সংবাদপত্রের ধর্মপাতা : একটি সাধারণ পর্যালোচনা

মাওলানা আবু সাঈদ


প্রস্তাবনা

বাংলাদেশে বর্তমানে আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে শতাধিক দৈনিক সংবাদপত্রসহ সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক ও ত্রৈমাসিক অনেক পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়। এসব পত্রপত্রিকায় ধর্ম বিষয়ক অনেক লেখা প্রকাশিত হয়ে থাকে। এজন্য তারা প্রশংসার দাবিদার। কারণ তারা দীনের প্রচার প্রসারে ভূমিকা রাখছে।

প্রতিবেদন রচনার ক্ষেত্রে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কিন্তু বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ার কারণে ধর্ম বিষয়ে মৌলিক ধারণা না থাকলে এ ব্যাপারে প্রতিবেদন রচনা করা সম্ভবপর নয়। বরং হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ধর্ম বিষয়ক প্রতিবেদন তথ্য-উৎস, ভাষা প্রয়োগ ও চয়নের বিচার বিবেচনায় অন্য দু-চারটি প্রতিবেদন অপেক্ষা স্বতন্ত্র ও আলাদা। কারণ ধর্ম ভিন্ন অন্যান্য বিষয়ে তথ্য বিচ্যুতি বা বিকৃতি ঘটলে তার ক্ষয়ক্ষতি যত বৃহদাকারই হোক না কেন তার কুফল ইহজগতের মধ্যেই সীমিত থাকে। পক্ষান্তরে ধর্মীয় কোনো বিষয়ে তথ্য বিকৃতিতে ‘আম ছালা’ দু’টোই খোয়া যায়। একদিকে ধর্ম পূর্ণ একটি জাতির সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে পুরো জাতির উপর এর একটা কুপ্রভাব প্রতিফলিত হয়। ফলে মুসলমানদের ঈমান আকীদা ও আমল বিনষ্ট হয়। সাথে সাথে হক ও বাতিলপন্থীদের মাঝে দাঙ্গা আরো চাঙ্গা হয়ে সমাজ অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। এজন্যই সাংবাদিকদের বলা হয় একটি জাতি নির্মাণ অথবা ধ্বংসের গদ্য। সংবাদকর্মীরা তাদের সদিচ্ছা, সততা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে সঠিক ইসলামী জ্ঞান প্রচার করে সমাজের রূপ পালটে দিতে পারে। এতে একজন মুসলিম হিসেবে তার দীন প্রচারের গুরু দায়িত্বও সম্পন্ন হয়।

কিন্তু আমাদের সাংবাদিক ভাইয়েরা কি সঠিক দীনকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারছেন? প্রকাশনা ও মিডিয়ায় বিনিয়োগকারী পুঁজিপতিরা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি বারের জন্যও কি এ বিষয়টি ভাবছেন? তাদের ভূমিকা ‘সরষের মধ্যে ভূত’ আর ‘বেড়ায় ক্ষেত খাওয়া’র মতো নয়তো? প্রশ্নগুলোর উত্তর সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে এই নিবন্ধে।

পর্যালোচনার উদ্দেশ্য

১. ধর্ম বিষয়ক সংবাদে মূলত ধর্মের উপস্থিতি কতটুকু তা নিরূপণ করা।

২. ধর্ম বিষয়ক সংবাদ প্রচারে সংবাদকর্মীদের ভূমিকা ও বাস্তব ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা অনুসন্ধান করা।

৩. ধর্মীয় সংবাদ প্রচারকারী পত্রিকাগুলোর তথ্য গ্রহণের মূল ভিত্তি ও উৎস কি তা যাচাই করা।

৪. গণমাধ্যম ও গণমাধ্যম বার্তার প্রতি পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমত অনুসন্ধান।

৫. ধর্ম প্রচারে গণমাধ্যমের ব্যবহার ও উলামায়ে কেরামের অভিমত।

সংবাদপত্র বাছাই

এ পর্যালোচনার জন্য চারটি দৈনিক পত্রিকা ব্যবহার করা হয়েছে স্বেচ্ছাচয়িতভাবে। স্বেচ্ছাচয়নের ভিত্তি হলো তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের সার্কুলেশনের সর্বশেষ প্রতিবেদন।

সময়

পর্যালোচনার জন্য যে সময়কে বেছে নেয়া হয়েছে তা আকস্মিক চয়নকৃত। আর তা হলো এপ্রিল ২০১৪। প্রথম আলো, ইত্তেফাক, সমকাল এবং আমাদের সময়Ñ এ সংবাদপত্রগুলোর ধর্ম বিষয়ক নিবন্ধ এতে পর্যালোচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে শুক্রবারের ধর্মপাতা।

দেশের ৪টি দৈনিক পত্রিকার (৪ এপ্রিল থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত) নিবন্ধ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এই দিনগুলোতে সংবাদপত্রে ধর্ম বিষয়ক নিবন্ধ সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক ইত্তেফাক-এ। সর্বমোট ১৮টি। সমকাল-এ ১৫টি, প্রথম আলোতে ১০টি। সবচেয়ে কম প্রকাশিত হয়েছে আমাদের সময়-এ। মাত্র ৫টি। অবশ্য সবগুলো প্রতিবেদন ধর্ম পাতার নয়; বরং অন্য পাতার কিছু প্রতিবেদন দীনের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে। দীনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত প্রতিবেদন মোট ৩৪টি। যেখানে সব মিলে প্রতিবেদনের সংখ্যা ছিল ৪৮টি। এতে ঈমান আকীদা, ইবাদত, লেনদেন, সামাজিকতা, সূফীবাদ, আধ্যাত্মিকতা ও সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাকার বিষয়ের আলোচনা উঠে এসেছে। তবে অধিকাংশ সংবাদপত্রে ইতিবাচকের তুলনায় নেতিবাচক দিকগুলোরই প্রাধান্য লক্ষ্য করা গেছে। নিবন্ধগুলোর মধ্য হতে দশটি নিবন্ধের বিস্তারিত পর্যালোচনাপূর্বক একটা সমীক্ষা দাঁড় করানোর প্রয়াস পাবো ইনশাআল্লাহ। যাতে পাঠকের কাছে সংবাদপত্রগুলোর প্রকৃত রূপ ও ধর্মের ব্যাপারে তাদের অবস্থান উন্মোচিত হয়। সাথে সাথে এই ধরনের পত্রিকার ব্যাপারে শরীয়তের বিধান উল্লেখ করে দেয়াও আবশ্যক মনে করছি। যাতে পাঠকগণ ধর্মীয় জ্ঞান অন্বেষণে এ সংবদপত্রগুলোকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেন।

পর্যালোচনা

এসব নিবন্ধ ও প্রতিবেদন পর্যালোচনা থেকে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, সংবাদপত্রগুলো আমাদের সামনে ইসলামের সঠিক পরিচয়, বাস্তব রূপ ও নিরেট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তুলে ধরতে সক্ষম হয় নি এবং ইসলামের গৌরবময় ইতিহাস যা প্রত্যেক যুগে ইসলামের যথার্থতার প্রমাণ বহন করতে সহায়ক তা থেকে পুরোপুরি বিস্মৃত রয়েছে। পত্রিকার কলেবর বাড়ানোর উদ্দেশ্যে শুধু খবরের জন্য খবরই ছাপা হয়েছে বেশি। অথবা স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়েই জাতিকে ইসলামের সৌন্দর্য, সৌরভ, শিক্ষা-দীক্ষা, আদর্শ-চেতনা ও প্রত্যুজ্জ্বল জ্যোতি থেকে সুকৌশলে দূরে সরিয়ে রাখার বেশ একটা কসরত করেছে। অনেক কলামে সূফীবাদের নামে বিদ‘আতের সাজ-সজ্জাপূর্ণ চমকদার ও আকর্ষণীয় মোড়কে উপস্থাপন করা হয়েছে ইসলামকে, যা গোমরাহী ও বিভ্রান্তির চমকপ্রদ অত্যাধুনিক বাহন। যার আরোহীকে সে নরক নিলয়ে নিয়ে যায় একদম সোজাসুজি। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব গুরুত্বের সাথে সতর্ক করেছেন উম্মতে মুহাম্মাদীকে। ইরশাদ করেছেন,

জেনে রাখো! (ধর্মের ক্ষেত্রে) প্রত্যেক নব আবিষ্কৃত বিষয় (যা খাইরুল কুরুনে ছিল না) বিদ‘আত। আর প্রত্যেক বিদ‘আত পথভ্রষ্টতা। আর পথভ্রষ্টতার ফল জাহান্নাম। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ৪৬০৯)

কিছু কলাম পড়ে আঁচ করা গেছে যে, তা আমাদের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার ভজন-সাধনের নামে অতি সন্তর্পণে হিন্দুত্ব ঢুকিয়ে দেয়ার অস্পৃশ্য সাধনা করা হয়েছে। কোনো কোনো পত্রিকায় ধর্মজ্ঞানহীন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু অর্বাচীন পণ্ডিতের ধর্মের ব্যাপারে পাইকারী হারে অপবাদ, যুক্তিহীন অভিযোগ, অশ্লীল মন্তব্য এবং উদ্ভট ও বস্তা পঁচা সস্তা মন্তব্য ধর্মভীরুদের ব্যথিত করছে। আবার মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যসূচিতে আধুনিকতার ধোঁয়া তুলে, সাহিত্য-সংস্কৃতি, উৎসবের পরিমণ্ডল থেকে ধর্মের বাঁধ উঠিয়ে দেয়ার ব্যাপারে প্রগতিশীল কিছু ব্যক্তিত্বের হাইব্রিড মতাদর্শিক কিছু পত্রিকায় প্রায়ই হাইলাইট হয়ে প্রতিভাত হয়েছে। যা মূলত মাদরাসা শিক্ষার স্বচ্ছ ও নির্মল ধারাকে ব্যহত করার ষড়যন্ত্রে ইন্ধন যোগায়। ধর্মপাতার এ ধরনের অহেতুক, অদ্ভুত, বানোয়াট, অনভিপ্রেত ও বিভ্রান্তকর নিবন্ধের উপস্থাপনাকে ধর্মহীনতা বললে অত্যুক্তি হয় না। নিম্নে প্রমাণ হিসেবে সংবাদপত্রের সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি নজীর আমরা এখানে পেশ করে বিস্তারিত বিশ্লেষণের দিকে অগ্রসর হবো।

ধর্ম যার যার, উৎসব সংস্কৃতি সবার (!)

আমাদের ধর্ম যার যার, কিন্তু আমাদের ইতিহাস, অর্জন, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, উৎসব এ সবই গোষ্ঠী-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার। [‘মাদরাসার পাঠ্যসূচি’; আইরিন সুলতানা, দৈনিক সমকাল ১৭. ০৪. ২০১৪]।

এখানে প্রবন্ধকার স্ববিরোধী দুটি বক্তব্যের অবতারণা করেছেন। প্রথমে লিখেছেন ‘ধর্ম যার যার’ অর্থাৎ একজনের ধর্ম অন্যজনের জন্য পালনীয় নয়। আবার পরক্ষণেই লিখলেন ‘সাহিত্য, সংস্কৃতি উৎসব এ সবই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার’। এখানে অজ্ঞাতসারে তিনি তার অজ্ঞতাকে প্রকাশ করে দিয়েছেন। কারণ প্রত্যেক ধর্মেই ভিন্ন ভিন্ন কিছু সংস্কৃতি ও উৎসব রয়েছে। ধর্ম যেহেতু একটি জীবন বিধানের নাম। আর সংস্কৃতি উৎসব জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। তাই প্রত্যেক ধর্মে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি বিদ্যমান থাকা ঐ ধর্মের সত্যতা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য আবশ্যকীয়ও বটে। এ বাস্তবতা সাব্যস্ত হওয়ার পর যদি অমুসলিমরা মুসলমানের সংস্কৃতি-উৎসব পালন করে আর মুসলমানরা আপন করে নেয় অমুসলিমদের সংস্কৃতি-উৎসব তাহলে ‘ধর্ম যার যার’ কথাটির সার্থকতা আর রইল কোথায়! অবশ্য যেসব ধর্ম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান না হওয়ার কারণে তাতে সংস্কৃতি, উৎসব ইত্যাদির দৈন্যতা রয়েছে তাদের জন্য ভিন্ন সংস্কৃতি ধার করার একটা যৌক্তিকতা আছে। তা সত্ত্বেও অমুসলিমরা কিন্তু তা করে না। তারা তাদের ধর্মে সব বিষয়ের সমাধান না পেয়ে অনেক মনগড়া, অনর্থক অযৌক্তিক ও নোংরা যজ্ঞকে সংস্কৃতি জ্ঞান করে নিয়েছে। তবুও মুসলমানদের সংস্কৃতি গ্রহণ করে নি। অবশ্য তাদের যদি কিছু সুন্দর থেকে থাকে তা মূলত মুসলমানদের থেকে প্রকাশ্যে নয় বরং অতি সন্তর্পণে ধার করে নেয়া। যেমন কোনো কোনো উন্নত বিশ্বের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, সততা অবলম্বন করা ইত্যাদি। সাধারণ মুসলমানদের ধর্মজ্ঞান না থাকার কারণে এগুলোকে তারা অমুসলিমদের উন্নত সভ্যতা হিসেবে গাল ভরে বয়ান করে থাকে। অথচ এগুলো সবই মুসলমানদের সংস্কৃতি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

