মুফতী মাহমূদুল আমীন
আজকের পৃথিবী প্রযুক্তিময়। মানুষের জীবন প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে প্রযুক্তির ছোঁয়ায়। মোবাইল, কম্পিউটার , টিভি, ইন্টারনেট ইত্যাদি এখন জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এ সকল আধুনিক প্রযুক্তিতে স্বল্পতম সময়ে সংবাদ আদান-প্রদানসহ নানাবিধ উপকারিতা রয়েছে । তবে উপকারিতার তুলনায় এগুলোতে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। ডাক্তারের ছুরি জীবন রক্ষার উপায় আর ডাকাতের ছুরি জীবন বিনাশের মাধ্যম। ঠিক তেমনি প্রযুক্তির লাভ-ক্ষতি এর ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল। দুঃখজনক হলেও সত্য, এসকল প্রযুক্তি আজ চরম অপব্যবহারের শিকার। মোবাইল ইন্টারনেটের বল্গাহীন ব্যবহারে বর্তমানে পরিবার ও সমাজে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। ভবিষ্যত প্রজন্ম চারিত্রিক অবক্ষয়ের শিকার হয়ে তিলে তিলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একটি শিশু স্বচ্ছ, কোমল ও পবিত্র হৃদয় নিয়ে ধরার বুকে আগমন করে। পিতা-মাতার আখলাক চরিত্র ও ঘরের পরিবেশ তাকে প্রভাবিত করতে থাকে। পিতা-মাতার সুন্দর চরিত্র ও ঘরের নূরানী পরিবেশ যেমন তার দিলের শুভ্রতাকে উজ্জ্বলতর করতে থাকে তেমনি বড়দের মন্দ-চরিত্র ও ঘরের গান্দা পরিবেশ তার দিলকে কদর্য ও কলুষিত করে দেয়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রতিটি সন্তানই দুনিয়াতে ইসলামী স্বভাব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে; কিন্তু তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী বানায় অথবা খ্রিস্টান বানায় অথবা অগ্নিপূজক বানায়। ( সহীহ বুখারী; হা.ন. ১৩৮৫, সহীহ মুসলিম; হা.ন. ৬৯২৬)
জন্মের পর এখনকার শিশুরা কুরআনের অপার্থিব সুর লহরী নয় শোনে অবৈধ বাদ্যযন্ত্রের ঝঙ্কার। হাসপাতালের বেডে কিংবা ঘরের বিছানায় নবজাতক শুয়ে আছে আর তার কক্ষেই হয়তো চলছে টিভির নৃত্য-গীত কিংবা মোবাইলের অশুভ সঙ্গীত। তাকে কোলে নিয়ে এমনকি দুগ্ধদানকালেও হয়তো তার জননী তাকিয়ে আছে টিভির পর্দায়। ঘরে বাবা মা ও বড়রা টিভি দেখে, সিনেমা দেখে, সিরিয়াল দেখে, মোবাইল-ফেসবুকে ব্যস্ত থাকে। তাদের দেখে দেখে শিশুরাও টিভি, সিনেমা ও মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ে। এতে শিশুদের হৃদয়ের পবিত্র ভূমিতে বপিত হয় গুনাহের বীজ। স্মার্টফোনের কল্যাণে শৈশবের কোমলতা হারিয়ে সে হয়ে ওঠে ভিডিও গেমসে স্মার্ট, ছবি ও সেলফি তোলায় এক্সপার্ট। বলা হয় মায়ের কোল শিশুর প্রথম শিক্ষালয়। সেখানে সে সততা, নৈতিকতা ও দীনদারীর সবক পাবে। কিন্তু আফসোস! শত আফসোস!! সে শিক্ষালয়ে আজ টিভিপর্দার মারামারি আর নির্লজ্জ নৃত্যঝঙ্কারে গজবের পরিবেশ বিরাজিত। টিভি-মোবাইলে গান শুনে শুনে শিশু নিজেও গাইতে চায়, নাচ দেখে সে-ও নাচতে চায়, মাস্তানী দেখে দেখে সে-ও মাস্তানী করতে চায়। নায়ক, গায়ক ও মাতালের অভিনয় দেখে সেও নায়ক, গায়ক, মাতাল হতে চায়। তাই তো আজ লাখো তরুণ-যুবক মাদকের মরণ-নেশায় মত্ত। দীন ও নৈতিকতা থেকে তারা সম্পূর্ণ বিছিন্ন । আজ শিশুদের কোমল কণ্ঠে কুরআনের আসমানী সুর লহরী নয়; বাজে গানের কলি। কুরআন বুকে শিশু মসজিদে নয়; গীটার কাঁধে গান শিখতে যায়। শিশুর মুখে সূরা-কালিমা নয়, কিছু অর্থহীন কবিতা কিংবা দু-চারটি ইংরেজি শব্দে মা-বাবারা আহ্লাদিত হয়ে ওঠে।
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত(?) পরিবার ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে কৈশোর পেরোনোর আগেই শিশুরা বড়দের দেখে দেখে ফেসবুক, গুগল ও টুইটারের সন্ধান পেয়ে যায়। আর তারুণ্যের বেলাভূমিতে আকণ্ঠ ডুবে থাকে প্রযুক্তির নেশায়। অশ্লীল আকাশ-সংস্কৃতির বিষাক্ত ছোবলে নেমে আসে চারিত্রিক চরম অবক্ষয়। ফেসবুক, ইউটিউবের চিত্তহারী আহ্বান তার জীবন-যৌবনকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয়। একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্ট-
‘মোবাইলের কারণে কিশোর-কিশোরী ও তরণ-তরুণীদের মধ্যে ফেসবুক নেশা এখন সর্বাধিক। স্কুল-কলেজ পড়–য়া ছেলে-মেয়েদের মোবাইল আসক্তি হাজার হাজার পরিবারকে ফেলেছে দুর্ভাবনায়। হঠাৎ চালু হওয়া ‘মোবাইল সংস্কৃতি’ বুঝতে শেখার আগেই ফেসবুক, গুগলে উলঙ্গ বেলেল্লাপনা ছবির ছড়াছড়ি তরুণ-তরুণীদের কচি মন বিগড়ে দিচ্ছে। চরিত্র গড়ার আগেই নষ্ট হচ্ছে কিশোর-কিশোরীর চরিত্র। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে লেখাপড়ায় এবং পরিবার-সমাজে। জীবন গঠনের আগেই নতুন প্রজন্ম হারাচ্ছে পথের দিশা। বাবা-মায়ের ভাষায়, অপরিণত বয়সে ছেলে-মেয়েরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিষিদ্ধের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার সহজাত প্রবৃত্তির কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা বইয়ের বদলে মোবাইলের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে। ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যত। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির সুবিধায় ডিজিটালের নামে আগামী প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়ার রহস্য কী?। …মোবাইল ও ফেসবুক যুগের আগে ছেলে মেয়েরা রাতে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ত। এখন মোবাইল টিপতে টিপতে ঘুমিয়ে পড়ে। ব্লগ, ফেসবুক ও টুইটার ব্যবহারের কারণে শিশু-কিশোর ও তরুণদের ধ্যান-জ্ঞান হয়ে পড়েছে মোবাইল। দ্রুত যোগাযোগে মোবাইল আশীর্বাদ হলেও অনেকের জন্য হয়েছে সর্বনাশ…। ঢাকার একটি নামকরা কলেজের প্রায় তিনশ ছাত্র গত সপ্তাহে শিক্ষা সফরে কক্সবাজারে যায়। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেলো, প্রত্যেক ছাত্রের হাতে দুই-তিনটি করে মোবাইল, সবার কানে হেডফোন। শিক্ষকদের সামনেই ছাত্রদের কেউ ফোন টিপছে, কেউ গান শুনছে, কেউ ফোনে গেম খেলছে। তিনশ ছাত্রের মধ্যে মাত্র দুই-তিনজনের হাতে বই দেখা গেল। অথচ কয়েক বছর আগেও চিত্র ছিলো উল্টো। ভবিষ্যতের জীবন গঠনে বই যাদের নিত্যসঙ্গী হওয়ার কথা তাদের সঙ্গী হয়ে গেছে মোবাইল। (স্টালিন সরকার; দৈনিক ইনকিলাব, ২রা মার্চ ২০১৬)
মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক ইত্যাদির কারণে ভেঙ্গে যাচ্ছে অনেক ঘর, অশান্তির অনলে পুড়ছে মায়ার সংসার। স্বামী বা স্ত্রীর চাইতেও বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছে ফেসবুকি বন্ধু বা বান্ধবী। পরকীয়ার মত জঘন্য ঘটনা ঘটে চলেছে অহরহ। একাধিক সন্তান রেখে ফেসবুকি বন্ধুর হাত ধরে পালিয়ে যাওয়ার কিংবা পরকীয়ার স্বাক্ষী নিঃশেষ করার জন্য জন্মদানকারী মা কর্তৃক নিজ হাতে সন্তানকে গলা টিপে হত্যা করার হৃদয় বিদারক ঘটনাও ছাপা হচ্ছে পত্রিকার পাতায়। জন্ম হচ্ছে আজ ঐশীদের মত হন্তারকদের যারা বন্ধুর টানে আপন মা-বাবার খুনের নেশায় মেতে উঠছে। মোবাইলের মাধ্যমে হুমকি, চাঁদাবাজিসহ নানাবিধ অপরাধ প্রবণতা তো রয়েছেই। এককথায় প্রযুক্তির ভয়াল ছোবলে আজ ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে।
প্রযুক্তি ব্যবহারে করণীয়
আধুনিক প্রযুক্তির বিষাক্ত ছোবল থেকে বাঁচতে হলে আমাদেরকে নিম্নোক্ত কাজগুলো করতে হবে-
১. টিভি-মোবাইল জাতীয় সকল প্রযুক্তি শিশুদের থেকে দূরে রাখতে হবে। ঠিক যেমন সকল ঔষধ শিশুদের নাগালের বাইরে রাখতে হয়। শিশুদেরকে কোন ধরনের ভিডিও, ভিডিও কার্টুন, গেম ও নাচ-গান ইত্যাদি একেবারেই দেখানো যাবে না। অভিভাবকগণ নিজেরাও এসব দেখবে না এমনকি বাসায় আগত স্মার্ট ফোন ইত্যাদি বহনকারী মেহমানকেও সুষ্পষ্টভাবে নিষেধ করে দিবে, তারা যেন শিুশুদেরকে এগুলো না দেখায়। অভিভাবকগণ সন্তানদেরকে ছাত্র অবস্থায় কিছুতেই মোবাইল কিনে দিবে না। অন্য কোনভাবেও সে যেন মোবাইল ব্যবহার করতে না পারে সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবে।
উল্লেখ্য, ছোটদেরকে কোন গুনাহের কাজের সুযোগ করে দেয়া হলে তাদের খাতায় গুনাহ লেখা না হলেও সুযোগদাতা অভিভাক অবশ্যই গুনাহগার হবে। অভিভাবকদের সহায়তায় কিংবা তাদের শিথিলতায় শিশুদের চরিত্র নষ্ট হয়ে মনমানিসকতা গুনাহপ্রবণ হয়ে গেলে এর পুরো দায়ভার অভিভাবকদের উপরই বর্তাবে। একটু সতর্ক হলে যে হতো মা-বাবা ও অভিভাবকদের জন্য সদকায়ে জারিয়া সে-ই তখন হয়ে যাবে গুনাহে জারিয়া। কিয়ামতের ময়দানে যখন বিপথগামী এসব সন্তানেরা ভয়াবহ শাস্তির মুখোমুখি হবে তখন তারা ক্ষোভে-দুঃখে অভিভাবকদেরকে পায়ের নিচে পিষে ফেলতে চাইবে। (সুরা হা-মীম সাজদা- ২৯) তারা এসকল অভিভাবকদের জন্য বদ-দু‘আ করবে, হে আমাদের রব! আপনি তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদের উপর মহাঅভিসম্পাত নাযিল করুন। (সূরা আহযাব- ৬৪)
২. প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সকল প্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। বিশেষ করে চোখ ও কানের হিফাযত অত্যন্ত জরুরী। বেগানা কারো ছবি দেখা ও গান-বাদ্য শোনা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকতে হবে। বেগানাদের কণ্ঠের হামদ-নাত এমনকি কুরআন তিলাওয়াতও শোনা যাবে না। মনে রাখতে হবে, আমাদের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি সব আল্লাহর দেয়া আমানত। এই আমানতের খেয়ানত করলে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই চোখ, কান ও হৃদয় এই প্রত্যেকটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। (সূরা বনী ইসরাঈল- ৩৬ ) অন্য আয়াতে বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা দৃষ্টিসমূহের খেয়ানত সম্পর্কে খুব ভালো করে জানেন। (সুরা মুমিন- ১৯) সুতরাং জবাবদিহিতার ভয় অন্তরে নিয়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অযাচিত কোন দৃশ্য যেন সামনে না আসে এর জন্য অ্যাডব্লক, পর্নোব্লক ও ইমেজব্লক ইত্যাদি সফটওয়্যার ইনস্টল করে নিতে হবে। মোবাইল রিংটোনটি যেন মিউজিক না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
৩. প্রাণীর ছবি ও সেলফি তোলাসহ যাবতীয় শরীয়ত গর্হিত কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে শরীয়ত অনুমোদিত প্রয়োজন ছাড়া ছবি তোলা সম্পূর্ণ হারাম। যে ছবি তোলে তার উপর আল্লাহর লা’নত বর্ষিত হয়। তাকে কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তি দেয়া হবে (নাউযুবিল্লাহ)। অনেকে শখ করে ছোট শিশুদের ছবি তোলে ও স্ক্রীনে সেভ করে রাখে, এটা মারত্মক গুনাহের কাজ। ক্যামেরাওয়ালা মোবাইলের সুবাদে আজ মুসলমান ব্যাপকভাবে এই মারাত্মক গুনাহে লিপ্ত হয়ে অভিশপ্ত হয়ে পড়ছে।
৪. অপ্রয়োজনীয় ও অধিক কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা অপ্রয়োজনীয় ও অধিক কথা বলা সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ। কলরেট কম বা ফ্রি বলেই অযথা কথা বলা জায়েয হয়ে যায় না। আমাদের মুখ থেকে যে কথাই উচ্চারিত হয় তা সাথে সাথেই একজন ফেরেশতা সংরক্ষণ করে ফেলেন। (সূরা ক্বাফ- ১৮) প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, অধিকাংশ মানুষ মুখের কারণে অধঃমুখো হয়ে জাহান্নামে যাবে। (সুনানে তিরমিযী; হা.ন. ২৬১৬)
৫. অর্থ ও সময়ের অপব্যয় করা যাবে না। অপ্রয়োজনে প্রযুক্তির ব্যবহারে দু’টোরই অপচয় হয়। অথচ কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহ তা‘আলা সময় ও অর্থ ব্যবহারের হিসাব চাইবেন। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, কোন মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত তার পা নিজ স্থান হতে সরাতে পারবে না যতক্ষণ না তাকে পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে, তার জীবন কোথায় ব্যয় করেছে, যৌবন কোথায় শেষ করেছে, সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে ও কোথায় ব্যয় করেছে। ইলম অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ২৪১৬) হাশরের ময়দানের হিসাবের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
৬. প্রযুক্তির ব্যবহার যেন আল্লাহর মহব্বত ও তাঁর ইবাদত থেকে গাফেল করে না দেয় সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। মোবাইল-ইন্টারনেটের ব্যবহার যেন অন্যের কষ্টের কারণ না হয় সেদিকেও খুব খেয়াল রাখতে হবে। অনেকে বিকট শব্দের রিংটোন বাজিয়ে বা জোরে জোরে কথা বলে কিংবা অসময়ে ফোন করে অন্যকে কষ্ট দেয়, অথচ অন্যকে কষ্ট দেয়া সম্পূর্ণ হারাম।
দীন প্রচারে প্রযুক্তির ব্যবহার
বর্তমানে দীন প্রচার ও বাতিল প্রতিরোধের নামে ফেসবুক ও ইন্টারনেট ব্যবহারে হিড়িক পড়েছে। তাকওয়া-তাহারাত ও ইলমী-আমলী মযবুতি ছাড়াই প্রযুক্তির মাধ্যমে দীন প্রচারে নেমে নিজের দীনদারীকেই বিকিয়ে দিচ্ছে অসংখ্য আলেম, তালেবে ইলম। একজন বিজ্ঞ আলেম বড় মূল্যবান কথা বলেছেন, গভীর পানিতে স্বর্ণের হার পড়ে গেছে, হারটি পানি থেকে উঠানো প্রয়োজন; কিন্তু তুমি সাঁতার জানো না। এরপরও কি হারটি উদ্ধারের জন্য তুমি পানিতে নেমে পড়বে? যদি হার উঠানোর জযবায় সাঁতার না শিখেই তুমি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ো, তাহলে হারটির সাথে সাথে তোমার জীবনেরও সলিল সমাধি ঘটবে।
এই মূল্যবান উপমাটিই আমাদের তলাবা ও নবীন আলেমদের ব্যাপারে প্রযোজ্য। যারা দীন প্রচারের জযবায় প্রযুক্তির দরিয়ায় নিজেরাই আত্মাহুতি দেয়। সন্দেহ নেই দীনের প্রচার প্রসার ফরয যিম্মাদারী। কিন্তু যেখানে দীন প্রচার করতে গেলে খোদ প্রচারকের দীনদারীই বিদায় নেয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে সেখানে দীন প্রচারের এই জযবার লাগামকে কষে টেনে ধরা ফরয। আমাদের যদি দীন প্রচারের এতই জযবা থাকে তাহলে নবীওয়ালা পদ্ধতিতে
সরাসরি মানুষকে দাওয়াত দিই না কেন? আমি গায়েবী বন্ধুদেরকে ফেসবুকের মাধ্যমে নামাযের দাওয়াত দিচ্ছি, কিন্তু মাতা-পিতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনসহ আশপাশের শত শত বেনামাযী মানুষকে কেন নামাযের দাওয়াত দিচ্ছি না? কেন প্রযুক্তির অন্ধকার ও বিপদসঙ্কুল পথে আমাদের এত আগ্রহ। আল্লাহওয়ালা বানানোর বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিবে ইলম ও নবীন আলেমদের দীন প্রচারের নামে প্রবৃত্তিপূজার দৃশ্য আমরা স্বচক্ষে দেখছি আর বেদনাদগ্ধ হচ্ছি।
আমি একথা বলছি না যে, প্রযুক্তির সাহায্যে দীন প্রচার ও বাতিলপন্থীদের বিভ্রান্তির জবাব দেয়া যাবে না। অবশ্যই প্রযুক্তিকে দীনী কাজে ব্যবহার করে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বিশাল জনগোষ্ঠি বিশেষ করে তরুণদেরকে দীনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে হবে। লা-মাযহাবী, বিদআতী ও নাস্তিক-মুরতাদদের বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার থেকে মুসলমানদের দীন ও ঈমানকে হিফাযত করতে হবে। কিন্তু সেখানে দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা ও বাতিলের জবাব দেয়ার জন্য দা‘য়ীর মাঝে নিম্নোক্ত যোগ্যতাগুলো অবশ্যই পাওয়া যেতে হবে-
১. কুরআন-হাদীস ও ইসলামী ফিক্হের পর্যাপ্ত ইলমের অধিকারী হতে হবে।
২. ঈমান ও আমলে পরিপক্ক হতে হবে।
৩. গুনাহ থেকে বাঁচার ব্যাপারে নিজের উপর আস্থাশীল হতে হবে।
৪. (লিখিত দীন প্রচারের ক্ষেত্রে) সাহিত্য ও লেখা-লেখির যোগ্যতা থাকতে হবে। কেননা শুধুমাত্র লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার করার নাম দীন প্রচার নয়।
৫. যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমি যে পন্থায় দীন প্রচার করতে চাই তা শরীয়ত অনুমোদিত কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে এবং কোন আল্লাহওয়ালা মুরুব্বীর সামনে বিষয়টি বিস্তারিত পেশ করে তার মশওয়ারা নিতে হবে। পরবর্তীতে মাঝে মাঝে তাকে হালত জানিয়ে দু‘আ ও প্রয়োজনীয় সংশোধনী নিতে হবে।
৬. যারা মুরুব্বীগণের ছত্রছায়ায় এপথে সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের কাছ থেকে প্রযুক্তি ব্যবহারের নিরাপদ পন্থা ও দীন প্রচারের পদ্ধতি জেনে নিতে হবে।
মনে রাখতে হবে, আমাদের দীন প্রচার শুধু প্রচারের জন্য নয়, বরং আল্লাহ তা‘আলাকে খুশি করার জন্য। সুতরাং দীন প্রচারের নামে আল্লাহর নাফরমানীর কোন অবকাশ নেই।
কুরআনে কারীমের يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا (অর্থ : তারা মদ ও জুয়া সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, উভয়টির মধ্যে একটি বিরাট গুনাহ রয়েছে এবং মানুষের জন্য কিছু উপকারিতাও রয়েছে। তবে এ দু’টোর উপকারিতার চেয়ে গুনাহটি অনেক বড়। সূরা বাকারা- ২১৯) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হাকীমুল উম্মত হযরত থানবী রহ. বলেছেন, اثم (গুনাহ) একবচন এনেছেন। আর منافع (উপকারিতা) বহুবচন এনেছেন। এর দ্বারা একথা বুঝানো উদ্দেশ্য যে, কোন জিনিসে বা কোন কাজে যদি হাজারো লাভ থাকে কিন্তু তাতে একটি গুনাহও থাকে তাহলে সে হাজারো উপকারিতা এক গুনাহের সামনে তুচ্ছ ও ম্লান হয়ে যাবে। কেননা যেমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি চাই তা অতি অল্পই হোক না কেন অনেক বড় দৌলত। ورضوان من الله اكبر (আল্লাহ তা‘আলার সামান্য সন্তুষ্টিও অনেক বড়)। অনুরূপ আল্লাহর সামান্য অসন্তুষ্টিও অনেক বড় বিপদের কারণ। (খুতুবাতে হাকীমুল উম্মত ২/১৭৬)
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে প্রযুক্তির বাঁধভাঙ্গা সয়লাবের মুখেও সকল গুনাহ থেকে বিরত থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে অবিচল থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
পরিশেষে একজন আল্লাহওয়ালার কবিতার মাধ্যমে শেষ করছি,
ম্যাঁয় জাহাঁ ভি রহুঁ জিস ফিযা মেঁ রহুঁ, মেরা তাকওয়া হামেশা সালামাত রাহে।
‘যেখানেই থাকি যে পরিবেশেই থাকি/ তাকওয়া যেন সদা নিরাপদ থাকে।’