নীল সাগরের তীরে (২)

মুফতি হাফিজুর রহমান

শুরু হলো পথচলা

সবাই দৌড় ঝাপ করছে। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের এ ব্যাপারগুলো পর্দার আড়ালে চুপিসারে হচ্ছে। আমাদের উপরের বিভাগের দু’ চার জন ছাড়া আর কারো গোচরিভূত হয় নি ব্যাপারটি। গুছিয়ে উঠতে আমার খানিকটা সময় লেগে যায়। ঝুপড়ি থেকে সতীর্থরা বেরিয়ে পড়েছে। আমি ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। দ্বিতীয় সুড়ঙ্গ পথটা পেরিয়ে চত্তরে পা রাখতেই চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে যায়। শিক্ষাসচিব মহোদয় চত্তরের ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছেন। আশে পাশে কজন ছাত্র ছোট খাটো একটা জটলা তৈরি করে রেখেছে। গলায় কাটা বেধার মত হল। না এগুতে পারছি না পেছাতে। কি করব ভেবে পাই না। খানিকটা দাঁড়িয়ে থেকে কিছুটা সাহস যোগাড় করে দ্রুত পা ফেলে সামনে এগিয়ে যাই। চত্তরের মধ্যিখানটায় এসে চোরের মত পেছনে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে যায়। পায়ের গতি আমার থেমে নেই। একেবারে গেট পেরিয়ে গতি রোধ করি। যেন সুন্দরবন পাড়ি দিয়ে এলাম। ভেতরটা তখনও ধড়ফড় করছে। শিক্ষাসচিব মহোদয় হয়তো ভেবেছেন, ছেলেটা এভাবে না বলে দ্রুত চলে গেল কেন? প্রতিবারই তো আমাকে বলে যায়। আজ এমনটি করল কেন….? ভাবলাম, দেখা করতে গিয়ে না জানি কোন জালে আটকে যাই। আর কিছু না হোক তরতাজা একটি মিথ্যে কথা তো বলতেই হবে। নতুবা আশার গুঢ়ে বালু পড়ে যাবে। এজন্য নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বাইম মাছের মত কাদা মাখা হাত ফসকে বেরিয়ে পড়ি।

আজ যদি আমি ভার্সিটি পড়ুয়া স্টুডেন্ট হতাম তবে আমাকে ভয়ংকর এ সুন্দরবন পাড়ি দিতে হত না। সিনা টানটান করে বেরিয়ে যেতাম।

ভাষার টোনটা একটু অন্যরকম শোনালেও কথা বাস্তব। সিনা টানটান করে আমার প্রিয় উস্তাদের সামনে দিয়ে নির্ভয়ে আসতে না পারার জন্য আজ আমি গর্বিত।

ছুটি মানেই দুরন্ত স্বাধিনতা। নীল আকাশে ডানা মেলে যেথায় ইচ্ছে উড়ে বেড়াও। এ সংস্কৃতি শুধু মাদরাসা ভার্সিটিতেই নয় সব প্রতিষ্ঠানেই সমভাবে প্রযোজ্য। তবে সত্যিকারের মানুষের কোন ছুটি নেই। ছুটি মানে অবসর অবকাশ। একজন অন্বেষী মানুষ কখনো অবসর হতে পারে না। এটা মূলত কাজে হাঁপিয়ে উঠা মানুষের জন্য পুনরোদ্দমে কাজকে আরো গতিময় করার উদ্দেশে সাময়িক বিশ্রাম গ্রহণ।

আমাদের মাদরাসা ছুটি। সে মতে যেথায় ইচ্ছে সেথায় ছুটে যেতে পারি। এ সময় সুদূর চাঁদের দেশে চলে গেলেও কেউ কিছু বলবেন না। আমাদের উস্তাদদের সম্বন্ধে যতটুকু ধারণা রাখি তাতে এ না বলাটা নিশ্চিত। উপরন্তু শিক্ষাসচিব মহোদয় মমতাসমৃদ্ধ এক উদার মনের মানুষ। হুযুরকে সাহস করে বলে আসলে আমার ধারণা হুযুর যারপর নাই খুশি হতেন। তবু মনের কোণে এক টুকরো ভীতি কাজ করেছিল। না জানি হুযুর কি ভেবে বসেন। এ ভীতিকে অনুসরণ করেই আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যাওয়া। এতে করে ভীতিটা ফুলে ফেঁপে আরো বড় আকার ধারণ করে। ফলে দুর্গম গিরি কান্তার মরুর মত এক ভীতিকর এলাকা পার হওয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

একটু পেছনে যেতেই হয়। আমার লেখা পড়ার এ ছোট্ট জীবন ঘটনাবহুল এক মিশ্র জীবন। বেদনা ব্যথার হাজারো স্মৃতিতে ঋদ্ধ আমার অগোছালো এ শিক্ষা জীবন। একদা মাঝ দরিয়ায় এসে আমি খৈ হারিয়ে ফেলি। সমুখে তিমির আঁধার। কোথও আলোর ইশারা নেই। বৈরি স্রোতের বিপরীতে সাতরে আসা এক ক্লান্ত সাতারু মুহূর্তেই হাত পা ছেড়ে দিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আলগা স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়া ছাড়া যেন আর কোন উপায় নেই। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি…। রক্তপিচ্ছিল এ বন্ধুর পথ আমার নয়। মাঝ মরুতে এসে বেদনা ব্যথায় ন্যুব্জ হয়ে অশ্রু সজল নয়নে পেছনের পথে পা বাড়াই। জীবনে অনেক হেঁটেছি। সমুখে আগাবার আর এতটুকু সাধ্যও নেই। তাই সবার অগোচরে গহীন রাতে পা বাড়াই অজানা পথে। হঠাৎ কেন যেন হৃদয়ের গভীরে একটু খানি টান অনুভূত হয়। ভাবি, এভাবে পথ চলায় দু একটি হৃদয় কি ব্যথিত হবে না! যারা আমাকে সন্তর্পনে স্নেহ মমতা দেন। থমকে দাঁড়ালাম। অন্তত একটু বলে যাই। যারা আমায় এত শত দিনে এত কিছু দিলন তারা কি আমার এতটুকু বলে যাওয়া পান না! বিবেকের আদালতে নির্বাক হলাম।

একদিন ভর দুপুরে চেহারায় নীল বেদনার ছাপ মেখে শিক্ষা সচিবের কুঠরিতে গিয়ে উপস্থিত হই। আমি চলে যাচ্ছি শুধু এতটুকুই বলব। হুযুর আমার মনভাঙ্গা চেহারা দেখে যেন বুঝে ফেললেন এমন একটা কিছুই আমি বলব। তাই হুযুর আগে ভাগেই জিজ্ঞেস করে ফেললেন কি হয়েছে। আমি কোনো রকম জড়তা ছাড়াই বলে ফেললাম ‘আমি চলে যাচ্ছি’। হুযুর আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করুক- আমি চাচ্ছিলাম না। আমার বাসনা ছিল, আমার প্রথম কথা আমার শেষ কথা হোক- আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমার কামনা বাসনা শিকেয় তুলে হুযুর আমাকে ধরে বসলেন। আমি চাপা স্বভাবের মানুষ। ভাল হোক মন্দ হোক কোন ব্যপারেই আমি নিজেকে উন্মুক্ত করতে চাই না। হুযুরের পিতৃসুলভ স্নেহপূর্ণ ভাষার কাছে নিজেকে সঁপে দিতে বাধ্য হলাম। এই প্রথম আমার ভিতরের দাউ দাউ আগুনের কথা একজন মানুষ জানতে পেল। এ যাবত আর কেউ আমাকে জানতে পারে নি। একান্ত হৃদয়ের বন্ধুও নয়। হুযুরকে সব খুলে খুলে বললাম। হুযুর সীমাহীন ব্যথিত হলেন। পিতৃত্বের ছায়ায় আমাকে আগলে নিলেন। এবং স্নেহ ও দরদ মাখা অনেক কথা আমাকে বললেন। নিজের জীবনের দু চারটে কষ্টের স্মৃতিও আমাকে শুনালেন। পথহারা আমি মাঝ মরুতে এসে পথের দিশা পাই। তিমির আঁধারে আলোর ইশারা দেখতে পেলাম। আবার পথ চলা শুরু হল। এ পথ চলায় আর বিরতি হয় নি। বন্দরে নোঙ্গর ফেলে তবেই ক্ষান্ত হই।

ঝঞ্জা বিক্ষুব্ধ এক অশান্ত সাগরের অতল গহীনে তলিয়ে যাওয়া হতে উদ্ধার করে মুক্তির মহাসড়কে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন পিতৃপ্রতিম যে পবিত্র সত্তাটি- তার আমি কি করতে পেরেছি? ….।