১الطهور شطر الايمان ২ نظفوا افنيتكم ৩ الصدق ينجي

অর্থাৎ ১. পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ। ২. তোমরা তোমাদের আঙিনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখ। ৩. সত্য মুক্তি দেয় এবং মিথ্যা ধ্বংস ডেকে আনে। (সহীহ মুসলিম, হা.নং ৫৫৬, সুনানে তিরমিযী, হা.নং ২৭৯৯, আলফাতহুল কাবীর, হা.নং ৬৩২৯)

ইসলাম শুধু মুসলমানের জন্য; নয় বরং কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানবের আমৃত্যু বড়ো-ছোটো, খুটি-নাটি সর্ব বিষয়ের সমাধানের সমন্বয়ের নাম। ইরশাদ হয়েছে,

আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন মনোনীত করলাম। (‘সূরা মায়িদাহ’- ৩)

আর মুসলমানদের প্রত্যেকটি বিধান-উৎসব, যৌক্তিক, তাত্ত্বিক, স্বভাবজাত, কোমল-বিমল ও উভয় জাহানের কল্যাণের আধার। পক্ষান্তরে অমুসলিমদের উপাসনা, শিক্ষা, সংস্কৃতির না কোনো যৌক্তিকতা আছে, না আছে তার কোনো তাত্ত্বিকতা। আল্লাহ তা‘আলা তাদের ইবাদতের অসারতা কুরআনে এভাবে বর্ণনা করেছেন। ‘কাবা ঘরে তাদের নামায ছিল হাতে তালি দেয়া আর শিস বাজানো।’ (‘সূরা আনফাল’- ৩৫)

তবুও অনেক মুসলমান লজ্জার মাথা খেয়ে অমুসলিমদের তথাকথিত নোংরা আদর্শের অন্ধ অনুকরণে ব্যস্ত। (আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে রক্ষা করুন)।

মাদরাসা শিক্ষার্থীরাও শিখবে ব্রতচারী নৃত্য (!)

শিক্ষার্থীদের ‘মংডুর পথে’ পড়ানো হবে না, পড়ানো হবে না ব্রতচারী নৃত্য। পরিমার্জনা এখানেই থেমে থাকে নি। তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে হাফপ্যান্ট পরিহিত বালক আর কিশোরীর শাপলাফুল তোলার যে আবহমানকালের গ্রাম্য কৈশোর চিত্র, তার সঙ্গে পরিচিতি ঘটবে না মাদরাসা শিক্ষার্থীদের। পঞ্চম শ্রেণির বইয়ের প্রচ্ছদে কলসি কাঁখে ঘোমটা দেওয়া গাঁয়ের বধূর ঘাড়ের পাশ দিয়ে সাবলীলভাবে সামান্য অনাবৃত পিঠও নজর এড়ায় নি স্টিয়ারিং কমিটির। ঢেকে যাবে গাঁয়ের বধূর পিঠ, হিজাব পরবে শাপলা তোলা বালিকা, পাজামা পরবে বালক। এই বাস্তবতা বিবর্জিত ‘কানামাছি পাঠ্যসূচি’ প্রণয়ন করে কোমলমতি শিশুদের কোনো নৈতিক আদর্শে দীক্ষিত করা হবে তার দায়িত্বশীল ব্যাখ্যা কর্তৃপক্ষ দিতে পারবেন কি? [‘মাদরাসার পাঠ্যসূচী’; আইরিন সুলতানা, দৈনিক সমকাল ১৭. ০৪. ২০১৪]।

হুবহু একই ধরনের লেখা এসেছে প্রথম আলোর ২৮ এপ্রিলে। যার শিরোনাম হলো, ‘শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় আচ্ছাদন কেন?’ এখানে আপত্তি যদিও সরকারি মাদরাসার পাঠ্যসূচি নিয়ে। তথাপি তার আপত্তিতে মুসলিম হিসেবে আমাদের যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। সম্মানিত লেখিকার অজানা থাকার কথা নয় যে, প্রত্যেক শিক্ষা ধারার নিজস্ব একটা লক্ষ্য ও গতি থাকে। যার সীমাবদ্ধতায় কতৃপক্ষকে পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করতে হয়। আর মাদরাসা পড়–য়াদের আসল উদ্দেশ্য আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন করা ও গোটা মানব জাতিকে দুনিয়া-আখিরাতের স্থায়ী সুখ সফলতার পথ দেখানো। মুদ্রার ঝলক তাদের মূল লক্ষ্য নয়। তাই মাদরাসাগুলোতে স্কুল কলেজের পাঠ্যসূিচ চাপিয়ে দেয়া জ্ঞানশূন্যতা আর অনধিকার চর্চা বৈ কিছু নয়। যেমনটি তারা মাদরাসার পাঠ্যসূচি স্কুলে বাধ্যতামূলক করার ব্যাপারে অনুধাবন করে থাকেন। তবে প্রত্যেকেই নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সংগতি রেখে কিছু বিষয়ের সংযোজন বিয়োজন করতে পারেন এবং এটা উচিতও বটে। এ ব্যাপারে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তথা উলামায়ে কেরাম যুগে যুগে সচেতনতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। অর্থাৎ দীনের রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রচার-প্রসারের জন্য তারা বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সহনীয় পর্যায়ে গ্রহণ করেছেন। ফলে উলামায়ে কেরাম পার্থিব বিষয়ে আংশিক পরনির্ভর আর আখেরাতের ব্যাপারে আলহামদুলিল্লাহ সম্পূর্ণই স্বনির্ভর। তবে প্রগতিশীল ও আধুনিক চিন্তার অধিকারীগণ এ ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন। তারা ইহজগতের কল্যাণে সারাজীবন ওয়াক্ফ করে দিলেও মাত্র দু-একটি বিষয়েই অভিজ্ঞ হয়ে থাকেন। আর আখেরাতের ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণই পরনির্ভর। অর্থাৎ তাদের আলেমদের দ্বারস্থ হতে হয় জীবনের পরতে পরতে। তাই বলতে হয় ‘মোল্লার দৌড় যদি মসজিদ পর্যন্ত’ হয়ে থাকে তাহলে আপনার দৌড়ের ক্ষেত্র তো নাক-কান-গলা অথবা দাঁত বা নাড়িভুঁড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়।

মোদ্দাকথা, মাদরাসা কর্তৃপক্ষ সব আধুনিক বিষয়কে না বলেন না যদি তা ধর্মের সাথে সংগতিপূর্ণ হয়। কিন্তু ‘ব্রতচারী নৃত্যের’ সাথে মাদরাসা শিক্ষার সংগতিটা কোথায়?

‘মংডুর পথে’ও পড়ে দেখেছি। সেখানে এমন কোনো সাহিত্য আটকা পড়ে নি যা না পড়লে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা মূর্খ থেকে যাবে। আর জর্জ হ্যারিসনের হাতের গিটার আর ঝাঁকড়া চুলের নাম ইতিহাস নয়; বরং ছবি ছাড়াই আমরা অন্যান্য সব ইতিহাস অধ্যয়ন করে থাকি। তাতে ইতিহাসের খুব একটা ক্ষতি হয়ে যায় না।

ঐতিহ্যের ধ্বজাধারীদের বলি, কিই-বা প্রাচীন ঐতিহ্য লুকিয়ে আছে গ্রাম্য কৈশোরের চিত্রের মাঝে যা পর্যবেক্ষণ না করলে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা কট্টরপন্থী রয়ে যায়। যদি বইয়ের প্রচ্ছদে বালক পাজামা আর বালিকা হিজাব পরে, ঢেকে যায় যদি গ্রাম্যবধূর পিঠ তাতে কি আগুন জ্বলে যাবে তাদের বদনে! পাজামা, হিজাব আর বধূর আবৃত পিঠে কি কোনোই আদর্শ নেই? এতে যে আদর্শ আছে তা যদি জাতিকে ১৪ শত বছর পিছনে ফেলে দেয় তাহলে আধুনিকতার নামে ক্ষুদ্র বসনের সাদৃশ্য তো আপনাদের আরো ব্যাকডেটে নিয়ে যায়। পার্থক্য শুধু এই যে, আদিম যুগের মানুষেরা গাছের বাকল দিয়ে আব্রু ঢাকতো আর আপনারা প্রযুক্তির কল্যাণে গাছ থেকে তৈরি সুতার কাপড়ে আরো কম অঙ্গ ঢেকে আপডেট হতে চান।

আসলে পরিমার্জনায় তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। ধর্মীয় কারণই হলো তাদের মূল সমস্যা। আবার ধর্ম বলতে যে কোনো ধর্ম নয়; বরং ইসলাম ধর্মই মূলত তাদের সয় না। নইলে আমাদের স্কুল পাঠ্যসূচিতে কি ছাটাই বাছাই-ই না করা হয়েছে। ইসলামের গন্ধ যেখানে যেখানে ছিল বিদেশি ডিজিটাল মেশিনে তা ওয়াশ করে সে স্থানে আবার ন্যাপথলিন হিসেবে লালন ধর্ম আর হিন্দু ধর্মের আদর্শকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে সমাজকে সুবাসিত করার লক্ষে(?)। তাতে কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের মাথা ব্যথা হয় নি। ছেলে বন্ধুর পরিবর্তে মেয়ে বন্ধু গ্রহণ করতে আগ্রহী করা হয়েছে ক্লাস সেভেনের শিক্ষার্থীদেরকে তাদের ইংরেজি বইয়ে। যুবকের বিলম্বে ঘুম থেকে ওঠার ছবি দেখিয়ে ফজরের নামায না পড়ার আদর্শ শেখানো হয়েছে তাদেরকে, শেখানো হয় নি আর্লি ইন দা মর্নিং এর গুরুত্ব। কেন? তা কি বিজ্ঞানসম্মত নয়? তাছাড়া যুবক-যুবতীর একসাথে সাইক্লিং, ক্ষুদ্র বসনে অনাবৃত বক্ষে যুবতীর জগিং-রানিং এর চিত্র প্রদর্শন কি কোনো পরিমার্জন নয়? এ থেকে কোন আদর্শ শিখবে আমাদের প্রজন্ম? এতে কেন মাথা ব্যথা হয় না আমাদের ঐতিহ্যের ধারক-বাহকদের? এই সমস্ত আদর্শের নামে উন্নতির কলা দেখিয়ে আমাদের লেজকাটা শেয়ালের দেশে নিয়ে যাওয়ার পায়তারা বন্ধ করুন। যেখানে অপ্রাপ্ত বয়সেই সম্ভ্রম হারিয়ে পারিবারিক বন্ধন থেকে ছিটকে পড়ে মানুষ। অবশেষে বৃদ্ধ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমের অভিশপ্ত জীবনে ধুঁকে ধুঁকে তাদের প্রাণবায়ু বের হয়। ফ্রান্স, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো উন্নত বিশ্বে ক্ষমতায়নে, কর্ম ক্ষেত্রে, পারিবারিক অঙ্গনে নারীর প্রতি বৈষম্য, অবিচার, নির্যাতনের দৈনন্দিন খবর তো গণমাধ্যমগুলোতে আমরা আপনাদের দৌলতেই দেখে থাকি। তবুও সে দেশের প্রতি এত ঝোঁক কেন আপনাদের! দু‘আ করি আমাদের সকলের বোধোদয় হোক।

লালন শাঁইয়ের মানব ধর্মের অন্তরালে

ক. ‘লালন মরে জলপিপাসায় থাকতে নদী মেঘনা/হাতের কাছে ভরা কলস তৃষ্ণা মিটেনা।’ মানবদেহে বহমান কুদরতী জলকেই লালন সাধক হয়ে খুঁজছিলেন।

খ. ‘সূফী লালন হাতের কাছে মাটির কলস ধরার যে সাধন ভজন করে গেছেন, সেই মাটির কলস ছোঁয়ার চিরপ্রযুক্তিকে আজও মানুষ খুঁজে ফেরে। কারণ আধ্যাত্মিক পানির উৎস হচ্ছে এই মাটির দেহ।’ [‘কাদার মানুষ জল পিপাসায় কাঁদে’; খাইয়াম মাজহারী, আমাদের সময় ০৪. ০৪. ২০১৪]।

এই লেখাটির মাধ্যমে দেহতত্ত্ব সাধনের নামে বে-শরা ফকীর লালন শাহের মানবধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে। যা মূলত কোনো ধর্মই নয়। বরং লালনের নিজস্ব একটি দর্শন-মতবাদ বা প্রবৃত্তি চর্চা। যা সম্পূর্ণ কুফরী। কিন্তু অভিজ্ঞতার কথা হলো, জগতে যে কোনো মতবাদের কোনো না কোনো অনুসারী মিলেই যায়। তাই কিছু হিন্দু-মুসলমান লালনের অনুসরণের বেলায়ও এই মূলনীতির ব্যতিক্রম করে নি। আসলে এরা ঐ সমস্ত লোক যারা ধর্মের ব্যাপারে কোনো জ্ঞান রাখে না। ফলে লালনের সূক্ষè কথার মার প্যাঁচের ঈমান বিরোধী নতুন দর্শনকেই মহাজ্ঞান সাব্যস্ত করে নিয়েছে। বর্তমানে অনেক যুবককে এই ফাঁদে পা দিতে দেখা গেছে। যেহেতু এই দর্শনে নামায রোযার কোনো বালাই নেই, ধর্মের কোনো বিভেদ নেই। আর গান বাজনা এ দর্শনে বৈধ। তাই তারা এটাকে সহজেই গ্রহণ করে নেয়। নিম্নে ফকির লালন ও তার ধর্ম-দর্শন সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হলো।

ফকির লালন ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের চুয়াডাঙ্গা অথবা ঝিনাইদহে জন্মগহণ করেন। আর মৃত্যুবরণ করেন ১৮৯০ সালে। তিনি নির্দিষ্ট কোনো ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন না যা তার কবিতা, গান ইত্যাদিতে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। যদিও কোনো কোনো বাউল গবেষক লালনকে মুসলমান আখ্যায়িত না করলে নারাজ হন।

উদাহরণ স্বরূপ অতি দুঃখের সাথে ৮ম শ্রেণির বাংলা বইয়ে প্রদত্ত লালনের লিখিত ‘মানবধর্ম’ কবিতাটি পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।

লালন কয়, জেতের কী রূপ, দেখলাম না এ নজরে ॥

কেউ মালা, কেউ তস্বি গলায়,

তাইতে কী জাত ভিন্ন বলায়,

যাওয়া কিংবা আসার বেলায়

জেতের চিহ্ন রয় কার রে ॥

এই কবিতার শেষের দুই লাইন-

লালন সে জেতের ফাতা

বিকিয়েছে সাত বাজারে ॥

কবিতার ব্যাখ্যা বই থেকেই নেয়া যাক। বইয়ের ‘পাঠের উদ্দেশ্য’-এ লেখা আছে,

এই পাঠের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বুঝতে সক্ষম হবে যে, ধর্ম বা সম্প্রদায়গত পরিচিতির চেয়ে মানুষ হিসেবে পরিচয়টাই বড়ো। তারা জাত পাত বা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি বা মিথ্যে গর্ব করা থেকে বিরত হবে। মনুষ্য ধর্মই মূলকথা। জন্ম-মৃত্যুকালে কি কোনো মানুষ তসবি বা জপমালা ধারণ করে থাকে? সে সময়তো সবাই সমান। মানুষ জাত ও ধর্মভেদে যে ভিন্নতার কথা বলে লালন তা বিশ্বাস করে না।

উপরোক্ত কথাগুলো চরমভাবে ইসলামী আকীদার সাথে সংঘর্ষপূর্ণ। কেউ তা বিশ্বাস করলে ঈমান চলে যাবে। কারণ কুরআনুল কারীমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বাণী হলো,

আল্লাহ তা‘আলার কাছে পছন্দনীয় ধর্ম হলো একমাত্র ইসলাম। (‘সূরা আলে ইমরান’- ১৯)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,

যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো মতবাদ বা দর্শন ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করবে তা তিনি কস্মিনকালেও গ্রহণ করবেন না। আর ঐ ব্যক্তি পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। (‘সূরা আলে ইমরান’- ৮৫)

লালনের কতিপয় দর্শন ও রীতি

১. চার চন্দ্র ভেদতত্ত্ব : শুক্র, রজঃ, বিষ্ঠা ও মূত্র। অমাবস্যা ও পূর্ণিমা যোগে বাউলগণ প্রকৃতি আশ্রয়ী হয়ে সাধনা করতে গিয়ে পানক্রিয়া অনুষ্ঠানে তারা এগুলো পান করে থাকে। এই চার চন্দ্রের সাধনার কারণে তারা সব ধর্মে নিন্দিত। আর ইসলাম ধর্ম মতে এগুলো হারাম। আর হারামকে হালাল মনে করলে কাফের হয়ে যায়। উপরন্তু বাউলদের সম্পর্কে আরো ভয়ানক বার্তা রয়েছে। বাউল গবেষক ড. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লালনশাহ তথা বাউল সম্প্রদায়ের ধর্মমত সম্পর্কে বলেন, ‘বাউলগণ পুরুষদের বীজরূপী সত্তাকে ঈশ্বর বলেন। বাউলদের মতে এই বীজ সত্তা বা ঈশ্বর রস ভোক্তা, লীলাময় ও কাম ক্রিড়াশীল’। এজন্য তাদেরকে অনেকে বীজেশ্বরবাদী বলে অভিহিত করে থাকেন। বাউলদের এ দর্শন একটি স্পষ্ট কুফরী।

২. মনের মানুষ তত্ত্ব : বাউলগণ আল্লাহ, অচিনপাখী, মনেরমানুষ, আলোকসাঁই ইত্যাদিকে সমার্থবোধক মনে করে থাকেন। আত্মসন্ধানের মাধ্যমে তাদের এই কথিত ‘মনের মানুষ’ তথা খোদাকে সন্ধানই তাদের প্রধান লক্ষ। তাদের কথিত ‘মনের মানুষ’ এর কী অর্থ তা নিয়ে বাউল গবেষকদের মধ্যে প্রচুর মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য মুহাম্মাদ। কেউ বলেন আল্লাহ উদ্দেশ্য। এভাবে বাউলগণ আল্লাহর পরিচয়কে অস্পষ্ট করে ফেলেছে। তার কুফরী মতবাদ আরো সুস্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে লালনের এই পংক্তিগুলোতে-

আহাদে আহমাদ নাম হয়ে জগতে,

আত্মতত্ত্বে ফাজিল যে জনা,

জানতে পায় নিগুঢ় কারখানা,

হল রাসূল রূপে প্রকাশ রব্বানা।

এখানে একটি মিমের পার্থক্য দেখিয়ে আল্লাহ ও রাসূলকে এক করা হয়েছে, যা স্পষ্ট শিরক। কারণ আল্লাহ ও রাসূলের সত্তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। একজন খালিক আরেকজন মাখলুক। একজন স্রষ্টা আরেকজন সৃষ্ট।

অন্যত্র লালন তার মুর্শিদকে লক্ষ করে বলেন,

আপনি খোদা

আপনি নবী

আপনি সেই আদম ছবি

অনন্তরূপ ধরে ধারণ

কে বোঝে তার নিরাকারণ

নিরাকার হাকীম নিরঞ্জন

মুর্শিদরূপ ভজন পথে

বাউলগণ ‘ফানাফিল্লার’ অজুহাত দেখিয়ে তাদের এই দর্শন প্রমাণ করার চেষ্টা করে। প্রথম কথা হলো, ফানাফিল্লার ব্যাখ্যা এই নয় যে, সবকিছু আল্লাহ হয়ে যাওয়া; বরং আল্লাহর জন্য সব কিছু হয়ে যাওয়া হলো ফানাফিল্লার উদ্দেশ্য। তাছাড়া কোনো মাজযুবের (দুনিয়াবিমুখ আত্মহারা বিশেষ শ্রেণির মানুষ) বিশেষ অবস্থা শরীয়তের দলীল নয়। দলীল হলো, কুরআন আর হাদীস।

এছাড়াও সংসার বিমুখ হওয়া, ওহীভিত্তিক কোনো ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থা অস্বীকার করা, সংগীত সাধনার মতো পঙ্কিল মতবাদ লালন করা লালন ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যার বিস্তারিত আলোচনা বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত মোঃ সুলায়মান আলী সরকার লিখিত বাংলার বাউল দর্শন নামক গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। যার প্রকাশকাল ১৯৯২ ডিসেম্বর।

লালন ধর্মের স্বরূপ স্পষ্ট হওয়ার পরে আধ্যাত্মিকতার নামে লালনের জল খুঁজে না পাওয়ার কিচ্ছা-কাহিনী বর্ণনাকারীরা মূলত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষায় প্রবল বৃষ্টিতুল্য হেদায়াতের বারিই খুঁজে পায় নি। তাওহীদের পবিত্র-নির্মল সাগরের স্রোতধারা থেকে পলায়ন করে তারা চার তত্ত্বের পূতিদুর্গন্ধময় নাপাক কুয়ায় লাফিয়ে পড়েছে। ফলে তাদের দেহ ভেদ করে অন্তরে গিয়েও ক্রিয়াশীল হয়েছে সেই অপবিত্রতা। এই ধরনের নিবন্ধ গণমাধ্যমে প্রকাশ করায় গণমাধ্যমও আর পবিত্র থাকে না। তাহলে কীভাবে জাতির জন্য তা থেকে উপকৃত হওয়ার বৈধতা থাকতে পারে?

চুল-দাড়ি নিয়ে রং তামাশা

অন্য কোনও ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে চুল-দাড়ি রাঙানো মানুষ বিরল হলেও নিজেকে রং করতে মুসলিম দুনিয়া যেন ব্যাকুল। আচ্ছা খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু কোনো পোপকে কি চুল রাঙানো অবস্থায় দেখা যায়? ইহুদীদের ধর্মগুরু যারা রব্বাই বা রাব্বি বলে পরিচিত, তারা কি চুল-দাড়ি রং করে? মন্দিরের কোন পুরোহিতকেও রংমাখা টিকিতে দেখা যায় না। অনেক মুসলিম ধর্মগুরু যেমন চুল-দাড়িতে রং মাখেন, তেমনি তাদের শেখানো ধর্মে কর্মে যারা অভ্যস্ত তারাও রংমাখা ছদ্মজীবন ধারণ করছেন। তারা এ জীবনাচার কোত্থেকে পেলেন? কেউ-কেউ বলছেন, হাদীস থেকে। এ সময়ের আধুনিক হাদিসবেত্তারা তন্নতন্ন করে খুঁজেও এরকম কোনও সহি হাদিসের সন্ধান পাননি, যেখানে নবি (সা.) চুল-দাড়ি রাঙাতে বলেছেন উম্মতকে। অবশেষে তারা ওয়েব এবং নেটে সার্চ দিয়েও চুল-দাড়ি রাঙানোর কোনও হাদীস পাননি। এবার দেখা যাক তিরমিজি এবং মুসলিম শরিফে চোখ বুলিয়েÑ মশহুর সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ থেকে বর্ণিত : হজরত আবুবকরের বৃদ্ধ পিতার নাম ছিল আবু কু’হাফা। নবি (সা.) একদিন আবু কু’হাফার মাথার সাদা চুলগুলো আর দেখলেন না। দেখলেন কু’হাফা চুলকে কালো রং করে রেখেছেন। নবি (সা.) তখনই তাকে ডেকে কালো রং পরিহার করতে বললেন। এ হাদীসটি মুসলিম শরিফের। তিরমিজি শরিফে অন্য একটি হাদিস রয়েছে হজরত আমর ইবনে শোয়াইব থেকে। এখানে নবি (সা.) তার অনুসারীদের বলেছেন, তোমরা কখনও সাদা চুল উপড়ে ফেল না। কিয়ামতের দিন সাদা চুলওয়ালা আলোকময় হবে। [‘রঙিলা নায়ের বৈঠাহারী যাত্রী’; খাইয়াম মাজহারী, দৈনিক আমাদের সময় ১৮. ০৪. ২০১৪]।

এখানে কলাম লেখকের উলামা বৈরি ভাবের স্ফুটন ঘটেছে। সাথে সাথে তিনি যে, সব ধর্মের সমন্বয়ক এ কথারও প্রমাণ দিয়েছেন। নতুবা মুসলমান হয়ে কোন বিষয়ের বৈধতা বা অবৈধতার ব্যাপারে ভিন্ন ধর্মের গুরুদের কর্মকে কিরূপে দলীল হিসেবে পেশ করতে পারেন। প্রমাণ হিসেবে এই লেখকের ‘জ্ঞানবৃক্ষের পাতা পড়ে মনের ঘরে’ শিরোনামে আরো একটি লেখা যা ২৫. ০৪. ২০১৪ দৈনিক আমাদের সময় প্রকাশ করেছে তা পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

আজকের বড়ো বড়ো ডিগ্রিধারী, পাগড়িধারী রংবাহারি টুপি-জুব্বাওয়ালাদের এই স্বর্ণলতার হাল। তাদের কারোরই শেকড় নেই। মুসলমানের শেকড় হচ্ছে কুরআনে। এই কুরআন শেকড়ের এবং শাখা-প্রশাখার হেকিম হওয়ার কথা ছিল আলেমদের। যেহেতু তারা রাব্বি জিদনি ইলমার জ্ঞানবৃক্ষ খুঁজে পায় নি, তারা তাই একটি-দু’টি ডিগ্রি হাসিল করে চকচকে স্বর্ণলতার বাহারি জীবনকে খুঁজে নিয়েছে বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে। …হায় শেকড়হীন স্বর্ণলতা। হায় ইলমবঞ্চিত আলেম! আপনাদের সঙ্গে যদি ইলমগ্রন্থ কুরআনের সংযোগই থাকত তবে তো আপনারা মানবধর্মের কবিতাগুলোই প্রথম পড়াতেন শিশুদের। [‘জ্ঞান বৃক্ষের পাতা পড়ে মনের ঘরে’; খাইয়াম মাজহারী, দৈনিক আমাদের সময় ২৫.০৪.২০১৪]।

আসলে প্রত্যেকটি ছত্রই মূলত লেখকের ধর্মহীনতার সাথে সাথে তার মূর্খতাকে চরমভাবে প্রকাশ করেছে। লেখক এখানে উলামায়ে কেরামের উপর দুটি অভিযোগ এনেছেন।

১. উলামায়ে কেরাম এবং সাধারণ মুসলমান দাড়িতে মেহেদী ব্যবহার করে ভুল করেন।

২. উলামায়ে কেরাম কুরআন-হাদীসের জ্ঞান রাখেন না।

প্রথম বক্তব্যের দলীল হিসেবে তিনি পেশ করেছেন কুরআনে কারীমের আয়াত, ‘খোদাতায়ালার রং, খোদাতায়ালার রঙের চেয়ে উত্তম আর কার রং হতে পারে?’ (‘সূরা বাকারা’- ১৩৮)। আয়াতের অর্থটি তিনি এভাবেই করেছেন।

আর বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগুরুদের মডেল সাব্যস্ত করে তিনি দ্বিতীয় দলীল পেশ করেছেন।

এবার তাহলে চুল দাড়িতে মেহেদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে মূল বিধানটি কি তার আলোচনা করা যাক। এখানে আমরা চুল-দাড়িতে রং ব্যবহার সংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করব। এরপর লেখক মহোদয়ের বক্তব্যটিকে আমরা পাঠকের আদালতে ছেড়ে দেব। পাঠকবৃন্দ হাদীস পাঠের আলোকে লেখক মহাশয়ের জাজমেন্ট করবেন।

১.

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ أُتِىَ بِأَبِى قُحَافَةَ يَوْمَ فَتْحِ مَكَّةَ وَرَأْسُهُ وَلِحْيَتُهُ كَالثَّغَامَةِ بَيَاضًا فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم غَيِّرُوا هَذَا بِشَىْءٍ وَاجْتَنِبُوا السَّوَاد

অর্থ : জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন আবু কুহাফাকে আনা হলো। তখন তার চুল-দাড়ি ছিল শুভ্র ফলবান বৃক্ষরাজির মত ধবধবে সাদা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তার চুল-দাড়ির এ শুভ্রতাকে অন্য কোনো রং দিয়ে পরিবর্তন করে দাও। তবে কালো বর্ণ পরিহার করবে। (সহীহ মুসলিম [অধ্যায় : পোষাক-পরিচ্ছদ এবং সৌন্দর্য শোভা, পরিচ্ছেদ : চুলের শুভ্রতাকে হলুদ এবং লাল বর্ণ দ্বারা বর্ণিল করা মুস্তাহাব এবং উত্তম আর কালো বর্ণ ব্যবহার করা হারাম ও নিষিদ্ধ]; হা.নং ৫৬৩১)

পাঠক! কষ্ট করে লেখক মহোদয়ের বক্তব্যের উপর আরেকবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিন। লেখক মহোদয় সহীহ মুসলিম এর উদ্ধৃত্তিতে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. সূত্রে হাদীসের যে ভাষ্য তুলে ধরেছেন তা আমরা সহীহ মুসলিম এ পাই নি। লেখক মহোদয় কোথায় পেলেন, কীভাবে পেলেন? বিষয়টি আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।

২.

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى لاَ يَصْبغُونَ فَخَالِفُوهُم

অর্থ : আবু হুরায়রা রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইয়াহুদী খ্রিস্টানরা রং ব্যবহার করে না। সুতরাং তোমরা এক্ষেত্রে তাদের বিরোধিতা করো। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ৫৬৩২)

৩.

عَنْ أَنَسٍ أَنَّهُ سُئِلَ عَنْ خِضَابِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَذَكَرَ أَنَّهُ لَمْ يَخْضِبْ وَلَكِنْ قَدْ خَضَبَ أَبُو بَكْرٍ وَعُمَرُ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُمَا

অর্থ : আনাস রাযি. কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চুল রং করার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তিনি নিয়মিত চুলে রং ব্যবহার করতেন না। তবে আবু বকর এবং উমর রাযি. চুলে রং ব্যবহার করতেন। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ৪২১১)

৪.

عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَلْبَسُ النِّعَالَ السِّبْتِيَّةَ وَيُصَفِّرُ لِحْيَتَهُ بِالْوَرْسِ وَالزَّعْفَرَانِ وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ يَفْعَلُ ذَلِكَ

অর্থ : ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম …এবং দাড়িতে ওয়ারস উদ্ভিত থেকে উৎপন্ন লাল রং এবং জাফরান রং ব্যবহার করতেন। এবং ইবনে উমর রাযি.-ও এমনটি করতেন। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ৪২১২)

৫.

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ مَرَّ عَلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم رَجُلٌ قَدْ خَضَبَ بِالْحِنَّاءِ فَقَالَ مَا أَحْسَنَ هَذَا. قَالَ فَمَرَّ آخَرُ قَدْ خَضَبَ بِالْحِنَّاءِ وَالْكَتَمِ فَقَالَ هَذَا أَحْسَنُ مِنْ هَذَا. قَالَ فَمَرَّ آخَرُ قَدْ خَضَبَ بِالصُّفْرَةِ فَقَالَ هَذَا أَحْسَنُ مِنْ هَذَا كُلِّهِ

অর্থ : ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি চুলে মেহেদি ব্যবহার করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ দিয়ে গেল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কত সুন্দর রং! এরপর অন্য একজন চুলে মেহেদি এবং কাতাম বর্ণ ব্যবহার করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ দিয়ে অতিক্রম করল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ রংটি আগের রঙের চেয়েও সুন্দর। এরপর আরেকজন চুলে হলুদ রং ব্যবহার করে অতিক্রম করল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ রংটি সবচেয়ে বেশি সুন্দর। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ৪২১৩)

৬.

عن أبي ذر قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم إن أحسن ما غيرتم به الشيب الحناء والكتم

অর্থ : আবুযর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যেসব রং দিয়ে চুলের শুভ্রতাকে পরিবর্তন করা হয় তন্মধ্য হতে মেহেদি এবং কাতাম উদ্ভিদ থেকে উৎপন্ন রং সবচাইতে উত্তম। (সুনানে নাসায়ী; হা.নং ৫০৭৮)

৭.

عن أبي رمثة رضى الله تعالى عنه قال أتيت النبي صلى الله عليه وسلم ورأيته قد لطخ لحيته بالصفرة

অর্থ : আবু রিমসা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসলাম। তখন আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাড়িকে হলুদ বর্ণমাখা দেখতে পেলাম। (সুনানে নাসায়ী; হা.নং ৫০৮৪)

উপরোক্ত হাদীসগুলোর ভাষ্য মতে চুল-দাড়িতে মেহেদী জাতীয় বর্ণ ব্যবহার করা মুস্তাহাব এবং উত্তম কাজ। প্রবন্ধকার মহোদয়ের ভাষ্য মতে হাদীসগুলো নাকি মানব তৈরি। তিনি প্রমাণ হিসেবে বলতে চেয়েছেন, এগুলোর সাথে কুরআনের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। অমিলের জায়গাটা কিন্তু তিনি চিহ্নিত করে দেখালেন না। আশ্চর্য কথা! জ্ঞানহীনতার একটা সীমা থাকা চাই। সহীহ মুসলিমের হাদীসকে বলছেন মানুষের বানানো হাদীস। আসলে ধর্মচিন্তাবিদ সাহেব হাদীস কী তা বোঝেনই না। ভদ্রলোক এটাও বলেছেন, আল্লাহর রং এর সাথে এই হাদীসের মিল নেই তাই এটা হাদীস নয়। এখন তাকে জিজ্ঞাসা করা যাক, আল্লাহর রংয়ের অর্থ তিনি কি বুঝেছেন? বাহ্যিক রং নাকি আভ্যন্তরীণ রং? যদি বাহ্যিক রং হয় তাহলে নিশ্চয়ই সেই রংটা মুসলমানদের ব্যবহৃত খেজাবের রং ভিন্ন অন্য কোনো রং হওয়ার কথা। নইলে তো কুরআনের রঙের সাথে খেজাবের রঙের কোনো টক্কর লাগার কথা নয়। আর যদি আত্মিক রং উদ্দেশ্য হয়ে থাকে অর্থাৎ ঈমান উদ্দেশ্য হয় তাহলে উলামায়ে কেরাম এবং তার অনুসারীগণ তো ঈমানের রঙে রঙিন হয়েছেনই। তারা তো এক আল্লাহকে বিশ্বাস করেনই। ঈমানের সাথে বাহ্যিক রঙের বৈপরীত্য কীসের? ঈমানের বৈপরীত্য থাকলে সেটা কুফর বা ননইসলামের সাথে আছে। খেজাব বা বাহ্যিক রং ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ। শরীয়তের দলীল পাওয়া গেলে তার অনুমতি হবে অন্যথায় হবে না। আর খেজাব ব্যবহারের প্রমাণ আমরা ইতিপূর্বে প্রদান করেছি। মূলত রঙের বিরোধিতা তার উদ্দেশ্য নয়; উদ্দেশ্য দীনের ধারক-বাহক উলামায়ে কেরামের বিরোধিতা করা আর ‘মানবধর্ম’ প্রচার করা। আর যে ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে মানবধর্মের উপর ঈমান আনয়ন করেছে মুসলমানদের ‘ধর্ম পাতা’য় তিনি কলাম লেখেন কোন অধিকারে?

তিনি বলেন, আলেমদের নাকি কুরআনের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যদি কুরআনের সাথে তাদের সম্পর্ক থাকতই তবে শিশুদের তারা প্রথমে মানব ধর্মের কবিতাগুলো পড়াতেন। মানব ধর্মের কবিতা কী তার আলোচনা আমরা লেখকের অন্য আরেকটি লেখার পর্যালোচনায় ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। আরেকবার সেদিকে ইঙ্গিত করছি- মানবধর্মের প্রবর্তক লালন ফকিরের রচিত ‘মানবধর্ম’ কবিতা যা দুঃখজনকভাবে আমাদের অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে সন্নিবেশিত হয়েছে। সেখানে তিনি তার ধর্মহীনতার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন এবং ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে তার মানবধর্ম পালন করতে আহ্বান জানিয়েছেন। আর এই কবিতা না পড়লে আর না পড়ালে নাকি কুরআনের আলেম হওয়া যায় না। আসলে মানবধর্মের উক্ত কবিতাসহ অন্যান্য কবিতা কুরআনের কততম সূরার কততম আয়াত সেটা যদি গবেষক সাহেব নির্ধারিত করে দিতেন তাহলে আলেমদের জন্য সে কবিতার পাঠন পঠন আসান হতো। আছে কি এমন দুঃসাহস উক্ত ধর্মচিন্তাবিদের? আসলে তিনি না আলম চিনেন না আলেম চিনেন। তাই পাগলের প্রলাপের অধিক বিশ্লেষণ করে আর সময় ক্ষেপন করা ঠিক হবে না। শুধু ধর্মচিন্তাবিদ এবং তার সমমনস্কদের দরবারে গুজারেশ হলো, ইলম শিখুন উলামায়ে কেরামের সান্নিধ্যে এসে। লালনের চশমা চোখে লাগিয়ে ধর্মচর্চা করতে চাইলে সবকিছু লাল লালই দেখবেন। এর ফলে ইসলামও কিন্তু আপনাকে লালকার্ড দেখিয়ে দেবে।

বাক্য ব্যবহারে সচেতনতা কাম্য

(ক) সবকিছু শূন্য ও ফাঁকা করে এভাবে এত দূরে চলে যেতে নেই বাবারা! এতদূরে যেতে হয় না বাবারাÑ যেখান থেকে আর ফেরা যায় না কখনও। [‘এভাবে দূরে যেতে নেই’; আহমেদ আমিনুল ইসলাম, দৈনিক আমাদের সময় ২০. ০৪. ২০১৪]।

(খ) মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিলেন আবিদাল। ওই সময়ই একদল সমর্থকের সামনে তার উদ্দেশে ভিলানোভা বলেছিলেন, ‘তুমি যদি মানসিকভাবে শক্তিশালী হও তাহলে অবশ্যই ফিরে আসবে। আমরা তোমার অপেক্ষায় আছি’। আবিদাল সুস্থ হলেন। ডাক্তাররা বলেছিলেন, ‘হয়তো আর কোনোদিন ফরাসি এ ডিফেন্ডার মাঠে নামতে পারবে না’। কিন্তু প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির জোরে সবকিছু জয় করে চার মাস পর (২০১২ সালের ডিসেম্বরে) মাঠে ফিরেও এলেন। [‘বড্ড অসময়ে চলে গেলে বন্ধু’; ইমাম হোসাইন সোহেল, দৈনিক সমকাল ২৭. ০৪. ২০১৪]।

(গ) না ফেরার দেশে। [‘না ফেরার দেশে’; ইকবাল হাসান, দৈনিক সমকাল ২৯. ০৪. ২০১৪]।

অসময়ে চলে যাওয়া, অকালমৃত্যু, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া, না ফেরার দেশে যাওয়া ইত্যাদি শব্দগুলো সমাজে বহুল প্রচলিত। শব্দগুলোর ব্যবহার আসলে অপ্রকৃতিস্থ। কারণ সবার মৃত্যু সঠিক ও সুনির্দিষ্ট সময়েই হয়; অসময়ে হয় না। কোনো ব্যক্তি অল্প বয়সে মারা গেলে সাধারণত বলা হয়ে থাকে লোকটির অকালমৃত্যু হয়েছে। কথাটা আমরা সবাই বলে থাকি অবলীলাক্রমে। আসলে এটা আমাদের অবিদ্যার অভিশাপ। কথাটি আল্লাহ তা‘আলার অমোঘ বিধানের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সৃষ্টি করার সাথে সাথে আমাদের জীবনপরিধিও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। জীবনপ্রবাহ শেষ হওয়ার পূর্বে যেমন কেউ মৃত্যুবরণ করে না, তেমনি জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার পর কেউ চাইলেও বেঁচে থাকতে পারে না। নতুবা কেন মানুষ বিষপানে আত্মহুতি দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। আর অপর নাম জীবন যার তা পান করতে গিয়ে অনেকে মরণ বরণ করে নেয়! কেনই বা মৃত্যু অভিলাষী হাতিরঝিলে লাফিয়ে পড়া প্রেমিক যুগলের একজন মরে যায় আর আরেকজন ঘরে যায়! তার একটাই কারণ। তা হলো, যখন মানুষের মৃত্যুর সময় এসে যায় তখন তার এক মুহূর্ত পূর্বেও সে মারা যায় না। আর তাকে এক মুহূর্তের জন্য পশ্চাতেও ফেলতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,

তিনি ঐ সত্তা যিনি তোমাদেরকে মৃত্তিকা হতে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর এক কাল নির্ধারিত করে দিয়েছেন। এবং আরেকটি নির্ধারিত কাল আছে যা সম্বন্ধে তিনিই জ্ঞাত। এতদ সত্ত্বেও তোমরা সন্দেহ করো। (‘সূরা আনআম’- ২)

সূরা ইউনুসে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,

প্রতিটি জাতির একটি নির্দিষ্ট সময় আছে। যখন তাদের সময় আসবে তখন তারা মুহূর্তকালও বিলম্ব বা ত্বরা করতে পারবে না। (‘সূরা ইউনুস’- ৪৯)

বিষয়টা আরো স্পষ্ট হওয়ার জন্য একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ধরুন, বিবাহের একটা নির্ধারিত সময় থাকে। সাধারণত মানুষ ঐ সময়ে বিবাহ করে থাকে। আর ন্যূনতম প্রাপ্ত বয়স হলো মানুষের বিবাহের সময়। অন্যদিকে আমরা জানি যে, একটা ছেলে ১২-১৫ বছরে সাধারণত সাবালক হয়। তাই কোনো ছেলে যদি ৯-১০ বছর বয়সে বিবাহ করে তখন আমরা বলে থাকি ছেলেটি অকালে বা অসময়ে বিবাহ করেছে। এখানে অকাল শব্দটার যথার্থ ব্যবহারই হয়েছে। যেহেতু বিবাহের সর্বনি¤œ বয়সটা আমাদের জানা আছে; আর তা হলো প্রাপ্ত বয়সে উপনীত হওয়া। (এর আগে বিবাহ শুদ্ধ হলেও সেটা বিবাহের প্রাপ্ত বয়স নয়।) কিন্তু মৃত্যুর ব্যাপারে কুরআন, হাদীস, কোনো মহামনীষীর উক্তি বা আমাদের অভিজ্ঞতা কি এ কথা বলতে পারে যে, মৃত্যুর সর্বনি¤œ সময় এই? বরং যাদের পরকালের ব্যাপারে অত ডর ভয় নেই বা যারা পরকালীন জীবনকে বিশ্বাস করে না তারাও তো যুগ যুগ ধরে স্বীকারোক্তি দিয়ে আসছে এবং স্বীকারোক্তি দিতেই থাকবেÑ ‘এক সেকেন্ডের নাই ভরসা/বন্ধ হইবে রং তামাশা।’

তাহলে আমরা কথাটা শুদ্ধ করে এভাবে বলতে পারি- লোকটি অল্প বয়সে মারা গেছে। তিনি অল্পদিন বেঁচে ছিলেন। তাহলে আর কথাটা অনর্থক ও অবাস্তব হয় না। এ ব্যাপারে আমাদের সকলের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

এমনিভাবে ‘না ফেরার দেশে চলে গেছে’ কথাটাও বিশুদ্ধ নয়। কারণ আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকেই আবার ফিরিয়ে আনবেন। আমরা যাকে পুনরুত্থান বলে জানি; তা এই জমিনেই হবে। এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসে ভূরি ভূরি দলীল রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা সূরা ত্বাহা-এর ৫৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেছেন,

আমি তোমাদের এই মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি, এই মাটিতে তোমাদের ফিরিয়ে নেব, আর এই মাটি থেকেই তোমাদের পুনরুত্থিত করব।

অন্যত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন,

তোমরা এই পৃথিবীতে জীবনযাপন করবে, এখানেই মৃত্যুবরণ করবে আর এখান থেকেই তোমাদের পুনরুত্থান ঘটান হবে। (‘সূরা আ’রাফ’- ২৪)

তাই আমাদের এ কথাটি শুদ্ধ করে এভাবে বলতে পারি, তিনি তার আসল বাড়িতে ফিরে গেছেন বা তিনি আল্লাহ তা‘আলার কাছে ফিরে গেছেন বা চলে গেছেন।

আরেকটি সাংঘাতিক ভুল ব্যবহৃত শব্দ হলো, ‘মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া’। আসলে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া যায় না। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ার ক্ষমতা কারো নেই। এ কথা সহজবোধ্য যে, কারো সাথে পাঞ্জা লড়ার অর্থ হলো তার প্রতিপক্ষ হওয়া। আর কারো প্রতিপক্ষ হতে হলে ক্ষমতার দিক দিয়ে তার সমকক্ষ হতে হয় বা তার কাছাকছি ক্ষমতার অধিকারী হতে হয়। কিন্তু কে আছে মৃত্যুর সমকক্ষতার দাবিদার অথবা কে আছে মৃত্যুর কাছাকাছি ক্ষমতার অধিকারী? মৃত্যুর সাথে মানুষের পরাজয় চিরাচরিত বিধান। ইরশাদ হয়েছে ‘প্রাণী মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদনকারী’। হ্যাঁ কখনো কখনো মানুষ অসুস্থ হয় আবার আল্লাহর ইচ্ছায়ই সুস্থ হয়ে ওঠে। এটাকে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া বলা যায় না। মৃত্যু আর অসুখ ভিন্ন ভিন্ন জিনিস। মৃত্যু আসে আল্লাহর হুকুমে আর আল্লাহ তা‘আলার হুকুমের বিপরীতে কারো শক্তি হতে পারে না। তাই এ ধরনের শব্দ অবশ্যই বর্জনীয়। আর মৃত্যু যখন অবধারিত, অপ্রতিরোধ্য এবং তা নির্ধারিত সময়েই হয়ে থাকে, আর মানুষকে তার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতেই হয় বরং চলে যাওয়ার জন্যই তার আগমন তাই আমাদের সময়-এর ২০ এপ্রিলের কলাম লেখক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপকের সুরে সুর মিলিয়ে এ কথা বলারও সুযোগ নেইÑ ‘এভাবে এত দূরে চলে যেতে নেই বাবারা! এতদূরে যেতে হয় না বাবারাÑযেখান থেকে আর ফেরা যায় না কখনও।’ এ কথা বললে আখেরাতের উপর আর ঈমান বহাল থাকে না। মৃতের পরিবারকে সান্ত¡না-প্রবোধ দেওয়ার ভাষায় কি দৈন্য পড়েছে, নাকি সাহিত্য রসের দুর্দিন বইছে যে, অবিশুদ্ধ ও অব্যবহার্য শব্দ দিয়ে নাট্যকার সাহেবের নাটক রচনা করতে হলো! আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।

কবির পদ্যারাধনাই কি তার ইবাদাত?

তবে কি কবিকে অনুবাদকের নিয়োগপত্র দিয়েই পাঠান হয়েছিল! তাহলে নিষ্কর্মা বলে এত অভিযোগ কেন, ধর্মে-সংসারে-সমাজে। … কবি তো নির্মোহ। তিনি ভোট করেন না, কুতুবি করার জন্য দলা পাকান না। তিনি বরং মানুষের প্রতি আরও নিবিড় করে নিষ্ঠা ভাজন হয়ে ওঠেনÑ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। তবুও কেন তার নাম লেখা হচ্ছে বাতিলের খাতায়। হয়তো নিয়ম করে বন্দেগিখানায় যাওয়া হচ্ছে না তার। কিন্তু যার কব্জিজুড়ে অবিচ্ছিন্ন শ্রাবণ, তিনি তো তসবি ভেবে দমে দমে জপ করেন বৃষ্টিদানা। ভাস্কর্যের আড়ালে ভাস্করকে খুঁজে পেতে যার এত বুক ভরা আকুলতা, তিনি তো অনবরত এবাদতকারী।… নাম ধরে ডাকলেই ভালবাসার ডিগ্রি পাওয়া যায় নাকি! তাহলে প্রভুভক্ত প্রাণীদের কি হবে! কি হবে সহজপ্রেমের! ‘কবিদের এবাদত অথবা প্রকৃতির সত্যপাঠ’; আজাদুর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাক ২৫. ০৪. ২০১৪]।

কথাগুলো দর্শনপূর্ণ ও চমৎকার মনে হলেও সব কথার সমর্থন করা যায় না। কারণ এতে প্রবৃত্তি পূজার উন্মুক্ত দ্বারের সমর্থন অত্যাবশক হয়ে পড়ে। লেখক এখানে কবির প্রকৃতির মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মহান আল্লাহর অপার লীলা, কুদরত ও মহিমা নিয়ে চিন্তা ও কাব্যের মাধ্যমে তা ফুটিয়ে তোলাকেই ইবাদত মনে করেছেন এবং মৌলিক ইবাদতকে খাটো করে দেখেছেন যা জ্ঞানহীনতা ছাড়া কিছুই না।

কবিত্ব দ্বিমুখী এক হাতিয়ার। এর মাধ্যমে কারো প্রশংসা করে তাকে আকাশচুম্বী মর্যাদায় সমাসীন করা যায়, তেমনি কারো কুৎসা রটিয়ে তার জন্য পৃথিবীকে সংকীর্ণ করে দেয়া যায়। তাই ইসলামী শরীয়তে এর যত্রতত্র ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয় নি। তবে এর মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার পরিচয়, মহত্ত্ব, বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁর কুদরতের অপার লীলা বর্ণনার ক্ষেত্রে শুধু অনুমতিই নয় বরং উদ্বুদ্ধ করেছে। হযরত হাস্সান বিন সাবেত রাযি. কবিতার মাধ্যমে ইসলামের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতেন এবং মুশরিক কর্তৃক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কুৎসা সম্বলিত কবিতার জবাব দিতেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় তিনি রাসূলুল্লাহ সালালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কবিতা শোনাতেন। সহীহ বুখারীর ৬১৪৬ নম্বর হাদীসে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবিতা পাঠের কথা উল্লেখ আছে। সহীহ বুখারীর অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসসান রাযি.-এর জন্য কবিতা পাঠের ব্যাপারে দু‘আ করেছেন।Ñ ‘হে আল্লাহ! আপনি তাকে (হাস্সানকে) রূহুল কুদ্স (জিবরাঈল আ.) এর মাধ্যমে শক্তিশালী করুন।’ (হাদীস ৬১৫২)। কিন্তু কবিতা পাঠই ইবাদত এবং কেউ সুন্দর সুন্দর কবিতা রচনা আর পাঠ করলে তার জন্য নিয়মিত ইবাদত তথা নামায রোযাসহ অন্যান্য ইবাদত রহিত হয়ে যাবে এ কথা কুরআন-হাদীসের কোথাও বলা হয় নি। কবি যদি আল্লাহর সৃষ্টি ও তার কুদরত নিয়ে লেখেন এবং বৃষ্টির ফোঁটার সাথে সাথে তার মহিমার স্মরণে আপ্লুত হন নিঃসন্দেহে তা এক ধরনের প্রভুর স্মরণ বা যিকির। কিন্তু এর কারণে তো মৌখিক যিকিরের ফযীলত, গুরুত্ব, বরকত অস্বীকার করা বা তাকে খাটো চোখে দেখার কোনো কারণ থাকতে পারে না। যারা আল্লাহওয়ালা ডিগ্রি অর্জন করেছেন তারা আল্লাহর সৃষ্টিতে যেমন তার কারিশমা খুঁজেছেন, ধ্যানমগ্ন থেকেছেন তেমনি মৌখিক যিকিরে তারা সর্বদা স্বীয় জিহ্বা সতেজ রেখেছেন। কুরআন এবং হাদীসে মৌখিক যিকিরের জন্য শব্দ এবং সময়ও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। তাই শুধু বৃষ্টির ফোঁটা গণনা করলেই যিকিরের হক আদায় হয় না। এর সাথে যদি কবি সাহেব নিয়মতান্ত্রিক ইবাদত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন তাহলে তার নাম বতিলের খাতায় না লিখে হকের খাতায় লেখার ঠিকাদারীর কোনো সুযোগ নেই। এরূপ করলে ইসলামের স্বকীয়তা অবশিষ্ট থাকবে না; বরং প্রবৃত্তি পূজারিরা যে যার মতো ইসলাম ও এর বিধিবিধানের ব্যাখ্যা শুরু করে দেবে। ডাক্তারগণ মানবাঙ্গের রগরেশা ও শরীরের জোড়া গণনা করে মৌখিক যিকিরের ইস্তফা দিতে শুরু করবে। আবার রোযার একটি উদ্দেশ্য যেহেতু মানুষের প্রতি সহমর্মী হওয়া তাই রোযা না রেখে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে সময় কাটানোর পথও বেছে নিতে পারে অনেকে। ইতোমধ্যেই আল্লাহ প্রেমিকদের একাধিক হজ পালনের বিরোধিতা করে উক্ত অর্থ দুস্থ মানবতার সেবায় ব্যয়ের পরামর্শ উঠে এসেছে কোনো কোনো মহল থেকে। জ্ঞানের অভাবে বা জ্ঞানের ভারে অনেকে অনেক কিছু ভাবতে পারেন। কিন্তু তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আল্লাহ তা‘আলা কষ্টিপাথর হিসেবে আমাদেরকে কুরআন-হাদীস দান করেছেন। যে সমস্ত মতবাদ, চিন্তা-চেতনা নিখাদ বলে প্রমাণিত তা সাদরে গ্রহণীয় আর যা ভেজাল বলে প্রমাণিত তার উপযুক্ত স্থান হলো নর্দমা। ইসলাম প্রত্যেক কর্মকাণ্ড, ইবাদত-বন্দেগি, বিধি বিধানের একটা সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রত্যেককে তার সঠিক মর্যদায় মূল্যায়ন করা আবশ্যক। এর মধ্যে কোনো তারতম্য বা রদ-বদলের কোনো সুযোগ বা অধিকার কারো নেই। সুতরাং কবিদের প্রকৃতির সত্য পাঠের মাধ্যমে ইবাদত বা ফযীলতের পিছনে পড়ে কথিত প্রেমের অনলে পুড়া এবং ইসলামের মৌলিক ইবাদত বন্দেগী বিসর্জন দেয়া চরম বোকামী বৈ কিছুই নয়।

বায়েজীদ বোস্তামী রহ. সম্বন্ধে অতি ভক্তি

মক্তব হতে বাড়ি ফিরে তিনি তার মাতাকে কদমবুচি করলেন। তারপর তিনি তাঁর মাকে বললেন কুরআনের আয়াত পড়ে বুঝলাম আল্লাহ বলেছেন ‘আল্লাহর কাছে এবং মাতা-পিতার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ এই আয়াত পড়ে অনুভব করলাম যে, আমার পক্ষে দুই নৌকায় পা রাখা সম্ভব নয়। হয় তোমার খেদমতে সারা জীবন থাকব, না হয় আল্লাহর রাস্তায় চলে যাব। …হযরত বায়েজীদ বোস্তামী রহ.-এর আস্তানার পূর্বপার্শ্বে যে বিরাট পুকুর রয়েছে তাতে বিরাট বিরাট মাছ এবং কচ্ছপ রয়েছে। এগুলো গজারী মাজারী নামে পরিচিত। অত্যাচারী জিন, পরী, দেও-দানবকে হযরত বায়েজীদ বোস্তামী তাঁর অলৌকিক শক্তি দ্বারা উক্ত পুকুরে গজারী-মাজারীতে পরিণত করে আবদ্ধ করেন। [‘মাতৃসেবার অনন্য দৃষ্টান্ত হযরত বায়েজীদ বোস্তামী রহ.’; আবুল কাশেম ভূঁইয়া, দৈনিক ইত্তেফাক ০৪. ০৪. ২০১৪]।

প্রবন্ধকরের উক্ত লেখার মধ্যে তিনটি ভুল তথ্যের সমাবেশ ঘটেছে

ক. বায়েজীদ বোস্তামী তার মা-কে কদমবুসি করেছেন। একথা সপক্ষে তিনি কোনো রেফারেন্স পেশ করেন নি। আমরা বলি, এটি একটি অমূলক কথা। কারণ কদমবুসি ইসলামের কোন কৃষ্টি নয়; বরং এটা একটি হিন্দুয়ানী প্রথা। আর কদমবুসির সময় যদি মাথা ঝুঁকে যায় তাহলে তা সিজদার সাথে সামঞ্জস্য হয়ে আরো মারাত্মক রূপ ধারণ করে। কেননা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সিজদা করা সম্পূর্ণ শিরক। তাই আমাদের সমাজের সাথে সংগতি রেখে বা তুলনা করে বায়েজীদ বোস্তামী রহ.-এর মতো বুযুর্গের ব্যাপারে এই ধরনের কর্মের সম্বন্ধ করা অসমীচীন। কারণ বায়েজীদ বোস্তামী রহ. আমাদের মতো অদূরদর্শী ছিলেন না। আর লেখকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তার পিতাও একজন বুযুর্গ ছিলেন। আর বুযুর্গদের থেকে এহেন আমল যুক্তি বহির্ভূত।

খ. দ্বিতীয় ভুলটি হলো, বায়েজীদ বোস্তামী রহ. তার মাতাকে কুরআনের রেফারেন্স দিয়ে এ কথা বললেন যে, হয় আল্লাহর কৃতজ্ঞতা করব, নয় তোমার আনুগত্য করব। এ কথাটাও একদম ভিত্তিহীন। কারণ আয়াতের মধ্যে বলা হয়েছে তোমরা আমার এবং মাতা-পিতার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। আল্লাহ তা‘আলা একথা বলেননি যে, আমার অথবা মাতা-পিতার আনুগত্য কর। তাহলে বায়েজীদ বোস্তামী রহ. কীভাবে মায়ের কাছে যেকোনো একটার অনুমতি চাইতে পারেন? অথচ আল্লাহ হুকুম করেছেন দুইটি বিষয়ের। কেউ যদি মাতা-পিতা বা সংসার ছেড়ে আল্লাহর রাস্তায় ইবাদতের জন্য সারা জীবন কাটাতে চায় ইসলাম তার অনুমতি দেয় নি। আবার ইবাদত বন্দেগী বাদ দিয়ে শুধু মা-বাবার খিদমত করারও কোনো সুযোগ নেই। বরং আল্লাহ তা‘আলা এবং মাতা-পিতা উভয়ের কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য একই সাথে পালনীয়। তবে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য পিতা-মাতার আনুগত্যের উপর প্রাধান্য পাবে। তাই আল্লাহ তা‘আলা নিজের আনুগত্যের কথা আগে এবং মাতা-পিতার আনুগত্যের কথা পরে এনেছেন। মূলত লেখক এখানে বায়েজীদ বোস্তামী রহ.-এর মাতা ভক্তির অনন্য দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে গিয়ে তার প্রতি নিজের অতি ভক্তি প্রকাশ করে ফেলেছেন। ইসলামে এরূপ অতিরঞ্জন অতি নিন্দনীয়।

গ. বায়েজীদ বোস্তামী রহ.-এর মাজার ও তার অলৌকিক ক্ষমতাবলে জিন-পরীকে গজার মাছে রূপান্তর করার চটকদার কাহিনির সত্যতা ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যায় না। এ মাজারটি সম্পর্কে একটি নিরপেক্ষ প্রতিবেদন পেশ করেছেন জনাব আবদুল মান্নান তালিব তার রচিত বাংলাদেশে ইসলাম নামক গ্রন্থে। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে ইসলামিক ফউন্ডেশন বাংলাদেশ। সেই গ্রন্থে তিনি লিখেছেন যে,

‘প্রাচীন সুফী দরবেশদের মধ্য হতে খ্রিস্টীয় নবম শতকে পারস্যের বায়েজীদ বোস্তামীর (মৃত্যু ৮৭৪ হি.) চট্টগ্রাম অঞ্চলে আগমনের কথা শোনা যায়। চট্টগ্রাম শহরের পাঁচ মাইল উত্তরে নাসিরাবাদ গ্রামের পর্বত চূড়ায় তার স্মারক সমাধিও দেখা যায়। জনশ্রুতি আছে যে তৎকালে এ অঞ্চল গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। জঙ্গলে হিংস্র জানোয়ার ও জিনদের বসবাস ছিল। হযরত বায়েজিদ বোস্তামী রহ. এ অঞ্চলে আগমন করে ইসলাম প্রচার করেন। ফলে এখানে জনবসতি গড়ে উঠে। অবশ্য জনশ্রুতির সত্যতা প্রমাণ করার মতো কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। তবে একথা সবাই স্বীকার করেন যে, বায়েজীদ বোস্তামী (রহ.) এখানে ইন্তেকাল করেন নি। পারস্যের বোস্তাম নগরে ৮৭৪ হিজরীতে তাঁর ইন্তেকাল হয় এবং তথায় তাঁর সমাধি বিদ্যমান।’ (বাংলাদেশে ইসলাম; পৃষ্ঠা ১১১) এই প্রতিবেদন থেকে প্রতিভাত হলো বায়েজিদ বোস্তামী রহ.-এর মাজার নামে যে মাজার রয়েছে তা কবরশূন্য একটি কল্পিত মাজার। (পয়গামে সুন্নাত ১৪২৭-২৮ হি. পৃষ্ঠা ২১৫)

উক্ত প্রতিবেদনের আলোকে প্রতীয়মান হলো যে, বায়েজীদ বোস্তামী রহ.-এর বাংলাদেশে আগমনের ব্যাপারটি উদ্ভট একটি কল্পকথা। ইতিহাসের সাথে এর সামান্যতম সংশ্লিষ্টতা নেই। খিজির আ. (শুদ্ধ হলো খাজির) এর মাজার, খিজির আ.-এর খলীফার মাজার, কালু-গাজীর মাজার নামে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে বহু কাল্পনিক মাজার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বায়েজীদ বোস্তামীর মাজার ও এ ধরনের একটি কল্প মাজার। এর সাথে বাস্তবতার কোনো যোগসূত্র নেই। তবে উক্ত প্রতিবেদনটিতে বায়েজীদ বোস্তামীর যে মৃত্যু সন উল্লেখ করা হয়েছে তা চরম পর্যায়ের একটি ভুল তথ্য। কারণ তিনি ইন্তেকাল করেন ২৬১ হিজরী সনে। তো দুটি মৃত্যু সনের মাঝে আকাশ পাতাল ব্যবধান। তবে যদি আমরা ইংরেজি সনের দিকে লক্ষ করি তাহলে এ ব্যবধান বহুলাংশে কমে আসবে। কারণ তিনি ৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। (খাইরুদ্দীন যিরিকলী, আলআ’লাম ৩/২৩৫, ইমাম যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১৩/৮৯)

তাছাড়া বায়েজীদ বোস্তামী রহ. যে বোস্তাম শহরে মৃত্যুবরণ করেছেন তা ঐতিহাসিক সত্য। এতে ন্যূনতম সন্দেহের অবকাশ নেই।

যাকারিয়া বিন মুহাম্মদ কাযভীনী রহ. বলেন,

আবুল ফাতহ মুহাম্মদ বিন ফযল ইসফারায়িনী রহ. দীর্ঘ একটা সময় বাগদাদে কাটিয়েছেন। যখন তিনি খুরাসানে ফিরে যাওয়ার মনস্থ করলেন তখন তার শিষ্যরা তার বিদায়ের ব্যাপারে অনুযোগ করল। তখন তিনি বললেন, সম্ভবত আল্লাহ তা‘আলা চাচ্ছেন, আমার সমাধি একজন সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তির পাশে হবে। যখন তিনি বিস্তাম নগরীতে পৌঁছালেন তখন তার ইন্তেকাল হয়। এবং আবু ইয়াযীদ বিস্তামী রহ.-এর সমাধির পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। বিস্তামের সূফীবাদের পুরোধা ঈসা বিন ঈসা রহ. বলেন, আমি নিজের জন্য আবু ইয়াযীদের সমাধির পাশে একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে রেখেছিলাম। কিন্তু এক্ষেত্রে শায়খ আবুল ফাতহকে প্রাধান্য দেই এবং তাকে আবু ইয়াযীদের পাশে সমাহিত করি। (যাকারিয়া বিন মুহাম্মদ কাযভীনী, আসারুল বিলাদ ওয়া আখবারুল ইবাদ ১/২০)

ইমাম যাহাবী রহ. বলেন,

আবু ইয়াযীদ বিস্তাম নগরীতে ২৬১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১৩/৮৯)

খাইরুদ্দীন যিরিকলী রহ. বলেন,

আবু ইয়াযীদ তাইফুর বিন ঈসা বিস্তামী ইরাক এবং খুরাসানের মধ্যবর্তী জনপদ বিস্তামের অধিবাসী ছিলেন। এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। (খাইরুদ্দীন যিরিকলী, আলআ’লাম ৩/২৩৫)

উল্লেখ্য, বায়েযীদ বোস্তামীর মূল নাম হলো, আবু ইয়াযীদ তাইফুর বিন ঈসা আলবিস্তামী। কিন্তু লোক মুখে বায়েজীদ বোস্তামী নামে প্রসিদ্ধ হয়ে পড়ে। বোস্তামী মূলত বিস্তামী অথবা বাস্তামী হবে। বোস্তাম নামে পৃথিবীতে কোনো জনপদ নেই। জনপদটি হলো বিস্তাম অথবা বাস্তাম। তবে অধিকাংশের মতে বিস্তামীই শুদ্ধ। বোস্তামী শব্দটি কায়েদায়ে বোগদাদীর মতো ভুল পরিচিতি লাভ করে। অথচ শব্দটি হলো বাগদাদ। সুতরাং উপরোক্ত তথ্যবিবরণীতে প্রমাণিত হলো, চট্টগ্রামে বায়েজীদ বোস্তামী মাজার নামে যে মাজারটি রয়েছে তা একটি মিথ্যা এবং কাল্পনিক মাজার। এ মাজার যিয়ারতকে বৈধতা দেয়ার কোনোই সুযোগ নেই।

তরীকতপন্থীদের পঙ্কিল সাধনা

(ক) আল্লাহ পাক মানুষকে নিজ সুরতে সৃষ্টি করে আবার তিনি নিজে মানুষেরই অন্তরে অবস্থান নিয়েছেন। তাই মানুষের দিল হচ্ছে মহাভেদ ও বাতেনের দরিয়া।

(খ) অজু করার যথাযথ নিয়ম পালন করার সময় মনে মনে খেয়াল করতে হবে পানি দিয়ে আমরা নিজের যাহেরী হাত, মুখ নাক, মুখমণ্ডল, মাথা, কান, গলা এবং পা ধুয়ে দেহ যেমন পবিত্র করি, ঠিক তেমনি বাতেনী হাত, মুখ, নাক, মুখমণ্ডল মাথা, কান, গলা এবং পা-ও মুর্শেদের ফায়েজ দিয়ে ধৌত করে আত্মা পবিত্র করছি।

(গ) একজন তরীকতপন্থী সাধক মূলত হাকীকতে সালাত আদায় করে থাকেন। কারণ তাকে যাহেরের সঙ্গে বাতেন ঠিক রেখে সাধনা করতে হয়। তাই হাকিকতে অজু শেষে কেবলমুখী হয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে দুই চোখ বন্ধ করে খেয়াল কলবে ডুব দিয়ে আল্লাহকে লক্ষ্য করে মনে মনে বলতে হবে, ‘ওগো দয়াল মাওলা, দয়াল আল্লাহ, তোমাকে দেখার মতো যোগ্য চক্ষু আমার নেই, তাই আমি তোমাকে দেখি না; কিন্তু তুমি আমাকে দেখছ। …মনে রাখতে হবে, জাহেরী চক্ষু না বন্ধ করলে বাতেনী চক্ষু খোলে না। [‘দোয়া-আমল দুনিয়া ও আখেরাতের সম্বল’; আলহাজ্ব হাকিম সৈয়দ সালেহ আহমেদ, দৈনিক ইত্তেফাক ০৪. ০৪. ২০১৪]।

প্রবাদ আছে ‘সর্বাঙ্গে ঘা মলম দেব কোথা’। লেখাটির অবস্থাও তাই। তথাপি বড়ো বড়ো কিছু ক্ষত চিহ্নিত করে ব্যবস্থা দেওয়া হলো। প্রবন্ধের শুরু কথাই গলদ। অর্থাৎ মানুষকে আল্লাহ নিজ আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। আবার তিনি মানুষের অন্তরেই অবস্থান নিয়েছেন। এই দুই আকীদাই মারাত্মক ধরনের গোমরাহী। কুরআন-হাদীসে এই আকীদার কোনো সমর্থন নেই। সম্ভবত এই আকিদা পোষণকারীদের একটি প্রসিদ্ধ হাদীস যা সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমসহ অন্যান্য হাদীসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে তা বোঝার ক্ষেত্রে ভ্রম হয়েছে। হাদীসটির মূলপাঠ হলো,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ خَلَقَ اللَّهُ آدَمَ عَلَى صُورَتِهِ طُولُهُ سِتُّونَ ذِرَاعًا فَلَمَّا خَلَقَهُ قَالَ اذْهَبْ فَسَلِّمْ عَلَى أُولَئِكَ النَّفَرِ مِنْ الْمَلَائِكَةِ جُلُوسٌ فَاسْتَمِعْ مَا يُحَيُّونَكَ فَإِنَّهَا تَحِيَّتُكَ وَتَحِيَّةُ ذُرِّيَّتِكَ فَقَالَ السَّلَامُ عَلَيْكُمْ فَقَالُوا السَّلَامُ عَلَيْكَ وَرَحْمَةُ اللَّهِ فَزَادُوهُ وَرَحْمَةُ اللَّهِ فَكُلُّ مَنْ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ عَلَى صُورَةِ آدَمَ فَلَمْ يَزَلْ الْخَلْقُ يَنْقُصُ بَعْدُ حَتَّى الْآنَ

অর্থ : আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা‘আলা আদম আ. কে তাঁর আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর দৈহিক দৈর্ঘ্য হলো, ষাট গজ। যখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে সৃষ্টি করলেন, তখন বললেন, যাও ঐ ফেরেশতাদলকে সালাম করো। তারা বসে আছে। এরপর শুনো তারা তোমার সালামের জবাবে কি বাক্য বলে অভিবাদন দেয়। তাদের সে অভিবাদনই তোমার এবং তোমার অনাগত বংশধরদের অভিবাদন হিসেবে গণ্য হবে। আদম আ. তাদের কাছে গিয়ে বললেন, আসসালামু আলাইকুম। প্রতিউত্তরে তারা বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ’। ফেরেশতারা তার সালামের বাক্যের সাথে ‘ওয়ারাহমাতুল্লাহ’ সংযুক্ত করে দিল। যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে তারা আদম আদম আ.-এর আকৃতিতেই প্রবেশ করবে। এরপর থেকে অদ্যাবধি মানুষের গঠনাকৃতি ছোটো হয়ে আসছে। (সহীহ বুখারী, হা.নং ৬২২৭)। অন্য হাদীসে রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের কেউ যদি তার ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হয় সে যেন চেহারায় আঘাত করা থেকে বিরত থাকে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা আদম আ. কে তাঁর আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ৬৮২১)

আমাদের আলোচিত বিষয় হলো, দীর্ঘ হাদীসের ‘আল্লাহ তা‘আলা আদম আ. কে তাঁর আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন।’ অংশটুকু। এ অংশটুকুর মধ্য হতে ‘তাঁর আকৃতিতে’ এর মধ্যকার সর্বনামটির লক্ষবস্তু কে? এটা নিয়ে হাদীসবেত্তা এবং হাদীস ব্যাখ্যাকারদের মাঝে কিছুটা মতভিন্নতা দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে তিনটি মত লক্ষ করা যায়।

১. সর্বনামটির লক্ষবস্তু আল্লাহ নয়। ইমাম ইবনে হিব্বান রহ. সহীহ মুসলিমের হাদীসটি বর্ণনা করার পর বলেন,

হাদীসের মধ্যকার সর্বনাম দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি উদ্দেশ্য। কারণ ঘাতক ব্যক্তি যখন তার মুসলিম ভাইয়ের চেহারায় আঘাত করে তখন সে এমন চেহারায় আঘাত করে যার আকৃতিতে আল্লাহ তা‘আলা আদম আ.-কে সৃষ্টি করেছেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান; হা.নং ৬০৫)

ইমাম খাত্তাবী রহ. হাদীসটির ব্যাখ্যায় বলেন,

সর্বনাম দ্বারা উদ্দেশ্য আদম আ.। হাদীসের অর্থ হলো, আদম আ.-এর বংশধরদেরকে ধাপে ধাপে সৃষ্টি করা হয়েছে। সৃষ্টির শুরুতে পর্যায়ক্রমে তারা ছিল বীর্য, জমাট রক্ত, মাংসপিণ্ড-এর আকৃতিতে। এরপর গর্ভধারনের সময় পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তারা বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে। এরপর তারা সদ্যজাত শিশু হয়ে ভূমিষ্ট হয়। এরপর শৈশব কৈশোর পার হয়ে পরিপক্ব বয়সে উপণীত হয়। এরপর তার দৈহিক দৈর্ঘ্য পূর্ণ হয়। তো আদম আ. নানা ধাপ অতিক্রম করে এভাবে সৃজিত হয় নি। প্রথম সৃষ্টিতেই সে পূর্ণ দৈহিক গঠন লাভ করে। এবং তার দেহের দৈর্ঘ্য হয় ষাট গজ। (হুসাইন বিন মাসউদ বাগাবী, শরহুস সুন্নাহ ১২/২৫৫)

ইমাম ইবনে হিব্বান রহ. ১৬৬২ নাম্বার হাদীসের অধীনে অত্যন্ত জোড়ালোভাবে বিষয়টিকে প্রমাণ করেছেন। তেমনিভাবে ইবনে হাজার আস্কালানী রহ. ও এ বক্তব্যের সমর্থনে বলিষ্ঠ আলোচনা করেছেন (ফাতহুল বারী ৫/১৮৩) এবং কাযী ইয়ায, কালাবাযীসহ আরো অনেক মুহাদ্দিসীনে কেরাম এই মত পোষণ করেছেন।

২. সর্বনাম দ্বারা উদ্দেশ্য স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা। তবে এক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে সর্বনামের সম্বন্ধটা সত্তাগত নয়; স্বত্বগত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ (৭২)

অর্থ : যখন আমি তাকে সুষম করব এবং তাতে আমার রূহ সঞ্চার করব তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো। (‘সূরা সোয়াদ’- ৭২)

এটাই ইবনে আকীল রহ.-এর অভিমত। তিনি বলেন,

আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির ক্ষেত্রে আদম আ. কে স্বীয় আকৃতির সাথে সম্বন্ধ করেছেন বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে যা তার মাঝে রয়েছে। আর সেটা হলো কর্তৃত্ব, দাসত্ব, মাথানতকরণ, সেবাগ্রহণ, কার্য বাস্তবায়ন এবং রাজনীতির দিক দিয়ে প্রভুত্বের সাথে সাদৃশ্য রাখে। এসব গুণাবলির মাধ্যমে সে নগর শাসন করবে এবং মানুষের সমস্যা সমাধান করবে। জিন এবং ফেরেশতাকুলের মাঝে এমন কেউ নেই যার আনুগত্য জিন এবং ফেরেশতা সম্প্রদায় মেনে নিবে। (আবুল ফারজ ইবনুল জাউযী, কাশফুল মুশকিল মিন হাদীসি সাহীহাইন ১/৯৯২)

আইনী রহ. বলেন,

বলা হয়, সর্বনাম দ্বারা উদ্দেশ্য আল্লাহ তা‘আলা। তখন এর অর্থ হবে, আল্লাহ তা‘আলা আদম আ. কে নিজ গুণ এবং বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ তাকে জীবন, জ্ঞান, শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং বাকশক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। অথবা আল্লাহর আকৃতির সাথে তার সম্বন্ধটা হলো সম্মানজনক সম্বন্ধ। যেমন বলা হয়, আল্লাহর ঘর, আল্লাহর রূহ ইত্যাদি। কারণ আল্লাহ তা‘আলা তাকে পূর্বের কোনো নমুনা ব্যতিরেকেই নবরূপে সৃষ্টি করেছেন। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা নিজের দিকে সম্বন্ধ করে তাকে মর্যাদাবান করে দিলেন। (উমদাতুল কারী শরহু সাহীহিল বুখারী ৩২/৪৪)

ইমাম সুয়ূতী রহ. এ ব্যাখ্যাকে সর্বোত্তম ব্যাখ্যা বলে অভিহিত করেছেন। (আদদীবাজ আলা সহীহি মুসলিম ৫/৫৩৮)

৩. এ ধরনের হাদীসের ব্যাখ্যার ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করা। আবু মুহাম্মদ আলবারবাহারী রহ. বলেন,

তোমাকে এ জাতীয় হাদীসকে সত্য মনে করতে হবে, স্বীকৃতি দিতে হবে এবং এ জাতীয় হাদীসের ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করতে হবে। তুমি নিজ কল্পনা ও প্রবৃত্তি মতে এ জাতীয় হাদীসের ব্যাখ্যা করতে যেয়ো না। কারণ এসব হাদীস বিশ্বাস করা আবশ্যক। যে ব্যক্তি আপন প্রবৃত্তি মতে এসব হাদীসের ব্যাখ্যা করতে যাবে এবং এ হাদীসকে প্রত্যাখান করবে সে ‘জাহমিয়া’ সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি এ জগতে আল্লাহকে দেখেছে বলে দাবি করবে সে কাফের তথা আল্লাহ তা‘আলাকে অস্বীকারকারী বলে সাব্যস্ত হবে। আল্লাহ তা‘আলার সত্তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা বিদ‘আত। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করো; আল্লাহর সত্তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করো না। কারণ স্রষ্টা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করলে অন্তরে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি হয়। (কিতাবু শারহিস সুন্নাহ ১/৬)

সুনানে আবু দাউদের ব্যাখ্যাকার আব্দুল মুহসিন ইবাদ রহ. বলেন,

অধিকাংশ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের অনুসারী উলামায়ে কেরামের অভিমত হলো, সর্বনাম দ্বারা উদ্দেশ্য আল্লাহ তা‘আলা। এবং হাদীসের ব্যাখ্যায় তারা বলেছেন যে, তিনি শ্রবণকারী, দ্রষ্টা এবং বাকশক্তিসম্পন্ন। যদিও আল্লহ তা‘আলার দিকে শোনা, দেখা এবং কথা বলার সম্বন্ধটা তার সত্তা উপযোগী হবে। তেমনিভাবে মানুষের দিকে শোনা, দেখা এবং কথা বলার সম্বন্ধটা তার প্রকৃতি অনুযায়ী হবে। (শরহু সুনানি আবী দাউদ ১/২)

কিন্তু কোনো মুহাদ্দিস বা ব্যাখ্যাকার হাদীসের এই অর্থ করেন নি যে, আদম আ. কে বা বনী আদমকে আল্লাহ তা‘আলা আল্লাহর স্বীয় রূপে সৃষ্টি করেছেন। কারণ এ কথার অর্থ দাঁড়ায়, আল্লাহর দেহাকৃতি এবং আদম আ.-এর দৈহিক গঠন একই রকম ছিল। কিন্তু কুরআন হাদীস স্রষ্টা এবং সৃষ্টির এমন অবিকল সামঞ্জস্যতার স্বীকৃতি প্রদান করে না। হ্যাঁ, আল্লাহ তা‘আলার রূপ আছে, কিন্তু তা কোনো মাখলুকের রূপের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আল্লাহ তা‘আলার রূপ কেমন তা তিনি নিজেই জানেন; কোনো মানুষ জানে না এবং এ ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করারও মানুষের অনুমতি নেই। কেবলমাত্র জান্নাতে গিয়েই আল্লাহ তা‘আলাকে স্বীয়রূপে দর্শন করা যাবে। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা। আল্লাহ তা‘আলার যেহেতু মানুষের মতো বাহ্যিক আকৃতি নেই। তাই কোনো নির্ধারিত স্থানে নির্ধারিত অবস্থায় অবস্থানও তার নেই। তিনি তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সমাসীন আছেন। তাই আল্লাহ তা‘আলা কোনো মানুষের অন্তরে অবস্থান করতে পারেন না। বরং তিনি স্থান, কাল, পাত্র থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। তাই আল্লাহর অবস্থানের উপর ভিত্তি করে মানুষের অন্তরকে মহাভেদের ও মহা বাতেনের দরিয়ার আকীদা মূলত মহাবাতেল আকীদা-বিশ্বাস। কুরআন-সুন্নাহর সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

আর একটি শিরকী আকীদা উক্ত লেখার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে, তা হলো মুর্শিদের ফয়েয দ্বারা বাতেনী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধৌত করা। কুরআন-হাদীস বা ফিকহ শাস্ত্রে এর কোনো ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। হাদীসের মধ্যে এসেছে, বান্দা যখন উযূ করে তখন উযূর পানির সাথে তার ছোটো ছোটো গুনাহসমূহ ঝরে যায়। মুর্শিদের ফয়েযে গুনাহ ঝরে যাওয়া বা আত্মা ধৌত করার কোনো প্রমাণ শরীয়তে ইসলামীতে পাওয়া যায় না। এটা আসলে বিদ‘আতপন্থী ভণ্ডপীরদের অতিরঞ্চন এবং বাড়াবাড়ি।

লেখক হাকীকতে সালাতের পদ্ধতি এবং আল্লাহর দীদারের যে তরীকা উল্লেখ করেছেন তাও তার মনগড়া কথা। কারণ নামাযের মধ্যে চোখ বন্ধ রাখা মাকরূহ। আর মাকরূহ আমল করে কীভাবে আল্লাহকে পাওয়া যাবে! চোখ বন্ধ করে খেয়াল কলবে ডুব দিলে নামাযী নিজেও অন্ধ হবে নামাযও অন্ধ হয়ে যাবে। আর এত অন্ধকারে আল্লাহকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আল্লাহকে দেখতে হলে সুন্নাতের চেরাগের আলোতেই দেখতে হবে। আর নামাযে চক্ষু খোলা রাখাই হলো সুন্নাত। আর জাহেরী চোখ বন্ধ না করলে বাতেনী চোখ খোলেনা এ কথাও ঠিক নয়। আমাদের জানা থাকা উচিত যে বাতেনী চোখ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, মনের ভিতর এমন একটা ভাবের উদয় হওয়া যার দ্বারা আল্লাহর দয়া-রহমত, কুদরত অনুভূত হয়। অন্তরে নুরানিয়াত তথা জ্যোতির্ময়তা সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর প্রেম-ভালবাসা হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়ে দিন দিন উন্নতি লাভ করে। আর অন্তরের এই অবস্থা শরীয়তের উপর পরিপূর্ণ পাবন্দি করার মাধ্যমে অর্জিত হয়। চোখ খোলা বা বন্ধ রাখার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। যদি তাই হতো তাহলে তো দুনিয়ার অন্ধরাই সবচে বড়ো আল্লাহওয়ালা হতো। কিন্তু তা কি ঠিক?

উপসংহার

নোবেল বিজয়ী অমর্ত্যসেন বলেছেন ‘সংবাদপত্র সঠিক দায়িত্ব পালন করলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না।’ কারণ সংবাদকর্মীদের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে শহর থেকে বিদ্যুৎ কমিয়ে গ্রামের কৃষকের চাহিদা পূরণ করা হয়, ফঁড়িয়াদের গুদামজাতের কারণে গ্রামের কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেলে সাংবাদিকরা রিপোর্ট করে বলেই খাদ্যমন্ত্রী এর একটা ব্যবস্থা নেন, কোথাও এন.জি.ও-র চড়া সুদের কবলে কৃষক সর্বস্ব হারায়; সাংবদিকরা লেখে বলে মাইক্রোক্রেডিক রেগুলেটরি অথরিটি হয়, এমনিভাবে সার সংকট দেখা দেয়ার আগে সংবাদ তৈরি করা, কৃষকের ভরতুকির টাকার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি কৃষি সেবাগুলো কৃষকেরা সাংবাদিকদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার দৌলতেই পেয়ে থাকে। তাহলে অমর্ত্যসেনের মূলনীতির সাথে সংগতি রেখে আমরাও দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে একথা বলতে পারি যে, সংবাদকর্মীরা যদি ধর্মের ব্যাপারে একটু শ্রদ্ধাশীল, দায়িত্বশীল ও উদার হন এবং ধর্মের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তাদের অন্তঃকরণে বদ্ধমূল থাকে তবে অল্পদিনেই ইসলামের সুবাতাস সমাজে ছড়িয়ে পড়বে। সে বাতাসে মানুষের হৃদয় শান্ত-প্রশান্ত ও শীতল হবে। ইসলামের কোমল-বিমল জ্যোতিতে মানবহৃদয় হবে আলোকিত। কিন্তু দিন দিন সংবাদপত্রের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে ধর্মপাতার কলামের বরাদ্দও, শুধু বাড়ছে না ধর্মপাতার কাক্সিক্ষত ফল। বরং অনাকাক্সিক্ষতভাবে ধর্মের নামে অধর্ম ও অন্য ধর্মের চর্চা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

আজ কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রী কখন কোথায় গেলেন, কি খেলেন, কি পরিধান করলেন, তার অন্তঃসত্তার বয়স কয়দিন, কাকে ছাড়লেন, কাকে ধরলেন সবই উঠে আসে আমাদের সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়। কিন্তু ইসলামের মোটা মোটা খবরগুলোও পত্রিকায় সঠিকভাবে স্থান পায় না। পার্বত্য অঞ্চলে খ্রিস্টান মিশনারির অপতৎপরতা প্রতিনিয়ত চলছে। গরিব মুসলমানদের ঋণ দিয়ে, গরু-ছাগল দিয়ে, কাউকে বা ঘর করে দিয়ে তাদের অমূল্য সম্পদ ঈমান হরণ করছে তা কিন্তু কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয় না। গ্রামাঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ধর্মশিক্ষার মাধ্যম, মাদরাসা-মক্তব রয়েছে কিনা, সেবার আড়ালে এন.জি.ও-রা কি করছে এ ব্যাপারে আমাদের কি করণীয় এই পরামর্শ কিন্তু কোনো পত্রিকার সম্পাদক সাহেব আমাদের ধর্মমন্ত্রীকে প্রদান করেন না।

তাই সংবাদপত্রের সংবাদ বিশেষ করে ধর্মীয় সংবাদগুলো সঠিক মানে উন্নীত হওয়ার জন্য, তার প্রচার-প্রসারের ব্যাপকতা ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের জন্য, অন্ততপক্ষে দীন প্রচারের ক্ষেত্রে মুসলমান হিসেবে সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষের জিম্মাদারী এড়ানোর জন্য তাদেরকে আরো দায়িত্বশীল ও যতœবান হওয়ার পাশাপাশি কুরআন-হাদীস তথা ইসলামী আইনলব্ধ কিছু মূলনীতির অনুসরণ আবশ্যক। নিম্নে কিছু মূলনীতি প্রদত্ত হলো

১. পত্রিকার পরিচালক ও সম্পাদক এমন ব্যক্তি হবেন যিনি ইসলামী শিক্ষায় পারদর্শী, নতুবা আলেম-উলামাদের কাছে যাতায়াতে অভ্যস্ত এবং ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

২. দীন ধর্মের জন্য ক্ষতিকর কোনো গ্রন্থ কিংবা শরয়ীয়ত গর্হিত কোনো লেনদেনের বিজ্ঞাপন প্রচার করবে না।

৩. অনিশ্চিত সংবাদ তথা সূত্র যাচাই ব্যাতিরেকে কোনো লেখা প্রকাশ করবে না। কেননা অধিকাংশ সময় এসব সংবাদের পুরোটা বা আংশিক ভুল হয়ে থাকে। আর তদন্ত বিহীন সংবাদ প্রচার-প্রসারের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। (‘সূরা বাকারা’- ১০২)

৪. দীনী আকাইদ ও মাসাইল নিয়ে আলোচনা করা হলে শরয়ী প্রমাণ উল্লেখ না করে শুধু যুক্তির আলোকে তা সাব্যস্ত করা থেকে বিরত থাকবে। এতে অনেক মাসআলা শরীয়ত বিরোধী, শরীয়ত বিকৃতি এবং মিথ্যাচারের পর্যায়ভুক্ত হয়ে যায়। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ৬০)

৫. সত্য এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও প্রতিবেদন পরিবেশন করবে। ভ্রান্ত ও অসত্য সংবাদ পরিবেশন করবে না।

৬. নিয়তকে বিশুদ্ধ করে নিবে। মানবের কল্যাণ সাধন ও দীন প্রচারের দায়িত্ব পালনের লক্ষে সংবাদ সংগ্রহ করবেন ও ছাপাবেন।

৭. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকজের নিষেধের দায়িত্ব আদায়ের ক্ষেত্রে নবীগণ প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে কাজ করার যে উত্তম আদর্শ রেখে গেছেন সে অনুযায়ী কর্মপন্থা নির্ধারণ করবে।

৮. সত্য সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে শিষ্টতা ও কোমলতার প্রতি সবিশেষ লক্ষ রাখবে। উপস্থাপনা রূঢ় ও আক্রমণাত্মক যাতে না হয় সেদিকে যতœবান হবে।

৯. অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের লেখা ছাপাতে হলে বিজ্ঞ আলেমকে দেখিয়ে তা সত্যায়িত করে নিবে।

১০. মানুষকে বিশেষত যুব সমাজকে চারিত্রিক এবং নৈতিক অবক্ষয় থেকে বাঁচাতে বিনোদন পাতার নামে অশ্লীল ছবির আয়োজনকে চিরতরে রুদ্ধ করে দিবে।

(হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী রহ.-এর আখবার বীনী অবলম্বনে।)

হে আল্লাহ! আমাদেরসবাইকে সঠিক পথের দিশা দিন এবং সমগ্র মানবজাতির হিদায়াতের সামান্যতম অবলম্বন হিসেবেহলেও আমাদের কবুল করুন। আমীন ইয়া রাব্বাল আলামিন।

লেখক

মুহতামিম, বাইতুস সুন্নাহ মাদরাসা কালিগঞ্জ, কালকিনি, মাদারীপুর।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *