মুফতী হাফিজুর রহমান
আমাদের জাতীয় দৈনিকগুলোতে সপ্তাহে একদিন হলেও ইসলামী বিষয়ের জন্য একটি পাতা বরাদ্দ রাখা হয়। এটি একটি ইতিবাচক ও আশাব্যাঞ্জক দিক। কিন্তু সেখানে ইসলাম বিষয়ে যে যাই লিখবে তাই কোন বাছ বিচার ব্যতিরেকে ছেপে দেয়াটা নিতান্তই আপত্তিকর একটি বিষয়। লেখকের ইসলাম বিষয়ে বিশুদ্ধ একাডেমিক বিদ্যা আছে কিনা- কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে অনুসন্ধিৎসু মানসিকতা লালন করার গরজবোধ করেন না। সমাজে ধর্মহীনতা এবং ধর্মের নামে কূপমুণ্ডকতার বিষবাষ্প মূলত এভাবেই ছড়ায়। সব ক্ষেত্রে বাকস্বাধিনতা বা চারু স্বাধীনতার উদার নীতি গ্রহণ করার পরিণতি খুব একটা ভালো হয় না। রাইহান-নির্ঝর যুগলের নিবন্ধটি এ জাতীয় একটি অতি বিতর্কিত নিবন্ধ। এতে ইসলামের শাশ্বত পর্দা বিধান সম্পর্কে পাঠকবৃন্দকে ভুল বার্তা দেয়া হয়েছে। এ ভুলের দায় কি পত্রিকা কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারবেন? আল্লাহর কাঠগড়ায় এ ভুলের কী জবাব দেবেন তা কি একটি বারও ভেবে দেখেছেন?
লেখক যুগল নিবন্ধের গৌরচন্দ্রিকায় মার্জিত পোষাক পরিহিতা অনার্সের পার্টটাইম চাকুরিজীবি এক শিক্ষার্থীকে টেনে এনেছেন। লেখক যুগল বলেন,
…এখন সোনিয়াকে যদি বলা হয় আপনাকে বোরকা পরতে হবে। যেহেতু আপনি মুসলমান। আপনাকে চেহারা ঢেকে পথ চলতে হবে। কেননা আপনি মুসলমান। এ অবস্থায় সোনিয়ার করণীয় কি? সে কথাই বলছি। এক. মুসলমান মেয়েদের কি ঘরের বাইরে বোরকা পরা আবশ্যক? দুই. মুসলমান মেয়েদের চেহারা ঢেকে ঘর থেকে বেরোতে হয় এটা কি অবশ্য করণীয়?
এরপর লেখকদ্বয় প্রশ্ন দু’টির সমাধান দিতে যথাসাধ্য কসরত করেছেন এবং সমাধানপত্রে কুরআন, হাদীস এবং ইসলামী শরীয়ার অন্যান্য সূত্র-উদ্ধৃতির প্রাচুর্য ঘটিয়েছেন। এতে করে জনাবদ্বয় ইসলাম বিষয়ে তাদের জ্ঞানিক সক্ষমতার জানান দিতে চেষ্টা করেছেন। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে লেখকদ্বয় বলেছেন,
শব্দটির উৎপত্তি আরবী ‘বুরকুউন’ শব্দ থেকে। যার অর্থ, অবগুন্ঠন। বিকৃত অর্থে মেয়েদের পর্দা রক্ষক পরিচ্ছেদ।
লেখকদ্বয় বলেছেন, বোরকা বা বুরকু বিকৃত অর্থে, মেয়েদের পর্দা রক্ষক পরিচ্ছদ। তাহলে বোরকা এর অবিকৃত অর্থ বা প্রকৃত অর্থটা কি? লেখকদ্বয়ের কথাটিকে যদি আমরা বিপরীত দিক থেকে গ্রহণ করি তবে বোরকা এর অবিকৃত অর্থ দাঁড়ায়, এমন পরিচ্ছদ যা মেয়েদের পর্দা রক্ষক নয়। আরেকটু খুলে বললে, লেখকদ্বয়ের মতে বোরকা পরিধান করলে পর্দা পালিত হবে না। যেহেতু এটা প্রকৃত অর্থে পর্দা রক্ষক পরিচ্ছদ নয় তাই এতে পর্দা বিধান পালিত হবার কথা নয়। জানি না, লেখকদ্বয় এমন ব্যাখ্যা লালন করেন কিনা।
নিবন্ধের তৃতীয় কলামে লেখকদ্বয় বলেছেন,
যারা বোরকা পরে সবাইকে আমি মন্দ বলছি না। আপনি ঢিলে ঢালা বোরকা তৈরি করে তা পরে পথ চলুন।
লেখকদ্বয়ের এ বক্তব্যে প্রতীয়মান হয়, তারা বোরকাকেও পর্দা রক্ষক পরিচ্ছদ মনে করেন। অথচ তাদের পেছনের বক্তব্য বলিষ্ঠভাবে প্রমাণ করে, বোরকা পর্দা রক্ষক পরিচ্ছদ নয়।
হিজাব তথা মস্তকাবরণ ওড়নায় পর্দা বিধান পালিত হবে কিনা- এ বিষয়ে বিতর্ক হতে পারে। তাই বলে এ বিতর্ককে কেন্দ্র করে বোরকাকে পর্দা রক্ষক পরিচ্ছেদ থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়ার অবকাশ তো আমরা দেখি না। লেখকদ্বয় সুন্দর একটি বাংলা শব্দ যোগে বোরকা এর আভিধানিক অর্থ করেছেন। শব্দটি হলো অবগুন্ঠন। বোরকার জন্য যুৎসই এবং চমৎকার একটি শব্দ। বাংলা অধিধানে শব্দটির অর্থ করা হয়েছে ঘোমটা, (স্ত্রীলোকের) মুখাবরণ। অবগুন্ঠনবতী- অবগুন্ঠিতা, ঘোমটা পরা। অবগুন্ঠিত- ঘোমটায় মুখ ঢাকা আছে এমন। সংসদ বাংলা অভিধান ৩৪। উল্লেখ্য, বাংলা বোরকা এর আরবী মূল বুরকুউন এবং বুরকাউন উভয়টিই শুদ্ধ। আসসিহাহ ফিল লুগাহ (১/৪০)। এবার আমরা দেখতে চেষ্টা করবো, অভিধানবেত্তারা বুরকু বা বুরকা এর কি অর্থ করেছেন। সুপ্রশিদ্ধ আরবী অভিধান গ্রন্থ আলমুনজিদ এ বুরকা এর অর্থ করা হয়েছে, এমন পরিচ্ছদ যদ্দ্বারা নারীরা নিজেদের চেহারা অবগুণ্ঠিত করে। (পৃষ্ঠা ৩৫) আলমুগরিব ফি তারতীবিল মু’রিব, জামহারাতুললুগাহ, লিসানুল আরব এবং মু’জামু লুগাতিল ফুকাহা এর মত অনবদ্য গ্রন্থগুলোতে বুরকা এর এ অর্থই করা হয়েছে। তবে কি এ অর্থগুলো সবই বিকৃত? যদি অভিধানের অর্থকেও বিকৃত বলা হয় তবে প্রবক্তার বিদ্যা বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়াটা খুব একটা আশ্চর্যের বিষয় হবে না। নারীর চেহারা আচ্ছাদনের ব্যাপারটি যদি পর্দার ব্যাপার না হয় তাহলে যুগপরম্পরায় মুসলিম সমাজে এর চর্চা কেন হচ্ছে? সহীহ বুখারীতে আছে, আয়েশা রাযি. বলেন,
হজ ব্রত পালন কালে ইহরাম রত অবস্থায় তোমরা বোরকা পরিধান করো না। (হাদীস নং ১৫৪৫)
এখানে হাদীসটিতে বুরকা’ শব্দটিই ব্যবহৃত হয়েছে। লেখকদ্বয় বলেন,
আমাদের সমাজের বড় ক্যান্সার ‘ধর্মান্ধ’। প্রতিটি মহল্লাতেই এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। ওসব ধর্মান্ধরাই সমাজে এ ব্যাখ্যাটি ছড়িয়েছে যে, ইসলামের পর্দার বিধান মানতে হলে ‘বোরকা’ নামক ঐ পোষাকটি পরতেই হবে। এটা ডাহা মিথ্যা প্রচার। চমকে উঠবেন না। কথাটা আরো গভীর থেকে তুলে আনি। তাহলে কথার সত্যতা বুঝে আসবে।
লেখক যুগল ‘ধর্মান্ধ’ বলে তীর্যকভাবে এদেশের আলেম এবং ইমাম সমাজকে নির্দেশ করেছেন। কারণ তারাই সমাজে বোরকার কথা বলেন। লেখক যুগল বলতে চান, এদেশের আলেম সমাজ ধর্মান্ধ। ধর্ম সম্বন্ধে তাদের স্বচ্ছ এবং বিশুদ্ধ ধারণা নেই। তারা না জেনে না বুঝে অন্ধের মত ধর্ম চর্চা করেন। এবং চর্চিত সে ধর্মাচারকে প্রচার করে আপামর জনসমাজকে বিভ্রান্ত করেন। লেখক যুগল সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের ইজলাসে বসে চূড়ান্ত রায় দিয়ে দিলেন, এদেশের আলেম সমাজ ধর্মান্ধ। তবে বিচারকদ্বয়ের রায় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের অধিকার আমাদের রয়েছে। বিশেষত বাকস্বাধীনতার এদেশে। যেহেতু তারা ধর্ম বিষয়ক একটি ব্যাপারে রায় দিয়েছেন তাই আমাদের বিশ্লেষণের সূচনাটা শেকড় থেকেই করতে হবে। সুতরাং আমাদের প্রাথমে জানতে হবে, লেখকদ্বয়ের ধর্ম বিষয়ক জানা শোনার দৈর্ঘ-সীমানা কতটুকু? আইন বিষয়ে যে ব্যক্তি রায় প্রদান করেন আইন শাস্ত্রে তিনি সিদ্ধহস্ত হয়ে থাকেন বা আইন শাস্ত্রের মানদণ্ডে তিনি উত্তীর্ণ হয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আইন বিষয়ে সিদ্ধহস্ত নন তিনি আইন বিষয়ে চূড়ান্ত রায় প্রদান বা মত প্রকাশের অধিকার রাখেন না। লেখকদ্বয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মতে যদি এদেশের আলেম সমাজ ধর্মান্ধ হন তবে লেখকদ্বয় ধর্ম বিষয়ে তাদের তুলনায় অনেক বেশি পণ্ডিতজ্ঞ হবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে বাস্তবতা কি এ ফলকথার সমর্থন করে? আমাদের খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে ইচ্ছে করে লেখকদ্বয় কোন ধর্মালয়ের শিক্ষানবীস ছিলেন? ধর্মশাস্ত্রে তাদের একাডেমিক শিক্ষার পরিধি কতটুকু? কোন উপায়ে যদি তাদের শিক্ষা-দীক্ষার গতি-সীমানা অনুমান করা যেত তবে নির্ভুল জরিপ চালনা আমাদের জন্য সহজ হতো। বস্তুত যে কোন বিষয়ে মতবৈচিত্র একটি সার্বজনীন ব্যাপার। ধর্মীয় বিষয়াদিও এর আওতামুক্ত নয়। সাহাবায়ে কেরামের স্বর্ণালী যুগেও আমরা মতবৈচিত্রেরে চর্চা লক্ষ করি। এবিষয়ে কেউ দ্বিধাগ্রস্থ হলে সে চরম পন্থার শিকার বলে ধরে নিতে হবে। কর্মবৈচিত্রের ন্যায় মতবৈচিত্রও মানুষের স্বভাবজাত এবং সহজাত প্রকৃতি। শাশ্বত এ নীতিকে অগ্রাহ্য করার কোনই সুযোগ নেই। তবে মতবৈচিত্রের ক্ষেত্রে গৃহীত কিছু নীতিমালা রয়েছে। সেগুলোকে বিবেচনায় রেখেই তাতে গ্রহণ বর্জন নীতি গ্রহণ করতে হয়।
আজ চৌদ্দ শত বছর পরে এসে লেখকদ্বয় ইসলামী ইতিহাসের উলামায়ে কেরামকে ধর্মান্ধ -ধর্ম বিষয়ে অজ্ঞ- বলে আখ্যা দিয়ে ফেললেন। আঞ্চলিক পরিভাষায় একটি প্রবাদ আছে- খালি কলস বাজে বেশি। জানি না প্রবাদটি লেখকদ্বয়ের ক্ষেত্রে কতটুকু প্রযোজ্য হবে? ইসলামী আইনের মূলনীতি হলো, মারজুহ তথা অপ্রাধান্য অভিমতকেও শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতে হয়। ক্ষেত্রে বিশেষে অপ্রাধান্য অভিমতের মাধ্যমেও বহু জটিল সমস্যার সমাধান গ্রহণ করা হয়। লেখকদ্বয় যদি ইসলামী আইনের এ নীতিটিও গ্রহণ করতেন তবে তাদের কলমচালনায় এতটা উচ্ছৃঙ্খলতা প্রকাশ পেত না; কিছুটা সহনীয় ভাব ফুটে উঠত। কিন্তু তারা বিষয়টিকে ‘ডাহা মিথ্যা প্রচার’ বলে ক্ষতবিক্ষত করে দিলেন। সরেজমিন অনুসন্ধানে যদি উঠে আসে, লেখকদ্বয়ের ধর্ম বিষয়ক জানা শোনার সূচক নিম্নমুখী তবে ধর্মান্ধ শব্দটি বুমেরাং হয়ে তাদের উপরই চড়াও হবে। লেখকদ্বয় ‘কথাটাকে আরো গভীর থেকে তুলে’ আনতে গিয়ে বলেন,
ইসলামী শরীয়াতের মূলভিত্তি কোরাআন। যাকে নিয়েই আজকের ইসলাম। এ কোরআনে সর্বমোট চারটি স্থানে ব্যাপক পর্দার কথা উল্লেখ আছে।
এরপর লেখকদ্বয় সূরা আ’রাফের ২৬ এবং সূরা নূরের ৩০, ৩১ ও ৬০ সংখ্যার প্রবচনগুলোর অনুবাদ উল্লেখ করেছেন। লেখক যুগল পর্দা বিধানকে কুরআনের চারটি আয়াতের মাঝে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। অথচ পর্দা বিধানটি এ চারটি আয়াতের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। সূরা আহযাবের ৩৩, ৫৩ ও ৫৯ নাম্বার আয়াতও পর্দা বিধানের শক্তিশালী সূতিকাগার। পর্দা বিধান উৎসারণের ক্ষেত্রে এ আয়াতগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। পরিষ্কার ধারণা লাভের স্বার্থে আয়াতত্রয়ের অনুবাদ যথাক্রমে তুলে ধরা হলো-
(১) আর তোমরা তোমাদের গৃহেই অবস্থান করো এবং প্রাচীন যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়িয়ো না। (সূরা আহযাব- ৩৩)
(২) তোমাদের যদি নবী পত্নীদের কাছ থেকে কোন কিছু চাওয়ার প্রয়োজন হয় তবে পর্দার অন্তরাল থেকে চেয়ে নিবে। (প্রাগুক্ত- ৫৩)
(৩) হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা, এবং মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের চাদর বা উড়না নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদের চেনা সহজতর হবে। ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। (প্রাগুক্ত- ৫৯)
এ আয়াতত্রয় থেকে পর্দা তথা বোরকার বিধান উৎসারিত হয় কিনা এ ব্যাপারে কোন সুহৃদ বিতর্ক করার সুযোগ পেতে পারেন। তাই আমরা এ প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা তুলে ধরছি।
কুরআনের আলোকে মুখমণ্ডলের হিজাব প্রসঙ্গ
নারী চেহারা হিজাবের পর্যায়ভুক্ত। এ ব্যাপারে কুরআনের ভাষ্য :
এক. আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ
অর্থ : তোমাদের যদি নবী-পত্নীদের কাছ থেকে কোন জিনিসপত্র চাওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে পর্দার আড়াল থেকে চেয়ে নিবে। (সূরা আহযাব- ৫৩)
উক্ত আয়াতটি নারীদের চেহারাসহ সমগ্র শরীর আবৃত করা হিজাবের অংশ হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলীল। এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। তবে আয়াতের বিধানটি কাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। যারা মুখমণ্ডল আবৃত করা মুস্তাহাবের প্রবক্তা তারা বলেন, আয়াতের বিধানটি শুধু নবী-পত্নীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ আয়াতে তাঁদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে। তবে তাদের এ বক্তব্য শরয়ী দলীলের আলোকে যথার্থ নয়। কারণ আয়াতটির সম্বোধক ভাষ্য ও প্রেক্ষাপট সীমিত হলেও তার বক্তব্য বিধান ব্যাপক ও বিস্তৃত। হিজাব বিষয়ে আয়াতটি সমগ্র নারী সমাজকে ব্যাপৃত করে। কারণ, (ক) উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার মূল তাৎপর্য হলো, আত্মাকে পরিশুদ্ধকরণ যা আয়াতের পরবর্তী অংশে বিবৃত হয়েছে,
ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ.
অর্থ : আর এটা তোমাদের এবং তাঁদের আত্মার অধিক পবিত্রতার কারণ হবে। (সূরা আহযাব- ৫৩)
আর আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জনের বিষয়টি সর্বকালের সকল মানুষের জন্য সমভাবে আবশ্যক। সুতরাং যেহেতু উক্ত বিধানটি অবতীর্ণ হওয়ার উপলক্ষটি সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তাই বিধানটিও সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।
(খ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ ছিলেন মুসলিম উম্মাহর সকল নারী সদস্য থেকে সর্বাধিক পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকরিণী। মুমিনদের অন্তরে তাদের প্রতি ছিল গভীর মর্যাদাবোধ এবং অকৃত্রিম ভালোবাসা। তাঁরা ছিলেন অন্যান্য পুরুষের জন্য সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ এবং হারাম। এতদসত্ত্বেও যখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে আত্মার পরিশুদ্ধির লক্ষ্যে পর্দা পালনের নির্দেশ দিলেন তখন অন্যান্য নারী সকল যে ঐ নির্দেশের আওতাভুক্ত হবে তা সামান্য বিবেচনাতেও উপলব্ধ হয়।
(গ) যদি বলা হয় আলোচ্য আয়াতের পর্দা বিধানটি নবী-পত্নীদের সাথেই সম্পৃক্ত তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায়, নবী পত্নীদের অন্তরের তুলনায় অন্যান্য নারীদের অন্তর অধিক পবিত্র ও পরিশুদ্ধ। অথচ নবী-পত্নীগণ অতি উচ্চ স্তরের সাহাবিয়া। আর একজন নন-সাহাবী যত বড়ো বুযুর্গই হোন না কেন সে কখনই সাহাবীদের সমতুল্য হতে পারেন না।
(ঘ) যারা বলেন আয়াতের বিধানটি নবী-পত্নীদের সাথেই সম্পৃক্ত তারা এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, নবী-পত্নীদের মর্যাদার কারণে তাদেরকে এ নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এর উত্তর হলো, মর্যাদার বিষয়টি তো নবী-কন্যাদের মাঝেও পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান রয়েছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আয়াতের বিধানটি আর নবী-পত্নীদের সাথে সম্পৃক্ত থাকল কোথায়?
(ঙ) আরব বিশ্বের আলোচিত আলেম নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. তার جلباب المرأة (জিলবাবুল মারআ) নামক গ্রন্থে (৭৫ পৃষ্ঠা) স্বীকার করেছেন, আলোচ্য আয়াতের বিধান সকল নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
(চ) আল্লাহ তা‘আলা হিজাব সংক্রান্ত আলোচনা শেষে বলেন,
لَا جُنَاحَ عَلَيْهِنَّ فِي آبَائِهِنَّ وَلَا أَبْنَائِهِنَّ وَلَا إِخْوَانِهِنَّ
অর্থ : নবী-পত্নীগণের তাদের পিতা-পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, সহধর্মিনী নারী এবং অধিকারভুক্ত দাস-দাসীগণের সামনে যেতে কোন সমস্যা নেই। (সূরা আহযাব- ৫৫)
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন,
لما أمر تعالى النساء بالحجاب من الأجانب، بيَّن أن هؤلاء الأقارب لا يجب الاحتجاب منهم.
অর্থ : যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা নারীদেরকে পরপুরুষ থেকে পর্দা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন তাই এখন উক্ত আয়াতে ঐ সকল নিকটাত্মীয়দের কথা উল্লেখ করেছেন যাদের সাথে তাদের পর্দা পালন করা ওয়াজিব নয়। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ৬/৪৭৬)
আর এ বিধানটি সকল নারীর ক্ষেত্রে সর্বসম্মতিক্রমে প্রযোজ্য। সুতরাং কীভাবে বলা যায়, হিজাবের আয়াতটি নবী-পত্নীদের সাথেই সম্পৃক্ত? অথচ এর সাথে সম্পৃক্ত পরবর্তী আয়াতের বিধানটি সকল নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সুতরাং উপরোল্লিখিত আলোচনাসমূহ আয়াতটি ব্যাপক হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ়রূপে প্রমাণ বহন করে। আর যারা বলেন আয়াতটি নবী-পত্নীদের সাথেই সম্পৃক্ত তাদের বক্তব্যটি অসার বলে সাব্যস্ত হলো।
ইমাম জাস্সাস রহ. বলেন,
وهذا الحكم وإن نزل خاصا في النبي صلى الله عليه وسلم وأزواجه فالمعنى عام فيه وفي غيره إذ كنا مأمورين باتباعه والإقتداء به
অর্থ : উক্ত আয়াতের বিধানটি যদিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর স্ত্রীদের ব্যাপারে বিশেষভাবে অবতীর্ণ হয়েছে তবে এর অর্থ ব্যাপক। কেননা আমরা তাঁর অনুসরণ ও অনুকরণের ব্যাপারে আদিষ্ট। (আহকামুল কুরআন ৮/৪১৫)
দুই. আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ
অর্থ : হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা এবং মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের চাদর বা ওড়নার কিছু অংশ নিজেদের উপর নামিয়ে নেয়। (সূরা আহযাব- ৫৯)
আয়াতের বাহ্যিক অর্থ হলো, নারীরা ওড়না দ্বারা দেহের অন্যান্য অঙ্গের ন্যায় চেহারাও ঢেকে রাখবে। আয়াতটির অর্থগত বিধান নবী-পত্নী ও নবী-কন্যাদের ন্যায় অন্যান্য সাধারণ নারীদের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। বিষয়টি বিভিন্নভাবে প্রমাণিত। যথা-
(ক) আয়াতটি সুস্পষ্টভাবে এ বিষয়টি নির্দেশ করে, পর্দার বিধানটি নবী-পত্নী ও নবী-কন্যাদের ন্যায় অন্যান্য সাধারণ নারীদেরকেও সমভাবে ব্যাপৃত করে। কারণ আয়াতে নবী-পত্নী, নবী-কন্যা এবং সাধারণ মুমিন নারীদের আলোচনা সমভাবে একই সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এ কথা সর্বজন বিদিত, নবী-পত্নীদের মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ ছিল। সুতরাং নবী-পত্নী ও নবী-কন্যাদের ন্যায় অন্যান্য নারীদের মুখমণ্ডলও হিজাবের অংশ বলে গণ্য হবে।
(খ) ادناء (টেনে দেয়া) এর ব্যাখ্যায় যদি বলা হয়, মুখমণ্ডল খোলা রাখা যাবে তাহলে নবী-পত্নী, নবী-কন্যাসহ সকল নারীদের মুখমণ্ডল খোলা রাখা আবশ্যক হয়ে পড়ে। কারণ আয়াতের বিধানটি তো সকলের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। অথচ নবী পত্নীদের মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ হওয়ার ব্যাপারে কেউ দ্বিমত পোষণ করে না।
(গ) ইমাম ইবনে হাযম রহ. বলেন,
والجلباب في لغة العرب التي خاطبنا بها رسول الله صلى الله عليه وسلم هو ما غطى جميع الجسم، لا بعضه.
অর্থ : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ওড়না (جلباب) বিষয়ে আমাদের সম্বোধন করেছেন, আরবী পরিভাষায় তা ঐ ওড়নাকে বলা হয়, যা আংশিক দেহ নয়, সম্পূর্ণ দেহকে ঢেকে নেয়। (আল-মুহাল্লা বিল আসার ২/৩৪৬)
(ঘ) ইমাম আবূ বকর জাস্সাস রহ. يدنين (তারা টেনে দিবে) এর ব্যাখ্যায় বলেন, উক্ত আয়াতটি এ কথার প্রমাণ বহন করে, যুবতী নারীরা অপরিচিত পুরুষদের থেকে তাদের মুখমণ্ডল আবৃত করে রাখার ব্যাপারে আদিষ্ট। (আহকামুল কুরআন ৫/২৪৫)
(ঙ) ইমাম বাগাবী রহ. বলেন, ইবনে আব্বাস এবং আবূ উবাইদা রাযি. বলেছেন, মুমিন নারীদেরকে ওড়না দ্বারা তাদের মাথা এবং মুখমণ্ডল আবৃত করে রাখার ব্যাপারে আদেশ দেওয়া হয়েছে। তবে একটি চক্ষু খোলা রাখার অবকাশ দেওয়া হয়েছে, যাতে বুঝা যায় তারা স্বাধীন নারী। (তাফসীরে বাগাবী ৩/৪৬৯)
(চ) আল্লামা শানকীতী রহ. বলেন, তারা ওড়না দ্বারা তাদের পুরো মুখমণ্ডল ঢেকে ফেলবে। শুধুমাত্র একটি চক্ষু খোলা রাখবে, যা দিয়ে তারা দেখবে। ইবনে মাসউদ, উবনে আব্বাস, ও আবূ উবাইদা রাযি. সহ অনেকের বক্তব্য এটাই। (আযওয়াউল বায়ান ফী ঈযাহিল কুরআনি বিল কুরআন ৩৬/১১১)
(ছ) নাহব্ তথা আরবী ব্যাকরণ শাস্ত্রের ইমাম ও মুফাসসির আবূ হাইয়ান আল আন্দালুসী রহ. বলেন, من جلابيبهن এর মধ্যে من অব্যয়টি ‘কতেক’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আর عليهن এটা নারীদের সমস্ত শরীরকে ব্যাপৃত করে। অথবা عليهن অর্থ على وجوههن। অর্থাৎ তারা তাদের মুখমণ্ডলের উপর ওড়না টেনে দিবে। কেননা নারীরা জাহেলী যুগে তাদের দেহের যে অংশ প্রকাশ করে রাখত তা হলো মুখমণ্ডল। (আল-বাহরুল মুহীত [সূরা আহযাব] ৭/২৪০)
(জ) ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে নারীরা হিজাব ব্যতীত বের হতো। ফলে পুরুষরা তাদের চেহারা ও হাত দেখতে পেত। তখন দেখাও বৈধ ছিল। কারণ নারীদের জন্য মুখমণ্ডল ও হাত প্রকাশ করাও বৈধ ছিল। অতঃপর যখন পর্দার আয়াত يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ الخ অবতীর্ণ হলো তখন নারীরা পুরুষদের থেকে পর্দা করতে শুরু করল। (ইয়ানাতুল মুখতারীন বাইনান নিকাবি ওয়াল খিমার ১/১৬)
তিন.
وَالْقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَاءِ اللَّاتِي لَا يَرْجُونَ نِكَاحًا فَلَيْسَ عَلَيْهِنَّ جُنَاحٌ أَنْ يَضَعْنَ ثِيَابَهُنَّ
অর্থ : যেসব বৃদ্ধা নারী বিবাহের আশা করে না তাদের জন্য তাদের দেহের অতিরিক্ত কাপড় খুলে রাখতে কোন দোষ নেই। (সূরা নূর- ৬০)
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বৃদ্ধা নারীদেরকে কাপড় খুলে রাখার অনুমতি দিয়েছেন। এখানে এই বিষয়টি স্পষ্ট যে, এই আয়াতে (وضع ثياب) কাপড় খুলে রাখার দ্বারা দেহের সব কাপড় খুলে রাখা উদ্দেশ্য নয়; বরং উদ্দেশ্য হলো, (وضع جلباب) ওড়না খুলে রাখা বা দেহের উপরিভাগের ঐ বস্ত্রাংশ খুলে রাখা যা খুলে ফেললে সতর খুলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না। এ কারণেই হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. এই আয়াতে ব্যবহৃত (ثياب) কাপড় শব্দের ব্যাখ্যা (جلباب) ওড়না অথবা (رداء) চাদর দ্বারা করেছেন। আর জিলবাব হলো এমন বস্ত্র যাতে চেহারাসহ পূর্ণ দেহ আড়াল হয়ে যায়।
হযরত ইবনে আব্বাস রাযি., হযরত ইবনে উমর রাযি., হযরত মুজাহিদ রাযি., হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর রাযি., হযরত আবূ শাসা রাযি., হযরত ইবরাহীম নাখয়ী রহ., হযরত হাসান রহ., হযরত কাতাদাহ রহ., ইমাম যুহরী রহ. এবং ইমাম আওযায়ী রহ.সহ আরো অনেক সাহাবা তাবেয়ী (ثياب) কাপড় শব্দের উপরোক্ত ব্যাখ্যাই করেছেন।
সুতরাং এই আয়াতটিতে (وضع جلباب) ওড়না খুলে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যার চূড়ান্ত ফলাফল হচ্ছে, (كشف الوجه) চেহারা খুলে রাখা। আর এই নির্দেশনাটি কেবলমাত্র ঐসব বৃদ্ধা নারীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যাদের ভবিষ্যতে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা এবং দৈহিক সক্ষমতা নেই। কিন্তু যুবতী নারীদের ক্ষেত্রে এই বিধান মোটেও প্রযোজ্য নয়। তাদের জন্য পরপুরুষের সামনে (جلباب) ওড়না খোলাও জায়েয নেই।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
সঠিকতর সিদ্ধান্ত এই যে, নারীর জন্য পুরুষের সামনে দুই হাত, দুই পা ও মুখমণ্ডল খোলা রাখার অবকাশ নেই। (মাজমাউল ফাতাওয়া ২২/১১৪)
শাইখ ইবনে বায ও শাইখ ইবনে উসাইমিনও একই ফতওয়া দিয়েছেন। (রিসালাতুন ফিল হিজাব; পৃষ্ঠা ১৭, ফাতাওয়া উলামাই বালাদিল হারামাইন; পৃষ্ঠা ১১৬৯)
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
মুখমণ্ডল এটা নামাযের ক্ষেত্রে সতর নয়। তবে এটা দৃষ্টি দেয়ার ক্ষেত্রে সতর। কেননা চেহারার দিকে তাকানো জায়েয নেই। (আল ফাতাওয়া আলকুবরা ৪/৪০৯)
ইবনুল কাইয়িম জাওযী রহ. বলেন,
সতর দু’ প্রকার। (১) নামাযের ক্ষেত্রে সতর (২) দৃষ্টি দেয়ার ক্ষেত্রে সতর। সুতরাং স্বাধীন নারীরা চেহারা এবং উভয় হাতের তালু খোলা রেখে নামায আদায় করতে পারবে। তবে বাজারে বা লোকালয়ে চেহারা ও উভয় হাতের তালু খোলা রেখে বের হওয়ার অবকাশ নেই। (ই’লামুল মুয়াক্কিয়ীন ২/৮০)
উল্লিখিত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হল যে, পরপুরুষের সামনে বোরকার বিধানটি কুরআনের আয়াত দ্বারাই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। এরপরও লেখকদ্বয় কোন সাহসে বলতে পারলেন ‘এটা ধর্মান্ধদের মিথ্যাচার’!?
লেখকদ্বয় তাদের উদ্ধৃত আয়াতচতুষ্টয়ের অনুবাদ শেষে বলেন,
আমরা জানলাম পর্দা সম্বন্ধে কোরআনের বক্তব্য কি। এখন আমরা জোর গলায় বলতে পারি বোরকা ইসলামী বিধান নয়। ইসলাম কখনও বোরকা পরতে বলেনি। ইসলাম পর্দার কথা বলেছে। সমাজে প্রচলিত মার্জিত একটা পোষাক পরলেই পর্দার বিধান আদায় হয়ে যায়।
লেখকদ্বয় কুরআনের খণ্ডিত অংশ উপস্থাপন করে জোর গলায় কথা বলছেন। কুরআনের পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য উপস্থাপন করেও তো সব ক্ষেত্রে জোর গলায় কথা বলা যায় না। উপরন্তু শুধু কুরআনের বক্তব্য যোগে জোর গলায় কথা বলা তো ওয়ারিয়েন্টালিজম তথা প্রাচ্যবাদের আদর্শ। কুরআন একটি সংবিধান গ্রন্থ। নিছক সাংবিধানিক বক্তব্য দ্বারা জোর গলায় কথা বলা যায় না। সাংবিধানিক আইনের গৃহীত উপধারাগুলোকেও সামনে রাখতে হয়। লেখকদ্বয় কুরআনিক আইনের উপধারা হাদীসের আলোচনায় প্রবেশ না করেই জোর গলায় কথা বলছেন। বরং কুরআনিক আইনের খণ্ডিত উপস্থাপনাতেই লেখকদ্বয় গলার জোর বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ‘সমাজে প্রচলিত মার্জিত একটা পোষাক পরলেই’ নাকি ‘পর্দার বিধান আদায় হয়ে যায়।’ মার্জিত পোষাকের পরিধি কতটুকু। পাশ্চাত্যে উদাম বক্ষের পোষাকও অমার্জিত নয়। আমাদের দেশ অত উন্নতিতে (?) উন্নীত না হলেও আজকাল উড়না বিহীন পোষাকও এখানে মার্জিত পোষাকের রূপ নিয়েছে। ইউরোপ আমেরিকায় অনেক নারী মাথায় হিজাব পরে হাটু অবধি উন্মুক্ত পদে পথ চলে। এটাও তাদের নিকট মার্জিত পোষাক। তবে এরা সবাই কি পর্দা পালন করেন? পর্দার ব্যাপারটি যদি এতটাই সাহজিক হবে তবে এত আয়াত হাদীসের অবতারণা কেন? আজকের মত বস্ত্রহীন সংস্কৃতি তো প্রাচীন মূর্খতার যুগেও ছিল না। তারা যে পোষাক পরত তা আমাদের সমাজের প্রচলিত পোষাকের চেয়েও শালীন এবং মার্জিত ছিল। লেখকদ্বয় বলেন,
কোরআনের পর যে সব কিতাব গ্রন্থ থেকে ইসলামের বিধান উৎসারণ করা হয় সেগুলো হলো সহিহ বোখারি শরীফ, মুসলিম শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ, তিরমিযী শরীফ, ইবনে মাজাহ শরীফ, মুয়াত্তায়ে মালেক, মুয়াত্তায়ে মুহাম্মদ ও বায়হাকী। এসব কিতাব অধ্যায়ন করেছি। এসব কিতাবের কোন স্থানেই বোরকা পরা আবশ্যক বলে উল্লেখ নেই। অতএব আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম, বোরকা পরা মুসলিম মেয়েদের জন্য আবশ্যকীয় কোন বিধান নয়।
লেখকদ্বয় কুরআনের পর ইসলামী বিধান উৎসারণের মূল সূত্রকে আটটি হাদীস গ্রন্থের মাঝে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। হাদীস গ্রন্থ কি এ আট সংখ্যার মাঝেই সীমাবদ্ধ? আর কোন হাদীস গ্রন্থ কি নেই? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদীস সমগ্র কি উক্ত গ্রন্থ অষ্টকের মাঝেই সীমাবদ্ধ? প্রশ্নগুলোর উত্তরে লেখকদ্বয়ের বক্তব্য কি হবে জানি না। উত্তর যদি ইতিবাচক হয় তবে লেখকদ্বয়ের জ্ঞান গরিমার দূরত্বের পরিমাপ হয়ে যাবে। লেখকদ্বয় বলেছেন, এসব কিতাব তারা ‘অধ্যায়ন’ করেছেন। কিতাব ‘অধ্যায়ন’ করলে নানা রকম প্রান্তিকতার শিকার হতে হয়। কিতাব ‘অধ্যায়ন’ নয় অধ্যয়ন করতে হয়। যদি তারা অধ্যয়নই করে থাকেন তবে তারা কেমন অধ্যয়ন করলেন যে, অবগুণ্ঠন বিষয়ক হাদীসের উক্তিগুলো তাদের দৃষ্টিগোচর হলো না! লেখকদ্বয় কি গ্রন্থঅষ্টকের অনুবাদ অধ্যয়ন করেছেন না কি আরবী মূলপাঠ অধ্যয়ন করেছেন- পর্যালোচনার স্বার্থেই জানতে খুব ইচ্ছে করছে। এবার আমরা লেখকদ্বয়ের পঠিত কিতাব অষ্টক এবং অন্যান্য হাদীস গ্রন্থ থেকে বোরকা তথা চেহার আবৃত বিষয়ক কিছু হাদীস তুলে দিচ্ছি।
১। ইফ্কের ঘটনা সম্বন্ধে হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সফওয়ান ইবনে মুআত্তাল রাযি. আমাকে দেখে চিনে ফেলে। পর্দা বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে সে আমাকে দেখেছিল। সে আমাকে দেখে সাথে সাথে ইন্না লিল্লাহ বলে ওঠে। এতে আমি জাগ্রত হয়ে যাই এবং তৎক্ষণাৎ আমার ওড়না দ্বারা চেহারা ঢেকে নিই। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৪১৪১)
২। কাইস ইবনে শাম্মাস রাযি. বলেন, উম্মে খাল্লাদ নামক জনৈক নারী নেকাব পরিহিত অবস্থায় তার শহীদ হওয়া ছেলে সম্বন্ধে জানতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসল। এক সাহাবী তাকে বলল, তুমি তোমার ছেলে সম্বন্ধে জানতে নেকাব পরে এসেছো? তখন মহিলা বলল, আমি আমার ছেলে হারিয়ে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি বলে তো আমার লজ্জাকে হারিয়ে বিপদগ্রস্থ হতে পারি না। (সুনানে আবূ দাউদ; হা.নং ২৪৯০)
নেকাব বলা হয় এমন বস্ত্রখণ্ডকে যা নারীরা তাদের নাসিকার কোমলাস্থির উপর রেখে পূর্ণ চেহারাকে আবৃত করে নেয়। (আল-মুনজিদ ফিললুগাহ; পৃষ্ঠা ৮৫৯)
৩। জনৈক মহিলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলল, যদি কোন নারীর জিলবাব না থাকে (তবে সে কি করে ঈদগাহে যাবে)? তিনি বললেন, এক্ষেত্রে কেউ যেন তার বোনকে জিলবাব ধার দেয়। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৩২৪, সুনানে ইবনে মাজাহ; হা.নং ১৩০৭, সুনানে তিরমিযী; হা.নং ৫৩৯)
৪। অন্য বর্ণনায় এসেছে, উম্মে সালামা রাযি. বলেন, যখন يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلاَبِيبِهِنَّ (তারা যেন তাদের উপর জিলবাব টেনে নেয়।) আয়াতটি অবতীর্ণ হলো তখন আনসার মহিলাগণ এমন পোষাক পরে বের হলো যেন তাদের মাথায় কাক বসে আছে। (সুনানে আবূ দাউদ; হা.নং ৪১০৩)
জিলবাব এমন পরিচ্ছেদকে বলা যা সম্পূর্ণ দেহকে আবৃত করে নেয়। (আল-মু’জামুল ওয়াসীত ১২৮)
৫। নবী পত্নী উম্মে সালামা রাযি. বলেন, একদা আমি এবং মাইমূনা রাযি. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। ইত্যবসরে অন্ধ সাহাবী ইবনে উম্মে মাকতুম রাযি. সেখানে আসতে লাগলেন। এ ঘটনাটি ঘটেছিল আমাদের উপর পর্দার নির্দেশনা সম্বলিত বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পর। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বললেন, তোমরা তার থেকে পর্দা করো। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি কি অন্ধ নন? আমাদেরকে দেখতে পাচ্ছেন না, চিনতে পারছেন না! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তবে তোমরাও কি অন্ধ? তোমরা কি তাকে দেখতে পাচ্ছো না? (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস ৪১১৪, সুনানে তিরমিযী, হাদীস ২৭৭৮, সুনানে বাইহাকী কুবরা, হাদীস ১৩৩০৩, সুনানে নাসায়ী কুবরা, হাদীস ৯২৪১)
৬। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন তোমাদের কেউ কোন মেয়েকে বিবাহের প্রস্তাব দিবে তখন সে মেয়েকে দেখলে তার কোন গুনাহ হবে না। তবে সেটা কেবলমাত্র বিবাহ করার উদ্দেশ্যেই হতে হবে। যদিও সে মেয়েটি জানতে না পারে। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস ২৩৬৫০)
৭। বুরাইদা রহ. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে আলী! তুমি হঠাৎ কোন পরনারীর উপর দৃষ্টি পড়ার পর দ্বিতীয়বার ইচ্ছা করে সেদিকে তাকাবে না। কারণ প্রথমবার অনিচ্ছাকৃত দৃষ্টিপাত করা তোমার জন্য মার্জিত হলেও দ্বিতীয়বার ইচ্ছাকৃত দৃষ্টি দেয়া মার্জিত নয়। (সুনানে আবূ দাউদ; হা.নং ২১৫১)
৮। সাফিয়্যাহ বিনতে শাইবাহ বলেন, আমি আয়িশা রাযি. কে নিকাব পরিহিত অবস্থায় কাবা ঘর তওয়াফ করতে দেখেছি। (মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক; হা.নং ৮৮৫৯, তাবাকাতে ইবনে সা’দ ৭/৪০)
৯। ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফিয়্যা রাযি. কে পর্যবেক্ষণ করছিলেন তখন তিনি আয়িশা রাযি. কে মানুষের মাঝে নিকাব পরিহিত অবস্থায় দেখে চিনতে পারলেন। (তাবাকাতে ইবনে সা’দ ৭/৭৮)
১০। সফিয়্যাহ বিনতে শাইবা রাযি. বলেন, যখন সূরা নূরের وليضربن بخمرهن على جيوبهن এ আয়াতটি অবতীর্ণ হলো তখন আনসার সাহাবীগণ তাদের স্ত্রীদের কাছে গিয়ে এ আয়াত তিলাওয়াত করতে লাগল। প্রত্যেকেই তার স্ত্রী, কন্যা, ভগ্নি এবং নিকটাত্মীয়দের নিকট এ আয়াত পাঠ করে শোনাতে লাগল। ফলে নারীরা তাদের পোষাক ফেড়ে অবগুণ্ঠন বানিয়ে ফেলল। সকাল বেলা তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পেছনে অবগুণ্ঠিত অবস্থায় নামায আদায় করল। যেন তাদের প্রত্যেকের মাথায় কাক বসে আছে। (তাফসীরে ইবনে আবি হাতিম; হা.নং ১৪৪০৬)
হাদীসের ভাষ্যে فاعتجرت به শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দটির অর্থ হলো মাথার উপর কাপড় পেঁচিয়ে তার এক পার্শ চেহারার উপর ঝুলিয়ে রাখা। (আলমু’জামুল ওয়াসীত ৫৮৫)
১১। হযরত আয়েশা রাযি. বর্ণনা করেন, আমরা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ইহরাম অবস্থায় ছিলাম। এ সময় আমাদের পাশ দিয়েই মানুষের বাহনগুলো চলাচল করছিল। যখন বাহনগুলো আমাদের কাছাকাছি চলে আসত তখন আমরা আমাদের চাদর চেহারার উপর টেনে দিতাম। আর যখন বাহনগুলো আমাদের থেকে দূরে চলে যেত তখন আমরা আমাদের চেহারা থেকে চাদর সরিয়ে নিতাম। (সুনানে আবূ দাউদ; হা.নং ১৮৩৩)
১২। হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে এক নারীর ব্যাপারে আলোচনা করলাম, যাকে আমি বিবাহের প্রস্তাব দিতে আগ্রহী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যাও তুমি তাকে দেখে নাও। কারণ এটা তোমাদের মাঝে সুসম্পর্কের জন্য অধিক উপযোগী হবে। অতঃপর আমি এক আনসারী নারীর বাড়িতে আসলাম এবং তার পিতা-মাতার নিকট প্রস্তাব পেশ করলাম। সাথে সাথে তাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ সম্পর্কেও অবহিত করলাম। কিন্তু কেমন যেন তারা বিষয়টি অপছন্দ করল। মুগীরা ইবনে শু’বা রাযি. বলেন, এদিকে এ বিষয়টি ঐ নারী ঘরের ভিতর থেকে শুনতে পেল। সে বলল, যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে দেখার নির্দেশ দিয়ে থাকেন তাহলে তুমি দেখ। অন্যথায় আমি তোমাকে আল্লাহর শপথ দিচ্ছি (তুমি তা কর না)। কেমন যেন তাকে দেখার বিষয়টি তার উপর অনেক বড়ো বোঝার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। (মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ১৮১৩৭)
১৩। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি অহংকারবশত কাপড় হেঁচড়ে চলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তার দিকে তাকাবেন না। উম্মে সালামা রাযি. বললেন, তাহলে নারীরা তাদের আঁচল কিভাবে রাখবে? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তারা আঁচল এক বিঘত ঝুলিয়ে দিবে। উম্মে সালামা রাযি. বললেন, তাহলে তো নারীদের পদযুগল প্রকাশ পেয়ে যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে তারা এক হাত পরিমাণ ঝুলিয়ে দিবে। এর থেকে বেশি ঝুলাবে না। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ১৭৩১)
উক্ত হাদীসে পদযুগল ঢাকার ব্যাপারে এত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অথচ পদযুগল থেকে চেহারা প্রদর্শন অধিক অনাচারের কারণ। কেননা যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, পুরুষরা নারীদের পায়ের সৌন্দর্যের প্রতি বেশি আসক্ত না চেহারার প্রতি? স্বাভাবিক উত্তর হবে, চেহারার প্রতি। সুতরাং যখন পা ঢাকার ব্যাপারে এত বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে তখন চেহারা ঢাকার গুরুত্ব কতটুকু তা বলাই বাহুল্য।
১৪। আসমা বিনতে আবূ বকর রাযি. বলেন, আমরা পুরুষদের সামনে মুখমণ্ডল আবৃত করে রাখতাম। (আল মুসতাদরাক লিলহাকিম; হা.নং ১৬৬৮)
১৫। মুহাম্মদ ইবনে সিরীন রহ. বলেন, আমি উবাউদা সালমানী রাযি. কে يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلاَبِيبِهِنَّ (তারা যেন তাদের উপর জিলবাব টেনে নেয়) এ আয়াতের ব্যাখ্যা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি তখন তার গায়ে পরিহিত কম্বল দ্বারা ললাট পর্যন্ত সম্পূর্ণ মাথা আবৃত করে নিলেন। এরপর চেহারা ঢেকে নিলেন। এবং চেহারার বাম পার্শ থেকে বাম চোখটাকে বের করে রাখলেন। (তাফসীরে ইবনে আবি হাতিম রাযী; হা.নং ১৭৭৮৭)
১৬। উপরোক্ত আয়াতটির ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা মুমিন নারীদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যখন তারা বিশেষ কোন প্রয়োজনে ঘর থেকে বাহিরে যাবে তখন তারা জিলবাবের মাধ্যমে মাথার উপর থেকে চেহারা অবধি আবৃত করে রাখবে। এবং একটি মাত্র চোখ বের করে রাখবে। (তাফসীরে তাবারী ১৭/৪৩, হা.নং ২১৮৬১)
১৭। ইসমাঈল ইবনে উলইয়্যা রহ. আয়াতটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটি চাদর নিলেন এবং ঘোমটার মত করে মাথা এবং চেহারা আবৃত করে ফেললেন। কপাল, নাক এবং বাম চোখও আবৃত করলেন। শুধু ডান চোখটি অনাবৃত রাখলেন। এরপর তিনি বলেন, এভাবে আমাকে চাদর পরিধান করে দেখিয়েছেন আব্দুল্লাহ ইবনে আউন রহ., তাঁকে দেখিয়েছেন মুহাম্মদ ইবনে সিরীন রহ., আর তাঁকে দেখিয়েছেন উবাইদা সালমানী রাযি.। (জামিউল বায়ান, ইবনে জারীর তাবারী ১৭/৮৩, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ইবনে কাসীর ৩/৮২৫)
১৮। ফাতিমা বিনতে মুনযির রহ. বলেন, আমরা আসমা বিনতে আবুবাকারের সাথে ইহরামরত থাকাকালীন আমাদের মুখমণ্ডল আবৃত করে রাখতাম। মুয়াত্তা ইমাম মালেক; হা.নং ১১৭৬)
লেখকদ্বয় বলেন,
বরং একথা জোর গলায় বলতে পারি বর্তমান সময়ে পর্দা রক্ষার্থে বোরকা পরা ঠিক নয়। এখন বাজারে যে সব বোরকা পাওয়া যায় তা এমনভাবে তৈরি করা যে, বোরকা পরিহিত কোন নারীর দিকে তাকালে যৌন সুড়সুড়ি বৃদ্ধি পায়। যেটা সম্পূর্ণ ইসলামের পর্দা বিধানের পরিপন্থী। অথচ ওই মহিলা বা মেয়েটা যদি সাধারণ মার্জিত একটা পোষাক পরত তাহলে তার দিকে এ কুদৃষ্টিটা পড়ত না। পর্দার বিধানের মূল উদ্দেশ্য হল, মানুষ যেন অবৈধ যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত না হয়। ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান রাখে এমন একজন সাধারণ আলেমকে জিজ্ঞেস করলেও তিনি একই কথা বলবেন। আর বোরকা যদি অবৈধ যৌনক্রিয়ার দিকেই আহ্বান করে তবে সেই বোরকা পরা পরিত্যাগ করার চেয়ে উত্তম কাজ আর কি হতে পারে! বর্তমান সময়ে বোরকাকে ব্যবহার করা হচ্ছে নিষিদ্ধ কর্মে। আমরা প্রায়ই খবরের কাগজগুলোতে এমনটি দেখতে পাই। সন্ত্রাসী আর জঙ্গী তৎপরতা থেকে শুরু করে পতিতাকর্মেও এ বোরকা ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা বোরাকা পরে সবাইকে আমি মন্দ বলছি না। আপনি ঢিলেঢালা কোন বোরকা তৈরি করে তা পরে পথ চলুন। সেটা আপনার ইচ্ছা। আপনার স্বাধীনতা। আমি শুধু বলতে চাই, যারা অফিস আদালত বা কর্মক্ষেত্রে যান তাদের জন্য বোরকা পরা কতটা উচিত। আর যারা চাকরি-বাকরি করেন না তাদের উচিত সমাজকে অপরাধমুক্ত করার স্বার্থে বোরকা পরিত্যাগ করা। কারণ পর্দার জন্য তো বোরকা আবশ্যক নয়।
লেখকদ্বয় একদিকে জোর গলায় বললেন, ‘পর্দা রক্ষার্থে বোরকা পরিধান করা ঠিক নয়।’ অন্যদিকে তারা বলছেন, ‘আপনি ঢিলেঢালা কোন বোরকা তৈরি করে তা পরে পথ চলুন। সেটা আপনার ইচ্ছা। আপনার স্বাধীনতা।’ এটা কি স্ববিরোধিতা নয়? একজন ব্যক্তি তার স্বাধীনতার অধিকার ভোগ করবে। এতে বেঠিক এর কি হলো। কোন বেঠিক বা অনুচিত বিষয়ে তো কারো স্বাধীনতা থাকতে পারে না। কোন ব্যক্তি ইচ্ছা করলেই অনুচিত বা বেঠিক কাজ করার স্বাধীনতা লাভ করতে পারে না।
লেখকদ্বয় তাদের থিউরি ‘পর্দা পরিধান করা ঠিক নয় এবং পর্দা পরিত্যাগ করা উত্তম কাজ’ এর সপক্ষে দু’টি যুক্তি তুলে ধরেছেন। ১। ‘এখন বাজারে যে সব বোরকা পাওয়া যায় তা এমনভাবে তৈরি করা যে, বোরকা পরিহিত কোন নারীর দিকে তাকালে যৌন সুড়সুড়ি বৃদ্ধি পায়।’ ২। ‘বর্তমান সময়ে বোরকাকে ব্যবহার করা হচ্ছে নিষিদ্ধ নিষিদ্ধ কর্মে।’ লেখকদ্বয়ের দু’টি যুক্তির সারবক্তব্য একই। আর তা হলো, ধর্মীয় বিষয়াদিকে নিষিদ্ধ এবং অবিধানিক কর্মে ব্যবহার করা। আমরা লেখকদ্বয়ের যুক্তির বাস্তবতাকে পুরোপুরি অস্বীকার করি না। শুধু এতটুকুই নয়; আমরা একথাও স্বীকার করি, আজকের সমাজে কিছু মানুষ শুধু বোরকা নয়; আস্ত ধর্মটাকেই নিষিদ্ধ কর্মে ব্যবহার করে। এটা বিচ্ছিন্নভাবে হয় না। বরং পরিকল্পিতভাবে বিশদ পরিসরে এ কার্যটি সম্পাদন করা হয়। সুতরাং বোরকাকে নিষিদ্ধ কর্মে ব্যবহার করার কারণে যদি স্বয়ং বোরকাটিই নিষিদ্ধ হয়ে যায় তবে লেখকদ্বয়ের থিউরি মতে ধর্মটাকে নিষিদ্ধ কর্মে ব্যবহার করার কারণে স্বয়ং ধর্মটাকেই বাজেয়াপ্ত করে দেয়াটাই কি উচিৎ এবং যথাযথ নয়? লেখকদ্বয়ের উপস্থাপনা শৈলিতে বারবার এ ফলটিই প্রতিবিম্বিত হয়ে উঠেছে। প্রত্যক্ষভাবে বোরকার নিষিদ্ধতা কামনা করলেও পরোক্ষভাবে তারা বোরকার শেকড় দীনে ইসলামের বিলুপ্তি এবং নিষিদ্ধতাই যেন কামনা করছেন। তবে মনের এ কমনাকে স্পষ্টভাষায় বলতে গেলে মহা শঙ্কার ঘনঘটা সৃষ্টি হবে ভেবে মনে হয় তারা চোরাই পথে তাদের মনোবসনার চালান করতে চাচ্ছেন। বোরকাকে ব্যবহার করা হয় নিষিদ্ধ কর্মে। এতে বোরকা বেচারীর কি দোষ? যারা নিষিদ্ধ কর্মে ব্যবহার করবে তাদের কর্মপন্থাকে বিলুপ্ত না করে এবং তাদেরকে শায়েস্তা না করে বেচারী বোরকাকেই দু টুকরো করে দেয়া হচ্ছে। সমধিকারের এদেশে একেমন বৈষম্য? আমার হাতটি যদি রোগাক্রান্ত হয় তবে কি হাতটিকেই ফেল দেব নাকি আগে রোগের ট্রিটমেন্ট করবো? আজকের সমাজে নিষিদ্ধ কর্ম সংঘটিত হওয়ার মাধ্যম কি শুধু এ বোরকাই? অন্য কোন মাধ্যমে কি নিষিদ্ধ কর্ম সংঘটিত হয় না? উত্তর ইতিবাচক হলে তবে কেন তারা সেসব মাধ্যমকে বিলুপ্ত ঘোষণার দাবিতে এগিয়ে আসেন না? কেন সেসব মাধ্যমের ব্যবহারকে অনুচিত এবং বেঠিক বলেন না? কেন সেসব মাধ্যমকে পরিত্যাগ করা সর্বোত্তম কাজ হয় না? এর কি কোন সদুত্তর আছে লেখকদ্বয়ের জাম্বিলে? উপরন্তু এদেশের কতভাগ মানুষ বোরকাকে নিষিদ্ধ কর্মে ব্যবহার করে? যদি জরিপ করা হয় তবে দেখা যাবে খুব কম সংখ্যক মানুষই ধর্মীয় পবিত্র নিদর্শন বোরকাকে নিষিদ্ধ কর্মে ব্যবহার করে থাকে। তবে কি সামান্য কিছু মানুষের অপকর্মের কারণে সিংহভাগ মানুষের ধর্মীয় অধিকারকেই বিলুপ্ত করে দেয়া হবে? অনুচিত এবং অপাঙক্তেয় ঘোষণা করার দুঃসাহস দেখানো হবে? গণতান্ত্রিক এ দেশে একেমন সংখ্যাগরিষ্ঠের পরিণতি ফল!
লেখকদ্বয় পর্দা এবং বোরকা বিষয়ক আলোচনা শেষে মেয়েদের চেহারা পর্দাভুক্ত কিনা তা নিয়ে স্বতন্ত্র আলোচনার অবতারণা করেছেন। লেখকদ্বয় বলেন,
এবার আসা যাক দ্বিতীয় প্রশ্নের আলোচনায়। মুসলমান মেয়েদের চেহারা ঢেকে ঘর থেকে বেরোতে হয় এটা কি অবশ্য করণীয়? ইসলামে কি এ ধরনের কোন বিধান আছে? এখানেও আমি সূরা নূরের ৩১ আয়াত ‘মোমিন নারীদের বলুন! তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। তারা যেন সাধারণত প্রকাশমান সৌন্দর্য ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে।’ এর আলোচনা করব। এ আয়াতে বলা হয়েছে ‘তারা যেন সাধারণত প্রকাশমান সৌন্দর্য ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে’। ‘সাধারণত প্রকাশমান সৌন্দর্য’ বলতে আমরা হাতের করতল এবং চেহারাটুকু বুঝি। অর্থাৎ এসব অঙ্গ প্রদর্শন করা যাবে। এসব ঢেকে রাখতে হবে না।…
এরপর তারা ‘সাধারণত প্রকাশমান সৌন্দয’ এর ব্যাখ্যায় মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা থেকে ইবনে আব্বাস রাযি. এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। সাথে তাঁর এ ব্যাখ্যাকে কোন কোন মনীষীজন সমর্থন করেছেন তাও উল্লেখ করেছেন। এরপর তারা বলেন,
অতএব, কোরআনই যখন চেহারা অনাবৃত রাখার অনুমতি দিচ্ছে নারীরা কোন যুক্তিতে চেহারা ঢেকে রাখবে। সমাজে চেহারা ঢাকার জঘন্য প্রথাটাও চালু করেছে ধর্মের চক্রান্তকারীরা। ইসলামের এর কোন স্থান নেই।
জনাবদ্বয়! এবার আমাদের কিছু কথা শুনুন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
অর্থ : হে নবী! আপনি মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিম্নগামী করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হিফাযত করে। তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে না বেড়ায়। তবে (শরীরের) যে অংশ (এমনিতেই) প্রকাশ হয়ে যায় তার কথা ভিন্ন। (‘সূরা নূর’- ৩১)
উল্লেখ্য, লেখকদ্বয় সাধারণত প্রকাশমান বলে আয়াতাংশের যে অর্থ করেছেন তা মূলানুগ এবং যথার্থ অর্থ নয়।
مَا ظَهَرَ مِنْهَا ‘তবে তার (শরীরের) যে অংশ খোলা থাকে (তার কথা ভিন্ন)’ আয়াতের এ অংশটুকুর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তাফসীর কারকগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. مَا ظَهَرَ مِنْهَا এর ব্যাখ্যা ‘চাদর এবং ওড়না’র দ্বারা করেছেন। অর্থাৎ নারীরা তাদের পরিধেয় পরিচ্ছদের উপর যে ওড়না বা চাদর মুড়িয়ে নেয় তা পরপুরুষের সামনে প্রকাশিত হলে কোন সমস্যা নেই। কেননা তা আড়াল করে রাখা অসম্ভব। হযরত হাসান রহ., ইমাম ইবনে সীরীন রহ., আবুল জাওযা রহ., ইবরাহীম নাখয়ী রহ. প্রমুখের মতও এটি। এ ব্যাখ্যাটিই কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন সুস্পষ্ট বক্তব্যের অনুকূলে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. مَا ظَهَرَ مِنْهَا এর ব্যাখ্যা চেহারা, দুই হাতের তালু এবং আংটি দ্বারা করেছেন। হযরত ইবনে উমর রাযি., হযরত আতা রাযি., হযরত ইকরামা রাযি. প্রমুখের মতও এটি। (আযওয়াউল বায়ান ফী ইযাহিল কুরআনি বিল কুরআন ২৭/২৮১)
যারা বলেন, মুখমণ্ডল আবৃত রাখা মুস্তাহাব বা বর্তমানে যারা বলেন, মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ নয়, তারা ইবনে আব্বাস রাযি.-এর ব্যাখাটিকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে থাকেন। তবে ইবনে আব্বাস রাযি.-এর ব্যাখ্যাটিকে মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ না হওয়ার পক্ষে দলীল হিসেবে গ্রহণ করা কয়েকটি কারণে যথার্থ নয়।
(ক) زينة (সৌন্দর্য) এর ব্যাখ্যা মুখমণ্ডল এবং উভয় হাতের তালু দ্বারা করাটা বাস্তব-সম্মত নয়। কারণ زينة বলা হয়, ঐ উপাদানকে যদ্দ্বারা নারীরা সাজসজ্জা অবলম্বন করে থাকে। যেমন, অলঙ্কার, বস্ত্র ইত্যাদি। আর সেটা নারীদের শারীরিক কোন অংশ নয়। সুতরাং زينة-এর ব্যাখ্যা নারীদের শরীরের কোন অংশ তথা মুখমণ্ডল বা উভয় হাতের তালু দ্বারা করা বাস্তবতা পরিপন্থী। আর এ ব্যাখ্যার সমর্থনে শক্তিশালী কোন দলীলও পাওয়া যায় না। বরং এর বিপক্ষে সুস্পষ্ট দলীল রয়েছে। যাতে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত যে, মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ।
(খ) কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াতে زينة শব্দটি ব্যবহার হয়েছে, সেখানে যীনাত দ্বারা সাজসজ্জার উপকরণ উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। সুসজ্জিত বস্তুর কোন অংশ উদ্দেশ্য নেয়া হয়নি। যেমন,
১. خُذُوا زِينَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ
‘হে বনী আদম! তোমরা নামাযের সময় সাজসজ্জা গ্রহণ কর।’ (সূরা আ’রাফ- ৩১)
২. الْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا
‘ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্তুতি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য।’ (সূরা কাহাফ- ৪৬)
৩. وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِنْ زِينَتِهِنَّ
‘তারা যেন তাদের গোপন সাজসজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে।’ (সূরা নূর- ৩১)
৪. وَلكِنَّا حُمِّلْنَا أَوْزَارًا مِنْ زِينَةِ الْقَوْمِ
‘কিন্তু আমাদের উপর ফিরাউনীদের অলঙ্কারের বোঝা চাপিয়ে দেয়।’ (সূরা ত্বা-হা- ৮৭)
৫. وَمَا أُوتِيتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَمَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَزِينَتُهَا
‘তোমাদের যা কিছু দেয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের ভোগ ও শোভা বৈ কিছুই নয়।’ (সূরা ক্বাসাস- ৬০)
৬. إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى الْأَرْضِ زِينَةً لَهَا
‘আমি পৃথিবীস্থ সবকিছুকে পৃথিবীর জন্য শোভা করেছি।’ (সূরা কাহাফ- ৭)
৭. قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ
‘আপনি বলুন, আল্লাহর সাজসজ্জা যা তিনি বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে?’ (সূরা আ’রাফ- ৩২)
এছাড়াও অন্যান্য আয়াতে زينة দ্বারা সাজসজ্জার উপকরণ উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। আর এটা শতসিদ্ধ কথা, উপকরণ কখনো মূল অবয়বের অংশ হয় না। কুরআনে কারীমে زينة শব্দটি ব্যাপকভাবে এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং বিরোধপূর্ণ স্থানে ঐ অর্থই উদ্দেশ্য নেয়া হবে যা কুরআনে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে।
(গ) ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, ইবনে আব্বাস রাযি. يدنين عليهن-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, নারীরা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হলে একটি চক্ষু ব্যতীত পুরো শরীর আবৃত করে বের হবে। আর এখানে الا ما ظهر منها এর ব্যাখ্যায় তিনি মুখমণ্ডল এবং উভয় হাতের তালু খোলা রাখার কথা বলবেন এতে তো স্ববিরোধী বক্তব্য প্রমাণিত হয়। মূলত তার দু’টি ব্যাখ্যার মাঝে কোন বিরোধ নেই। কারণ আল্লামা ইবনে জারীর রহ. সহীহ সূত্রে ইবনে আব্বাস রাযি. এ একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। বর্ণনাটি হলো-
حدثنى على قال حدثنا عبد الله قال حدثنى معاوية عن على عن ابن عباس ولا يدنين زينتهن الا ما ظهر منها قال الزينة الظاهرة الوجه وكحل العين وخضا الكف والخاتم فهذه تظهر فى بيتها لمن دخل من الناس عليها.
অর্থ : ইবনে আব্বাস রাযি. ولا يدنين زينتهن الا ما ظهر منها ‘তারা তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়াবে না। তবে যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় তার কথা ভিন্ন’ এর ব্যাখ্যায় বলেন, দৃশ্যমান সৌন্দর্য হলো মুখমণ্ডল, চোখের সুরমা, হাতের মেহেদী এবং আংটি। সুতরাং নারীরা তাদের গৃহে যে সকল লোক প্রবেশ করে তাদের সামনে এগুলো প্রকাশ করতে পারবে। (তাফসীরে ইবনে জারীর ত্ববারী ১২/১৮৬)
এই বর্ণনার দ্বারা উভয় বক্তব্যের বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে গেল। কারণ ইবনে আব্বাস রাযি. উক্ত বর্ণনায় সুস্পষ্টরূপে বলে দিয়েছেন, নারীরা মুখমণ্ডল এবং উভয় হাতের তালু তাদের গৃহে যারা প্রবেশ করে তাদের সামনেই শুধু প্রকাশ করতে পারবে। আর তারা হলেন মাহরাম। কারণ নারীগৃহে অপরিচিত লোকদের অবাধ প্রবেশকে কেউ বৈধ বলেন না। সুতরাং ইবনে আব্বাস রাযি.-এর ব্যাখ্যাকে মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ না হওয়ার পক্ষে দলীল হিসেবে পেশ করা সম্পূর্ণ ভুল ও অগ্রহণযোগ্য। এতে স্পষ্ট হয়ে গেল, ইবনে আব্বাস রাযি.-এর মতেও নারীদের জন্য তাদের মুখমণ্ডল পরপুরুষের সামনে অনাবৃত রাখা বৈধ নয়।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
ইবনে আব্বাস রাযি. ইসলামের প্রাথমিক অবস্থার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অর্থাৎ ইসলামের প্রাথমিক যুগে নারীদের জন্য চেহারা এবং করতল অনাবৃত রাখা বৈধ ছিল। (মাজমূউল ফাতাওয়া লিইবনি তাইমিয়াহ ২২/১০৯)
(ঘ) তাছাড়া যদি মেনেও নেয়া হয় যে, ما ظهر দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মুখমণ্ডল এবং উভয় হাতের তালু। তবুও আলোচ্য আয়াতাংশ দ্বারা মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ না হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয় না। কারণ আয়াতে অকর্মক ক্রিয়া ظهر ব্যবহার হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, নিজে নিজে প্রকাশ পাওয়া বা অনিচ্ছায় প্রকাশ হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা সকর্ম ক্রিয়া اظهر ব্যবহার করেননি। যার অর্থ হচ্ছে, ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ করা। সুতরাং এখন আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়, ‘নারীরা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করে বেড়াবে না। তবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের সৌন্দর্যের যে অংশ প্রকাশ হয়ে যায় তাতে কোন ক্ষতি নেই।’ আর মুখমণ্ডল অনিচ্ছায় সাধারণত প্রকাশ হয় না। বরং ব্যক্তির ইচ্ছাক্রমেই প্রকাশ পেয়ে থাকে। হ্যাঁ, তারপরও যদি কখনো মুখমণ্ডল অনিচ্ছায় প্রকাশ হয়ে যায় বা শরীয়ত অনুমোদিত প্রয়োজনের স্বার্থে মুখমণ্ডল অনাবৃত করতে হয় তাতে কোন সমস্যা নেই। (ইমদাদুল ফাতাওয়া ৪/১৮২)
উক্ত ব্যাখ্যাটি আল্লামা ইবনে কাসীর রহ.-এর তাফসীর দ্বারা সমর্থিত। তিনি বলেন,
وَلا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلا مَا ظَهَرَ مِنْهَا أي: لا يُظهرْنَ شيئا من الزينة للأجانب، إلا ما لا يمكن إخفاؤه.
অর্থ : তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করে বেড়াবে না। তবে তার (শরীরের) যে অংশ আড়াল করে রাখা অসম্ভব তার কথা ভিন্ন। অর্থাৎ নারীরা তাদের সৌন্দর্যের কোন অংশই পরপুরুষের সামনে প্রকাশ করবে না। তবে সৌন্দর্যের যে অংশ আড়াল করে রাখা সম্ভব নয় তা প্রকাশ করতে পারবে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ১০/৩৯৬)
আর এ কথা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে, মুখমণ্ডল আড়াল করে রাখা অসম্ভব কিছু নয়; বরং খুবই সহজ। সুতরাং কুরআনে কারীমের পূর্বোল্লেখিত আয়াত দ্বারা সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণিত, মুখমণ্ডল হিজাবের অংশ।
আলকুরআনে উল্লেখিত زِينَتَهُنَّ এবং مَا ظَهَرَ مِنْهَا এর ব্যাখ্যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সুষ্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়নি। তবে সাহাবী এবং তাবিয়ীদের বক্তব্যে এগুলোর ব্যাখ্যা উল্লেখিত হয়েছে। এবং তাদের বক্তব্যেও একক কোন ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়নি। সেখানেও নানা রকম ব্যাখ্যা বিদ্যমান রয়েছে। এবার কয়েকটি ব্যাখ্যার সাথে পরিচিত হওয়া যাক।
১। ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন,
‘তবে দেহের যে অংশ এমনিতেই প্রকাশ পেয়ে যায় তার কথা ভিন্ন।’ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, সুরমা এবং আংটি। (সুনানে বাইহাকী কুবরা; হা.নং ৩৩৪০)
২। অন্য একটি বর্ণনায় আয়াতাংশটির ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন,
প্রকাশমান সৌন্দর্য হলো চেহারা এবং চোখের সুরামা ও করতলের বর্ণিল কারুকাজ এবং আংটি। মেয়েরা এগুলোকে প্রকাশ করতে পারবে নিজেদের ঘরে প্রবেশাধিকার প্রাপ্তদের সম্মুখে। (সুনানে বাইহাকী কুবরা; হা.নং ১৩৯২১)
৩। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ রাযি. ما ظهر منها এর ব্যাখ্যায় বলেন,
এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, পরিহিত বস্ত্র। (আলমুসতাদরাক আলাস সাহীহাইন লিলহাকেম; হা.নং ৩৪৪৯)
৪। অন্য একটি বর্ণনায় আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন,
এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো হাতের তালু এবং চেহারার বস্ত্রখণ্ড। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ; হা.নং ১৭২৮১)
৫। আবূ সালেহ এবং ইকরামা রাযি. আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় বলেন,
তারা যেন তাদের গাত্রাবরণের উপরস্থ সৌন্দর্যকে প্রকাশ না করে। তবে যা এমনিতেই প্রকাশ পেয়ে যায় তাতে কোন সমস্যা নেই। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ; হা.নং ১৭২৮৪)
৬। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. বলেন,
সৌন্দর্য দুই প্রকার- (১) প্রকাশ্য সৌন্দর্য। (২) অপ্রকাশ্য সৌন্দর্য। প্রকাশ্য সৌন্দর্য হলো পরিধেয় বস্ত্র। আর অপ্রকাশ্য সৌন্দর্য হলো, সুরমা, চুড়ি এবং আংটি। এ অপ্রকাশ্য সৌন্দর্য একমাত্র স্বামী ব্যতীত আর কারো দেখার অধিকার নেই। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা; হা.নং ১৭২৯৫, তাফসীরে ইবনে আবী হাতেম; হা.নং ১৩৩৮৬)
৭। ইবনে শিহাব যুহরী রহ. আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় বলেন,
নারীরা ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের সম্মুখে চুড়ি, ওড়না, কানের দুল ব্যতীত অন্য কিছু প্রকাশ করবে না যাদের সাথে আল্লাহ তা‘আলা তাদের বিবাহ নিষিদ্ধ করেছেন। আর সাধারণ মানুষের সম্মুখে একমাত্র আংটি ব্যতীত আর কিছুই প্রকাশ করবে না। (তাফসীরে ইবনে আবী হাতেম; হা.নং ১৩৩৮৯)
৮। সাঈদ ইবনে জুবাইর রাযি. বলেন,
তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না-এর অর্থ তারা তাদের জিলবাব খুলবে না। আর জিলবাব হলো উড়নার উপর পরিহিত এমন একটি বস্ত্র যা পুরো দেহকে ঢেকে নেয়। (তাফসীরে ইবনে আবী হাতেম; হা.নং ১৩৪০০)
৯। উবাইদা সালমানী রাযি.يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلابِيبِهِنّ এর ব্যাখ্যায় বলেন,
নারীরা তাদের বড় চাদরকে মাথার উপর দিয়ে টেনে নিবে। এবং তাদের চোখ ব্যতীত আর কিছুই উন্মুক্ত রাখবে না। এটা হলো, পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পরের নির্দেশনা। এর পূর্বে নারীরা জিলবাব বা বড় চাদর পরিধান করা ব্যতিরেকে চলাচল করতো। ফলে তাদের চেহারা ও করতল দেখা যেত। কারণ পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, নারীরা তাদের সৌন্দর্যকে প্রকাশ করবে না। তবে যা এমনিতেই প্রকাশ পেয়ে যায় তার কথা ভিন্ন। এরপর নারীদেরকে তাদের চেহারা ও করতল আবৃত করে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। (কিতাবুল ঈমান মিন ফাতহিল বারী ৩/৯৮)
লেখকদ্বয় বলেছেন,
সাধারণত প্রকাশমান সৌন্দর্য’ বলতে আমরা হাতের করতল এবং চেহারাটুকু বুঝি। অর্থাৎ এসব অঙ্গ প্রদর্শন করা যাবে। এসব ঢেকে রাখতে হবে না। এটা আমার বক্তব্য নয়। কোরআন সম্পর্কে আমি কী বুঝি? আমি এর কী ব্যাখ্যা করব? যারা কোরআন সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন তারাই এ কথা বলেছেন।
লেখকদ্বয়ের বিনয় উপস্থাপনাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তারা কুরআন বোঝার মত অতি স্পর্শকাতর বিষয়টিকে বিজ্ঞজনদের রিফার করেছেন। এক্ষেত্রে নিজেরা দুঃসাহস দেখাতে যাননি। আমরা পেছনে উল্লেখ করেছি, আলোচিত আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় সাহাবী এবং তাবিয়ী রাযি. থেকে বিভিন্ন বক্তব্য এসেছে। এমন কি স্বয়ং ইবনে আব্বাস রাযি. থেকেও এ সম্বন্ধে একাধিক বক্তব্য বর্ণিত হয়েছে। ফলকথা, এটি একটি মতবৈচিত্রপূর্ণ বিষয়। এ জাতীয় মতবৈচিত্রপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে ইসলামী আইন শাস্ত্রের মূলনীতি কি কলম ধরার আগে তদসম্পর্কে লেখকদ্বয়ের বিষদ অধ্যয়নের প্রয়োজন ছিল। মতবৈচিত্র বিষয় থেকে একটি মতকে ধারণ করে অন্য মতাবলম্বীদেরকে তারা ‘চক্রান্তকারী’ আখ্যা দিলেন কি করে? সাহাবা, তাবেঈন, তাবে তাবেঈনসহ বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম যারা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে মুখমণ্ডলকে হিজাবের অংশ বলেছেন তারা সবাই কি চক্রান্তকারী? নাউযুবিল্লাহ। এ সকল স্বর্ণ মানবদের চক্রান্তকারী আখ্যা দিয়ে লেখকদ্বয় পর্দা ও দীনের বিরুদ্ধে নিজেদের চক্রান্তের বিষয়টিই কি জানান দিচ্ছেন?!
এটা হলো স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা। বাস্তবে কোন মতটি কুরআন সুন্নাহর বক্তব্যের সাথে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ তাই বিবেচ্য। ইবনে আব্বাস রাযি. তার ব্যাখ্যায় কি বুঝাতে চেয়েছেন তা বেরিয়ে এসেছে তাঁর অন্য দু’টি বক্তব্যে। তিনি একটি বর্ণনায় আয়াতাংশটির ব্যাখ্যায় বলেন,
প্রকাশমান সৌন্দর্য হলো চেহারা এবং চোখের সুরামা ও করতলের বর্ণিল কারুকাজ এবং আংটি। মেয়েরা এগুলোকে প্রকাশ করতে পারবে নিজেদের ঘরে প্রবেশাধিকার প্রাপ্তদের সম্মুখে। (সুনানে বাইহাকী কুবরা, হাদীস ১৩৯২১)
অন্য একটি বর্ণনায় তিনি আরো বলেন,
এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো হাতের তালু এবং চেহারার বস্ত্রখণ্ড। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ, হাদীস ১৭২৮১)
এখানে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়া হয়েছে, প্রকাশমান সৌন্দর্য দ্বারা চেহারা এবং করতল উদ্দেশ্য হলেও পরপুরুষের এগুলো প্রদর্শন করার অধিকার নেই। অর্থাৎ নারীরা তাদের এ দু’টি অঙ্গকে তাদের মাহরাম তথা একান্ত ঘনিষ্ঠ ব্লাড রিলেটেড পুরুষদেরেই দেখাতে পারবে; অন্যদের নয়। অন্য বর্ণনায় তো ইবনে আব্বাস রাযি. প্রকাশমান সৌন্দর্য দ্বারা চেহারার বস্ত্রখণ্ড উদ্দেশ্য নিয়েছন। এরপরও কি লেখকদ্বয় জোর গলায় বলবেন ‘সমাজে চেহারা ঢাকার জঘন্য প্রথাটাও চালু করেছে ধর্মের চক্রান্তকারীরা’? লেখকদ্বয় ইবনে আব্বাস রাযি. এর স্বপক্ষে যাদের বক্তব্য রয়েছে তাদের মধ্যে একটি নাম এনেছেন, ইবনে আবি রাবিহা। আমরা সিয়ার, তারিখ এবং রিজাল শাস্ত্রের বিতাবপত্র ঘেটে এ জাতীয় কোন বিজ্ঞ মনীষীর নাম উদ্ধার করতে পারিনি। জানি না লেখকদ্বয় কোন গ্রহ থেকে এ নামের অবতারণা করেছেন। আমরা কেবল আতা ইবনে আবি রবাহ নামক একজন খ্যাতিমান মনীষী জ্ঞানীর কথাই জানি।
লেখকদ্বয় বলেন,
সাধারণত সঠিক পথে রয়েছে এমন পাঁচটি দল বা মতাদর্শের ওপর ইসলাম বিভক্ত। গায়রে মুকাল্লিদিন, হানাফি, শাফেয়ি, হাম্বলি এবং মালেকি। এর ভিতর গায়রে মুকাল্লিদিন, শাফেয়ি, হাম্বলি এবং মালেকিদের মতে নারীরা চেহারা অনাবৃত রাখবে এটাই সিদ্ধান্ত। বাকি আছে হানাফি মতাদর্শ। আমাদের উপমহাদেশের প্রায় সব মুসলমানই হানাফি মতাদর্শের অনুসারী। এ হানাফি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে বলে থাকে, আমাদের এ মতাদর্শ অনুযায়ী আবশ্যক হল, নারীরা চেহারা ঢেকে ঘর থেকে বেরোবে। অথচ এ বক্তব্যটির সত্যতা নেই। একটা বানোয়াট কথা। কিছু প্রমাণ হাজির করছি। স্বয়ং হানাফি মতাদর্শের প্রবর্তক ইমাম আবূ হানিফা রহ. নিজেই বলেছেন, যে মহিলারা চেহারা অনাবৃত রাখবে।
লেখকদ্বয় প্রমাণস্বরূপ বাদাইউস সানাই’, আলমাবসূত, জামিউল বয়ান, আলজামি’ লিআহকামিল কুরআন গ্রন্থ নিচয়ের উদ্ধৃতি পেশ করেছেন। এরপর তারা বলেন,
এরপর যারা হানাফি মাজহাবের বিজ্ঞ আলেম যেমন- ইমাম জাস্সাস, হাসান শাইবানি, কুদুরি, সারাখসি এদের মতো জগৎখ্যাত ইসলাম বিশারদরা চেহারা অনাবৃত রাখার পক্ষে ছিলেন। আপনি এদের কথা মতে নামাজে বুকের ওপর হাত না বেঁধে নাভির নিচে হাত বাঁধতে পারলে এদেরই কথানুযায়ী চেহারা অনাবৃত রাখতে পারবেন না কেন?
জনাবদ্বয়! আপনাদের কে বলেছে গাইরে মুকাল্লিদ, শাফেয়ী এবং হাম্বলী মতাদর্শ মতে নারীর চেহারা অনাবৃত রাখাটাই সিদ্ধান্ত? এ তথ্য কোথা থেকে হাজির করেছেন? জনাব! শাফেয়ী এবং হাম্বলী মতাদর্শ মতে নারীর চেহারা আবৃত করে রাখাটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এ মতাদর্শ দু’টিতে এ বিষয়ে বিচ্ছিন্ন কিছু ভিন্নমত পরিলক্ষিত হলেও সেগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। প্রয়োজনে খতীব শারবিনী রহ. এর মুগনিল মুহতাজ, শাফিয়ী সগীর রহ. এর নিহায়াতুল মুহতাজ এবং ইবনে কুদামা রহ. এর আলমুগনী গ্রন্থত্রয় থেকে নারীর পর্দা বিষয়ক পূর্ণ আলোচনা অধ্যায় গভীর মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করুন। কোন মাসলাকের কোন মতটি অগ্রাধিকারযোগ্য এবং মুফতা বিহী তথা ফতওয়ার পর্যায়ভুক্ত তা নির্ণয়ের কিছু মূলনীতি রয়েছে। সেসব মূলনীতির আলোকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। এটি একটি শাস্ত্রীয় বিধি। হুট করেই কোন একটি মতকে সিদ্ধান্ত বক্তব্যের পর্যায়ভুক্ত করা যায় না। আর গাইরে মুকাল্লিদ এটা কোন সুবিন্যস্ত মাজহাব বা মতাদর্শ নয়। যারা দীন চর্চার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন ইমাম পর্যায়ের মনীষীজনকে অনুকরণ করে না তারাই হলো গাইরে মুকাল্লিদ। এদের মাঝেও রয়েছে নানা মাত্রিক মত ও পথের ভিন্নতা। তাই কতিপয় ব্যক্তি বিশেষের অভিমতকে ঢালাওভাবে সকল গাইরে মুকাল্লিদ উলামায়ে কেরামের অভিমত বলে চালিয়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই। তবে বর্তমানে যারা আহলে হাদীস বা সালাফী বলে নিজেদের পরিচয় দেয় তাদের অধিকাংশই নারী চেহারা অবৃত করে রাখার প্রবক্তা। কেবল শায়খ আলবানী রহ. এবং জনাব জাকির নায়েক সাহেবের মত কয়েকজন গাইরে মুকাল্লিদ সজ্জন রয়েছেন যারা নারীর চেহারাকে অনাবৃত করে রাখার প্রবক্তা।
আর হানাফী এবং মালেকি মতাদর্শে নিরঙ্কুশভাবে নারীদের জন্য চেহারা অনাবৃত করে রাখার বৈধতা দেয়া হয়নি। বরং এ দু’টি মতাদর্শ মতে নারীরা কেবল ঐসকল ক্ষেত্রেই চেহারা অনাবৃত করে বেরুতে পারবে যেখানে পুরুষের লোলুপ ও কাম দৃষ্টি পড়ার আশঙ্কা নেই এবং পারস্পারিক আকর্ষণ বিকর্ষণেরও সম্ভাবনা নেই। আল্লামা উলাইশ রহ. বলেন,
যদি সম্মোহন বা আকর্ষণ সৃষ্টির আশঙ্কা না থাকে তবে নারীদের জন্য পরপুরুষের সম্মুখে চেহারা এবং করতল অনাবৃত করে রাখার অবকাশ আছে এবং পুরুষের জন্যও নারী চেহারা দেখার অনুমতি আছে। আর যদি সম্মোহন বা আকর্ষণ সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয় তবে সিদ্ধ এবং চূড়ান্ত কথা হলো এজাতীয় ক্ষেত্রে চেহারা এবং করতল আবৃত করে রাখা আবশ্যক। আল্লামা হাত্তাব রহ. এর মাওয়াহিবুল জালীল গ্রন্থেও এমনটি বিবৃত হয়েছে। (মিনাহুল জালীল ১/১৩২, মাওয়াহিবুল জালীল ১/৪৯৯)
হানাফী মতাদর্শের সর্বজন সমাদৃত অনবদ্য বিশ্লেষণী ফতওয়া গ্রন্থ ফাতাওয়া শামী এর বিদগ্ধ গ্রন্থকার আল্লামা ইবনে আবিদীন রহ. বলেন,
যদি কামনা বা সম্মোহন সৃষ্টির আশঙ্কা বা শংসয় সৃষ্টি হয় তবে পরনারীর চেহারা দর্শন করা নিষিদ্ধ। এ নির্দেশনা হলো সত্যান্বেষী পূর্বসূরীদের সময়কার। আর আমাদের যুগে যুব বয়সী নারীদের চেহারা দর্শন সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ হবে। তবে মামলা মুকাদ্দামার মত একান্ত প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলোর ব্যাপার স্বতন্ত্র।
তিনি সালাতের শর্ত অধ্যায়ে বলেন,
‘পরপরুষের সামনে যুবতী নারীদের জন্য চেহারা অনাবৃত রাখা নিষিদ্ধ। এ নিষিদ্ধতা সতরের কারণে নয়; বরং সম্মোহন বা আকর্ষণ সৃষ্টির আশঙ্কার কারণে।’ তাযীর তথা লঘুদণ্ড অধ্যায়ে তিনি বলেন, স্ত্রীরা পরপুরুষের সম্মুখে চেহারা অনাবৃত রাখলে স্বামীরা তাদের লঘু দণ্ড প্রদান করবে।’ (তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম ৪/১৫৮)
শামসুল আইম্মাহ সারাখসী রহ. পর্দা বিষয়ক আলোচানা শেষে বলেন,
যদি জানা যায় নারী চেহারার দিকে দৃষ্টি দিলে সম্মোহন বা আকর্ষণ সৃষ্টি হবে তবে নারীর কোন অঙ্গ দেখা কোন ক্রমেই বৈধ হবে না। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কাম বশত পরনারীর সৌন্দর্যের দিকে দৃষ্টিপাত করবে কিয়ামতের দিন তার দু চোখে গলিত শিশা ঢেলে দেয়া হবে। এবং তিনি আলী রাযি. কে বলেছেন একবার দৃষ্টি দেয়ার পর দ্বিতীয়বার দৃষ্টিপাত করবে না। কারণ প্রথমবার দৃষ্টি দেয়া তোমার জন্য অনুমোদিত। আর দ্বিতীয়বার দৃষ্টি দেয়া তোমার জন্য নিষিদ্ধ। অর্থাৎ দ্বিতীয়বার কাম বা সম্মোহন বশত দৃষ্টিপাত করা তোমার জন্য নিষিদ্ধ। তেমনিভাবে যদি প্রবল ধারণা হয়, দৃষ্টিপাত করলে সম্মোহন বা আকর্ষণ সৃষ্টি হবে তবুও দৃষ্টিপাত করা নিষিদ্ধ হবে। কারণ অজ্ঞাত ক্ষেত্রে প্রবল ধারণা নিশ্চয়তার নামান্তর। (আলমাবসূত লিস সারাখসী ৩/৩০১)
একারণেই হানাফী মতাদর্শে দু’টি ধারা তৈরি হয়েছে। ১। উলামায়ে মুতাকাদ্দিমীন তথা পূর্বসূরী উলামায়ে কেরাম। ২। উলমায়ে মুতাআখখিরীন তথা পরবর্তী উলামায়ে কেরাম। পরবর্তী উলামায়ে কেরামের মতাদর্শ হলো নারীরা বাহিরে বের হলে চেহারা আবৃত করে বেরোবে। যদিও পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরাম এক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা প্রদর্শন করেছেন। এবং সে শিথিলতা সে যুগের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। শায়খ তাকি উসমানী দা.বা. বলেন,
উপভোগেচ্ছা এবং সম্মোহন সৃষ্টি থেকে নিরাপদ থাকার শর্ত সাপেক্ষে হানাফী এবং মালেকী মতাদর্শিক উলামায়ে কেরাম পরনারীর চেহারা দর্শনের অনুমতি দিয়েছেন। তবে এ শর্তের উপস্থিতি বেশ দুরুহ ব্যাপার। বিশেষত আমাদের এ আধুনিক যুগে। যখন ব্যাপকভাবে বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ শর্ত পাওয়া যায় না। একারণে পরবর্তী উলামায়ে কেরাম পরনারীর চেহারা দর্শনকে নিরংকুশভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। (তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম ৪/১৫৮)
লেখকদ্বয় বলেছেন, ইমাম আবূ হানীফা রাযি. নিজেই বলেছেন, মহিলারা চেহারা অনাবৃত রাখবে। এর সপক্ষে তিনি বাদাইউস সানাই’সহ বেশ কয়েকটি ফিকহী গ্রন্থের উদ্ধৃতি উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু লেখকদ্বয় রিফার করা গ্রন্থগুলো কি আদৌ অধ্যয়ন করে দেখেছেন। অধ্যয়ন করে থাকলে আংশিক অধ্যয়ন করেছেন না পূর্ণাঙ্গ অধ্যয়ন করেছেন। কোন গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি পেশ করতে হলে পূর্ণ উদ্ধৃতিই পেশ করতে হয়। আংশিক উদ্ধৃত করলে পাঠক বিভ্রান্ত হয়। ইমাম কাসানী রহ. বাদাইউস সানায়ে’ তে বলেছেন,
বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য চেহারা এবং করতল অনাবৃত রাখা বৈধ আছে। এটা ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর বক্তব্য। অন্য একটি বর্ণনা মতে আবূ হানীফা রহ. এর মতে পদযুগলও অনাবৃত রাখা বৈধ আছে। তবে এ বর্ণনাটি ‘যাহিরুর রিওয়াইয়াহ’ এর পর্যায়ভুক্ত নয়। আর ফতওয়া প্রদানের ক্ষেত্রে যাহিরুর রিওয়াইয়াহই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। যাহিরুর রিওয়াইয়াহ এর বক্তব্য মতে নারীদের পদযুগল অনাবৃত রাখা যাবে না।
ইমাম কাসানী রহ. এর সপক্ষে যুক্তি টেনে বলেন,
কারণ ইবনে আব্বাস রাযি. এর ব্যাখ্য মতে পবিত্র কুরআনে শুধু চেহারা এবং করতলকে অনাবৃত রাখার অবকাশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং চেহারা এবং করতল ব্যতিরেকে অন্যান্য সকল অঙ্গের ক্ষেত্রে অনাবৃত করে রাখার নিষেধাজ্ঞা যথা নিয়মে বলবৎ থাকবে। উপরন্তু পরনারীর চেহারা দর্শনের বৈধতা বিশেষ প্রয়োজন সাপেক্ষে প্রদান করা হয়েছে। আর পদযুগল অনাবৃত করে রাখার কোন প্রয়োজন নেই। সুতরাং পরনারীর পদযুগল দর্শন করা বা অনাবৃত রাখা বৈধ হবে না। এরপর কাসানী রহ. বলেন, পরনারীর চেহারা দর্শন তখনই বৈধ হবে যখন সম্মোহন, আকর্ষণ এবং কামবাসনা থেকে নিরাপদ থাকবে। কামবাসনা বা সম্মোহন বা আকর্ষণ সৃষ্টি হলে পরনারীর চেহারা বা করতল দর্শন করা বৈধ হবে না। বাদাইউস সানাই’ ৪/২৯৪ (মাকাতাবা যাকারিয়া দেওবন্দ, ইন্ডিয়া)
লেখকদ্বয় দীর্ঘ এ আলোচনাংশ থেকে খণ্ডিত একটি অংশ উল্লেখ করে বিভ্রান্তিকর উপস্থাপনায় বলে দিলেন, ‘স্বয়ং হানাফী মতাদর্শের প্রবর্তক ইমাম আবূ হানিফা রহ. নিজেই বলেছেন যে, মহিলারা চেহারা অনাবৃত রাখবে।’ অথচ হানাফী ফিকহী গ্রন্থসমগ্রের কোন জায়গায়ই ঢালাওভাবে নারী চেহারাকে অনাবৃত করে রাখার কথা বলা হয়নি। তাদের উপস্থাপনায় মনে হয়, ইমাম আবূ হানীফা রহ. নারীদের চেহারা অনাবৃত রাখার ব্যাপার নির্দেশ দিয়েছেন। কলম চালনার ক্ষেত্রে এ জাতীয় কর্মপন্থা গ্রহণ করা কি কোন নীতি নৈতিকতা বা সততার পর্যায় পড়ে?
লেখকদ্বয় হানাফী মতাদর্শের যেসব বিজ্ঞ আলেমের কথা উল্লেখ করেছেন তাদের কেউ ঢালাওভাবে নারী চেহারা অনাবৃত রাখার পক্ষে ছিলেন না। তারা বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে নারী চেহারা অনাবৃত রাখার অনুমতি দিয়েছেন। লেখকদ্বয় হানাফী মাসলাকের বিজ্ঞ আলেমদের তালিকা দিতে গিয়ে ‘হাসান শাইবানী’ নামের একজন ব্যক্তিকে উল্লেখ করেছেন। কে এই হাসান শাইবানী? লেখকদ্বয় কি তার পরিচয় জানেন? আমরা তো জ্ঞান আকাশের তারকা, খ্যাতিমান মনীষী মুহাম্মদ ইবনুল হাসান আশশাইবানী রাযি. কে চিনি। হাসান শাইবানী নামে তো কাউকে চিনি না।
লেখকদ্বয় বলেছেন,
আপনি এদের কথা মতে নামাজে বুকের ওপর হাত না বেঁধে নাভির নিচে হাত বাঁধতে পারলে এদেরই কথানুযায় চেহারা অনাবৃত রাখতে পারবেন না কেন?
জনাব! আমরা কারো কথা মতে নামাযে বুকের উপর হাত না বেঁধে নাভির নিচে হাত বাঁধি না এবং বাঁধতেও পারি না। সূত্রপরম্পরায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাশ্বত কর্মপন্থা আমাদের সম্মুখে উপস্থিত। আমরা সেই কর্মপন্থা মতেই নামাযে নাভির নিচে হাত বাঁধি। সুতরাং কারো কথা মতে মুসলিম মা-বোনেরা চেহারা আবৃত রাখে না; বরং কুরআন-সুন্নাহর কথা মতে তারা চেহারা আবৃত রাখে।
লেখকদ্বয় বলেন,
কথা আর বাড়াতে চাই না। চেহারা অনাবৃত রাখার ব্যাপারে স্বয়ং ইসলামের প্রবর্তক মুহাম্মদ (সা.)-এর বক্তব্য কি তা জেনে নিই।
এরপর তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দু’টি বক্তব্য, একটি কর্মপন্থা এবং আয়েশা রাযি. এর একটি ব্যাখ্যামূলক বক্তব্য উল্লেখ করেছেন।
প্রথম হাদীসটি হলো, হযরত আয়েশা রাযি. বর্ণনা করেন,
একবার হযরত আসমা রাযি. এমন অবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখোমুখি হলেন যে, তার পরিধেয় বস্ত্র ছিল একেবারে পাতলা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তার উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন এবং তার উদ্দেশ্যে বললেন, হে আসমা! যখন নারীরা বয়ঃসন্ধিকালে উপনীত হয় তখন তাদের এমন কাপড় পরিধান করা উচিত নয়, যার দ্বারা তাদের দেহের কোন অংশ দৃষ্টিগোচর হয়, কেবলমাত্র এই অংশটি আর এই অংশটি ছাড়া। এ সময় তিনি চেহারা এবং হাতের তালুর দিকে ইঙ্গিত করেন। (সুনানে আবূ দাউদ; হা.নং ৪১০৬)
আলোচিত এ হাদীসটি দলীল হিসেবে উপযোগী নয়। কারণ ইবনে কাসীর রহ. বলেন,
আবূ দাউদ এবং আবূ হাতেম রাযী রহ. এর বর্ণনা সূত্রকে বিচ্ছিন্ন বলেছেন। কারণ হাদীসটির বর্ণনাকারী খালেদ ইবনে দারীক আয়েশা রাযি. এর সাক্ষাৎ পায়নি। উক্ত হাদীসের সূত্রে আবূ আব্দুর রহমান সাঈদ ইবনে বাশীর বসরী নামক একজন বর্ণনাকারী আছেন। যার ব্যাপারে রিজাল শাস্ত্রের একাধিক উলামায়ে কেরাম কালাম (শাস্ত্রীয় অভিযোগ) করেছেন।
হাফেয আবূ আহমদ আল জুরজানী হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন,
সাঈদ ইবনে বাশীর ছাড়া অন্য কেউ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন বলে আমি জানি না এবং সে একবার আয়েশা রাযি.-এর স্থানে উম্মে সালামা রাযি.-এর নাম উল্লেখ করেছে। অর্থাৎ তিনি ইজতেরারের দোষে দুষ্ট।
আল্লামা শানকীতী রহ. আযওয়াউল বায়ান-এর ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৫৯৭ পৃষ্ঠায় লেখেন,
হাদীসটি দুই দিক থেকে দুর্বল- (১) হাদীসটির সূত্র বিচ্ছিন্ন। কেননা খালেদ ইবনে দারীক আয়েশা রাযি. থেকে হাদীসটি শোনেননি, যেমনটি আবূ দাউদ এবং আবূ হাতেম রাযী রহ. বলেছেন। (২) উক্ত হাদীসের সূত্রে সাঈদ ইবনে বাশীর রয়েছেন যাকে ইবনে হাজার রহ. আত-তাকরীবে (ضعيف) দুর্বল বলে অভিহিত করেছেন। সাথে সাথে হিজাবের বিধান ব্যাপক হওয়ার ব্যাপারে যে সকল দলীল উল্লেখ করা হয়েছে তার বিপরীতে হাদীসটির অবস্থান খুবই দুর্বল। সর্বশেষ তিনি বলেন, হাদীসটি যে স্তরের তাতে এর দ্বারা দলীল পেশ করা যায় না। বিশেষ করে স্পর্শকাতর এ বিষয়ের ক্ষেত্রে। (আল ই’লাম বিনক্দিল হালালি ওয়াল হারাম; পৃষ্টা ৪৫-৪৬)
দ্বিতীয় বর্ণনাটি হলো, বলা হয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
কোন কিশোরী যখন ঋতৃ¯্রাবের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত বয়সে উপনীত হয় তখন তার চেহারা এবং কবজি পর্যন্ত দুই হাত ব্যতিরেকে অন্যকিছু দেখা বৈধ নয়। মারাসীলে আবূ দাউদ, হাদীস ৪১৩।
এ বর্ণনাটির সূত্র বিচ্ছিন্ন। বর্ণাটির সূত্রপরম্পরায় দু’জন বর্ণনাকারী উহ্য রয়েছে। দেখুন আননাযার লিইবনিল কাত্তান ১৬৮, আদ দিরায়াহ লিইবনি হাজর ১২৩।
তৃতীয় যে বর্ণনাটি তিনি উদ্ধৃত করেছেন তা হলো,
আয়েশা রাযি. বলেন, নারীর যা প্রকাশ থাকে তা হলো তার চেহারা এবং করতলদ্বয়।
লেখকদ্বয় বর্ণনাটির সূত্র হিসেবে মুসান্নাফে ইবনে শাইবা উল্লেখ করেছেন। খণ্ড নাম্বার ৩ এবং পৃষ্ঠা নাম্বার ৫৪৬ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু হাদীস নাম্বার এবং প্রকাশনা উল্লেখ করেননি। তবে আমাদের যথাসাধ্য অনুসন্ধানে বর্ণনাটি মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাতে পাওয়া যায়নি। হাদীসটি সুনানে বাইহাকী কুবরাতে রয়েছে। হাদীস নাম্বার ৩৩৪২। এ বর্ণনাটি দলীল উপযোগী নয়। কারণ এর সূত্র দুর্বল। দেখুন আলজাওহারুন নাকী, সুনানে বাইহাকী কুবরার সাথে মুদ্রিত (২/২২৫)।
অন্যদিকে আয়িশা রাযি. থেকে চেহারা আবৃত রাখা সংক্রান্ত একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
চতুর্থ পর্যায়ে লেখকদ্বয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যে আমলগত হাদীসটি উল্লেখ করেছেন তা হলো, মুযদালিফা থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রত্যাবর্তনের ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে হযরত আলী রাযি. বর্ণনা করেন,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফযল ইবনে আব্বাস রাযি. কে নিজের বাহনের পিছনে বসিয়ে নিলেন। অতঃপর তিনি জামরার (শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের স্থানের) কাছে চলে আসেন। এখানে তিনি রমী (পাথর নিক্ষেপ) করেন। এরপর তিনি চলে আসলেন কুরবানী করার স্থানে। এ বর্ণনাতেই এ কথা বর্ণিত আছে, খাসআম গোত্রের এক যুবতী নারী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা একেবারে বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। তার উপর হজ ফরয হয়েছে। যদি আমি তার পক্ষ থেকে হজ আদায় করে নেই, তাহলে কি তিনি দায়মুক্ত হবেন? জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, পিতার পক্ষ থেকে তুমি হজ আদায় করে নাও। এ কথার ফাঁকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ফযল ইবনে আব্বাস রাযি.-এর চেহারা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ৮৮৫)
সহীহ বুখারীর বর্ণনায় এসেছে,
ফযল ইবনে আব্বাস সেই নারীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। যুবতীর রূপ তাকে বিমোহিত করে ফেলল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রশ্নের জবাব দিবেন এই মুহূর্তে লক্ষ্য করলেন, ফযল ইবনে আব্বাস তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের হাত পেছনে নিয়ে ফযল ইবনে আব্বাস রাযি.-এর চিবুক ধরে তার মুখমণ্ডল যুবতীর দিক থেকে ফিরিয়ে দিলেন। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৬২২৮)
উপস্থাপিত চতুর্থ হাদীসটির উত্তরে শাইখ সালেহ ফাউযান রহ. বলেন,
এটা একটা আশ্চর্য ধরনের দলীল। কারণ প্রতিপক্ষ যা প্রমাণ করতে চেয়েছেন হাদীসটি এর বিপরীত জিনিস প্রমাণ করে। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো ফযল ইবনে আব্বাস রাযি.-কে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দেননি। বরং চেহারা ঘুরিয়ে দিয়েছেন। যদি পরনারীর চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকা বৈধ হতো তাহলে কীভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৈধ বিষয় থেকে বারণ করলেন?
ইমাম নববী রহ. উক্ত হাদীসের উপকারিতা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেন,
ومنها تحريم النظر الى الاجنبية অর্থাৎ উক্ত হাদীস থেকে এ কথাটি প্রমাণিত হয় যে, পরনারীর দিকে দৃষ্টি দেওয়া হারাম। ومنها ازالة المنكر باليد لمن امكنه অর্থাৎ উক্ত হাদীস থেকে এ বিষয়টিও প্রমাণ হয় যে, সক্ষম ব্যক্তির জন্য কর্তব্য হলো, শরীয়ত গর্হিত কাজ হাত দ্বারা প্রতিহত করা।
আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রহ. তার কিতাব রওযাতুল মুহিব্বীন-এর ১০২ পৃষ্ঠায় লেখেন,
وهذا منع وانكار بالفعل فلو كان النظر جائز لاقره عليه.
অর্থাৎ এটা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন এবং কাজের মাধ্যমে নিষেধকরণ। সুতরাং যদি দৃষ্টি দেওয়া জায়েয হতো তাহলে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দিতেন।
আল্লামা শানকীতী রহ. উক্ত দলীলের উত্তর দু’ভাবে প্রদান করেছেন। যার সারমর্ম হলো,
(ক) কোন হাদীসেই স্পষ্টভাবে এ বিষয়টি নেই যে, ঐ নারীর চেহারা খোলা ছিল এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার চেহারা অনাবৃত দেখে তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। বরং হাদীসে সর্বোচ্চ এতটুকু আছে যে, সে নারী সুশ্রী ছিল। কোন কোন বর্ণনায় আছে حسناء তথা খুব সুন্দরী ছিল। আর উজ্জ্বল বা সুন্দরী হওয়া এ বিষয়টি আবশ্যক করে না যে, তার চেহারা অনবৃত ছিল এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে এর উপর বহাল রেখেছেন। বরং কখনো কখনো অনিচ্ছায় চেহারার খুলে যায় ফলে অনিচ্ছায় কেউ দেখে ফেলে। অথবা এটাও হতে পারে যে, পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে তার সৌন্দর্য সম্পর্কে অবগত হয়েছিল। তাছাড়া নারীদের সৌন্দর্য বোঝার জন্য চেহারা খোলা থাকা জরুরি নয়। বরং হাতের আঙ্গুল দ্বারাই মহিলাদের সৌন্দর্য ও উজ্জ্বলতা অনুধাবন করা যায়।
(খ) ঐ নারী ইহরাম রত ছিলেন। আর ইহরাম অবস্থায় নারীদের জন্য চেহারা এবং উভয় হাতের তালু খোলা রাখা বৈধ যদি কোন পরপুরুষ সেখানে বিদ্যমান না থাকে। হ্যাঁ, যদি সেখানে কোন পুরুষ থাকে তাহলে চেহারা আবৃত রাখা আবশ্যক। যেমনটি উম্মাহাতুল মুমিনীনদের আমল ছিল। আর এ কথাও কেউ বলেনি যে, ঐ নারীকে ফযল ইবনে আব্বাস রাযি. ছাড়া অন্য কেউ দেখেছেন। আর ফযল ইবনে আব্বাস রাযি.-কে তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারণই করেছেন। সুতরাং উল্লিখিত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হলো যে, ঐ নারী ইহরামরত ছিলেন। ফলে তিনি মুখমণ্ডল অনাবৃত করেছেন মুহরিম হওয়ার কারণে। মুখমণ্ডল অনাবৃত রেখে সফরে বের হওয়া বৈধ এই জন্য নয়। অবশেষে তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফযল ইবনে আব্বাসের চেহারা ঘুরিয়ে দেয়ার দ্বারা এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, কোন যুবতী নারীর দিকে অপরিচিত পুরুষ ব্যক্তিকে তাকিয়ে থাকতে দেয়া যাবে না। আর পূর্বোক্ত দলীলসমূহ নারীদের সমস্ত শরীর ঢেকে রাখা আবশ্যক হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে। (আল ই’লাম বিনক্দিল হালালি ওয়াল হারাম; পৃষ্ঠা ৪৬-৪৮)
আর উম্মুল মুমিনীন এবং অন্যান্য বিজ্ঞ মহিয়সী সাহাবিয়াগণ তো হজ্বের সময়ও পরপুরুষের সম্মুখে মুখাবয়ব আবৃত রাখতেন। তাহলে কুরআনের একাধিক প্রবচন, হাদীসের অসংখ্য বিশুদ্ধ বর্ণনা এবং প্রথম সারির সাহাবিয়াদের কর্মপন্থার বিপরীতে এ জাতীয় একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দ্বারা কি করে একটি স্বীকৃত এবং স্বতঃসিদ্ধ বিধানকে ম্রিয়মাণ করার দুঃসাহস দেখানো যেতে পারে?
লেখকদ্বয় তার প্রবন্ধের প্রান্তিক আয়োজনে বলেন,
সুতরাং স্বয়ং মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষা হল মহিলারা কোনকালেই চেহারা ঢাকবে না। বরং লম্পট পুরুষদের উচিত তাদের দিকে না তাকানো। আমি মাদ্রাসাপড়–য়া ছাত্র। নবম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় জনৈক শিক্ষককে এ প্রশ্নটিই করেছিলাম যে, নারীকে চেহারা ঢাকতে হবে কেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন পুরুষ যেন তাদের রূপ দেখতে না পায়। কারণ তাহলে সমাজের শৃঙ্খলা নষ্ট হবে। শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে পুরুষদের কারণে। পুরুষরা যেমন মানুষ, নারীরাও তেমন মানুষ। পুরুষরা যেমন শ্রেষ্ঠ জীব নারীরাও তেমন শ্রেষ্ঠ জীব। স্রষ্টা কারও থেকে কারও মর্যাদা কম দিয়ে সৃষ্টি করেননি। সুতরাং পুরুষদের অপকর্মের বোঝা নারীরা বয়ে বেড়াবে কেন? এ পর্যায়ে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম, বোরকা পরা, চেহারা ঢাকা এসব তথাকথিত ওলামা-মাশায়েখদের উদ্ভট চিন্তার ফসল। আসলে ইসলাম ধর্মে এর কোন স্থান নেই। অতএব, শুধু সোনিয়া নয়, তার মতো সব নারীর করণীয় হল এ সব এড়িয়ে চলা। নারীদের জাগতে হবে। জীবনের জয়গান গাইতে হবে। আমি তথাকথিত নারী জাগরণের কথা বলছি না। রাজপথে অর্ধ উলঙ্গ হয়ে নাচতে বলছি না। আমি সুশীল সমাজের নারী জাগরণের কথা বলছি। যারা শুধু রাজপথে নাচবে না। জাতিকে কর্মক্ষেত্র দেখিয়ে দেবে। জাতির আদর্শ হবে।
লেখকদ্বয় বলছেন, ‘স্বয়ং মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষা হল মহিলারা কোনকালেই চেহারা ঢাকবে না।’ লেখকদ্বয়ের মাঝে যদি সামান্য পরিমাণও ঈমানের আলোকছটা থেকে থাকে তবে এ জাতীয় কথা লিখার ক্ষেত্রে তাদের হাতের কলমটি কেঁপে উঠার কথা ছিল। লেখকদ্বয়কে বলব, পর্দা বিষয়ক কুরআনিক প্রবচন, হাদীসের বাণী এবং ফিকহ ফতওয়ার মূলপাঠগুলো আবার গভীর অধ্যাবসায়ের সাথে পাঠ করুন। আশা করি, জড়তা কেটে যাবে। ভাষায় শালীনতা ফিরে আসবে। লেখকদ্বয় বলেছেন, ‘ বরং লম্পট পুরুষদের উচিত তাদের দিকে না তাকানো।’ জনাবদ্বয়! নারীদের দিকে চোখ তুলে না তাকানো লম্পট অলম্পট সকলের জন্য নিছক উচিতই নয়; আবশ্যকও বটে। এটা এক পাক্ষিক দায়বদ্ধতা। এক্ষেত্রে নারী পক্ষের কি কোন দায় নেই? নারী চেহারার আকর্ষণে তো আপাদ মস্তক একজন সভ্য শান্ত রক্ষণশীল ব্যক্তিও অকস্মাৎ লম্পট বনে যেতে পারে। পুরুষের এ জাতীয় লাম্পট্য থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য নারীর কি কোন করণীয় নেই? নারীর কারণে যদি পুরুষের লাম্পট্য বাস্তবতার মুখ দেখে তবে এতে কার কতটুকু ক্ষতি হবে? পুরুষ নামের পশুটি তো যৌনতার স্বাদ নিয়ে রিলাক্স মুডে ঘরে ফিরবে। কিন্তু নারী বেচারীর কি হবে? লেখকদ্বয় যদি বলেন, ‘বর্তমানের জরায়ূ স্বাধীনতার যুগে এতে নারীর কিছু আসে যায় না। এখন যৌনতা একটি শিল্প। লাভজনক বাণিজ্য। এখন পতিতারা হলো পর্ণ শিল্পী, নিশি কন্যা। এখন এতে নারীর কিছু আসে যায় না।’ তবে আমাদের আলোচনার গতিকে রিমুভ করতে হবে। দুদিক থেকে দু’টি গাড়ি আসলে দু’টি গাড়িরই দায় পড়ে যায় দুর্ঘটনাকে এড়িয়ে চলা। একটি গাড়ি যত সাবধানীই হোক না কেন অন্যটি যদি সাবধানী না হয় তাহলে দুর্ঘটনাকে এড়ানো কখনো সম্ভব হবে না। বরং এক্ষেত্রে যে গাড়িটি বেশি গতিময়, বেশি এক্সিডেন্ট প্রবণ সাবধানী হওয়া এবং দুর্ঘটনা এড়ানোর ক্ষেত্রে তার দায়টা বহু গুণে বেশি। পুরুষের তুলনায় নারীদের এক্সিডেন্ট ঘটানোর ক্ষমতা বেশি। তাই দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য তার দায়িত্বটাও তুলনামূলক বেশি। তাই তাকে পথ চলার ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার মূল উপাদানটিকে আড়াল করে রাখতে হয়। মুক্ত সিংহের নিকট দিয়ে চলাচলের সময় আত্মরক্ষার যাবতীয় ব্যবস্থা মানুষকেই গ্রহণ করতে হবে। সিংহকে ‘মানুষ হত্যা মহাপাপ’ -এর হাজারো ফতওয়া শুনিয়ে মানুষ আত্মরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে দায়মুক্ত হতে পারবে না। মানুষ হত্যা থেকে বিরত থাকার যাবতীয় দায়ভার সিংহের উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে দায়মুক্ত হতে গেলে তার খেসারত মানুষকেই দিতে হবে। সুতরাং মানুষ নামের পশুর উপর যাবতীয় দায়ভার চাপিয়ে দিয়ে নারীদের সম্পূর্ণ দায়মুক্ত হয়ে অনাবৃত চেহারায় বের হওয়ার কোন সুযোগ নেই। নিজের সতীত্ব রক্ষার্থেই নারীকে এ বাড়তি ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। চেহারা আবৃত রাখার ক্ষেত্রে স্বার্থটা মূলত নারীর; পুরুষের নয়। নারীর নিরাপত্তা বিধানের স্বার্থেই তাকে চেহারা আবৃত করে পথ চলতে হবে।
লেখক বলেছেন, আমি মাদরাসা পড়ুয়া ছাত্র। এখানে এসে আলমাস সাহেব যুগলবন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে গেলেন। আমরা থেকে আমিতে চলে এসেছেন। এতে প্রতীয়মান হলো আলোচিত নিবন্ধের মূল পথিকৃত তিনি নিজেই। তাসফিয়া সাহেবার এতে শেয়ার থাকলেও তা যৎসামান্য। কিন্তু কথা হলো তিনি মাদরাসা পড়ুয়া ছাত্র হয়ে এ জাতীয় বিভ্রান্তিকর তথ্যে ঠাসা এমন একটি অশালীন উপস্থাপনার নিবন্ধ লিখতে পারলেন কি করে? এতে কি মাদরাসা পড়ুয়া ছাত্রদের মান ক্ষুণ্ন হয় না? মাদরাসা জীবনে নিয়মিত পাঠে মনোযোগী হলে তো এ জাতীয় অশালীন মানসিকতা ও তথ্যবিভ্রাটে নিপতিত হওয়ার কথা নয়।
লেখকদ্বয় বলেছেন, ‘শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে পুরুষদের কারণে।’ জনাব! সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্টের জন্য কি একমাত্র পুরুষই দায়ী? নারীদের এখানে কোন দায় নেই? আলমাস সাহেব! চোখ কান খোলা রেখে চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে কলম চালনা করুন। তবে কলমে উদারতা আসবে। সংকীর্ণতা, কূপমণ্ডুকতা এবং প্রান্তিকতা বিদূরীত হবে। নারী ঘটিত সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্টের জন্য কে কতটুকু দায়ি তার ফিরিস্তি তুলে ধরতে গেলে স্বতন্ত্র একটি নিবন্ধ দাঁড়িয়ে যাবে। এক হাতে তালি বাজানোর অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শনের কসরত করবেন না। নারীদের ঘর থেকে বের করে এনে, তাদের চেহারার আবরণ খুলে দিয়ে কি যে মর্যাদার উপঢৌকন আপনারা তাদের গিফট করতে চান তা আজ বেশ ভালো করেই উপলুব্ধ হচ্ছে।
লেখকদ্বয় বলেছেন, ‘স্রষ্টা কারও থেকে কারও মর্যাদা কম দিয়ে সৃষ্টি করেননি।’ একথা বলে লেখকদ্বয় কি বুঝাতে চান? নারী পুরুষের সমমর্যাদা এবং সমধিকারের কথা বলতে চান? তবে তো দীর্ঘ আলোচান সাপেক্ষ একটি বিষয়ের অবতারণা করে ফেললেন। বস্তুত স্রষ্টা মর্যাদার ঝুড়ি মাথায় তুলে দিয়ে মানুষকে এ জগতে পাঠাননি। স্রষ্টা মানুষকে বিধানগত কিছু মূলনীতি দিয়েছেন। সে মূলনীতি অনুসারে পথ চলে মানুষকে মর্যাদা অর্জন করে নিতে হয়। মর্যাদা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার মত কোন বস্তু নয়। এটি একটি অর্জনগত বিষয়। মানুষকে এটা তার কর্ম ও আচরণ দিয়ে অর্জন করে নিতে হয়। এদিক বিবেচনায় পুরষের মাঝেও মর্যাদাগত তারতম্য সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে একজন নারীও তার কর্ম ও আচরণগত শ্রেষ্ঠত্যের মাপকাঠিতে একজন পুরুষ থেকেও অধিক মর্যাদার আসনে সমাসীন হতে পারে। আলকুরআনের ভাষ্যমতে শ্রেষ্ঠত্ব এবং মর্যাদার মাপকাঠি হলো স্রষ্টাভীতি। নারীকে মহান স্রষ্টা যে দায়িত্ব প্রদান করেছেন তার যথাযথ প্রতিপালনে সে পুরুষের সমান কেন তার চেয়েও অধিক মর্যাদার আসনে সমাসীন হয়ে যেতে পারে। নারীকে যেমন গঠনগত, সৃষ্টিগত এবং আচরণগত দিক থেকে পুরুষ থেকে একটু স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে তাই তার দায়িত্ব ও কর্মের মাঝেও পুরুষের দায়িত্বের তুলনায় কিছুটা স্বাতন্ত্র্য প্রদান করা হয়েছে। এ স্বাতন্ত্র্যকে বৈষম্য বলে চেচামেচি করলে তাকে নিছক উন্মাদনা বৈ আর কিছুই বলা হবে না। মানুষের পদমর্যাদা এবং ধনৈশ্বর্যের ব্যবধানের মাঝে যদি কেউ বৈষম্য খোঁজে বেড়ায় তবে তাকে আস্ত পাগল ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে। তেমনিভাবে যদি কেউ নারীর চেহারা আবরণ আর পুরুষের চেহারা অনাবরণের মাঝে বৈষম্য অন্বেষণ করে তবে সে একই অভিধা প্রাপ্তির যোগ্য হবে। এখানে বৈষম্য হলে নারীর বক্ষাবরণ এবং পুরুষের বক্ষ অনাবরণের মাঝেও বৈষম্য সৃষ্টি হবে।
লেখকদ্বয় বলেছেন, ‘পুরুষদের অপকর্মের বোঝা নারীরা বয়ে বেড়াবে কেন?’ জনাব! পুরুষের অপকর্মের বোঝা পুরুষকেই বয়ে বেড়াতে হবে; নারীকে নয়। পুরুষ অপকর্ম করলে তার জন্য ইহকালীন এবং পরকালীন দণ্ড রয়েছে। সে এ অপকর্মের দায় থেকে আদৌ মুক্ত হবে না। পৃথিবীর আদালত তার দণ্ড কার্যকর না করলেও পরকালীন আদালত তাকে চুল পরিমাণও ছাড় দিবে না। সুতরাং তার অপকর্মের দায় তাকেই নিতে হবে। তবে যদি নারী পুরুষের অপকর্মের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় তবে নারীও এ অপকর্মের দায় থেকে মুক্ত হবে না। রাতে গৃহদার উন্মুক্ত করে ঘুমিয়ে থেকে ভোর বেলা মালামাল চুরির যাবতীয় দায়ভার চোরের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে তো গৃহকর্তা অপকর্ম থেকে সম্পূর্ণরূপে দায়মুক্ত হতে পারবে না। উপরন্তু চোরের কাঁধে অপকর্মের যাবতীয় দায় চাপিয়ে এলাকা মুখরিত করে ফেললেও কোন লাভ হবে না। যে ঐশ্বর্য হারিয়ে গেছে তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না। চোর বেচারা আপন ঘরে বসে তৃপ্তির ঢেকুর তুলবে।
লেখকদ্বয় বলেছেন,
এ পর্যায়ে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম, বোরকা পরা, চেহারা ঢাকা এসব তথাকথিত ওলমা-মাশায়েখদের উদ্ভট চিন্তার ফসল।
লেখকদ্বয়কে করজোর নিবেদন করে বলছি, ভাষায় শালীনতা আনতে চেষ্টা করুন। বোরকা পরা এবং চেহারা ঢাকা সংক্রান্ত অসংখ্য হাদীসের বাণী আপনাদের উপহার দিয়েছি। নবী যুগে, সাহাবী যুগে, তাবিয়ী যুগে নারীরা চেহারা ঢেকে পথ চলত। আপনারা স্বর্ণ যুগের ইসলামী সামাজিক ইতিহাস পাঠ করুন। দেখুন তখনকার যুগে নারীরা চেহারা অনাবৃত করে পথ চলত কিনা? ইমাম আবূ হামেদ গাযালী রহ. (মৃত্যু ৫০৫হি.) বলেন,
‘যুগ যুগ ধরে পুরুষরা মুখমণ্ডল খোলা রেখে আসছে এবং নারীদের নেকাব পরিহিত অবস্থায় বের হওয়ার প্রচলন চলে আসছে।’ (ইয়াহইয়াউ উলূমিদ্দীন ১/৭২৯)
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন,
নারীদের মসজিদ, বাজার এবং সফরে নেকাব পরিহিত অবস্থায় বের হওয়ার কর্মপন্থা যুগ পরম্পরায় চলে এসেছে। যাতে করে পুরুষরা তাদের না দেখতে পারে। (ফাতহুল বারী ৯/৩৩৭)
লেখকদ্বয়! বোরকা পরা, চেহারা ঢাকা এসব যদি তথাকথিত ওলামা-মাশায়েখদের উদ্ভট চিন্তার ফসল হয় তাহলে (নাউযুবিল্লাহ) এ উদ্ভট (?!) চিন্তাটা তো নবী সাহাবী যুগ থেকে বাস্তবায়িত হয়ে আসছে। তবে কি পৃথিবীর সেই শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোর চিন্তাও ‘উদ্ভট’ (?!) ছিল?। উদ্ভট চিন্তার ধারকগণই এমন জঘন্য উদ্ভট দাবী করতে পারে।
লেখকদ্বয় বলেছেন, ‘নারীদের জাগতে হবে।’ জনাব! নারীদের আর জাগতে হবে না। নারীরা অনেক জেগেছে এবং অনেক জেগে গেছে। প্লিজ! এখন তাদের একটু ঘুমুতে দিন। জেগে জেগে তারা দেহ মন ক্ষয় করে ফেললে তো সমাজ বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে। কারণ তারা তো আমাদের সমাজেরই একটি অন্যতম অংশ। নারী পুরষের সমন্বয়ে তো একটি সমাজ দেহসৌষ্ঠব লাভ করে। এবার তাদের একটু ঘুমুতে দিন। তারা ঘুমিয়ে তাদের দেহ মনের ক্লান্তি অবসাদ বিদূরীত করুক। তবে সমাজ আবার তার চাঞ্চল্য ফিরে পাবে।
লেখকদ্বয় নিবন্ধের সর্বশেষে বলেছেন, ‘আমি তথাকথিত নারী জাগরণের কথা বলছি না। রাজপথে অর্ধ উলঙ্গ হয়ে নাচতে বলছি না। আমি সুশীল সমাজের নারী জাগরণের কথা বলছি। যারা শুধু রাজপথে নাচবে না। জাতিকে কর্মক্ষেত্র দেখিয়ে দেবে। জাতির আদর্শ হবে।’ জনাব! তথাকথিত নারী জাগরণ আর আপনার নারী জাগরণের মাঝে আমরা খুব বেশি তফাৎ দেখতে পাই না। আপনার বাক্যের গঠন শৈলির সাথে তাদের বাক্য গঠনশৈলির বেশ সাযুজ্য রয়েছে। আপনি সুশীল সমাজের নারী জাগরণের কথা বলছেন। সুশীল সমাজ বর্তমানে একটি স্বতন্ত্র পরিভাষা। এ সুশীল সমাজের নারী জাগরণ আর তথাকথিত নারী জাগরণের মাঝে তিল পরিমাণও পার্থক্য নেই। আপনারা বলেছেন, ‘যারা শুধু রাজপথে নাচবে না। জাতিকে কর্মক্ষেত্র দেখিয়ে দেবে। জাতির আদর্শ হবে।’ অর্থাৎ আপনাদের স্বপ্নের নারী জাগরণের নারীরা রাজপথে ড্যান্স করার সাথে সাথে জাতিকে কর্মক্ষেত্র দেখিয়ে দেবে। এবং এর মাধ্যমে তারা জাতির আইডলে পরিণত হবে। এই তো! এ যদি আপনার চিন্তা প্রসূত কল্পনার ফসল হয় তাহলে তথাকথিত নারী জাগরণের সাথে আপনার স্বপ্নের নারী জাগরণের অমিলটা কোথায়? বলবেন কি? আল্লাহ আপনাদের, আমাদের এবং সবাইকে সুস্থ চিন্তা, বিশুদ্ধ বিশ্বাস এবং বিশুদ্ধ কর্মপন্থার ঐশ্বর্য দান করুন।