আমি জীবনে অনেক মানুষের স্নেহ ভালবাসা পেয়েছি। কিন্তু তাদের ভালবাসার মূল্য দিতে পারি নি। আত্মকেন্দ্রিকতা আর বাকস্বল্পতার ছুতো দিয়ে শুধু আড়ালে আড়ালেই থেকেছি হতভাগা এই অধম আমি।

ছাত্র মমতায় হযরত ইবরাহীম হিলাল সাহেব হুযুরের তুলনা হুযুর নিজেই। ছাত্র সমাজের মাঝে স্নেহ ভালবাসা আর মায়া মমতায় হুযুর এক জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে আছেন। ছাত্রদের মাঝে হুযুর আজ আব্বাজান অভিধায় অভিষিক্ত। হুযুরের দক্ষ সঞ্চালনায় রাহমানিয়ার শিক্ষার মান আজ দেশ ব্যাপী আলোচিত

গেট পেরিয়ে দেখি সাদা পোষাক পরে দু হাত দুলিয়ে এগিয়ে আসছে সুহৃদ মামুন। সবাই বেরিয়ে পড়েছে। আমি একা পেছনে পড়ে আছি। আমাকে তাড়া করে এগিয়ে নিতেই সুহৃদ মামুনের এ ছুটে আসা। উত্তর দিকে মুখ করে পা চালিয়ে দুজনে সামনে এগিয়ে যাই।

আমরা যে পথটি ধরে হেঁটে চলছি তার দু ধারে আজ সারি সারি আকাশ ছোঁয়া ইমারাত। এক সময় এলাকাটি ছিল পূতিগন্ধময় এক ভাগাড় ভূমি। নাক চেপে ধরে মানুষ চলাচল করত। ৯৯ তে আমি নিজেও নাক চেপে ধরে হেঁটেছি মনে পড়ে। আশির দশকে এখানে রাহমানিয়া ভবন ছাড়া আর কোনো ভবন চোখে পড়ত না। রাহমানিয়ার আশ পাশ জুড়ে ছিল খা খা শূন্যতা। তখনকার ছবিগুলো আজো মনে করিয়ে দেয় সে খা খা শূন্যতার স্মৃতিকথা। এ পথের ধারেই ছিল পূতিগন্ধময় মাথা মোটা মাগুরের আবাস ভূমি। উৎকট গন্ধে রি রি করে উঠত চারি ধার। এই সেদিন মুড়ি ছিটিয়ে মাগুরের সাথে খেলা করেছি। আজ এখানে ‘ওয়া বিহি ক্বলা হাদ্দাসানা’(হাদীসের সূত্রপরম্পরার বর্ণনা) এর রিমিঝিমি শোনা যায়। এসবি মাহা মহিমের বিচিত্র করুণা।

তিন রাস্তার মোহনায় এসে দেখি, ধবধবে সাদা মাইক্রোটি আমাদের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। ওর পেটের ভেতরে সাদা সাদা এক দুজন ঢুকছে বেরুচ্ছে করছে। আমি গাড়ির গা ঘেষা সিঙ্গেল আসনটিতে গিয়ে বসে পড়ি। ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে কোলের ভেতরে গুঁজে রাখি। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি সদ্য গজিয়ে উঠা ভদ্রলোকের মত আসন পেতে বসে আছে বহু দিনের পুরনো বন্ধু সফিউল্লাহ। আরে সফিউল্লাহ তুমি! দু’ ঠোটের মাঝে এক গাদা খিলখিলে হাসির প্রলেপ মেখে দুখান হাত বাড়িয়ে দেয় সফিউল্লাহ। হাত চেপে বলি কথা বার্তা সাবধানে বলো। ভ্রমণ এমনি কষ্টকর। বেশি হাস্য করা যাবে না কিন্তু!

আমি নয়া মুসাফির। আদ্যোপান্ত কিছুই জানি না। সতীর্থ হাবীবকে খুব ব্যস্ত দেখাচ্ছে। দু একটি কথা উড়ে এসে আমার কানের কাছটায় হালকা শব্দ করছে। শব্দগুলোকে জোড়া তালি দিয়ে বুঝার চেষ্টা করি। কিন্তু ব্যর্থ হই। সবাই আমার বহু দিনের পুরনো সহপাঠী। তবু কেন যেন আমার খুব নতুন নতুন লাগছে। পুরনোদের মাঝে নতুনদের যে একটা সংকোচ ভাব সৃষ্টি হয়, সেটা আমি খুব অনুভব করছি। পুরনো হয়েও যেন আমি নতুন মানুষ।

সহযাত্রী কত জন এবং কে কে এর ফিরিস্তি আমার কাছে নেই। তবে এক আধটু আমি জানি। সুহৃদ মাহমূদ থেকে জেনেছি, আমাদের চালক বন্ধু আমাদের মত সাদা মাথার মানুষ। শুনে প্রীত হলাম। আমরা সবে একি নায়ের মাঝি। খুব মজা হবে তবে। চালক বন্ধুকে দুচোখে দেখে তো আক্কেলগুড়–ম। এ তো দূর দেশ থেকে উড়ে আসা ফুটফুটে চেহারার এক মহান সাধক। ধবধবে ইয়া এক জুব্বা গায়ে জড়িয়ে গাড়ির কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা মাইক্রোটি আমাদের মুখে পুরে নিলেই ছুটে পালাবে দখিনা হাওয়ায়।

চালক বন্ধুর সোজা পেছনে জোড়া সিট দুটোয় এসে বসে মাহমূদ আর আতাউল্লাহ। তার পরে শুআইব সফিউল্লাহ। এরপরের দুটোয় মামুন মাহবুব। সবার শেষে পেছনের সিটে এসে বসে ভ্রমণ প্যাকেজের অন্যতম উদ্যোক্তা আমের দেশের হাবীবুর রহমান। বাম দিকটায় সিঙ্গেল তিনটে সিট। একেবারে সামনেরটা এখনো শূন্য পড়ে আছে। এর পর দরজা ঘেষা যেটা সেটাও শূন্য। তৃতীটায় আমি। আমার পেছনে চার পাঁচ জনের একটা দীর্ঘ আসন। কেউ ইচ্ছে করলে পা মেলে ঘুমোতেও পারবে।

অনন্ত দূরের পানে

আগপিছ করে সবাই গাড়িতে চড়ে বসেছি। এবার শুরু হবে দূর পাল্লার অভিযাত্রা। পিচ ঢালা পথ মাড়িয়ে সবুজ বাংলার বুক চিড়ে শুরু হবে দূর দিগন্তে ছুটে চলা। যখন ইঞ্জিনের বাটন চেপে বিলাল ভাইয়া গাড়ি ছুটালেন তখন আমাদের হাতে মোবাইল ছিল, মোবাইলে ঘড়িও ছিল। তবে আমাদের সময় দেখার সময় ছিল না। কারণ আনন্দ অভিযাত্রায় সময়ের হিসাব নিকাশ করা হয়ে উঠে না। উপরন্তু এতে করে আনন্দ জোয়ারে খানিকটা হলেও ভাটা পড়ে যায়। তবু আমাদের পুরোটা ভ্রমণ জুড়ে সময়ের হিসেব কষে বেড়াতে হয়েছে। রাখালের মত আমাদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে এ সময়গুলো। যেখানে পা রেখেছি সময় আমাদের পিছু নিয়েছে। পদে পদে সময়কে আমাদের সেলুট করতে হয়েছে। আমরা ছিলাম সময়ের হাতের পুতুল। সময়কে আমাদের বসে আনতে পারি নি। আমাদের হাতে সময় মাত্র তিন দিন। এ সময়ের ভিতরেই আমাদের ভ্রমণ যাত্রা গুছিয়ে সাগর পাড়ের এলাকা ত্যাগ করতে হবে।

মিষ্টি সকালের নীরবতা ভেঙ্গে আমরা এগিয়ে চলছি। চিরচেনা উঁচু উঁচু দালানগুলোকে হাত নেড়ে বিদেয় জানাই। বিদেয় জানাই এক সময়ের মোহনপুর আজকের মুহাম্মদপুরকে। আমাদের হাঁটা চলায় মুখরিত হয়ে থাকা পথটুকু চালক বন্ধুকে বলে দ্রুত পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাই।

নরম ভোরের অবারিত রাজপথ। সুন্দর ঝকঝকে পরিষ্কার। দেখে হৃদয়টা সজীব হয়ে উঠে। হায়! যদি আমাদের ঢাকাটা সবসময় এমন ঝকঝকে হতো। গণমানুষ আর যানজটের এ শহুরে জীবন বড়ই পীড়াদায়ক। তবু মানুষ ঢাকামুখী। এত হাও কাও এত জঞ্জাল। তবু মানুষ ঢাকা থেকে বেরুতে চায় না। যেন পান্না হিরা আর মতি জওহর সব ঢাকার গর্ভেই লুকিয়ে আছে। আমরা এগিয়ে চলছি। আর দুচোখ মেলে ভোরের নরম আলো মাখা আমাদের সুন্দর ঢাকার দেহখানি নিবিড় করে দেখছি।

সবার চোখে মুখে নান্দনিক রেখা ফুটে উঠেছে। কমলার কোয়ার মতন দুধরাঙ্গা ঠোটগুলোর গা জুড়ে অন্যরকম এক হাসির প্রলেপ লেগে আছে। সুহৃদ মাহমূদের ঠোটের এক কোণে ঝুলে থাকা এক ফোঁটা হাসি পেছন থেকে দেখা যাচ্ছে। বাকিটুকু কালো মাথাটার আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। শুআইবের চোখে মুখে লেগে থাকা আনন্দ রেখা পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে না। ঘুমের ভারে চোখ দুটো ছোট হয়ে আছে। আনন্দ রেখার উপর দিয়ে রাতজাগা ক্লান্তির ধূলো বালি পড়েছে। সুতীব্র নিদ্রা জোয়ারে আনন্দের বিকাশ ঘটাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কারণ এ মানুষটাকে লেপের তলদেশ থেকে সদ্য তুলে আনা হয়েছে। সুহৃদ মামুন কাচুমাচু করে একটুখানি মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছে। যেখানে রাত সেখানেই কাত এর মত একটুখানি জায়গা পেলেই হল। ব্যস, দুচোখ জুড়ে এসে ভর করবে সাতসমুদ্র তের নদীর ঘুম। নিমিষেই বন্ধ হয়ে যাবে দুটি চোখের লোমশ কপাট। হয়তোবা মিলে যাবে খানিকটা নরম তুলতুলে জায়গা। এখন শুধু সুযোগটুকু হাতের মুঠোয় পুরে নিতে বাকি। আমাদের গারিটি ধানমন্ডি, জিগাতলা, সিটিকলেজ, নিউমার্কেট এবং ইডেন কলেজ হয়ে বেরিয়ে যাবে। ইডেন কলেজ থেকে আমাদের দূর পাল্লায় যোগ দিবে আরেক সতীর্থ। নয়া এ মুসাফির আমাদের চিরচেনা বিশারতুল্লাহ। হৃদয়ে স্বপ্ন আঁকা উতাল দিনের পড়ার সাথী। তিন বছর নয়-যেন একজনমের পরিচিত মুখ।

সুহৃদ বিশারতুল্লাহ এ পথে থেকেও ওপথের ডাকসাইটে কর্মকর্তা। ইন্টারনেট জগতের এক মহা কিংবদন্তি। সারাক্ষণ বাটন টিপে সময় পার করে। মানুষটা আমাদের মত নেই। দ্বিখন্ডিত হয়েছে অনেক আগেই। কোথাও গেলে হৃদয়ে টান লাগে। হৃদয়ের গহীনে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়। অর্ধাঙ্গ রেখে আমাদের সতীর্থ হচ্ছেন এটা তার জন্য অনেক বড় আত্মত্যাগ।

আমাদের সাদা ধবধবে মাইক্রোটি চাকা ঘুরিয়ে আজিমপুরের দোর গোড়ায় এসে গেছে। সুহৃদ হাবীব মুঠোফোনে বিশারতুল্লাহকে দাঁড়াবার জায়গা বলে দিচ্ছে। ‘আপনি ইডেন কলেজ ঘেষা ফুটপাতটিতে দাঁড়ান। আমরা আপনাকে নিয়ে যাবো।’ ইতিমধ্যে আমরা ইডেন কলেজের কাছে চলে আসি। কলেজ ঘেষা পথের ধারে লম্বা লম্বা বাসগুলো সারে সারে দাঁড়িয়ে আছে।

কিন্তু সারি বাধা বাসের ফাঁক ফোকড়ে সাদা টুপি পরা কাউকে দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার অপজিটেও সবাই চোখ রাখছি। ওখানে দুএকজন পথচারি ছাড়া সাদা কিছু নেই। মাইক্রোটি পথ চেয়ে চেয়ে চার রাস্তার মোহনায় পৌঁছে যায়। সমুখে না এগিয়ে উপায় নেই। কারণ দাঁড়াবার মত যুৎসই জায়গা আশেপাশে নেই। গাড়িটা পূর্ব দিকে মোড় নিয়ে খানিকটা দাঁড়াল। এখানেও ভয়ের শেষ নেই। এদিক ওদিক পুলিশ বন্ধুরা হাঁটা হাঁটি করছে। আমাদের দুএকজন নেমে পড়ে বিশারতুল্লাহর খোঁজে। দুতিন মিনিট না যেতেই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মুখে হাসি ছড়িয়ে দৌড়ে এসে গাড়িতে চড়ে বিশারতুল্লাহ। আমরা মুখে হাসির ফোয়ারা ছড়িয়ে বিশারতুল্লাহকে বরণ করে নিই।

ইট ইমারতের ভিতরে আটকে থাকা মানুষগুলো রাস্তায় নেমে পড়েছে। নীরব শহর মুখরিত হয়ে উঠছে। শহুরে মানুষগুলোর হাত পাগুলো নড়ে চড়ে উঠছে আপন আপন কাজে। নাগরিক জীবন আবার জীবন্ত রূপে ফিরে এসেছে। একদু টুকরো উষার আলো আমাদের গাড়ির গাঢ় কাচ ভেদ করে আমাদের গায়ে এসে পড়ছে।

গাড়ির চাকা আবার সচল হয়। ভার্সিটি ক্যাম্পাস ঘেষে কাটাবন হয়ে এগিয়ে যাই মতিঝিলের দিকে। মতিঝিলে মতি নেই। আছে ইয়া বড় এক সাদা শাপলা। শাপলার পাপড়ি ঘেষে প্যাপু শব্দ করা চেলা পুটিগুলো ছুটাছুটি করে সারাক্ষণ। এ শাপলা চত্তর থেকে আমাদের সাথে যোগ হবে আরো দুজন ভ্রমণ পিয়াসী।

দুটি হৃদয়ের সংযোজন

আমাদের গাড়িটি শাপলা ফুলের পাশে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়ে, খানিকটা দূরে সাদা আবরণের দুজন মানুষ রিক্সা থেকে নামছে। গাড়িটি এলোমেলো অনেকগুলো রাস্তার মোহনা পেরিয়ে অপজিটে গিয়ে পার্ক করে। রিক্সা থেকে নামা সাদা মানুষ দুটি আমাদের গাড়িতে এসে চড়ে বসে। এদুটি চেহারা এর আগে আমি দেখি নি। দুজনই দারুর রাশাদে লেখা পড়া করে। সুহৃদ হাবীবের দূর কিংবা কাছের রক্তীয়। আমাদের সরাসরি না হলেও সুহৃদ হাবীব সূত্রে কিছু একটা হবে। তবু নতুন অনতুন, চেনা অচেনাদের মাঝে যে একটা প্রচ্ছন্নতা তৈরি হয় সেটা লেগেই ছিল সারাটা পথ আমাদের এবং দুজনের সাথে। দুজনের একজন চালক বন্ধুর অপজিটে গিয়ে বসে। যেন সাইড ড্রাইভার। আরেকজন পিছনে গিয়ে সুহৃদ হাবীবের সঙ্গ দেয়। পেছনে আরো দুটো আসন শূন্য পড়ে আছে। কয়েকটি কালো ব্যাগ ওই আসন দুটো পূরণ করে বসে। চালক বন্ধু গাড়ি সচকিত করে। গাড়ি ছুটে চলছে।

একটি ক্ষুদে বিড়ম্বনা

যাত্রাবাড়ির কাছে এসে গাড়িটি আচমকা থেমে যায়। কারণ আমি আমরা কেউ জানি না। জানেন ব্রেকে চাপ দিয়েছেন যিনি শুধুই তিনি। ভাবলাম, হয়তো কিছু একটা হয়েছে। না। ভাবনা ভুল হলো। কিছুই হয় নি। ড্রাইভার দিব্বি বসে আছে। মুঠো ফোনে কথা বলছে। আর জানালার ফাঁক গলিয়ে কালো মাথাটা বের করে বারবার পেছনে তাকাচ্ছে। কে আসছে কেন আসছে? কিছুই জানি না। আমরা ফিসফাস করি। এক আধটু বিরক্ত হই। চালক বলেন, এইতো এসে পড়েছে। কিন্তু ‘এইতো’ এর সীমানা বেড়ে চলে। সহজে শেষ হয় না। আমাদের বিড়ম্বনা বেড়ে যায়। যাত্রা পথে গাড়ি থামিয়ে এভাবে অকারণে বসে থাকতে বড় কষ্ট লাগে। আমাদের হাতে সময় সীমিত। পাঁচ মিনিটেরও অনেক মূল্য। এ পাঁচ মিনিট আমরা স্পটে কাটাব। লাভ হবে। সময়ের কদর এখন খুব উপলব্ধ হচ্ছে। অন্য সময় যদিও এতটা অনুভূত হয় না। তবে পরীক্ষার ব্যপারটা আলাদা। এ সময় সময়ের মর্যাদা হুহু করে বেড়ে যায়। এত দামের এ সময়গুলোর একটি নয় দুটি নয় পাকা দশ থেকে পনেরটি মিনিট ড্রাইভার সাহেব আস্ত মুখে পুরে খায়। তার একটাই জবাব, এতটুকু সময়ে কি হয়? আমাদের তো গা জ্বলে যাচ্ছে। ক্ষোভে হাত নিশপিশ করছে।

পনের মিনিট পর আলাদা রকমের একটা মানষ দৌড়ে আসে। এবং গাড়িতে চড়ে একেবারে চালক বন্ধুর গা ঘেষে গিয়ে বসে। অবয়ব আবরণে আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। চালক বন্ধুর সাথেও তেমন মিল নেই। আমাদের সাথে খানিকটা সাজুয্য রক্ষার্থে মাথায় একটা ঘন ফুটো সাদা কাপড় এঁটে নেয়। বুঝতে বেগ পেতে হল না মানুষটা আমাদের সাথ যাবে। চালক বন্ধু খুলে কিছু বলেন নি। এখনও বলছেন না। ব্যপারটি আমাদের কাছে ভাল ঠেকছে না। আমাদের মাঝে ফিসফাস এবং কানাকানি হচ্ছে। চালক বন্ধু শুনেও শুনে না। বুঝেও বুঝে না।

নতুন এ মানুষটা চালকের ভাগ্নে। ভেবেছিলাম, রক্তীয় এবং সহোদরার পেটের ছেলে হবে। পরে বুঝেছি, কাছের নয় দূরের- অনেক দূরের। ভাগ্নের- দূরের হলেও সে ভাগ্নে- বসার মত কিছু নেই। সামনে দুপাশে দুটো আসন। মাঝে একটুখানি খালি জায়গা। এখানে কেউ বসে না। মামা ও খালি জায়গাটুকুতে এক গুচ্ছ ময়লা কাপড় গুঁজে দেয়। কৃত্রিম নরম একটা বসার জায়গা বনে যায়। ভাগ্নে এখানে হাসি হাসি মুখ করে যুত করে বসে পড়ে। হাসিটা ছিল মামার প্রতি কৃতজ্ঞতার হাসি। দূরের হয়েও এ দূর যাত্রায় মামা ভাগ্নেকে এক দণ্ড ভুলতে পারে নি।

ভাগ্নের বসন পর্ব শেষ হলে মামা গাড়ি ছুটান। আমাদের মুখ ভার করা চেহারাগুলো মামা একটুও চেয়ে দেখলেন না। নাটকের এ অভিনয়টা যে আমাদের ভাল লাগে নি মামা বুঝেও বুঝলেন না। সব জায়গায় সব কিছু বুঝতে নেই-ইচ্ছে করেই- এটা মামা ভাল বুঝেন।

আসলে মামাটা ভাল মানুষ। ওপথ থেকে এপথে এসেছে। চেহারা শরীর বদলিয়েছে। এটা অনেক বড় কিছু। মানুষ হিসেবে এক আধটু কিছু থাকতেই পারে। যেমন আমরাও মুক্ত নই ছিটে ফোঁটা মানবীয় দোষ গুণ হতে। তবে মামাটা বেশ চটপটে। বেশ ডান পিঠে। বেশ রসিক এবং মিশুক। এসব আমাদের ভাল লেগেছে।

মুঠোয় মুঠোয় সময় পেরুচ্ছে। ঢাকার বাড়ি গাড়ি সব পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে চলছি সমুখ পানে।

বিষম বিরক্ত করা সে জ্যাম নামের  যমের আয়োজন এখনো শুরু হয় নি। ওজিনিসটা তৈরি হবার আগেই এ মানুষ গাড়ি প্রাসাদ ভরা দুঃসহ্য ঢাকার উদর থেকে বেরুতে চাই।

গাড়িটা তুলনামূলক লম্বাটে। তাই ভিতরে বসে বুঝার উপায় নেই ওর চলার গতি। যেন খুব ধীর গতিতে কচ্ছপের মত করে এগুচ্ছে। রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো ঠিকই উপলব্ধি করছে কচ্ছপ নয় কান খাড়া করা বুনো খরগোসই ছুটে চলছে ঐ দূর অজানায়।

বিদায় ঢাকা

পৃথিবী ঘুরছে। ঘুরছে আমাদের গাড়ির চাকা। ঘুরছে, ঘুরছে এবং ঘুরছে। কোনো বিরাম নেই। ক’বার ঘুরল। ক’বার পাঁক খেল। হাতে বুড়ো বেটে আঙ্গুলটাকে সচকিত করে এক দু কড় করে গুণি। ঝুলে থাকা লাল ব্রিজটার কাছে যেতে ক’বার পাঁক খাবে এ চাকাগুলো। ১ এর পেছনে ছোট ছোট ডিম্ব বসাতে শুরু করি। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গায়ে গায়ে লেগে থাকা মিম্বগুলোতে যদি ছোট্ট বাংলাদেশটা ভরে যায়। তবে কি ফলটা বেরিয়ে আসবে? হিসেবটা মিলে যাবে? নাকি বাংলার সীমানা পেরুতে হবে। বিজ্ঞানের বিস্ময় সময়ের খুব প্রয়োজনীয় জিনিসটাও হয়তো পা পিছলে যাবে এখানে এসে। জটিল একটা অংকের উপর চড়ে আমরা এগিয়ে চলছি।

ভোরে এক ঢোক পানি পান করারও সুযোগ হয় নি। ক্ষিধেয় পেট চো চো করছে। শুধু আমার নয়; সবার। বাশ বাগানের মাথার উপরে যে লাল সূর্যটা হাসি হাসি করছে; আমাদের মনে হচ্ছে ওটা আস্ত একটা ঝলসানো পরোটা। হাত বাড়িয়ে ছিড়ে খেতে খুব ইচ্ছে করছে।

আমার পানির তেষ্টা পেয়েছে সে ভোর থেকে। বেলা বেড়ে তার সাথে যোগ হয়েছে জঠর জ্বালা। দুটোয় মিলে এখন আমি ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। তবে এ ক্ষুৎপিপাসা তেমন কাবু করতে পারছে না। কারণ সুখ আনন্দে তো আমাদের দেহ মন ভরপুর। দূর যাত্রায় এ আনন্দ খেয়ে খেয়ে ক্ষুধার জ্বালা মিটাচ্ছি। তবে মাঝে মধ্যে ক্ষুধায় ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে।

এতক্ষণে আমরা বাস ট্রাকের প্যা-পু আর কলকারখানার ঘ্যানর ঘ্যানর করা শব্দে মুখরিত ঢাকা থেকে বেরিয়ে পড়েছি। নিঝুম নিস্তব্ধ সুন্দর প্রকৃতি। গ্রামীণ সবুজ আবহ আহা কতই না মনোরম। দিগন্ত জোড়া সবুজ মাঠ। সারি সারি ঘর বাঁধা ছোট ছোট গ্রাম। বাশবাগানের মাথার উপর দিয়ে জেগে উঠেছে সোনালী রবি। গাছ গাছালির ফাঁক গলিয়ে আমাদের চোখে মুখে গালে ঠোটে গায়ে বুকে ঠিকরে পড়ছে কাঁচা কাঁচা রোদমাখা ভোরের আলো। কিষানেরা এক দুজন করে কাস্তে হাতে নেমে পড়ছে সবুজ মাঠে। আঁকা বাঁকা পথ বেয়ে শিশিরে ভেজা নরম ঘাস মাড়িয়ে রাখালেরা ছুটে চলছে গরু হাঁকিয়ে। খালে পুকুরে গায়ের কিশোরীরা নেমে পড়েছে কলসি কাঁখে। খর কুটোর বাসা ছেড়ে পাখিরা বেরিয়ে এসেছে দিনের আলোয়। ডানা মেলে এগাছ ওগাছ করছে বিষম আনন্দে। ছোট ছোট ছেলে মেয়রা কায়দা হাতে ছুটে চলছে মক্তব মাদরাসায়। মর্নিং স্কুলের কিশোর কিশোরীরা গায়ে এক রঙ্গা পোষাক ঝুলিয়ে হেঁটে চলছে পাঠশালায়।

(চলবে, ইনশাআল্লাহ)

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *