মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম
আল্লাহ তা‘আলা মানুষের হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে অনেক নবী রাসূল পাঠিয়েছেন। সর্বশেষ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রিসালাতের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তারপর আর কোনো নবী আসবেন না। নবুওয়াতের এই বিরাট দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়ার জন্য এক শক্তিশালী কর্মদক্ষ জামাআতের প্রয়োজন। উম্মতের হাজারো মানুষের মধ্যে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উলামায়ে কেরামের জামাআতকে নির্বাচন করেছেন। নবীর পর নবুওয়াতের সমস্ত কাজ আঞ্জাম দিবেন হযরত উলামায়ে কেরাম। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
العلماء هم ورثة الأنبياء
অর্থ; নিশ্চয়ই উলামায়ে কেরাম নবীগণের ওয়ারিস। -সহীহ বুখারী; হাদীস ৬৭।
যতদিন উলামায়ে কেরাম পৃথিবীতে থাকবেন, ততদিন পৃথিবী টিকে থাকবে। যখন আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবী ধ্বংস করে কিয়ামত সংঘটিত করার ইচ্ছা করবেন, তখন প্রথমে দুনিয়া থেকে ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে। কাগজের কালো কালি সাদা করে কিংবা কুরআন শরীফ গায়েব করে দিয়ে ইলম উঠাবেন না। ধীরে ধীরে হক্কানী উলামায়ে কেরামকে উঠিয়ে নিবেন। উলামাদের বিদায় মানে ইলমের বিদায়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إن الله لا يقبض العلم انتزاعا ينتزعه من العباد ولكن يقبض العلم بقبض العلماء حتى إذا لم يبق عالما اتخذ الناس رءوسا جهالا فسئلوا فأفتوا بغير علم فضلوا وأضلوا
অর্থ; আল্লাহ তা‘আলা হঠাৎ করে এই ইলম বান্দাদের থেকে ছিনিয়ে নেবেন না। বরং উলামাদেরকে উঠানোর দ্বারা ইলম উঠিয়ে নেবেন। এক পর্যায়ে যখন কোনো আলেম থাকবে না, তখন মানুষ মুর্খ লোকদেরকে নেতা বানিয়ে নিবে। তারা না জেনে ইসলামের বিধি বিধান বর্ণনা করবে। ফলে নিজেরাও গোমরাহ হবে। অন্যদেরকেও গোমরাহ করবে। -সহীহ বুখারী; হাদীস ১০০।
এর দ্বারা পরিস্কার বুঝা যায় যে, উলামাদের মৃত্যু কিয়ামতের আলামত। কিয়ামত যত নিকটবর্তী হবে, উলামাদের মৃত্যু তত বাড়তে থাকবে। উলামাদের মৃত্যুর মাধ্যমেই পৃথিবী সংকুচিত হয়ে আসবে। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
أو لم يروا أنا نأتي الأرض ننقصها من أطرافها
অর্থ; তারা কি দেখে না যে, আমি যমীনকে চতুর্দিক দিয়ে সংকুচিত করে আনছি। -সূরা রা’দ; আয়াত ৪১।
হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. ও মুজাহিদ রহ. এই আয়াতের তাফসীরে বলেন, উলামাদের মৃত্যুর দ্বারা দুনিয়া সংকুচিত হয়ে আসবে। -তাফসীরে ইবনে কাসীর।
যখন অধিক হারে আলেমদের ইন্তেকাল হবে, তখন মানুষ দীনের রাহবারহারা হয়ে যাবে। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ঘুরতে থাকবে। দীনের ব্যাপারে কোনো রাহবারী না পেয়ে জাহান্নামের পথে ধাবিত হতে থাকবে। এজন্য আলেমরা পৃথিবীতে জীবিত থাকা আমাদের জন্য এক মহা নেয়ামত। তাদের মৃত্যু আমাদের জন্য বদ কিসমতী। মানুষের মৃত্যুতে পার্থিব কিছু ক্ষতি হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু উলামায়ে কেরামের মৃত্যুতে দীনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়। এজন্যই আল্লাহর রাসূল বলেন, আলেমের মৃত্যু এমন মসীবত যার প্রতিকার নেই। এমন ক্ষতি যা পূরণ হয় না। এরা এমন তারকা যার মৃত্যুতে পৃথিবী আলোহীন হয়ে যায়। একজন আলেমের মৃত্যু অপেক্ষা একটি গোত্রের মৃত্যু অতি নগণ্য। -সুনানে বাইহাকী, ৩/১৫৭।
এ হাদীসে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ আছে, একটি গোত্রের সকল মানুষ মৃত্যুবরণ করলে যতটা ক্ষতি হয়, একজন আলেমের মৃত্যুতে তারচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়। হযরত সাঈদ ইবনে যুবায়ের রহ. কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল- বনী আদম ধ্বংস হওয়ার আলামত কী? তখন তিনি জবাবে বলেন, তাদের উলামাদের মৃত্যুই তারা ধ্বংস হওয়ার আলামত। -তাহযীবুল কামাল, ১০/৩৬৫।
বর্তমানে আমাদের দেশের বড় বড় উলামায়ে কেরামকে আমরা হারিয়েছি। খুব কাছাকাছি সময়ে বহু সম্মানিত বুযুর্গ ব্যক্তিবর্গের ছায়া আমাদের মাথার উপর থেকে উঠে গেল। শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী, আল্লামা নূর হুসাইন কাসেমী, মুফতী ওয়াক্কাস সাহেব সহ আরও বহু উলামায়ে কেরাম আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছেন। কিছুদিন পূর্বে কওমী অঙ্গনের শীর্ষ মুরুব্বী আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী সাহেব ও কয়েকদিন আগে মুফতী আব্দুস সালাম চাটগামী সাহেব রহ. আমাদেরকে আলবিদা জানিয়ে পরপারে চলে গেলেন।
দেশের বাইরেও বহু উলামায়ে কেরাম ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছেন। দারুল উলূম দেওবন্দের দিকে তাকালে বুকের ভেতরে কামড় দিয়ে ওঠে। কয়েকদিনের ব্যবধানে ইলমী সাগরের দক্ষ ডুবুরীদেরকে হারালাম। মুফতী জামীল আহমদ সাকরোডাভী, মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী, আল্লামা হাবীবুর রহমান আযমী, হযরত নূর আলম খলীল আমীনি, মাওলানা আবদুল খালেক সাম্ভলীসহ আরও অনেক উলামায়ে কেরাম ওপারে চলে গেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের সবাইকে জান্নাতুল ফেরদাউসের আ’লা মাকাম নসীব করেন। আমাদের জন্য তাদের নি’মাল বদল (উত্তম প্রতিদান) দান করেন। এ সময় আমাদের বিশেষ করণীয় হল, তাদের জন্য বেশী বেশী ইসালে সওয়াব করা। তাদের রেখে যাওয়া আদর্শ মজবুত ভাবে আকড়ে ধরা। নিজেরা তাদের যোগ্য অনুসারী হয়ে তাদের শূণ্যতা পূরণের চেষ্টা করা।