আবী হাতেম সূত্রে বর্ণিত, মুহাম্মদ ইবনে সীরীন রহ. বলেন, আমি আবিদাতুস সালমানী রহ. কে আল্লাহর বাণী يُدْنِيْنَ عَلَيْهِنَّ الخ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তখন তিনি কম্বল দ্বারা তার একটি চক্ষু ব্যাতিরেকে তার মাথা ও মুখমণ্ডলসহ সমস্ত শরীর ঢেকে দিলেন। (আদ্দুররুল মানসূর ৬/৬৬১)

(৮) عن ابن عباس رضي الله ، عنهما في هذه الآية قال : امر الله نساء المؤمنين إذا خرجن من بيوتهن في حاجة ان يغطين وجوههن من فوق رؤوسهن بالجلابيب ، يبدين عينا واحدة.

(৮) ইমাম রাযী রহ. বলেন, উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, আল্লাহ তা‘আলা মুমিন নারীদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যখন তারা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে তখন তারা ওড়না দ্বারা তাদের মুখমণ্ডল মাথার উপর দিক থেকে ঢেকে নিবে। তবে একটি চক্ষু খোলা রাখবে। (তাফসীরে ইবনে আবী হাতেম ২/১৩)

(৯) ومعنى يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جلابيبهن يرخينها عليهنّ، ويغطين بها وجوههنّ وأعطافهنّ.

(৯) আল্লামা যামাখসারী রহ. বলেন, ‘তারা তাদের ওড়না নিজেদের উপর টেনে দিবে’ এর অর্থ হলো, তারা তাদের দেহের উপর ওড়না ঝুলিয়ে দিবে এবং এর দ্বারা তাদের চেহারা ও দেহের পার্শ্বসমূহ ঢেকে নিবে। (আল কাশ্শাফ ৩/২৭৪)

(১০) ومن في : مِن جَلَـابِيبِهِنَّ للتبعيض، وعَلَيْهِنَّ : شامل لجميع أجسادهن، أو عَلَيْهِنَّ : على وجوههن، لأن الذي كان يبدو منهن في الجاهلية هو الوجه.

(১০) নাহব্ তথা আরবী ব্যাকরণ শাস্ত্রের ইমাম ও মুফাসসির আবু হাইয়ান আল আন্দালুসী রহ. বলেন, من جلابيبهن এর মধ্যে من অব্যয়টি ‘কতেক’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আর عليهن এটা নারীদের সমস্ত শরীরকে ব্যাপৃত করে। অথবা عليهن অর্থ على وجوههن। অর্থাৎ তারা তাদের মুখমণ্ডলের উপর ওড়না টেনে দিবে। কেননা নারীরা জাহেলী যুগে তাদের দেহের যে অংশ প্রকাশ করে রাখত তা হলো মুখমণ্ডল। (আলবাহরুল মুহীত; ‘সূরা আহযাব’ ৭/২৪০)

(১১) ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে নারীরা হিজাব ব্যতীত বের হতো। ফলে পুরুষরা তাদের চেহারা ও হাত দেখতে পেত। তখন দেখাও বৈধ ছিল। কারণ নারীদের জন্য মুখমণ্ডল ও হাত প্রকাশ করাও বৈধ ছিল। অতঃপর যখন পর্দার আয়াত يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ الخ অবতীর্ণ হলো তখন নারীরা পুরুষদের থেকে পর্দা করতে শুরু করল। (ইয়ানাতুল মুখতারীন বাইনান নিকাবি ওয়াল খিমার ১/১৬)

তিন.

وَالْقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَاءِ اللَّاتِي لَا يَرْجُونَ نِكَاحًا فَلَيْسَ عَلَيْهِنَّ جُنَاحٌ أَنْ يَضَعْنَ ثِيَابَهُنَّ

অর্থ : যেসব বৃদ্ধা নারী বিবাহের আশা করে না তাদের জন্য তাদের দেহের অতিরিক্ত কাপড় খুলে রাখতে কোনো দোষ নেই। (‘সূরা নূর’- ৬০)

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বৃদ্ধা নারীদেরকে কাপড় খুলে রাখার অনুমতি দিয়েছেন। এখানে এই বিষয়টি স্পষ্ট যে, এই আয়াতে (وضع ثياب) কাপড় খুলে রাখার দ্বারা দেহের সব কাপড় খুলে রাখা উদ্দেশ্য নয়; বরং উদ্দেশ্য হলো, (وضع جلباب) ওড়না খুলে রাখা বা দেহের উপরিভাগের ঐ কাপড় অংশ খুলে রাখা যা খুলে ফেললে সতর খুলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না। এ কারণেই হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. এই আয়াতে ব্যবহৃত (ثياب) কাপড় শব্দের ব্যাখ্যা (جلباب) ওড়না অথবা (رداء) চাদর দ্বারা করেছেন। আর জিলবাব হলো এমন বস্তু যাতে পূর্ণ দেহ আড়াল হয়ে যায়।

হযরত ইবনে আব্বাস রাযি., হযরত ইবনে উমর রাযি., হযরত মুজাহিদ রাযি., হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর রাযি., হযরত আবু শাসা রাযি., হযরত ইবরাহীম নাখয়ী রহ., হযরত হাসান রহ., হযরত কাতাদাহ রহ., ইমাম যুহরী রহ. এবং ইমাম আওযায়ী রহ. সহ আরো অনেক সাহাবা তাবেয়ী (ثياب) কাপড় শব্দের উপরোক্ত ব্যাখ্যাই করেছেন।

সুতরাং এই আয়াতটিতে (وضع جلباب) ওড়না খুলে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যার চূড়ান্ত ফলাফল হচ্ছে, (كشف الوجه) চেহারা খুলে রাখা। আর এই নির্দেশটি কেবলমাত্র ঐসব বৃদ্ধা নারীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যাদের ভবিষ্যতে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা এবং দৈহিক সক্ষমতা নেই। কিন্তু যুবতী নারীদের ক্ষেত্রে এই বিধান মোটেও প্রযোজ্য নয়। তাদের জন্য অপরিচিত লোকদের সামনে (جلباب) ওড়না খোলাও জায়েয নেই।

চার.

وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا

অর্থ : হে নবী! আপনি মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নি¤œগামী করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হিফাযত করে। তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে না বেড়ায়। তবে (শরীরের) যে অংশ (এমনিতেই) প্রকাশ হয়ে যায় তার কথা ভিন্ন। (‘সূরা নূর’- ৩১)

مَا ظَهَرَ مِنْهَا ‘তবে তার (শরীরের) যে অংশ খোলা থাকে (তার কথা ভিন্ন)’ আয়াতের এ অংশটুকুর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তাফসীর কারকগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. مَا ظَهَرَ مِنْهَا এর ব্যাখ্যা ‘চাদর এবং ওড়না’র দ্বারা করেছেন। অর্থাৎ নারীরা তাদের পরিধেয় পরিচ্ছদের উপর যে ওড়না বা চাদর মুড়িয়ে নেয় তা পরপুরুষের সামনে প্রকাশিত হলে কোনো সমস্যা নেই। কেননা তা আড়াল করে রাখা অসম্ভব। হযরত হাসান রহ., ইমাম ইবনে সীরীন রহ., আবুল জাওযা রহ., ইবরাহীম নাখয়ী রহ. প্রমুখের মতও এটিই। এ ব্যাখ্যাটিই কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন সুস্পষ্ট বক্তব্যের অনুকূলে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. مَا ظَهَرَ مِنْهَا এর ব্যাখ্যা চেহারা, দুই হাতের তালু এবং আংটি দ্বারা করেছেন। হযরত ইবনে উমর রাযি., হযরত আতা রাযি., হযরত ইকরামা রাযি. প্রমুখের মতও এটি। (আযওয়াউল বায়ান ফী ইযাহিল কুরআনি বিল কুরআন ২৭/২৮১)

যারা বলেন, মুখমণ্ডল আবৃত রাখা মুস্তাহাব বা বর্তমানে যারা বলেন, মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ নয়, তারা ইবনে আব্বাস রাযি.-এর ব্যাখাটিকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে থাকেন। তবে ইবনে আব্বাস রাযি.-এর ব্যাখ্যাটিকে মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ না হওয়ার পক্ষে দলীল হিসেবে গ্রহণ করা কয়েকটি কারণে যথার্থ নয়।

(ক) زينة (সৌন্দর্য) এর ব্যাখ্যা মুখমণ্ডল এবং উভয় হাতের তালু দ্বারা করাটা বাস্তব-সম্মত নয়। কারণ زينة বলা হয়, ما تتزين به المرأة ঐ উপাদানকে যদ্দ¦ারা নারীরা সাজসজ্জা অবলম্বন করে থাকে। যেমন, অলঙ্কার, বস্ত্র ইত্যাদি। আর সেটা নারীদের শারীরিক কোনো অংশ নয়। সুতরাং زينة-এর ব্যাখ্যা নারীদের শরীরের কোনো অংশ তথা মুখমণ্ডল বা উভয় হাতের তালু দ্বারা করা বাস্তবতা পরিপন্থী। আর এ ব্যাখ্যার সমর্থনে শক্তিশালী কোনো দলীলও পাওয়া যায় না। বরং এর বিপক্ষে সুস্পষ্ট দলীল রয়েছে। যাতে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত যে, মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ।

(খ) কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াতে زينة শব্দটি ব্যবহার হয়েছে, সেখানে যীনাত দ্বারা সাজসজ্জার উপকরণ উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। সুসজ্জিত বস্তুর কোনো অংশ উদ্দেশ্য নেয়া হয় নি। যেমন,

১. خُذُوا زِينَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ

‘হে বনী আদম! তোমরা নামাযের সময় সাজসজ্জা গ্রহণ কর।’ (‘সূরা আ’রাফ’- ৩১)

২. الْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا

‘ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্তুতি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য।’ (‘সূরা কাহাফ’- ৪৬)

৩. وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِنْ زِينَتِهِنَّ

‘তারা যেন তাদের গোপন সাজসজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে।’ (‘সূরা নূর’- ৩১)

৪. وَلكِنَّا حُمِّلْنَا أَوْزَارًا مِنْ زِينَةِ الْقَوْمِ

‘কিন্তু আমাদের উপর ফিরাউনীদের অলঙ্কারের বোঝা চাপিয়ে দেয়।’ (‘সূরা ত্বাহা’- ৮৭)

৫. وَمَا أُوتِيتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَمَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَزِينَتُهَا

‘তোমাদের যা কিছু দেয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের ভোগ ও শোভা বৈ কিছুই নয়।’ (‘সূরা ক্বাসাস’- ৬০)

৬. إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى الْأَرْضِ زِينَةً لَهَا

‘আমি পৃথিবীস্থ সবকিছুকে পৃথিবীর জন্য শোভা করেছি।’ (‘সূরা কাহাফ’- ৭)

৭. قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ

‘আপনি বলুন, আল্লাহর সাজসজ্জা যা তিনি বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে?’ (‘সূরা আ’রাফ’- ৩২)

এছাড়া অন্যান্য আয়াতে زينة দ্বারা সাজসজ্জার উপকরণ উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছে। আর এটা শতসিদ্ধ কথা, উপকরণ কখনো মূল অবয়বের অংশ হয় না। কুরআনে কারীমে زينة শব্দটি ব্যাপকভাবে এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং বিরোধপূর্ণ স্থানে ঐ অর্থই উদ্দেশ্য নেয়া হবে যা কুরআনে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে।

(গ) ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, ইবনে আব্বাস রাযি. يدنين عليهن-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, নারীরা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হলে একটি চক্ষু ব্যতীত পুরো শরীর আবৃত করে বের হবে। আর এখানে الا ما ظهر منها এর ব্যাখ্যায় তিনি মুখমণ্ডল এবং উভয় হাতের তালু খোলা রাখার কথা বলবেন এতে তো স্ববিরোধী বক্তব্য প্রমাণিত হয়। মূলত তার দুটি ব্যাখ্যার মাঝে কোনো বিরোধ নেই। কারণ আল্লামা ইবনে জারীর রহ. সহীহ সূত্রে ইবনে আব্বাস রাযি. এ একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। বর্ণনাটি হলো

حدثنى على قال حدثنا عبد الله قال حدثنى معاوية عن على عن ابن عباس ولا يدنين زينتهن الا ما ظهر منها قال الزينة الظاهرة الوجه وكحل العين وخضا الكف والخاتم فهذه تظهر فى بيتها لمن دخل من الناس عليها.

অর্থ : ইবনে আব্বাস রাযি. ولا يدنين زينتهن الا ما ظهر منها ‘তারা তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়াবে না। তবে যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় তার কথা ভিন্ন’ এর ব্যাখ্যায় বলেন, দৃশ্যমান সৌন্দর্য হলো মুখমণ্ডল, চোখের সুরমা, হাতের মেহেদী এবং আংটি। সুতরাং নারীরা তাদের গৃহে যে সকল লোক প্রবেশ করে তাদের সামনে এগুলো প্রকাশ করতে পারবে। (তাফসীরে ইবনে জারীর ত্ববারী ১২/১৮৬)

এই বর্ণনার দ্বারা উভয় বক্তব্যের বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে গেল। কারণ ইবনে আব্বাস রাযি. উক্ত বর্ণনায় সুস্পষ্টরূপে বলে দিয়েছেন, নারীরা মুখমণ্ডল এবং উভয় হাতের তালু তাদের গৃহে যারা প্রবেশ করে তাদের সামনেই শুধু প্রকাশ করতে পারবে। আর তারা হলেন মাহরাম। কারণ নারীগৃহে অপরিচিত লোকদের অবাধ প্রবেশকে কেউ বৈধ বলেন না। সুতরাং ইবনে আব্বাস রাযি.-এর ব্যাখ্যাকে মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ না হওয়ার পক্ষে দলীল হিসেবে পেশ করা সম্পূর্ণ ভুল ও অগ্রহণযোগ্য। এতে স্পষ্ট হয়ে গেল, ইবনে আব্বাস রাযি.-এর মতেও নারীদের জন্য তাদের মুখমণ্ডল পরপুরুষের সামনে অনাবৃত রাখা বৈধ নয়।

(ঘ) তাছাড়া যদি মেনেও নেয়া হয় যে, ما ظهر দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মুখমণ্ডল এবং উভয় হাতের তালু। তবুও আলোচ্য আয়াতাংশ দ্বারা মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ না হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয় না। কারণ আয়াতে অকর্মক ক্রিয়া ظهر ব্যবহার হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, নিজে নিজে প্রকাশ পাওয়া বা অনিচ্ছায় প্রকাশ হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা সকর্ম ক্রিয়া اظهر ব্যবহার করেননি। যার অর্থ হচ্ছে, ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ করা। সুতরাং এখন আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়, ‘নারীরা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করে বেড়াবে না। তবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের সৌন্দর্যের যে অংশ প্রকাশ হয়ে যায় তাতে কোনো ক্ষতি নেই।’ আর মুখমণ্ডল অনিচ্ছায় সাধারণত প্রকাশ হয় না। বরং ব্যক্তির ইচ্ছাক্রমেই প্রকাশ পেয়ে থাকে। হ্যাঁ, তারপরও যদি কখনো মুখমণ্ডল অনিচ্ছায় প্রকাশ হয়ে যায় বা শরীয়ত অনুমোদিত প্রয়োজনের স্বার্থে মুখমণ্ডল অনাবৃত করতে হয় তাতে কোনো সমস্যা নেই। (ইমদাদুল ফাতাওয়া ৪/১৮২)

উক্ত ব্যাখ্যাটি আল্লামা ইবনে কাসীর রহ.-এর তাফসীর দ্বারা সমর্থিত। তিনি বলেন,

وَلا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلا مَا ظَهَرَ مِنْهَا أي: لا يُظهرْنَ شيئا من الزينة للأجانب، إلا ما لا يمكن إخفاؤه.

অর্থ : তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করে বেড়াবে না। তবে তার (শরীরের) যে অংশ আড়াল করে রাখা অসম্ভব তার কথা ভিন্ন। অর্থাৎ নারীরা তাদের সৌন্দর্যের কোনো অংশই পরপুরুষের সামনে প্রকাশ করবে না। তবে সৌন্দর্যের যে অংশ আড়াল করে রাখা সম্ভব নয় তা প্রকাশ করতে পারবে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ১০/৩৯৬)

আর এ কথা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে, মুখমণ্ডল আড়াল করে রাখা অসম্ভব কিছু নয়; বরং খুবই সহজ। সুতরাং কুরআনে কারীমের পূর্বোল্লেখিত চারটি আয়াত দ্বারা সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণিত, মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ।

নারী চেহারা হিজাবের অংশ এ ব্যাপারে হাদীসের ভাষ্য

হাদীসের আলোকে হিজাব প্রসঙ্গ

১. হযরত আয়েশা রাযি. বর্ণনা করেন,

كان الركبان يمرون بنا ونحن مع رسول الله صلى الله عليه وسلم محرمات فإذا حاذوا بنا سدلت إحدانا جلبابها من رأسها على وجهها فإذا جاوزنا كشفناه.

অর্থ : আমরা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ইহরাম অবস্থায় ছিলাম। এ সময় আমাদের পাশ দিয়েই মানুষের বাহনগুলো চলাচল করছিল। যখন বাহনগুলো আমাদের কাছাকাছি চলে আসত তখন আমরা আমাদের চাদর চেহারার উপর টেনে দিতাম। আর যখন বাহনগুলো আমাদের থেকে দূরে চলে যেত তখন আমরা আমাদের চেহারা থেকে চাদর সরিয়ে নিতাম। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ১৮৩৩)

২. ইফ্কের ঘটনা সম্বন্ধে হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

সফওয়ান ইবনে মুআত্তাল রাযি. আমাকে দেখে চিনে ফেলে এবং সাথে সাথে ইন্না লিল্লাহ বলে ওঠে। এতে আমি জাগ্রত হয়ে যাই এবং তৎক্ষণাৎ আমি আমার ওড়না দ্বারা চেহারা ঢেকে নিই। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৪১৪১)

৩. হযরত জাবের রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

যখন তোমাদের কেউ কোনো নারীকে বিবাহের প্রস্তাব দিবে তখন যদি বিবাহের প্রতি উদ্বুদ্ধকারী কোনো কিছু দেখতে সক্ষম হয় তাহলে যেন সে দেখে নেয়। (মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ১৪৬২৬)

এ কথা সর্বজন বিদিত যে, বিবাহের প্রস্তাবকারীর জন্য মেয়ের মুখমণ্ডল, দুই হাত কব্জি পর্যন্ত ও দুই পা টাখনু পর্যন্ত দেখা বৈধ। সুতরাং যদি নারীদের জন্য মুখমণ্ডল ও উভয় হাতের তালু অনাবৃত রাখা বৈধ হত তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভিন্ন করে এগুলো দেখার নির্দেশ দিতেন না। এতে প্রমাণ হয়, নারীদের চেহারা হিজাবেরই অংশ।

৪. হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে এক নারীর ব্যাপারে আলোচনা করলাম, যাকে আমি বিবাহের প্রস্তাব দিতে আগ্রহী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যাও তুমি তাকে দেখে নাও। কারণ এটা তোমাদের মাঝে সুসম্পর্কের জন্য অধিক উপযোগী হবে। অতঃপর আমি এক আনসারী নারীর বাড়িতে আসলাম এবং তার পিতা-মাতার নিকট প্রস্তাব দিলাম। সাথে সাথে তাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ সম্পর্কে অবহিত করলাম। কিন্তু কেমন যেন তারা বিষয়টি অপছন্দ করল। মুগীরা ইবনে শু’বা রাযি. বলেন, এ বিষয়টি ঐ নারী ঘরের ভিতর থেকে শুনতে পেল। সে বলল, যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে দেখার নির্দেশ দিয়ে থাকেন তাহলে তুমি দেখ। অন্যথায় আমি তোমাকে আল্লাহর শপথ দিচ্ছি (তুমি তা কর না)। কেমন যেন তাকে দেখার বিষয়টি তার উপর অনেক বড়ো ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। (মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ১৮১৩৭)

৫. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

যে ব্যক্তি অহংকারবশত কাপড় হেঁচড়ে চলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তার দিকে তাকাবেন না। উম্মে সালামা রাযি. বললেন, তাহলে নারীরা তাদের আঁচল কিভাবে রাখবে? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তারা আঁচল এক বিঘত ঝুলিয়ে দিবে। উম্মে সালামা রাযি. বললেন, তাহলে তো নারীদের পদযুগল প্রকাশ পেয়ে যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে তারা এক হাত পরিমাণ ঝুলিয়ে দিবে। এর থেকে বেশি ঝুলাবে না। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ১৭৩১)

উক্ত হাদীসে পা ঢাকার ব্যাপারে এত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অথচ পায়ের থেকে চেহারা প্রদর্শন অধিক অনাচারের কারণ। কেননা যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, পুরুষরা নারীদের পায়ের সৌন্দর্যের প্রতি বেশি আসক্ত না চেহারার প্রতি? এর উত্তর এটাই আসবে যে, চেহারার প্রতি। সুতরাং যখন পা ঢাকার ব্যাপারে এত বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে তখন চেহারা ঢাকার গুরুত্ব কতটুকু তা বলাই বাহুল্য।

৬. হযরত ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

নারী জাতি গুপ্ত বিষয়। এরা বের হলে শয়তান উঁকি ঝুঁকি দিতে থাকে। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ১১৭৩)

৭. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

যদি তোমাদের কারো মুকাতাব গোলাম (অর্থের বিনিময়ে মুক্তি লাভের চুক্তিতে আবদ্ধ দাস) থাকে এবং ঐ গোলামের নিকট এ পরিমাণ অর্থ থাকে যার মাধ্যমে সে নিজেকে মুক্ত করতে পারে, তাহলে যেন নারী মনিব তার সাথে পর্দা করে চলে। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ৩৯২৮)

উক্ত হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হলো যে, নারী মনিবের জন্য গোলামের সামনে মুখমণ্ডল খোলা রাখা বৈধ যতক্ষণ গোলাম তার মালিকানায় থাকবে। যখন সে তার মালিকানা থেকে বের হয়ে যাবে তখন নারী মনিবের জন্য তার সাথে পর্দা করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। কেননা এখন সে অপরিচিত হয়ে গেছে। সুতরাং উক্ত হাদীসটি নারীদের পর্দা করা ওয়াজিব হওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে। (ইয়ানাতুল মুখতারীন বাইনান নিকাবি ওয়াল খিমার ১/১২)

৮. আসমা বিনতে আবু বকর রাযি. বলেন,

আমরা পুরুষদের সামনে মুখমণ্ডল আবৃত করে রাখতাম। (আল মুসতাদরাক লিলহাকিম ১/৪৫৪)

নারী চেহারা হিজাবের অংশ নয় বলে যারা মত প্রকাশ করেন তারা এর সপক্ষে কয়েকটি হাদীস দলীল হিসেবে পেশ করেন। যথা

১. হযরত আয়েশা রাযি. বর্ণনা করেন,

একবার হযরত আসমা রাযি. এমন অবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখোমুখি হলেন যে, তার পরিধেয় বস্ত্র ছিল একেবারে পাতলা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তার উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন এবং তার উদ্দেশ্যে বললেন, হে আসমা! যখন নারীরা বয়ঃসন্ধিকালে উপনীত হয় তখন তাদের এমন কাপড় পরিধান করা উচিত নয়, যার দ্বারা তাদের দেহের কোনো অংশ দৃষ্টিগোচর হয়, কেবলমাত্র এই অংশটি আর এই অংশটি ছাড়া। এ সময় তিনি চেহারা এবং হাতের তালুর দিকে ইঙ্গিত করেন। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ৪১০৬)

২. মুযদালিফা থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রত্যাবর্তনের ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে হযরত আলী রাযি. বর্ণনা করেন,

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফযল ইবনে আব্বাস রাযি. কে নিজের বাহনের পিছনে বসিয়ে নিলেন। অতঃপর তিনি জামরার (শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের স্থানের) কাছে চলে আসেন। এখানে তিনি রমী (পাথর নিক্ষেপ) করেন। এরপর তিনি চলে আসলেন কুরবানী করার স্থানে। এ বর্ণনাতেই এ কথা বর্ণিত আছে, খাসআম গোত্রের এক যুবতী নারী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা একেবারে বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। তার উপর হজ ফরয হয়েছে। যদি আমি তার পক্ষ থেকে হজ আদায় করে নেই, তাহলে কি তিনি দায়মুক্ত হবেন? জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, পিতার পক্ষ থেকে তুমি হজ আদায় করে নাও। এ কথার ফাঁকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ফযল ইবনে আব্বাস রাযি.-এর চেহারা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ৮৮৫)

সহীহ বুখারীর বর্ণনায় আছে,

ফযল ইবনে আব্বাস সেই নারীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। যুবতীর রূপ তাকে বিমোহিত করে ফেলল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রশ্নের জবাব দিবেন এই মুহূর্তে লক্ষ্য করলেন, ফযল ইবনে আব্বাস তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের হাত পেছনে নিয়ে ফযল ইবনে আব্বাস রাযি.-এর চিবুক ধরে তার মুখমণ্ডল যুবতীর দিক থেকে ফিরিয়ে দিলেন। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৬২২৮)

৩. হযরত সাহল ইবনে সা’দ রাযি. থেকে বর্ণিত,

এক নারী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি নিজেকে আপনার জন্য হেবা করার উদ্দেশ্যে এসেছি। এ কথা শুনার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ নারীর দিকে তাকালেন এবং তার আপাদমস্তক ভালোভাবে দেখে নিয়ে দৃষ্টি নি¤œগামী করলেন এবং নিজের শির মুবারক অবনত করে ফেললেন। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৫১২৫)

৪. হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত,

এক নারী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করার জন্য আসল। তার হাতে মেহেদি লাগানো ছিল না। ফলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে নারী হাতে মেহেদি লাগানোর আগ পর্যন্ত তাকে বাইয়াত করেন নি। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ; হা.নং ১৭২)

উপরোক্ত হাদীসগুলোর বক্তব্য বিষয়ে কিছু কথা

১. উসূলবিদগণের একটি উসূল বা মূলনীতি রয়েছে যে,

ان الاصل بقاء الشئ على ما كان عليه فاذا وجد الدليل على الناقل عن الاصل دل ذلك على طروء الحكم على الاصل وتغييره له.

অর্থ : বিষয়টি যেভাবে ছিল তাকে সেভাবেই রেখে দেয়াই মূলনীতির দাবি। তবে এর বিপরীতে যদি দলীল উপস্থিত করা যায় তাতে প্রমাণিত হবে যে, মূল অবস্থাটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন নতুন বিধান আরোপিত হবে।

সুতরাং উক্ত মূলনীতির আলোকে উপরোক্ত হাদীসসমূহকে মুখমণ্ডল খোলা রাখা বৈধ হওয়ার সপক্ষে দলীল হিসেবে পেশ করার অবকাশ নেই। কারণ ইসলামের শুরু যুগে নারীদের স্বাভাবিক অবস্থা ছিল মুখমণ্ডল খোলা রাখা। সুতরাং মুখমণ্ডল খোলা রাখা ছিল নারীদের আসল অবস্থা। এ হিসেবে নারীদের মুখমণ্ডল খোলা রাখা বৈধ হওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, আসল অবস্থা পরিবর্তন হওয়ার উপর বহু দলীল বিদ্যমান রয়েছে, যেগুলো নারীদের মুখমণ্ডল আবৃত রাখার নির্দেশ বহন করে। তাছাড়া অপর একটি মূলনীতি রয়েছে المثبت مقدم على النافى তথা যে দলীল নতুন কোনো বিধান প্রবর্তন হওয়াকে প্রমাণ করে সে দলীল ঐ দলীলের উপর প্রাধান্য পাবে যে দলীল নতুন কোন বিধান প্রবর্তন হওয়াকে প্রমাণ করে না। উক্ত মূলনীতির আলোকে যে সকল আয়াত এবং হাদীসসমূহ মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ হওয়াকে প্রমাণ করে সে সকল আয়াত এবং হাদীস ঐ সকল হাদীস ও দলীলের উপর প্রাধান্য পাবে যেগুলো মুখমণ্ডল হিজবের অংশ হওয়ারকে প্রমাণ করে না।

এ পর্যায়ে আমার উপস্থাপিত হাদীসগুলো নিয়ে দু’ একটি কথা আরজ করব

১. প্রথম হাদীসটি দলীল হিসেবে উপযোগী নয়। কারণ ইবনে কাসীর রহ. বলেন,

আবু দাউদ এবং আবু হাতেম রাযী রহ.-এর বর্ণনা সূত্রকে বিচ্ছিন্ন বলেছেন। কারণ হাদীসটির বর্ণনাকারী খালেদ ইবনে দারীক আয়েশা রাযি.-এর সাক্ষাৎ পায় নি। উক্ত হাদীসের সূত্রে আবু আব্দুর রহমান সাঈদ ইবনে বাশীর বসরী নামক একজন বর্ণনাকারী আছেন। যার ব্যাপারে রিজাল শাস্ত্রের একাধিক উলামায়ে কেরাম কালাম (শাস্ত্রীয় অভিযোগ) করেছেন।

হাফেয আবু আহমদ আল জুরজানী হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন,

সাঈদ ইবনে বাশীর ছাড়া অন্য কেউ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন বলে আমি জানি না এবং সে একবার আয়েশা রাযি.-এর স্থানে উম্মে সালামা রাযি.-এর নাম উল্লেখ করেছে। অর্থাৎ তিনি ইজতেরারের দোষে দুষ্ট।

আল্লামা শানকীতী রহ. আযওয়াউল বায়ান-এর ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৫৯৭ পৃষ্ঠায় লেখেন,

হাদীসটি দুই দিক দিয়ে দুর্বল। (১) হাদীসটির সূত্র বিচ্ছিন্ন। কেননা খালেদ ইবনে দারীক আয়েশা রাযি. থেকে হাদীসটি শোনেন নি, যেমনটি আবু দাউদ এবং আবু হাতেম রাযী রহ. বলেছেন। (২) উক্ত হাদীসের সূত্রে সাঈদ ইবনে বাশীর রয়েছেন যাকে ইবনে হাজার রহ. আত-তাকরীবে (ضعيف) দুর্বল বলে অভিহিত করেছেন। সাথে সাথে হিজাবের বিধান ব্যাপক হওয়ার ব্যাপারে যে সকল দলীল উল্লেখ করা হয়েছে তার বিপরীতে হাদীসটির অবস্থান খুবই দুর্বল। সর্বশেষ তিনি বলেন, হাদীসটি যে স্তরের তাতে এর দ্বারা দলীল পেশ করা যায় না। বিশেষ করে স্পর্শকাতর এ বিষয়ের ক্ষেত্রে। (আল ই’লাম বিনক্দিল হালালি ওয়াল হারাম; পৃষ্টা ৪৫-৪৬)

২. উপস্থাপিত দ্বিতীয় হাদীসটির উত্তরে শাইখ সালেহ ফাউযান রহ. বলেন,

এটা একটা আশ্চর্য ধরনের দলীল। কারণ প্রতিপক্ষ যা প্রমাণ করতে চেয়েছেন হাদীসটি এর বিপরীত জিনিস প্রমাণ করে। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো ফযল ইবনে আব্বাস রাযি.-কে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দেন নি। বরং চেহারা ঘুরিয়ে দিয়েছেন। যদি পরনারীর চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকা বৈধ হতো তাহলে কীভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৈধ বিষয় থেকে বারণ করলেন?

ইমাম নববী রহ. উক্ত হাদীসের উপকারিতা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেন,

ومنها تحريم النظر الى الاجنبية অর্থাৎ উক্ত হাদীস থেকে এ কথাটি প্রমাণিত হয় যে, পরনারীর দিকে দৃষ্টি দেওয়া হারাম। ومنها ازالة المنكر باليد لمن امكنه অর্থাৎ উক্ত হাদীস থেকে এ বিষয়টিও প্রমাণ হয় যে, সক্ষম ব্যক্তির জন্য কর্তব্য হলো, শরীয়ত গর্হিত কাজ হাত দ্বারা প্রতিহত করা।

আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রহ. তার কিতাব রওযাতুল মুহিব্বীন-এর ১০২ পৃষ্ঠায় লেখেন,

وهذا منع وانكار بالفعل فلو كان النظر جائز لاقره عليه অর্থাৎ এটা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন এবং কাজের মাধ্যমে নিষেধকরণ। সুতরাং যদি দৃষ্টি দেওয়া জায়েয হতো তাহলে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দিতেন।

আল্লামা শানকীতী রহ. উক্ত দলীলের উত্তর দু’ ভাবে দেন। যার সারমর্ম হলো, (ক) কোনো হাদীসেই স্পষ্টভাবে এ বিষয়টি নেই যে, ঐ নারীর চেহারা খোলা ছিল এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার চেহারা খোলা দেখে তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। বরং হাদীসে সর্বোচ্চ এতটুকু আছে যে, সে নারী উজ্জ্বল ছিল। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে حسناء তথা খুব সুন্দরী ছিল। আর উজ্জ্বল বা সুন্দরী হওয়া এ বিষয়টি আবশ্যক করে না যে, তার চেহারা খোলা ছিল এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে এর উপর বহাল রেখেছেন। বরং কখনো কখনো অনিচ্ছায় চেহারার খুলে যায় ফলে অনিচ্ছায় কেউ দেখে ফেলে। অথবা এটাও হতে পারে যে, পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে তার সৌন্দর্য সম্পর্কে অবগত হয়েছিল। তাছাড়া নারীদের সৌন্দর্য বোঝার জন্য চেহারা খোলা থাকা জরুরি নয়। বরং হাতের আঙ্গুল দ্বারাই মহিলাদের সৌন্দর্য ও উজ্জ্বলতা অনুধাবন করা যায়।

(খ) ঐ নারী ইহরাম রত ছিলেন। আর ইহরাম অবস্থায় নারীদের জন্য চেহারা এবং উভয় হাতের তালু খোলা রাখা বৈধ যদি কোনো পরপুরুষ সেখানে বিদ্যমান না থাকে। হ্যাঁ, যদি সেখানে কোনো পুরুষ থাকে তাহলে চেহারা আবৃত রাখা আবশ্যক। যেমনটি উম্মাহাতুল মুমিনীনদের আমল ছিল। আর এ কথাও কেউ বলে নি যে, ঐ নারীকে ফযল ইবনে আব্বাস রাযি. ছাড়া অন্য কেউ দেখেছেন। আর ফযল ইবনে আব্বাস রাযি.-কে তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারণই করেছেন। সুতরাং উল্লিখিত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হলো যে, ঐ নারী ইহরামরত ছিলেন। ফলে তিনি মুখমণ্ডল অনাবৃত করেছেন মুহরিম হওয়ার কারণে। মুখমণ্ডল অনাবৃত রেখে সফরে বের হওয়া বৈধ এই জন্য নয়। অবশেষে তিনি বলেন,

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফযল ইবনে আব্বাসের চেহারা ঘুরিয়ে দেয়ার দ্বারা এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, কোনো যুবতী নারীর দিকে অপরিচিত পুরুষ ব্যক্তিকে তাকিয়ে থাকতে দেয়া যাবে না। আর পূর্বোক্ত দলীলসমূহ নারীদের সমস্ত শরীর ঢেকে রাখা আবশ্যক হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে। (আল ই’লাম বিনক্দিল হালালি ওয়াল হারাম; পৃষ্ঠা ৪৬-৪৮)

৩. তাদের উপস্থাপিত তৃতীয় হাদীসের উত্তর হলো, ঐ নারী নিজেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে পেশ করেছেন যাতে তিনি তাকে বিবাহ করে নেন। ফলে সে তার মুখমণ্ডল প্রকাশ করেছে। যাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখে নিতে পারেন। (আর এতে তো কোনো সমস্যা নেই) কারণ এটা বিবাহের উদ্দেশ্যে প্রস্তাবকারীর পক্ষ থেকে প্রস্তাবকৃত নারীর প্রতি দৃষ্টি দান। আর এটা তো শরীয়তসম্মত। সুতরাং এটা তাদের বিপক্ষে দলীল। যেমনটি হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন,

وفيه جواز تأمل محاسن المرأة لارادة تزويجها যার মর্ম হলো, বিবাহের উদ্দেশ্যে প্রস্তাবকারীর জন্য প্রস্তাবকৃত নারীর চেহারা ও উভয় হাতের তালুর দিকে তাকানো বৈধ। এছাড়া অন্য অঙ্গের প্রতি তাকানো বৈধ নয়। (আদিল্লাতু তাগতিয়াতিল ওয়াজহি মিনাল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ ১/৬)

তেরো শতাব্দী পর্যন্ত নারীরা মুখমণ্ডল অনাবৃত রেখে বের হতো না। এ ব্যাপারে কতক বিজ্ঞ আলেমের মতামত নি¤েœ পেশ করা হলো

১. ইমাম আবু হামেদ গাযালী রহ. (মৃত্যু ৫০৫হি.) বলেন,

لم يزل الرجال على حمد الزمان مكشوفى الوجوه والنساء يخرجن منتقبات.

অর্থ : যুগ যুগ ধরে পুরুষরা মুখমণ্ডল খোলা রেখে আসছে এবং নারীদের নেকাব পরিহিত অবস্থায় বের হওয়ার প্রচলন চলে আসছে। (ইয়াহইয়াউ উলূমিদ্দীন ১/৭২৯)

২. ইবনে হাইয়্যান আন্দালুসী রহ, বলেন,

وكذا عادة بلاد الأندلس، لا يظهر من المرأة إلا عينها الواحدة.

অর্থ : আন্দালুস শহরের অবস্থাও এমনই। সেখানের নারীরা শুধুমাত্র তাদের একটি চক্ষু প্রকাশ করত। (আলবাহরুল মুহীত ৭/২৫০)

৩. আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন,

استمرار العمل على جواز خروج النساء إلى المساجد والاسواق والاسفار منتقبات لئلا يراهن الرجال.

অর্থ : নারীদের মসজিদ, বাজার এবং সফরে নেকাব পরিহিত অবস্থায় বের হওয়ার আমল যুগ পরম্পরায় চলে এসেছে। যাতে করে পুরুষরা তাদের না দেখতে পারে। (ফাতহুল বারী ৯/৩৩৭)

মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ এ ব্যাপারে জগদ্বিখ্যাত কতক আলেমের ফতওয়া ও উক্তি নি¤েœ প্রদত্ত হলো

১. ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,

সঠিকতর সিদ্ধান্ত এই যে, নারীর জন্য পুরুষের সামনে দুই হাত, দুই পা ও মুখমণ্ডল খোলা রাখার অবকাশ নেই। (মাজমাউল ফাতাওয়া ২২/১১৪)

২. শাইখ ইবনে বায ও শাইখ ইবনে উসাইমিনও একই ফতওয়া দিয়েছেন। (রিসালাতুন ফিল হিজাব; পৃষ্ঠা ১৭, ফাতাওয়া উলামাই বালাদিল হারামাইন; পৃষ্ঠা ১১৬৯)

৩. ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,

মুখমণ্ডল এটা নামাযের ক্ষেত্রে সতর নয়। তবে এটা দৃষ্টি দেয়ার ক্ষেত্রে সতর। কেননা চেহারার দিকে তাকানো জায়েয নেই। (আল ফাতাওয়া আলকুবরা ৪/৪০৯)

৪. ইবনুল কাইয়িম জাওযী রহ. বলেন,

সতর দু’ প্রকার। (১) নামাযের ক্ষেত্রে সতর (২) দৃষ্টি দেয়ার ক্ষেত্রে সতর। সুতরাং স্বাধীন নারীরা চেহারা এবং উভয় হাতের তালু খোলা রেখে নামায আদায় করতে পারবে। তবে বাজারে বা লোকালয়ে চেহারা ও উভয় হাতের তালু খোলা রেখে বের হওয়ার অবকাশ নেই। (ই’লামুল মুয়াক্কিয়ীন ২/৮০)

৪. আল্লামা ইবনে রাসলান রহ. চেহারা অনাবৃত রেখে নারীদের বের হওয়া নিষেধ হওয়ার উপর মুসলমানদের ঐক্যমতের কথা উদ্ধৃত করেছেন। (নাইলুল আওতার লিশ্ শাউকানী ৬/১১৪)

উল্লেখ্য, এখানে উপমাস্বরূপ বিশিষ্ট কয়েকজন উলামায়ে কেরামের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। নতুবা এর তালিকা বেশ নাতিদীর্ঘ। এখানে এ বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য, এ তালিকায় ভারত উপমহাদেশের উলামায়ে কেরামের নাম উল্লেখ করা হয় নি। এর কারণ হলো, যেসব সুহৃদ বন্ধু মুখমণ্ডল হিজাবভুক্ত নয় বলে প্রচারণা চালান তারা তাদের সপক্ষে আরবের কিছু উলামায়ে কেরামের নাম ব্যবহার করে থাকেন। এজন্য আমাদের তালিকায় ঐ সমস্ত বরেণ্য উলামায়ে কেরামের নাম স্থান পেয়েছে যারা আমাদের সেসব সুহৃদ বন্ধুদের নিকটও বরেণ্য হিসেবে স্বীকৃত। তাছাড়া ভারত উপমহাদেশের স্বীকৃত উলামায়ে কেরাম মুখমণ্ডল হিজাবের অন্তর্ভুক্ত বলে ঐমত্য পোষণ করে থাকেন।

সারকথা, কুরআনে কারীমের মাধ্যমে নারীদেরকে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা নিজেদের ঘরেই অবস্থান করবে। প্রয়োজন ছাড়া ঘর হতে বের হবে না। যদি কোনো শরঈ প্রয়োজনে তাদের ঘর থেকে বের হতে হয়, তাহলে তাদের ক্ষেত্রে নির্দেশ হলো, তারা বোরকা, ওড়না ইত্যাদি দ্বারা পুরো দেহ ঢেকে নিবে। এমনকি তারা মুখমণ্ডলও খোলা রাখবে না। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে সামান্য ব্যতিক্রম করার অবকাশ রয়েছে। যথা, মুখমণ্ডল খোলার এমন তীব্র প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় যে, তা ঢেকে রাখলে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। উদাহরণত তীব্র ভিড়ের মধ্যে চলাফেরা করার সময় কিংবা সাক্ষ্য ইত্যাদি প্রদান করার ক্ষেত্রে। এসব ক্ষেত্রে চেহারা খোলা রাখার অবকাশ রয়েছে।

সর্বশেষ নিবেদন এই যে, শরীয়তের কোনো স্বীকৃত বিধান সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর ফতওয়া প্রদানের পরিণাম খুবই ভয়াবহ। কিন্তু এই ভয়াবহ কাজই এখন ব্যাপকভাবে হচ্ছে। এজন্য দীনদার ভাই-বোনদের অবশ্য কর্তব্য হলো, তথাকথিত আলেম, মিডিয়া ও প্রচার মাধ্যমগুলোর যে কোনো কথা বা লেখায় প্রভাবিত না হওয়া। যেসব ক্ষেত্রে সংশয় সৃষ্টি হবে সেসব ক্ষেত্রে বিজ্ঞ ও খোদাভীরু আলেমের শরণাপন্ন হবেন। মূলত আমাদের সকলকে আল্লাহর দরবারে হাযির হতে হবে এবং প্রতিটি কথা ও কাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে।

লেখক

শিক্ষক, মাহাদুল বুহুসিল ইসলামিয়া

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *